নিজস্ব প্রতিবেদক : ঢাকার শাহজাহানপুরে রাতে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ জাহিদুল ইসলাম টিপুকে। ঘটনার সাড়ে তিন মাস আগে পরিকল্পনা হয় এই হত্যাকা-ের। তাও আবার মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আদালত চত্বরে বসে করা হয় পরিকল্পনা। এরপর আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন সুমন শিকদার ওরফে মুসার সঙ্গে পরিকল্পনা করে টিপুকে হত্যার জন্য ভাড়া করা হয় কিলার। গ্রেফতারদের বরাতে এমনটি দাবি করছে র্যাব।
এরই মধ্যে গত শুক্রবার (১ এপ্রিল) রাতে রাজধানীর মুগদা, শাহজাহানপুর ও মিরপুর থেকে ৪ গ্রেফতার করে র্যাব-৩। তারা হলেন- ঘটনার অন্যতম ‘মাস্টারমাইন্ড’ ওমর ফারুক (৫২) ও ‘পরিকল্পনায় সম্পৃক্ত’, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ (৩৮), মো. নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির (৩৮), এবং মো. মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশ (৫১)। এসময় উদ্ধার করা হয়, নজরদারির কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, হত্যার জন্য চুক্তির ১৫ লাখ টাকার মধ্যে তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা ও মোবাইলসহ অন্যান্য সামগ্রী।
গতকাল শনিবার দুপুরে কারওয়ান বাজার সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব সদরদপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতি হত্যার পর র্যাব এ বিষয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করে। সেই সঙ্গে বাড়ানো হয় গোয়েন্দা নজরদারি। তদন্তের এক পর্যায়ে গতকাল মুগদা, শাহজাহানপুর ও মিরপুর অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে হত্যার মোটিভ সম্পর্কে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে টিপু ও গ্রেফতারদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, স্কুল-কলেজের ভর্তি বাণিজ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাদের মধ্যে ছিল দ্বন্দ্ব-সংঘাত। এর একপর্যায়ে ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে মিল্কী হত্যার ঘটনা ঘটে। এলাকায় মিল্কীর সহযোগী হিসেবে পরিচিতি টিপু হত্যার ঘটনায় গ্রেফতাররা জানান, মিল্কী হত্যাকা-ের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে টিপুর বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেন ওমর ফারুক ও তার সহযোগীরা। এছাড়া মিল্কী হত্যা মামলার বাদীর মাধ্যমে টিপুর নাম এজাহারে দেন ওমর ফারুক ও তার সহযোগীরা। পরে আদালতের মাধ্যমে মামলা থেকে অব্যাহতি পান টিপু। এতে ক্ষুব্ধ হন ওমর ফারুকরা। পরে ২০১৬ সালে একই দ্বন্দ্বের জেরে টিপুর সহযোগী রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবুকে হত্যা করে ওমর ফারুকের দল। বর্তমানে রিজভী হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।
গ্রেফতাররা আরও জানান, তাদের ধারণা টিপুর কারণেই রিজভী হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরিত হয়েছে। এরই মধ্যে মামলার বাদী রিজভীর বাবা আবুল কালামের সঙ্গে গ্রেফতার ওমর ফারুক ও তার সহযোগীরা ৫০ লাখ টাকায় দফারফা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু টিপুর কারণে মীমাংসায় যাননি কালাম।
এক পর্যায়ে কালামকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ওমর ফারুকরা। কিন্তু জাহিদুল ইসলাম টিপুর সঙ্গে চলাচল করার কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরে তারা যখন দেখলো, কালামের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ, তখন তারা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন, যাতে মামলা পরিচালনা ধীরগতি করা যায়। তাদের ধারণা ছিল, কালাম একা মামলাটি সঠিকভাবে চালাতে পারবেন না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় তিন মাস আগে, রিজভী হত্যা মামলার সাক্ষ্য শেষে আদালত চত্বর এলাকায় টিপু হত্যার বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা করে ওমর ফারুকরা। র্যাবের মুখপাত্র বলেন, রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবু হত্যাকা-ের অন্যতম সাক্ষী মো. মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশকে তারা অর্থের বিনিময়ে সাক্ষ্য দিতে বিরত থাকতে বলেন। মোরশেদুল আলম রাজি থাকলেও টিপুর চাপে সাক্ষ্য দেন।
পরবর্তীতে রিজভী হত্যাকা-ে গ্রেফতার আসামিদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে টিপুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে অংশ নেন মোরশেদুল আলম। এরপর টিপু হত্যা বাস্তবায়নের জন্য ফারুক ও মুসাকে ফোনে কয়েকজন আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন মোরশেদুল। হত্যাকা-টি বাস্তবায়নে চূড়ান্ত সমন্বয়ের জন্য গত ১২ মার্চ দুবাই যান হত্যার নির্দেশদাতা সুমন শিকদার ওরফে মুসা।
র্যাব বলছে, হত্যাকা-টি দেশে সংঘটিত হলেও নিয়ন্ত্রণ করা হয় দুবাই থেকে। ঘটনার আগে দেশ থেকে নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, মোরশেদুল আলম ওরফে কাইল্লা পলাশসহ আরও কয়েকজন টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসার কাছে তথ্য দিতেন। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর, নাছির আনুমানিক চারবার টিপুর অবস্থান সম্পর্কে মুসাকে জানান। পরবর্তীতে টিপু গ্র্যান্ড সুলতান রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার সময় কাইল্লা পলাশ তাকে নজরদারিতে রাখেন। সেই সঙ্গে তার অবস্থান সম্পর্কে ফ্রিডম মানিক নামে আরেকজনকে জানান। সেই তথ্য অনুযায়ী হত্যাকা-টি ঘটায় কিলার।
মূলত, দুবাই বসে টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দেন মুসা। আর এই হত্যার জন্য চুক্তি হয় ১৫ লাখ টাকা। এই ১৫ লাখ টাকার কে কত দেবে তাও ভাগ করে দেন মুসা। ৯ লাখ টাকা দেন ওমর ফারুক। বাকি ৬ লাখ টাকা দেন গ্রেফতার নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির, আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ ও মুসা। দুবাইয়ে যাওয়ার আগে ৫ লাখ টাকা নিয়ে যান মুসা, হুন্ডির মাধ্যমে আরও ৪ লাখ টাকা মুসাকে দেওয়া হয়। বাকি ৬ লাখ টাকা দেশে হস্তান্তর করার চুক্তি হয়। ৬ লাখের মধ্যে র্যাব গ্রেফতারের সময় ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা জব্দ করে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকা-ের সময় কিলার নাছিরকে ঘটনাস্থলের পাশে সাদা শার্ট, জিনস প্যান্ট ও কেডস পরা অবস্থায় দেখা যায়। টিপুকে হত্যার পর নাছির তার মোবাইল ফ্লাশ করে বিক্রি করে দেন ও সিমকার্ড ভেঙে ফেলেন। পরবর্তীতে মোবাইল ও সিমকার্ডটি উদ্ধার করে র্যাব। এছাড়া ঘটনার আগের দিন নাছির সীমান্তবর্তী চৌদ্দগ্রাম এলাকায় একদিন অবস্থান করেছিলেন। কাইল্লা পলাশ ঘটনার দিন টিপুকে নজরদারি ও আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে। শুটার সালেহ ঘটনার পরিকল্পনা ও অর্থ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত।
হত্যার ‘পরিকল্পনাকারী’ ওমর ফারুককে আ. লীগ থেকে বহিষ্কার : আওয়ামী লীগের নেতা জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপু হত্যাকা-ের ঘটনার ‘অন্যতম পরিকল্পনাকারী’ ওমর ফারুককে মতিঝিল থানার অধীন ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বিষয়টি সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ। রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ বলেন, টিপু হত্যাকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাব তাকে গ্রেফতার করেছে। সেখানে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সে কারণে মহানগর আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তার দায়ভার তো মহানগর আওয়ামী লীগ নিতে পারে না। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৭ ধারায় তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
আন্ডারওয়ার্ল্ডের সহযোগিতা থাকতেও পারে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, মতিঝিল থানা আ.লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুসহ জোড়া খুনের ঘটনায় জড়িত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। এ মর্মান্তিক ও ন্যক্কারজনক হত্যাকা-ের সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সহযোগিতা থাকতেও পারে। সে বিষয়টি আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না।
গতকাল শনিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তদন্তে যদি অন্য কারো সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসে তাকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে এ বিষয়ে দ্রুত তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
টিপু হত্যা আওয়ামী লীগ নেতার পরিকল্পনায়
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ