ঢাকা ১০:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৩ জুন ২০২৫

টিউলিপ সিদ্দিকের মন্ত্রিত্বে গর্বিত বাংলাদেশ

  • আপডেট সময় : ১০:২০:৫১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৪ জুলাই ২০২৪
  • ৮৪ বার পড়া হয়েছে

তাপস হালদার : যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের পর সবচেয়ে বেশি বাঙালির উপস্থিতি ছিল ব্রিটেনে। ২৫ মার্চ গণহত্যার পর বার্মিংহামে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয়েছিল। পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম যুক্তরাজ্যে হয়ে ঢাকা ফিরেছিলেন।
রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ভেঙে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথ।পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যে তথা ব্রিটেনের স্থায়ী বাসিন্দা হন। সময়ের পরিক্রমায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্রী, প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও শেখ রেহানার জেষ্ঠ্য কন্যা টিউলিপ সিদ্দিক আজ গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটেনের রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
গত ৪ জুলাই অনুষ্ঠিত যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ক্ষমতায় এসেছে দলটি।প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন স্যার কেয়ার স্টারমার।প্রথম ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক।তিনি স্যার কেয়ার স্টারমারের নতুন সরকারে ‘ইকোনোমিক সেক্রেটারি টু দ্য ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার’ হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। যুক্তরাজ্যর ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার মূলত ‘মিনিস্টার ফর ফাইন্যান্স সিটি।’
অর্থ্যাৎ তিনি আর্থিক সেবা খাতের নীতিনির্ধারণী নেতৃত্ব দিবেন।অর্থনৈতিক খাতের প্রযুক্তি ও ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ন্ত্রণ এবং ঋণ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণের দায়িত্বও পালন করবেন। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের আর্থিক টানাপোড়েনের সময়ে এই মন্ত্রণালয়টির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রী হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় টিউলিপ সিদ্দিক টুইটে লিখেছেন, ‘এটা খুবই গর্বের বিষয় ট্রেজারি ও সিটি মিনিস্টার ইকোনমিক সেক্রেটারি হিসেবে আমাকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য। আমাদের ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি বৃটেনের অন্যতম বড় সম্পদ। অর্থনীতির গতিশীলতা ফিরিয়ে আনা আমার বড় কাজ।নষ্ট করার মতো সময় নেই।’

যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে টানা চতুর্থ বারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক। লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে হ্যাম্পস্টেড-হাইগেট আসন থেকে তিনি ২৩ হাজার ৪৩২ ভোট পেয়েছেন যা প্রদত্ত ভোটের হারে ৪৮ শতাংশ। প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির ডন উইলিয়ামসকে পনের হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন।
২০১৫,২০১৭ ও ২৯১৯ সালের নির্বাচনেও একই আসন থেকে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। একসময়ের কনজারভেটিভ পার্টির নিরাপদ আসনটি টিউলিপ সিদ্দিক লেবার পার্টির নিরাপদ আসনে পরিনত করেছেন। ২০১৬ সাল থেকেই তিনি লেবার পার্টির হয়ে ছায়ামন্ত্রী, সর্বদলীয় পার্লামেন্ট গ্রুপের ভাইস-চেয়ার, নারী ও পুরুষ সমতা নির্বাচন কমিটির সদস্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। টিউলিপ সিদ্দিক তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনীতি শুরু করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হয়েছেন। ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিল নির্বাচনে প্রথম বাঙালি নারী প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালের নির্বাচনে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। প্রথম নির্বাচনে জয়ের ব্যবধান ছিল ১ হাজার ১৩৮ ভোট, তারপর থেকে প্রতিবারই ভোটের ব্যবধান বাড়িয়ে নিজে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সাথে তিনি প্রায় একদশক ধরে ঘনিষ্ঠ দলীয় সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। ২০২০ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্টারমারকে লেবার পার্টির নেতা হওয়ার প্রার্থিতার জন্য কমপক্ষে ২২ জন দলীয় এমপির সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। সেসময় স্টারমারকে জোরালো ভাবে সমর্থন করেছিলেন টিউলিপ সিদ্দিক।তখন তিনি বলেছিলেন,‘পরবর্তী লেবার নেতার কথা চিন্তা করার ক্ষেত্রে আমার জন্য এক নম্বর অগ্রাধিকার বিষয় হলো কে আমাদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে নিতে পারবেন’। এ ঘটনায় প্রমানিত হয়েছে তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, নেতা নির্বাচনে তিনি ভুল করেননি। মাত্র চার বছরের মধ্যেই স্টারমার দলকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,ব্যক্তির চেয়ে দল বড়,আর দলের চেয়ে দেশ বড়। অর্থাৎ দেশের জনগণের স্বার্থই বড়। টিউলিপ সিদ্দিক নানা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে বড় হয়েছেন। তাঁর কার্যক্রমের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে জনগণের স্বার্থকেই সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়েছেন। নিজের এলাকার জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে ব্রেক্সিট ইস্যুতে দলের সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে সংবাদমাধ্যমে আলোচনার ঝড় তুলেছিলেন। এমনকি ছায়া সরকারের ছায়ামন্ত্রী থেকেও পদত্যাগ করেছিলেন। নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছিলেন,আমার নির্বাচনী এলাকার ৭৫ শতাংশ জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছে। আমাদের ম্যান্ডেট ছিল শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে, মাতৃত্বের অধিকার এবং ইউরোপীয়দের অধিকার নিয়ে। এর কোনোটাই এখনও পূরণ হয়নি। যদি একটিও পূরণ হতো তাহলেও হয়তো ব্রেক্সিট বিলে ভোটের জন্য বিবেচনা করতাম।’
তখন টিউলিপ ছিলেন সন্তানসম্ভবা।ব্রেক্সিটে ভোট দেওয়ার কারণে সিজারের সময় পিছিয়ে দিয়েছিলেন।টিউলিপের এমন সিন্ধান্ত শুধু বৃটেন নয়,আন্তর্জাতিক বিশ্বেও সমানভাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। ওয়ালস্ট্রিট পত্রিকার সাবেক সম্পাদক থেরেসি রাফায়েল ‘দৈনিক ব্লুমবার্গে’ ব্রেক্সিট নিয়ে কলামে টিউলিপ সিদ্দিকের সাহসী সিন্ধান্তের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
শান্তি ও মানবাধিকারের প্রশ্নে তিনি সর্বদা আপোসহীন। সিরিয়ান শরণার্থীদের বিষয়ে এবং সেখানে গৃহযুদ্ধ বন্ধের পক্ষে অবস্থান নিতে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে চিঠি লিখেছিলেন।এছাড়া ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসন ও নারী-শিশুদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে জোরালো সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছেন। বৃটেনে নারী-পুরুষের সমান বেতনের জন্য আন্দোলন করেছেন। ব্রেক্সিটের বিপক্ষে থাকায় হুমকি পেয়েছেন, তবুও নীতি আদর্শ থেকে একবিন্দুও সরে আসেননি।

টিউলিপ সিদ্দিক রাজনীতির বাইরে সামাজিক ও মানবাধিকার বিষয় নিয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠন ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে কাজ করেছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, গ্রেটার লন্ডন অথরিটি, ফিলিপ গোল্ড অ্যাসোসিয়েটস, সেভ দ্য চিলড্রেন ছাড়াও লন্ডনের বর্তমান মেয়র সাদিক খান, ব্রিটিশ এমপি ওনা কিং ও হ্যারি কোহেনের সঙ্গে কাজ করেছেন। এছাড়া ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণাতেও অংশগ্রহণ করেছিলেন।
টিউলিপ সিদ্দিক কাজের মাধ্যমে অনেক মর্যাদাবান স্বীকৃতি পেয়েছেন। ব্রিটেনের জনপ্রিয় পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’ বলেছে ভবিষ্যতের অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের একজন ‘ঙহব ঃড় ডধঃপয’,সানডে টাইমস ‘লেবার পার্টির উদীয়মান তারকা’, ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ডের ‘দ্য প্রোগ্রেস -১০০০’তালিকায় তিনি লন্ডনের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের মধ্যে একজন, ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার ম্যাগাজিনের সেরা ১০০ প্রভাবশালী ইন্সপায়ারের তালিকা স্থান পেয়েছেন। এছাড়া ২০১৫ সালে হাউজ অব কমন্সে তাঁর ভাষণটি বিবিসির সেরা ১০০ ভাষণের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
ভোটের ফল পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়ায় তাঁর ‘মা’ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা বলেন,‘আমি আসলে স্বপ্ন দেখিনি সে রাজনীতিতে আসুক;এটা তার নিজের ইচ্ছা।এখানে আমার অবদান নেই, সম্পূর্ণ তার নিজের চেষ্টায়।মা হিসেবে আমার যতটুকু করার শুধু সেটুকুই করেছি।সে তার জীবনটা উৎসর্গ করেছে ইথিকসের রাজনীতিতে।পরিচয় তার প্রয়োজন হয় না।’মা হিসেবে হয়তো তিনি সঠিক কথাই বলেছেন,সন্তানের জন্য তিনি কিছুই করেনি। কিন্তু একজন সফল সন্তানের জন্য মায়ের অবদান অপরিসীম। তিনি যোগ্য মায়ের যোগ্য সন্তান।
টিউলিপ সিদ্দিক সেকথাই বলেছিলেন, মা ও খালা তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ।সেন্টার ফর রিসার্চ এ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে রাজনীতির শিক্ষা কোথায় পেয়েছেন এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন,‘আমার মা ও খালার কাছ থেকে পেয়েছি। রাজনীতি করতে গেলে ধৈর্য্য দরকার,আমি খালার কাছ থেকে সেটা শিখেছি। আরও একটি বিষয় তাঁরা আমাকে শিখিয়েছেন,সেটা হলো বিনয়ী হওয়া। তুমি যতই বড় হও অহংকার করো না।অন্যের কথা শোনো। অন্যকে গুরুত্ব দাও। এটি রাজনীতির ক্ষেত্রে খুব জরুরি।’
নির্বাচনে বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বাঙালি অংশগ্রহণ করেছিলেন।তারমধ্যে টিউলিপ সিদ্দিক, রুশনারা আলী, রুপা হক, আপসানা বেগম এই চার বঙ্গকন্যা নির্বাচিত হয়েছেন। টিউলিপ সিদ্দিক ছাড়াও বাঙালিদের আরেক গর্ব রুশনারা আলীও মন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট থেকে তিনি টানা পাঁচ বারের নির্বাচিত এমপি। তিনি পেয়েছেন গৃহায়ণ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। টিউলিপ সিদ্দিক চাইলেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব সহজেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে পথে যাননি। বরং তিনি রাজনীতির কঠিন পথটিই বেছে নিয়েছেন। পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী দেশের মন্ত্রী হয়ে তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতাই তাঁকে আজ এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। ব্রিটিশরা দুইশ বছর এই উপমহাদেশ সহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ শাসন ও শোষণ করেছে। সেই ব্রিটিশ শাসন ক্ষমতার অংশ হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়, এটি অত্যন্ত গৌরব ও সম্মানের। টিউলিপ সিদ্দিকের অনন্য অর্জনে শুধুমাত্র তাঁর পরিবারই নয়, গর্বিত পুরো বাংলাদেশ।অভিনন্দন টিউলিপ সিদ্দিক।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও কলামিস্ট

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

দেশে কোরবানির পশু পর্যাপ্ত, পাশের দেশের প্রয়োজন নেই: উপদেষ্টা

টিউলিপ সিদ্দিকের মন্ত্রিত্বে গর্বিত বাংলাদেশ

আপডেট সময় : ১০:২০:৫১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৪ জুলাই ২০২৪

তাপস হালদার : যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের পর সবচেয়ে বেশি বাঙালির উপস্থিতি ছিল ব্রিটেনে। ২৫ মার্চ গণহত্যার পর বার্মিংহামে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয়েছিল। পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম যুক্তরাজ্যে হয়ে ঢাকা ফিরেছিলেন।
রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ভেঙে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার এডওয়ার্ড হিথ।পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা যুক্তরাজ্যে তথা ব্রিটেনের স্থায়ী বাসিন্দা হন। সময়ের পরিক্রমায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্রী, প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও শেখ রেহানার জেষ্ঠ্য কন্যা টিউলিপ সিদ্দিক আজ গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটেনের রাজনীতির এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
গত ৪ জুলাই অনুষ্ঠিত যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ক্ষমতায় এসেছে দলটি।প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন স্যার কেয়ার স্টারমার।প্রথম ব্রিটিশ-বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক।তিনি স্যার কেয়ার স্টারমারের নতুন সরকারে ‘ইকোনোমিক সেক্রেটারি টু দ্য ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার’ হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। যুক্তরাজ্যর ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার মূলত ‘মিনিস্টার ফর ফাইন্যান্স সিটি।’
অর্থ্যাৎ তিনি আর্থিক সেবা খাতের নীতিনির্ধারণী নেতৃত্ব দিবেন।অর্থনৈতিক খাতের প্রযুক্তি ও ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ন্ত্রণ এবং ঋণ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণের দায়িত্বও পালন করবেন। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের আর্থিক টানাপোড়েনের সময়ে এই মন্ত্রণালয়টির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রী হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় টিউলিপ সিদ্দিক টুইটে লিখেছেন, ‘এটা খুবই গর্বের বিষয় ট্রেজারি ও সিটি মিনিস্টার ইকোনমিক সেক্রেটারি হিসেবে আমাকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য। আমাদের ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি বৃটেনের অন্যতম বড় সম্পদ। অর্থনীতির গতিশীলতা ফিরিয়ে আনা আমার বড় কাজ।নষ্ট করার মতো সময় নেই।’

যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে টানা চতুর্থ বারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছেন টিউলিপ সিদ্দিক। লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে হ্যাম্পস্টেড-হাইগেট আসন থেকে তিনি ২৩ হাজার ৪৩২ ভোট পেয়েছেন যা প্রদত্ত ভোটের হারে ৪৮ শতাংশ। প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির ডন উইলিয়ামসকে পনের হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন।
২০১৫,২০১৭ ও ২৯১৯ সালের নির্বাচনেও একই আসন থেকে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। একসময়ের কনজারভেটিভ পার্টির নিরাপদ আসনটি টিউলিপ সিদ্দিক লেবার পার্টির নিরাপদ আসনে পরিনত করেছেন। ২০১৬ সাল থেকেই তিনি লেবার পার্টির হয়ে ছায়ামন্ত্রী, সর্বদলীয় পার্লামেন্ট গ্রুপের ভাইস-চেয়ার, নারী ও পুরুষ সমতা নির্বাচন কমিটির সদস্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। টিউলিপ সিদ্দিক তৃণমূল পর্যায় থেকে রাজনীতি শুরু করেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির সদস্য হয়েছেন। ২০১০ সালে ক্যামডেন কাউন্সিল নির্বাচনে প্রথম বাঙালি নারী প্রার্থী হিসেবে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালের নির্বাচনে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন। প্রথম নির্বাচনে জয়ের ব্যবধান ছিল ১ হাজার ১৩৮ ভোট, তারপর থেকে প্রতিবারই ভোটের ব্যবধান বাড়িয়ে নিজে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সাথে তিনি প্রায় একদশক ধরে ঘনিষ্ঠ দলীয় সহকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। ২০২০ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্টারমারকে লেবার পার্টির নেতা হওয়ার প্রার্থিতার জন্য কমপক্ষে ২২ জন দলীয় এমপির সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। সেসময় স্টারমারকে জোরালো ভাবে সমর্থন করেছিলেন টিউলিপ সিদ্দিক।তখন তিনি বলেছিলেন,‘পরবর্তী লেবার নেতার কথা চিন্তা করার ক্ষেত্রে আমার জন্য এক নম্বর অগ্রাধিকার বিষয় হলো কে আমাদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে নিতে পারবেন’। এ ঘটনায় প্রমানিত হয়েছে তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, নেতা নির্বাচনে তিনি ভুল করেননি। মাত্র চার বছরের মধ্যেই স্টারমার দলকে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,ব্যক্তির চেয়ে দল বড়,আর দলের চেয়ে দেশ বড়। অর্থাৎ দেশের জনগণের স্বার্থই বড়। টিউলিপ সিদ্দিক নানা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে বড় হয়েছেন। তাঁর কার্যক্রমের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে জনগণের স্বার্থকেই সর্বাগ্রে প্রাধান্য দিয়েছেন। নিজের এলাকার জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে ব্রেক্সিট ইস্যুতে দলের সিন্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে সংবাদমাধ্যমে আলোচনার ঝড় তুলেছিলেন। এমনকি ছায়া সরকারের ছায়ামন্ত্রী থেকেও পদত্যাগ করেছিলেন। নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছিলেন,আমার নির্বাচনী এলাকার ৭৫ শতাংশ জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছে। আমাদের ম্যান্ডেট ছিল শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে, মাতৃত্বের অধিকার এবং ইউরোপীয়দের অধিকার নিয়ে। এর কোনোটাই এখনও পূরণ হয়নি। যদি একটিও পূরণ হতো তাহলেও হয়তো ব্রেক্সিট বিলে ভোটের জন্য বিবেচনা করতাম।’
তখন টিউলিপ ছিলেন সন্তানসম্ভবা।ব্রেক্সিটে ভোট দেওয়ার কারণে সিজারের সময় পিছিয়ে দিয়েছিলেন।টিউলিপের এমন সিন্ধান্ত শুধু বৃটেন নয়,আন্তর্জাতিক বিশ্বেও সমানভাবে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। ওয়ালস্ট্রিট পত্রিকার সাবেক সম্পাদক থেরেসি রাফায়েল ‘দৈনিক ব্লুমবার্গে’ ব্রেক্সিট নিয়ে কলামে টিউলিপ সিদ্দিকের সাহসী সিন্ধান্তের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
শান্তি ও মানবাধিকারের প্রশ্নে তিনি সর্বদা আপোসহীন। সিরিয়ান শরণার্থীদের বিষয়ে এবং সেখানে গৃহযুদ্ধ বন্ধের পক্ষে অবস্থান নিতে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকে চিঠি লিখেছিলেন।এছাড়া ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসন ও নারী-শিশুদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে জোরালো সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছেন। বৃটেনে নারী-পুরুষের সমান বেতনের জন্য আন্দোলন করেছেন। ব্রেক্সিটের বিপক্ষে থাকায় হুমকি পেয়েছেন, তবুও নীতি আদর্শ থেকে একবিন্দুও সরে আসেননি।

টিউলিপ সিদ্দিক রাজনীতির বাইরে সামাজিক ও মানবাধিকার বিষয় নিয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠন ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাথে কাজ করেছেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, গ্রেটার লন্ডন অথরিটি, ফিলিপ গোল্ড অ্যাসোসিয়েটস, সেভ দ্য চিলড্রেন ছাড়াও লন্ডনের বর্তমান মেয়র সাদিক খান, ব্রিটিশ এমপি ওনা কিং ও হ্যারি কোহেনের সঙ্গে কাজ করেছেন। এছাড়া ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বারাক ওবামার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণাতেও অংশগ্রহণ করেছিলেন।
টিউলিপ সিদ্দিক কাজের মাধ্যমে অনেক মর্যাদাবান স্বীকৃতি পেয়েছেন। ব্রিটেনের জনপ্রিয় পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’ বলেছে ভবিষ্যতের অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের একজন ‘ঙহব ঃড় ডধঃপয’,সানডে টাইমস ‘লেবার পার্টির উদীয়মান তারকা’, ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ডের ‘দ্য প্রোগ্রেস -১০০০’তালিকায় তিনি লন্ডনের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের মধ্যে একজন, ব্রিটিশ বাংলাদেশি পাওয়ার ম্যাগাজিনের সেরা ১০০ প্রভাবশালী ইন্সপায়ারের তালিকা স্থান পেয়েছেন। এছাড়া ২০১৫ সালে হাউজ অব কমন্সে তাঁর ভাষণটি বিবিসির সেরা ১০০ ভাষণের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
ভোটের ফল পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়ায় তাঁর ‘মা’ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা বলেন,‘আমি আসলে স্বপ্ন দেখিনি সে রাজনীতিতে আসুক;এটা তার নিজের ইচ্ছা।এখানে আমার অবদান নেই, সম্পূর্ণ তার নিজের চেষ্টায়।মা হিসেবে আমার যতটুকু করার শুধু সেটুকুই করেছি।সে তার জীবনটা উৎসর্গ করেছে ইথিকসের রাজনীতিতে।পরিচয় তার প্রয়োজন হয় না।’মা হিসেবে হয়তো তিনি সঠিক কথাই বলেছেন,সন্তানের জন্য তিনি কিছুই করেনি। কিন্তু একজন সফল সন্তানের জন্য মায়ের অবদান অপরিসীম। তিনি যোগ্য মায়ের যোগ্য সন্তান।
টিউলিপ সিদ্দিক সেকথাই বলেছিলেন, মা ও খালা তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ।সেন্টার ফর রিসার্চ এ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে রাজনীতির শিক্ষা কোথায় পেয়েছেন এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন,‘আমার মা ও খালার কাছ থেকে পেয়েছি। রাজনীতি করতে গেলে ধৈর্য্য দরকার,আমি খালার কাছ থেকে সেটা শিখেছি। আরও একটি বিষয় তাঁরা আমাকে শিখিয়েছেন,সেটা হলো বিনয়ী হওয়া। তুমি যতই বড় হও অহংকার করো না।অন্যের কথা শোনো। অন্যকে গুরুত্ব দাও। এটি রাজনীতির ক্ষেত্রে খুব জরুরি।’
নির্বাচনে বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বাঙালি অংশগ্রহণ করেছিলেন।তারমধ্যে টিউলিপ সিদ্দিক, রুশনারা আলী, রুপা হক, আপসানা বেগম এই চার বঙ্গকন্যা নির্বাচিত হয়েছেন। টিউলিপ সিদ্দিক ছাড়াও বাঙালিদের আরেক গর্ব রুশনারা আলীও মন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট থেকে তিনি টানা পাঁচ বারের নির্বাচিত এমপি। তিনি পেয়েছেন গৃহায়ণ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। টিউলিপ সিদ্দিক চাইলেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব সহজেই প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে পথে যাননি। বরং তিনি রাজনীতির কঠিন পথটিই বেছে নিয়েছেন। পৃথিবীর অন্যতম প্রভাবশালী দেশের মন্ত্রী হয়ে তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতাই তাঁকে আজ এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। ব্রিটিশরা দুইশ বছর এই উপমহাদেশ সহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ শাসন ও শোষণ করেছে। সেই ব্রিটিশ শাসন ক্ষমতার অংশ হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়, এটি অত্যন্ত গৌরব ও সম্মানের। টিউলিপ সিদ্দিকের অনন্য অর্জনে শুধুমাত্র তাঁর পরিবারই নয়, গর্বিত পুরো বাংলাদেশ।অভিনন্দন টিউলিপ সিদ্দিক।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও কলামিস্ট