ঢাকা ০৩:৪৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

টিকার পেটেন্টে বিতর্ক কী নিয়ে, সমাধানই বা কী

  • আপডেট সময় : ০১:২৮:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ মে ২০২১
  • ১২৯ বার পড়া হয়েছে


প্রত্যাশা ডেস্ক : দুনিয়াজোড়া এই মহামারিতে অন্তত একটি বিষয়ে বিশ্বনেতারা সবাই একমত- যতক্ষণ না সবাইকে সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে, কেউ এখানে নিরাপদ নয়। সবাইকে সুরক্ষা দিতে চাই সবার জন্য টিকা; সমস্যা সেখানেই। উৎপাদন আর সরবরাহের গতি কম। টিকাদানের হার বিবেচনা করলে ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে ব্যবধান দুস্তর। আর করোনাভাইরাসের টিকার উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে বিশ্বনেতারা একমত হতে পারছেন না।
এতদিনের নীতি ভেঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র টিকার পেটেন্টে সাময়িক ছাড় দিতে রাজি হয়েছে। নানামুখী চাপের কারণে করোনাভাইরাসের টিকার মেধাস্বত্ব ছাড়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে জো বাইডেনের সরকার। টিকা পেতে দেশগুলোর কূটনৈতিক যুদ্ধের মধ্যে এটি একটি ভালো খবর। কিন্তু এ বিষয়ে জার্মানির উল্টো অবস্থান দুঃসংবাদই দিচ্ছে। ইউরোপের দেশটি পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে ছাড় দিতে নারাজ। মার্কিন সিদ্ধান্তে যে আশার আলো দেখা দিয়েছিল, জার্মানির অবস্থানের কারণে তাতে কিছুটা হলেও ভাটা পড়বে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজারের সঙ্গে যৌথভাবে টিকা উৎপাদন করছে জার্মান কোম্পানি বায়োএনটেক। বিশ্বজুড়ে তাদের টিকার ব্যবহার বাড়ছে। টিকার পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব নিয়ে বিশ্বে চলমান বিতর্কের একটি পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে। পেটেন্টের আওতায় ওষুধ ও অন্যান্য উদ্ভাবন যাতে নকল বা চুরি করে উৎপাদন করা না হয়, সেজন্য আইনগতভাবে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ করা হয়। যে কোনো টিকার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। উদ্ভাবকদের উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি সেগুলো সংরক্ষণের অধিকার দেওয়া হয় পেটেন্টের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে আরেকটি কাজ করা হয়, সেটি হল ওই উদ্ভাবন থেকে বেশি অর্থ আয়ের সুযোগ নিশ্চিত করা। এর পক্ষে যুক্তি হল- এতে উদ্ভাবনের জন্য সবাই আরো বেশি অনুপ্রাণিত হবেন। তবে এখন তো আর ‘স্বাভাবিক’সময় নয়।
করোনাভাইরাস মহামারিতে গত বছর বিশ্বজুড়ে টিকার উৎপাদন বাড়াতে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম ডব্লিউটিওতে মেধাস্বত্ব ছাড়ের প্রস্তাব তোলে। টিকা ছাড়াও কোভিড -১৯ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা সরঞ্জামেও ছাড় দেওয়ার দাবি তোলে দেশ দুটি।
তাদের যুক্তি ছিল, মহামারি যে ভয়ঙ্কর রূপ পেয়েছে, মানুষের জীবন বাঁচাতেই এ পদক্ষেপ নিতে হবে। টিকা উৎপাদনের ফর্মুলা, প্রযুক্তি ও কৌশল উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন শুরু করা যাবে। তাতে উৎপাদন বাড়বে ব্যাপকভাবে এবং দরিদ্র দেশগুলোর জন্য টিকা সহজলভ্য হবে।
তাতে সমস্যা কোথায়? পেটেন্ট ও মেধাস্বত্বে ছাড় দেওয়ার প্রসঙ্গ ওঠার পর থেকে এর বিরোধিতাও জোরালো হয়ে উঠতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র পক্ষ বদলে ছাড় দেওয়ার কথা বললেও ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা এ দুটো বিষয় উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা বলছে। সর্বশেষ জার্মানি এর বিরোধিতায় উচ্চকণ্ঠ হয়েছে। টিকা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ব্যয় হয় গবেষণা ও উন্নয়নে। উৎপাদন পর্যায়ে খরচ তুলনামূলক কম থাকে। পেটেন্ট তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তির সবচেয়ে বড় কারণ হল, তাতে দির্ঘমেয়াদি একচেটিয়া ব্যবসা থাকবে না, অর্থাৎ উদ্ভাবক কোম্পানির লাভের ভাগ কমে যাবে। তাতে উদ্ভাবন নিরুৎসাহিত হবে বলেই এ পক্ষের যুক্তি।
তাহলে এটা কি শুধু টাকা-পয়সার বিষয়? না, পেটেন্ট ও মেধাস্বত্বে ছাড় চাওয়া হচ্ছে সাময়িক সময়ের জন্য। অন্যরা এর বিরোধিতা করলেও অ্যাস্ট্রাজেনেকার মতো টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানি উৎপাদন খরচেই প্রতি ডোজ টিকা দিচ্ছে। টিকা উৎপাদক কোম্পানি ও দেশগুলোর যুক্তি হল, শুধু পেটেন্টে ছাড় দিলে সব সমস্যার সমাধান হবে না; এটা হবে রান্নার উপকরণ ও কৌশল না জানিয়ে শুধু রেসিপি ধরিয়ে দেওয়ার মত। পেটেন্টের মাধ্যমে একটি উদ্ভাবনের মূল ফর্মুলা গোপন রাখা হয়, তবে উৎপাদনের প্রক্রিয়া গোপন থাকে না। টিকার ক্ষেত্রে এটি গরুত্বপূর্ণ। ফাইজার ও মর্ডানার এমআএনএ টাইপ টিকা একবারেই নতুন ধারণা থেকে তৈরি করা। ফলে খুব কম লোকই এর উৎপাদন প্রক্রিয়া বুঝতে পারবে। মেধাস্বত্ব শিথিলের বিরোধী পক্ষের যুক্তি হল, সাধারণত টিকা তৈরির কৌশল অত্যন্ত গোপনীয় এবং সুরক্ষিত রাখা হয়, বিষয়গুলো যথেষ্ট জটিল। ফলে পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করে দিলেই টিকার বৈশ্বিক যোগান বাড়ানো যাবে না। তারা বলছেন, টিকা বানানোর প্রস্তুতপ্রণালি পেয়ে যাওয়ার মানে এই নয় যে, যে কোনো ওষুধ কোম্পানি তা দ্রুততার সঙ্গে উৎপাদন করতে পারবে।
বায়োএনটেক বলছে, এ ধরনের কাজে উৎপাদন প্রক্রিয়া গুছিয়ে নিতেই এক যুগের মত লম্বা সময় লেগে যায়। উৎপাদন কারখানা বা প্ল্যান্টকে টিকা তৈরির উপযোগী করতেও লাগে এক বছর। কাঁচামালের যোগানও একটি বড় বিষয়।
ওষুধ শিল্প সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, কীভাবে কীভাবে কী করতে হয় তার বিস্তারিত না জানিয়ে কেবল পেটেন্টে ছাড় দেওয়া হলে দিকে দিকে যদি টিকা তৈরির চেষ্টা শুরু হয়ে যায়, তাতে গুণগত মান, নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হতে পারে। এমনকি নকল হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিকল্প কী? ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, তারা কথা বলতে রাজি। এর আগে বলেছিল, উন্নত দেশগুলোর আরো বেশি পরিমাণ টিকা রপ্তানি করাই স্বল্প সময়ের সবচেয়ে ভালো সমাধান। কোভ্যাক্সের সবচেয়ে বড় দাতা দেশ যুক্তরাজ্য গরিব দেশগুলোতে টিকা সরবরাহ শুরু করার পরিকল্পনা নিচ্ছে। তারা স্বেচ্ছায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনেকার সঙ্গে ভারতে সেরাম ইন্সটিটিউটের টিকা উৎপাদনের অনুমোদন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়েছে। দেশটি চায় বিশ্ব বাণিজ্যের নীতি ও সংস্কার কার্যক্রম দেখভালকারী সংস্থা ডব্লিউটিও আরো এমন অংশীদারিত্বকে সমর্থন দিক। লাইসেন্স নিয়ে ডব্লিউটিওর যে কাঠামো রয়েছে, তাতে এ প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। কোনো দেশের সরকার চাইলে টিকা উৎপাদকদের বাধ্যতামূলকভাবে লাইসেন্সের শর্ত আরোপ করতে পারে, যাতে কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন কৌশল জানাতে বাধ্য থাকবে। সরকার উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া দেখভালও করতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে ওষুধ প্রস্তুতকারক ওই কোম্পানিগুলোকে সরকারের তরফ থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার একটি বিষয় থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্র মত পাল্টালো কেন? টিকা উৎপাদনের পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের নিয়ম শিথিল করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর চাপ ছিল ঘরের ভেতরে এবং বাইরে থেকে। বাইডেনের বাণিজ্য বিষয়ক প্রতিনিধি ক্যাথরিন টাই এ বিষয়ে একটি সমাধান বের করতে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন অংশীজনদের সঙ্গে। তিনি টিকা উৎপাদন দ্রুত বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা করেছেন। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়ার ঘোষণা আসে। কিন্ত এই সমঝোতার কৌশল নিয়েও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের ভালোভাবে ভাবতে হবে, যাতে টিকা প্রস্ততকারকরা স্বেচ্ছায় কিংবা স্বল্প ফি নিয়ে অনুমোদন দেওয়ার বেলায় যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করে।
এরপর কী? এখন ডব্লিউটিওতে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। বিশ্ব বাণিজ্যের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এই প্ল্যাটফর্মে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই আলোচনা টিআরআইপিএস (ট্রিপস) হিসেবে পরিচিত। এটা ওষুধ উৎপাদনে একক নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখার বাণিজ্য-বিষয়ক মেধাস্বত্ব অধিকার বিষয়ক চুক্তি।
ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রস্তাবে ডব্লিউটিওর সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে কিছু পেটেন্ট এবং ব্যবসায়িক গোপনীয়তার শর্তে ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ওই ছাড় শুধু টিকার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এ সংক্রান্ত চিকিৎসা পদ্ধতি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মেধাস্বত্বের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে। প্রভাবশালী দেশগুলোর সমর্থন ছাড়া এই উদ্যোগ থমকে থাকবে। তবে তাদের উদ্যোগ সমঝোতার দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা উৎপাদন বাড়াতে গতি আনবে। এখন দেখার বিষয় হলো, সেটা কবে হবে, আর কতটা।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

নতুন আপদ ‘মব সন্ত্রাস’, আতঙ্কে সারা দেশ

টিকার পেটেন্টে বিতর্ক কী নিয়ে, সমাধানই বা কী

আপডেট সময় : ০১:২৮:১১ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ মে ২০২১


প্রত্যাশা ডেস্ক : দুনিয়াজোড়া এই মহামারিতে অন্তত একটি বিষয়ে বিশ্বনেতারা সবাই একমত- যতক্ষণ না সবাইকে সুরক্ষা দেওয়া যাচ্ছে, কেউ এখানে নিরাপদ নয়। সবাইকে সুরক্ষা দিতে চাই সবার জন্য টিকা; সমস্যা সেখানেই। উৎপাদন আর সরবরাহের গতি কম। টিকাদানের হার বিবেচনা করলে ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে ব্যবধান দুস্তর। আর করোনাভাইরাসের টিকার উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে বিশ্বনেতারা একমত হতে পারছেন না।
এতদিনের নীতি ভেঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র টিকার পেটেন্টে সাময়িক ছাড় দিতে রাজি হয়েছে। নানামুখী চাপের কারণে করোনাভাইরাসের টিকার মেধাস্বত্ব ছাড়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে জো বাইডেনের সরকার। টিকা পেতে দেশগুলোর কূটনৈতিক যুদ্ধের মধ্যে এটি একটি ভালো খবর। কিন্তু এ বিষয়ে জার্মানির উল্টো অবস্থান দুঃসংবাদই দিচ্ছে। ইউরোপের দেশটি পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে ছাড় দিতে নারাজ। মার্কিন সিদ্ধান্তে যে আশার আলো দেখা দিয়েছিল, জার্মানির অবস্থানের কারণে তাতে কিছুটা হলেও ভাটা পড়বে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজারের সঙ্গে যৌথভাবে টিকা উৎপাদন করছে জার্মান কোম্পানি বায়োএনটেক। বিশ্বজুড়ে তাদের টিকার ব্যবহার বাড়ছে। টিকার পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব নিয়ে বিশ্বে চলমান বিতর্কের একটি পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির একটি প্রতিবেদনে। পেটেন্টের আওতায় ওষুধ ও অন্যান্য উদ্ভাবন যাতে নকল বা চুরি করে উৎপাদন করা না হয়, সেজন্য আইনগতভাবে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ করা হয়। যে কোনো টিকার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। উদ্ভাবকদের উদ্ভাবনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি সেগুলো সংরক্ষণের অধিকার দেওয়া হয় পেটেন্টের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে আরেকটি কাজ করা হয়, সেটি হল ওই উদ্ভাবন থেকে বেশি অর্থ আয়ের সুযোগ নিশ্চিত করা। এর পক্ষে যুক্তি হল- এতে উদ্ভাবনের জন্য সবাই আরো বেশি অনুপ্রাণিত হবেন। তবে এখন তো আর ‘স্বাভাবিক’সময় নয়।
করোনাভাইরাস মহামারিতে গত বছর বিশ্বজুড়ে টিকার উৎপাদন বাড়াতে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম ডব্লিউটিওতে মেধাস্বত্ব ছাড়ের প্রস্তাব তোলে। টিকা ছাড়াও কোভিড -১৯ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা সরঞ্জামেও ছাড় দেওয়ার দাবি তোলে দেশ দুটি।
তাদের যুক্তি ছিল, মহামারি যে ভয়ঙ্কর রূপ পেয়েছে, মানুষের জীবন বাঁচাতেই এ পদক্ষেপ নিতে হবে। টিকা উৎপাদনের ফর্মুলা, প্রযুক্তি ও কৌশল উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন শুরু করা যাবে। তাতে উৎপাদন বাড়বে ব্যাপকভাবে এবং দরিদ্র দেশগুলোর জন্য টিকা সহজলভ্য হবে।
তাতে সমস্যা কোথায়? পেটেন্ট ও মেধাস্বত্বে ছাড় দেওয়ার প্রসঙ্গ ওঠার পর থেকে এর বিরোধিতাও জোরালো হয়ে উঠতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র পক্ষ বদলে ছাড় দেওয়ার কথা বললেও ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা এ দুটো বিষয় উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা বলছে। সর্বশেষ জার্মানি এর বিরোধিতায় উচ্চকণ্ঠ হয়েছে। টিকা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ব্যয় হয় গবেষণা ও উন্নয়নে। উৎপাদন পর্যায়ে খরচ তুলনামূলক কম থাকে। পেটেন্ট তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তির সবচেয়ে বড় কারণ হল, তাতে দির্ঘমেয়াদি একচেটিয়া ব্যবসা থাকবে না, অর্থাৎ উদ্ভাবক কোম্পানির লাভের ভাগ কমে যাবে। তাতে উদ্ভাবন নিরুৎসাহিত হবে বলেই এ পক্ষের যুক্তি।
তাহলে এটা কি শুধু টাকা-পয়সার বিষয়? না, পেটেন্ট ও মেধাস্বত্বে ছাড় চাওয়া হচ্ছে সাময়িক সময়ের জন্য। অন্যরা এর বিরোধিতা করলেও অ্যাস্ট্রাজেনেকার মতো টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানি উৎপাদন খরচেই প্রতি ডোজ টিকা দিচ্ছে। টিকা উৎপাদক কোম্পানি ও দেশগুলোর যুক্তি হল, শুধু পেটেন্টে ছাড় দিলে সব সমস্যার সমাধান হবে না; এটা হবে রান্নার উপকরণ ও কৌশল না জানিয়ে শুধু রেসিপি ধরিয়ে দেওয়ার মত। পেটেন্টের মাধ্যমে একটি উদ্ভাবনের মূল ফর্মুলা গোপন রাখা হয়, তবে উৎপাদনের প্রক্রিয়া গোপন থাকে না। টিকার ক্ষেত্রে এটি গরুত্বপূর্ণ। ফাইজার ও মর্ডানার এমআএনএ টাইপ টিকা একবারেই নতুন ধারণা থেকে তৈরি করা। ফলে খুব কম লোকই এর উৎপাদন প্রক্রিয়া বুঝতে পারবে। মেধাস্বত্ব শিথিলের বিরোধী পক্ষের যুক্তি হল, সাধারণত টিকা তৈরির কৌশল অত্যন্ত গোপনীয় এবং সুরক্ষিত রাখা হয়, বিষয়গুলো যথেষ্ট জটিল। ফলে পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব উন্মুক্ত করে দিলেই টিকার বৈশ্বিক যোগান বাড়ানো যাবে না। তারা বলছেন, টিকা বানানোর প্রস্তুতপ্রণালি পেয়ে যাওয়ার মানে এই নয় যে, যে কোনো ওষুধ কোম্পানি তা দ্রুততার সঙ্গে উৎপাদন করতে পারবে।
বায়োএনটেক বলছে, এ ধরনের কাজে উৎপাদন প্রক্রিয়া গুছিয়ে নিতেই এক যুগের মত লম্বা সময় লেগে যায়। উৎপাদন কারখানা বা প্ল্যান্টকে টিকা তৈরির উপযোগী করতেও লাগে এক বছর। কাঁচামালের যোগানও একটি বড় বিষয়।
ওষুধ শিল্প সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, কীভাবে কীভাবে কী করতে হয় তার বিস্তারিত না জানিয়ে কেবল পেটেন্টে ছাড় দেওয়া হলে দিকে দিকে যদি টিকা তৈরির চেষ্টা শুরু হয়ে যায়, তাতে গুণগত মান, নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হতে পারে। এমনকি নকল হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিকল্প কী? ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে, তারা কথা বলতে রাজি। এর আগে বলেছিল, উন্নত দেশগুলোর আরো বেশি পরিমাণ টিকা রপ্তানি করাই স্বল্প সময়ের সবচেয়ে ভালো সমাধান। কোভ্যাক্সের সবচেয়ে বড় দাতা দেশ যুক্তরাজ্য গরিব দেশগুলোতে টিকা সরবরাহ শুরু করার পরিকল্পনা নিচ্ছে। তারা স্বেচ্ছায় অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনেকার সঙ্গে ভারতে সেরাম ইন্সটিটিউটের টিকা উৎপাদনের অনুমোদন প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়েছে। দেশটি চায় বিশ্ব বাণিজ্যের নীতি ও সংস্কার কার্যক্রম দেখভালকারী সংস্থা ডব্লিউটিও আরো এমন অংশীদারিত্বকে সমর্থন দিক। লাইসেন্স নিয়ে ডব্লিউটিওর যে কাঠামো রয়েছে, তাতে এ প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। কোনো দেশের সরকার চাইলে টিকা উৎপাদকদের বাধ্যতামূলকভাবে লাইসেন্সের শর্ত আরোপ করতে পারে, যাতে কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন কৌশল জানাতে বাধ্য থাকবে। সরকার উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া দেখভালও করতে পারবে। তবে সেক্ষেত্রে ওষুধ প্রস্তুতকারক ওই কোম্পানিগুলোকে সরকারের তরফ থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার একটি বিষয় থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্র মত পাল্টালো কেন? টিকা উৎপাদনের পেটেন্ট ও মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের নিয়ম শিথিল করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর চাপ ছিল ঘরের ভেতরে এবং বাইরে থেকে। বাইডেনের বাণিজ্য বিষয়ক প্রতিনিধি ক্যাথরিন টাই এ বিষয়ে একটি সমাধান বের করতে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন অংশীজনদের সঙ্গে। তিনি টিকা উৎপাদন দ্রুত বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা করেছেন। এরপরই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ছাড় দেওয়ার ঘোষণা আসে। কিন্ত এই সমঝোতার কৌশল নিয়েও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের ভালোভাবে ভাবতে হবে, যাতে টিকা প্রস্ততকারকরা স্বেচ্ছায় কিংবা স্বল্প ফি নিয়ে অনুমোদন দেওয়ার বেলায় যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করে।
এরপর কী? এখন ডব্লিউটিওতে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। বিশ্ব বাণিজ্যের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এই প্ল্যাটফর্মে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই আলোচনা টিআরআইপিএস (ট্রিপস) হিসেবে পরিচিত। এটা ওষুধ উৎপাদনে একক নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখার বাণিজ্য-বিষয়ক মেধাস্বত্ব অধিকার বিষয়ক চুক্তি।
ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রস্তাবে ডব্লিউটিওর সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে কিছু পেটেন্ট এবং ব্যবসায়িক গোপনীয়তার শর্তে ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ওই ছাড় শুধু টিকার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এ সংক্রান্ত চিকিৎসা পদ্ধতি ও চিকিৎসা সরঞ্জামের মেধাস্বত্বের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য হবে। প্রভাবশালী দেশগুলোর সমর্থন ছাড়া এই উদ্যোগ থমকে থাকবে। তবে তাদের উদ্যোগ সমঝোতার দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা উৎপাদন বাড়াতে গতি আনবে। এখন দেখার বিষয় হলো, সেটা কবে হবে, আর কতটা।