ঢাকা ০৭:৪৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫

টিআইবির ‘বেমক্কা’ গবেষণা নিয়ে তুমুল বিতর্ক

  • আপডেট সময় : ১০:২৮:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৪
  • ৯৯ বার পড়া হয়েছে

মো. জাকির হোসেন : আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে যত ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞ, নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা, মানবতা, সভ্যতা ও মানবাধিকারবিরোধী ঘটনা ঘটেছে তার বড় অংশ ঘটেছে ইউরোপ ও আমেরিকার প্ররোচনায়। তাদের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছে ইউরোপে। মানুষকে দাসে পরিণত করা ও তাদের পণ্য বানিয়ে ক্রয়-বিক্রয়ের অন্যতম দায় ইউরোপিয়ানদের। আফ্রিকার কালো মানুষদের খাঁচায় বন্দি করে আনন্দ উপভোগের উপকরণে পরিণত করার দায় ইউরোপের মানুষদের। হীরা সংগ্রহ করতে না পারায় কঙ্গোর লাখ লাখ মানুষের হাত কেটে ফেলার নৃশংসতা ইউরোপের শাসক করেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহকে উপনিবেশ বানিয়ে তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে প্রধানত ইউরোপিয়ানরা। রাজনীতি ও ধর্মের নামে ইউরোপে এত বেশি নিষ্ঠুরতা হয়েছে যে সেখানকার মানুষরা পালিয়ে গিয়ে নতুন পৃথিবী খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করেছে।
ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র কেড়ে নিয়ে স্থায়ী রক্তপাত ও অশান্তি সৃষ্টির দায় ইউরোপ ও আমেরিকার। পৃথিবীর নানা প্রান্তে গৃহযুদ্ধ, রক্তপাত, যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রধান ক্রীড়নক ইউরোপ, আমেরিকা ও রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র সমসাময়িক বিশ্বে গণতন্ত্র নির্মাণে ৮০টিরও বেশি দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। কখনও ‘ধ্বংসাত্মক ও গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ থাকার মিথ্যা অজুহাতে, আবার কখনও ‘মানবিক হস্তক্ষেপ’ কিংবা উগ্রবাদ দমনের ছদ্মবেশে চালানো হয়েছে আগ্রাসন। স্বার্থ উদ্ধারে প্রথমে হুমকি-ধমকি, তাতে কাজ না হলে ভয়ংকর সামরিক অভিযানে নির্বিচারে অবকাঠামো ধ্বংস ও লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
ডলার ডিপ্লোম্যাসি, ওয়ার ডিপ্লোম্যাসি, গুপ্ত হত্যা, কোনও দেশের বিরোধী দল বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা, প্রোপাগান্ডা ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশকে নিজের অনুগত করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এভাবে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ফলে আস্তে আস্তে দেশগুলো আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এরপর আধিপত্য ধরে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন, বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ, নব্য-উপনিবেশবাদ প্রবর্তন, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক জোট গঠন, মিডিয়া এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কৌশলী অভিবাসন নীতি ব্যবহার করছে।
সামরিক শক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহকে পদানত রাখতে বিশ্ব অর্থনীতি, মুদ্রাব্যবস্থা ও বাণিজ্য নীতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। নব্য উপনিবেশবাদের দাসত্বের নিগড়ে বন্দি দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহকে তাদের সার্বভৌমত্ব পশ্চিমাদের ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। জোট গঠনের মাধ্যমেও বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত জোট ন্যাটোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অনেক দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। জাতিসংঘ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করছে।
শক্তি প্রয়োগ করে কোনও রাষ্ট্রকে উপনিবেশে পরিণত করা বা উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার নীতি ব্যর্থ হলে পশ্চিমা ধনী রাষ্ট্রগুলো শক্তি প্রয়োগের ঐধৎফ ঢ়ড়বিৎ সবধহং বা ঐরময ঢ়ড়ষরঃরপং-এর পরিবর্তে শোষণের বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন কৌশল অবলম্বন করে, যা ঝড়ভঃ ঢ়ড়বিৎ সবধহং বা খড়ি ঢ়ড়ষরঃরপং নামে পরিচিত। শোষণের বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন কৌশল প্রয়োগের হাতিয়ার হিসাবে পশ্চিমা বিশ্ব বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, গ্যাট, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি এনজিওকেও বেছে নেয়।
‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর বাংলাদেশ চ্যাপ্টার হলো ‘টিআইবি’। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে আধুনিক আন্তর্জাতিক এনজিও’র আবির্ভাব হলেও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এরা জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের গঠনতন্ত্রের ৭১ অনুচ্ছেদে এনজিওদের পর্যবেক্ষক মর্যাদা প্রদান করা হয়। এর কয়েক দশক পর রিগ্যান-থ্যাচার বৈশ্বিক আমলে নিওলিবারেল মতাদর্শের অনুপ্রেরণায় পুঁজিবাদ ও মুক্তবাজার অর্থনীতি যখন বিশ্বকে ভয়ংকরভাবে গ্রাস করে তখন তৃতীয় বিশ্বের সরকারগুলোকে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি দায়িত্ব থেকে হাত গুটাতে বাধ্য করা হয়। আর এ সুযোগে এনজিও প্রতিষ্ঠানের বিস্ফোরণ ঘটে। এনজিও বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাষ্ট্রসমূহ দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহকে সরকারি চ্যানেলের পরিবর্তে এনজিওদের মাধ্যমে অধিক হারে সাহায্য প্রদান করতে শুরু করে।
গবেষক ঔর এরষবং টহমঢ়ধশড়ৎহ-এর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে এনজিওর মাধ্যমে সাহায্য প্রদানের হার ১৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এনজিওকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করে সরকারের সমান্তরাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পেছনে পশ্চিমা বিশ্বের অশুভ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশেষ করে ৬০-এর দশকে ঔপনিবেশিক সরকারদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে উপনিবেশের জাঁতাকলে পিষ্ট রাষ্ট্রগুলো একের পর এক স্বাধীন হতে থাকে। ধনী রাষ্ট্রগুলো দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর সম্পদ পাচার অব্যাহত রাখতে দারিদ্র্য দূরীকরণের নামে তাদের নবসৃষ্ট সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দরিদ্র দেশের উন্নয়নের পরামর্শকরূপে পরিচিত করার চেষ্টা করে।
পশ্চিমা বিশ্বের প্রত্যক্ষ মদত ও সহযোগিতায় অনেক এনজিও গণতন্ত্র ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণসহ রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বচ্ছতার নামে রীতিমতো রাজনৈতিক কর্মকা-ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কর্মকা-ে নানামুখী হস্তক্ষেপও করছে তারা।
মানবাধিকার সুরক্ষার নামে কিছু এনজিও নানাভাবে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার কাজে লিপ্ত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। টিআইবির মাতৃসংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী অভিযোগ, এটি সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডার অংশীদার। এ সংস্থা অধিকতর স্বচ্ছতা ও উন্মুক্ততার নামে তৃতীয় বিশ্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এসব দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ধনী রাষ্ট্রের প্রবেশকে আরও অবাধ করার কাজে ব্যাপৃত রয়েছে বলে অভিযোগ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও তাদের সহযোগীরা স্বচ্ছতা ও সুশাসনের দাবির মোড়কে দরিদ্র রাষ্ট্রের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পশ্চিমাদের প্রেসক্রাইবড কিছু মূল্যবোধ ও বিধিবিধান চাপিয়ে দিতে চায়। আর এসবের মূল লক্ষ্য দরিদ্র রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও আইনগত সংস্কারে বাধ্য করে ধনী রাষ্ট্রের আর্থিক এন্টারপ্রাইজ, বিশেষ করে তাদের বহুজাতিক কোম্পানি ও তাদের স্থানীয় দোসরদের জন্য অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তৈরি করা। কারণ, পুঁজিবাদ টিকে থাকে ক্রমবর্ধমান ভোগবাদের ওপর।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ হলো তারা দরিদ্র রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা নিয়ে উচ্চকিত হলেও বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, নিরাপত্তা পরিষদ, জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে কোনও বক্তব্য দিতে নারাজ। অথচ এ প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বচ্ছতা দরিদ্র রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য অত্যাবশ্যক।
পশ্চিমাদের এজেন্ট হিসাবে কাজ করতে গিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও তাদের সহযোগীরা দুর্নীতির যে ধারণাসূচক প্রবর্তন করেছে তা বৈশ্বিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ঝঃধভভধহ অহফবৎংংড়হ ও চধঁষ ঐবুড়িড়ফ তাদের ঞযব চড়ষরঃরপং ড়ভ চবৎপবঢ়ঃরড়হ: টংব ধহফ অনঁংব ড়ভ ঞৎধহংঢ়ধৎবহপু ওহঃবৎহধঃরড়হধষ’ং অঢ়ঢ়ৎড়ধপয ঃড় গবধংঁৎরহম ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ শিরোনামের প্রবন্ধে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের অবৈজ্ঞানিক ও ত্রুটিপূর্ণ কার্যপদ্ধতি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশেও টিআইবির মনগড়া ও ত্রুটিপূর্ণ গবেষণা নিয়ে নানা সমালোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। কয়েক বছর আগে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের পর আদালত গবেষণা সংক্রান্ত নথিপত্র জমা দিতে বললে টিআইবি তাদের গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদকে ‘পুতুল নাচের নাট্যশালা’ হিসেবে মন্তব্য করে টিআইবি তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। কঠোর পরিশ্রম ব্যতিরেকে বিদেশি দানা-পানিতে বিলাসী জীবনযাপন করলে এমন ‘বেমক্কা’ মন্তব্য বেরিয়ে আসা অস্বাভাবিক নয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে টিআইবির এমনই এক বেমক্কা গবেষণা তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। টিআইবি বলেছে, নির্বাচনে শেষের এক ঘণ্টায় ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ ভোটসহ মোট ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়া বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তথ্যটি কেবল বিভ্রান্তিকরই নয়, অসত্যও বটে। নির্বাচন কমিশন ভোটের প্রথম চার ঘণ্টায় ১৭.১৫ শতাংশ ভোট পড়ার তথ্য দিয়েছিল (দুয়েকটি পত্রিকায় ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ উল্লেখ রয়েছে)। এই হার অস্বাভাবিক নয়। একদিকে ছিল তীব্র শীত, অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে ভোট বর্জনকারীরা নির্বাচন প্রতিহত করতে ট্রেনে-বাসে জঙ্গি আক্রমণ করেছে। বিশেষ করে ভোটের অব্যবহিত আগে বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনে পুড়িয়ে নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ হত্যা করেছে ও ভোটের আগের রাতে ভোটকেন্দ্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করেছে। নির্বাচনের দিন সকাল বেলায় ভোটকেন্দ্রের পাশে একজনের লাশ পাওয়া গেছে। এসব নাশকতা ও নৃশংসতা ভোটারদের মনস্তত্ত্বে তাৎক্ষণিক ভীতির সঞ্চার করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন ও নির্বাচনের পরে বিএনপি-জামায়াত যে নৃশংসতা ঘটিয়েছে তা মানুষের স্মৃতিতে আজও জ্বল জ্বল করছে। ভোটার উপস্থিতিতে এসবের প্রভাব পড়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। মানুষের কাছে ভোটের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।
যাহোক, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ দেখতে পায় নজিরবিহীন নিরাপত্তায় অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে ক্রমশই বাড়তে থাকে ভোটারদের আগ্রহ ও ভোটার উপস্থিতি। দুপুর গড়িয়ে বিকালে ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ততক্ষণে বিএনপির অনেক সমর্থকও তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। ভোট হয়ে যাচ্ছে দেখে তাদেরও একটি অংশ ভোটে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু কিছু ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া পরিকল্পিতভাবে কেবল সকালের ভোটের চিত্র বারবার তাদের মিডিয়ায় উপস্থাপন করে নির্বাচনকে ভোটারবিহীন প্রমাণ করার অপচেষ্টা চালিয়েছে।
টিআইবিও ওই দলভুক্ত। তাই অসত্য তথ্য দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা করছে। বিকাল তিনটায় কমিশনের সচিব জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছিলেন, ঢাকা বিভাগে ভোট পড়েছে ২৫ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ২৭ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ৩২ শতাংশ, সিলেট বিভাগে ২২ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৯ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ২৬ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ২৬ শতাংশ এবং বরিশাল বিভাগে ৩১ শতাংশ। আট বিভাগের প্রদত্ত ভোটের হার গড় করলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ২৭.২৫ শতাংশ।
ইসি সচিব ওই সময় বলেছিলেন, ‘কয়েকটা উপজেলার কেন্দ্রে তথ্য হালনাগাদ নাও হতে পারে, সে কারণে এই সংখ্যাটা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ সংখ্যাটা বেড়ে ২৭.২৫-এর পরিবর্তে ২৮ শতাংশ হলে নির্বাচনে শেষের এক ঘণ্টায় ভোটের হার ১৩.৮ শতাংশ। আর ২৯ শতাংশ হলে শেষের এক ঘণ্টায় ভোটের হার হবে ১২.৮ শতাংশ।
কোনোভাবেই ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ নয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। ওই নির্বাচনে ভোটদানের হার ছিল প্রায় ৮৮ শতাংশ। যদি ধরে নিই, শীতের সকালে প্রথম চার ঘণ্টা ৯ শতাংশ হারে ভোট পড়েছে তাহলে ১২টা পর্যন্ত ভোট পড়েছিল ৩৬ শতাংশ। আর পরবর্তী ৪ ঘণ্টায় ভোট পড়েছে ৫২ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ভোট পড়ার হার ছিল ১৩ শতাংশ।
আমি আমার পিতার চারটি নির্বাচনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে দায়িত্ব নিয়ে বলছি, মফস্বলের ভোটারদের একটি অংশ দুপুরের খাবার খেয়ে বিকালে ভোট দিতে আসে। তারা বিলম্বে ভোট দিতে আসে এই প্রস্তুতি নিয়ে যে ভোটের ফলাফল জেনে ঘরে ফিরবেন। তাই শেষ বিকালে ভোটারের ব্যাপক চাপ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে টিআইবি’র গবেষণাকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েক বছর আগে আমি একটা কলাম লিখেছিলাম। টিআইবি’র গবেষণা প্রতিবেদন দেখে আমার একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। এক গবেষক তেলাপোকা নিয়ে গবেষণার করার মনস্থ করলেন। তেলাপোকার ছয় জোড়া পায়ের প্রথম জোড়া কেটে ছেড়ে দিয়ে বললেন ‘গো’। তেলাপোকা ছুটে চললো। দ্বিতীয় জোড়া পা কেটে বললেন ‘গো’। এবারও একজোড়া পায়ে ভর করে কষ্ট করে তেলাপোকা এগোতে থাকে। অবশিষ্ট পা দুটো কেটে বললেন ‘গো’। পা-বিহীন তেলাপোকা আর এগোতো পারে না। গবেষক সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, তেলাপোকার সব পা কাটলে সে কানে শুনতে পায় না।
টিআইবি বলেছে, নির্বাচন কমিশন একতরফা নির্বাচনের ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়নের অন্যতম অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রশাসন অনুরূপভাবে একই ‘অ্যাজেন্ডা’র সহায়ক ভূমিকায় ব্যবহৃত হয়েছে। একটি গল্প শুনেছিলাম- প্রচ- শীতের গভীর রাত। নদীর দু’পারে মানুষের পানি ব্যবহারের শব্দ শোনা যায়। একজন বুজুর্গ রাতের নামাজ আদায় করতে নদীর পানিতে ওজু করতে এসেছেন। অন্যজন সারা রাত চুরি করে শরীর ধৌত করতে এসেছেন। চোর মনে মনে ভাবছে ওই লোকটিও তার মতো বড় চোর। আর বুজুর্গ লোকটি ভাবছে ওই পাড়ের লোকটি না জানি কত বড় বুজুর্গ। যারা অন্য রাষ্ট্রের গোপন ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়নের সারথী, তারা অন্যকেও ওইরূপ মনে করবে এটা অস্বাভাবিক নয়। টিআইবি বলেছে, নির্বাচনের আইনগত বৈধতা নিয়ে কোনও চ্যালেঞ্জ হয়তো হবে না, তবে এ সাফল্য রাজনৈতিক শুদ্ধাচার, গণতান্ত্রিক ও নৈতিকতার মানদ-ে চিরকাল প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে। নির্বাচনে অবাধ, অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নিশ্চিতের যে পূর্বশর্ত থাকে, তা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রতিপালিত হয়নি। টিআইবি মনে করছে, সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের সম্ভাব্য সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে যতটুকু আগ্রহ থাকবে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হবে শুদ্ধাচার ও নৈতিকতার মানদ-ে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন এবং তার প্রভাব। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের জরিপের ফলাফল উদ্ধৃত করছি-
এক. সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, আওয়ামী লীগ যে নতুন সরকার গঠন করবে, তার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল। আপনিও কি তা-ই মনে করেন? জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬২ শতাংশ না, আর ৩৬ শতাংশ হ্যাঁ বলেছেন।
দুই. হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের সদস্যদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন ও সহিংসতা সুষ্ঠু ভোটের অঙ্গীকার ক্ষুণ্ন করেছে। আপনিও কি তা-ই মনে করেন? উত্তরদাতাদের ৬৬ শতাংশ না বলেছেন, আর ৩২ শতাংশ হ্যাঁ বলেছেন।
তিন. সহিংসতা ও বিরোধীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করেছে বলে মনে করছেন চার মার্কিন সিনেটর। আপনিও কি তা-ই মনে করেন? জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৩ শতাংশ না ও ১৬ শতাংশ হ্যাঁ বলেছেন।
চার. বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, নির্বাচন জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বর্জন করেছে। আপনিও কি তাই মনে করেন? বিএনপি নেতার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন ৪১.৯৩ শতাংশ আর না বলেছেন ৫৭.৪৫ শতাংশ।

টিআইবির কথা শুনলে মনে হয় আওয়ামী লীগ শরণার্থীদের দল, এ দেশে তাদের কোনও ভিত্তি নেই। সব মানুষ বিএনপিকে সমর্থন করে যারা স্বাধীনতার স্থপতিকে মানে না, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মানে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছে, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটিয়েছে। যাদের জোট, ভোট ও সরকারের সঙ্গী স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী, তাদের কথায় কেউ ভোট দিতে যায়নি।
সবাই বিএনপির সঙ্গে থাকলে গণবিস্ফোরণ হলো না কেন? মিয়ানমারে জনতার শক্তির কাছে জান্তার বিমান হামলা, স্থল হামলা কিছুই পেরে উঠছে না। প্রকৃত সত্যিটা হলো আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। এই দল দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন তার প্রায় সবটুকুই আওয়ামী লীগের হাত ধরে হয়েছে। ৪১.৮ শতাংশ ভোট কোনোভাবেই অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বিএনপি যতদিন নির্বাচনে আসবে না, ততদিন দেশে কোনও নির্বাচন হবে না, এমন কোনও সুযোগ আছে কি?
নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তা ও সাহসিকতায় সামান্য কিছু ব্যত্যয় বাদ দিলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে মন্তব্য করে প্রশংসা করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, কানাডা, জাপান, চীন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রিত বিদেশি পর্যবেক্ষকরা।
এসব বিদেশি পর্যবেক্ষক বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের পরিবেশের ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা প্রক্রিয়ার প্রশংসা করেছেন। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্য রয়েছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্পষ্ট করে ঘোষণা দিয়েছেন, ভোটের হার ৪১.৮ শতাংশ, সন্দেহ হলে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। তিনি বলেন, “কারো যদি কোনো সন্দেহ, দ্বিধা থাকে, ইউ ক্যান চ্যালেঞ্জ ইট। যদি মনে করেন, এটাকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাদের অসততা, যদি মনে করেন, তাহলে সেটাকে আপনারা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।”
আমার জানা মতে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ঘোষণাকে টিআইবি চ্যালেঞ্জ জানায়নি। নির্বাচন কমিশন কিংবা আদালতে কোনও অভিযোগও দায়ের করেনি। ৬০টি দেশের সরকার-রাষ্ট্র প্রধান এবং জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশের নবগঠিত সরকার ও জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এমন পরিপ্রেক্ষিতে টিআইবির বেমক্কা গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্যে মতলববাজি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গবেষণা প্রতিবেদন ঘিরে তাই শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

টিআইবির ‘বেমক্কা’ গবেষণা নিয়ে তুমুল বিতর্ক

আপডেট সময় : ১০:২৮:২৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৪

মো. জাকির হোসেন : আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে যত ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞ, নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা, মানবতা, সভ্যতা ও মানবাধিকারবিরোধী ঘটনা ঘটেছে তার বড় অংশ ঘটেছে ইউরোপ ও আমেরিকার প্ররোচনায়। তাদের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছে ইউরোপে। মানুষকে দাসে পরিণত করা ও তাদের পণ্য বানিয়ে ক্রয়-বিক্রয়ের অন্যতম দায় ইউরোপিয়ানদের। আফ্রিকার কালো মানুষদের খাঁচায় বন্দি করে আনন্দ উপভোগের উপকরণে পরিণত করার দায় ইউরোপের মানুষদের। হীরা সংগ্রহ করতে না পারায় কঙ্গোর লাখ লাখ মানুষের হাত কেটে ফেলার নৃশংসতা ইউরোপের শাসক করেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহকে উপনিবেশ বানিয়ে তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে প্রধানত ইউরোপিয়ানরা। রাজনীতি ও ধর্মের নামে ইউরোপে এত বেশি নিষ্ঠুরতা হয়েছে যে সেখানকার মানুষরা পালিয়ে গিয়ে নতুন পৃথিবী খ্যাত যুক্তরাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করেছে।
ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র কেড়ে নিয়ে স্থায়ী রক্তপাত ও অশান্তি সৃষ্টির দায় ইউরোপ ও আমেরিকার। পৃথিবীর নানা প্রান্তে গৃহযুদ্ধ, রক্তপাত, যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রধান ক্রীড়নক ইউরোপ, আমেরিকা ও রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র সমসাময়িক বিশ্বে গণতন্ত্র নির্মাণে ৮০টিরও বেশি দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। কখনও ‘ধ্বংসাত্মক ও গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ থাকার মিথ্যা অজুহাতে, আবার কখনও ‘মানবিক হস্তক্ষেপ’ কিংবা উগ্রবাদ দমনের ছদ্মবেশে চালানো হয়েছে আগ্রাসন। স্বার্থ উদ্ধারে প্রথমে হুমকি-ধমকি, তাতে কাজ না হলে ভয়ংকর সামরিক অভিযানে নির্বিচারে অবকাঠামো ধ্বংস ও লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
ডলার ডিপ্লোম্যাসি, ওয়ার ডিপ্লোম্যাসি, গুপ্ত হত্যা, কোনও দেশের বিরোধী দল বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা, প্রোপাগান্ডা ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশকে নিজের অনুগত করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এভাবে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ফলে আস্তে আস্তে দেশগুলো আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। এরপর আধিপত্য ধরে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন, বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ, নব্য-উপনিবেশবাদ প্রবর্তন, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামরিক জোট গঠন, মিডিয়া এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কৌশলী অভিবাসন নীতি ব্যবহার করছে।
সামরিক শক্তি প্রদর্শনের পাশাপাশি দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহকে পদানত রাখতে বিশ্ব অর্থনীতি, মুদ্রাব্যবস্থা ও বাণিজ্য নীতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। নব্য উপনিবেশবাদের দাসত্বের নিগড়ে বন্দি দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহকে তাদের সার্বভৌমত্ব পশ্চিমাদের ইচ্ছার কাছে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। জোট গঠনের মাধ্যমেও বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত জোট ন্যাটোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অনেক দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে। জাতিসংঘ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করছে।
শক্তি প্রয়োগ করে কোনও রাষ্ট্রকে উপনিবেশে পরিণত করা বা উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার নীতি ব্যর্থ হলে পশ্চিমা ধনী রাষ্ট্রগুলো শক্তি প্রয়োগের ঐধৎফ ঢ়ড়বিৎ সবধহং বা ঐরময ঢ়ড়ষরঃরপং-এর পরিবর্তে শোষণের বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন কৌশল অবলম্বন করে, যা ঝড়ভঃ ঢ়ড়বিৎ সবধহং বা খড়ি ঢ়ড়ষরঃরপং নামে পরিচিত। শোষণের বুদ্ধিবৃত্তিক নতুন কৌশল প্রয়োগের হাতিয়ার হিসাবে পশ্চিমা বিশ্ব বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, গ্যাট, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি এনজিওকেও বেছে নেয়।
‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর বাংলাদেশ চ্যাপ্টার হলো ‘টিআইবি’। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে আধুনিক আন্তর্জাতিক এনজিও’র আবির্ভাব হলেও বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এরা জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের গঠনতন্ত্রের ৭১ অনুচ্ছেদে এনজিওদের পর্যবেক্ষক মর্যাদা প্রদান করা হয়। এর কয়েক দশক পর রিগ্যান-থ্যাচার বৈশ্বিক আমলে নিওলিবারেল মতাদর্শের অনুপ্রেরণায় পুঁজিবাদ ও মুক্তবাজার অর্থনীতি যখন বিশ্বকে ভয়ংকরভাবে গ্রাস করে তখন তৃতীয় বিশ্বের সরকারগুলোকে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি দায়িত্ব থেকে হাত গুটাতে বাধ্য করা হয়। আর এ সুযোগে এনজিও প্রতিষ্ঠানের বিস্ফোরণ ঘটে। এনজিও বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিকভাবে উন্নত রাষ্ট্রসমূহ দরিদ্র রাষ্ট্রসমূহকে সরকারি চ্যানেলের পরিবর্তে এনজিওদের মাধ্যমে অধিক হারে সাহায্য প্রদান করতে শুরু করে।
গবেষক ঔর এরষবং টহমঢ়ধশড়ৎহ-এর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে এনজিওর মাধ্যমে সাহায্য প্রদানের হার ১৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এনজিওকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করে সরকারের সমান্তরাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পেছনে পশ্চিমা বিশ্বের অশুভ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশেষ করে ৬০-এর দশকে ঔপনিবেশিক সরকারদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে উপনিবেশের জাঁতাকলে পিষ্ট রাষ্ট্রগুলো একের পর এক স্বাধীন হতে থাকে। ধনী রাষ্ট্রগুলো দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর সম্পদ পাচার অব্যাহত রাখতে দারিদ্র্য দূরীকরণের নামে তাদের নবসৃষ্ট সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দরিদ্র দেশের উন্নয়নের পরামর্শকরূপে পরিচিত করার চেষ্টা করে।
পশ্চিমা বিশ্বের প্রত্যক্ষ মদত ও সহযোগিতায় অনেক এনজিও গণতন্ত্র ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণসহ রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বচ্ছতার নামে রীতিমতো রাজনৈতিক কর্মকা-ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কর্মকা-ে নানামুখী হস্তক্ষেপও করছে তারা।
মানবাধিকার সুরক্ষার নামে কিছু এনজিও নানাভাবে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার কাজে লিপ্ত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। টিআইবির মাতৃসংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী অভিযোগ, এটি সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডার অংশীদার। এ সংস্থা অধিকতর স্বচ্ছতা ও উন্মুক্ততার নামে তৃতীয় বিশ্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এসব দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ধনী রাষ্ট্রের প্রবেশকে আরও অবাধ করার কাজে ব্যাপৃত রয়েছে বলে অভিযোগ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও তাদের সহযোগীরা স্বচ্ছতা ও সুশাসনের দাবির মোড়কে দরিদ্র রাষ্ট্রের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পশ্চিমাদের প্রেসক্রাইবড কিছু মূল্যবোধ ও বিধিবিধান চাপিয়ে দিতে চায়। আর এসবের মূল লক্ষ্য দরিদ্র রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও আইনগত সংস্কারে বাধ্য করে ধনী রাষ্ট্রের আর্থিক এন্টারপ্রাইজ, বিশেষ করে তাদের বহুজাতিক কোম্পানি ও তাদের স্থানীয় দোসরদের জন্য অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তৈরি করা। কারণ, পুঁজিবাদ টিকে থাকে ক্রমবর্ধমান ভোগবাদের ওপর।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ হলো তারা দরিদ্র রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা নিয়ে উচ্চকিত হলেও বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, নিরাপত্তা পরিষদ, জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে কোনও বক্তব্য দিতে নারাজ। অথচ এ প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বচ্ছতা দরিদ্র রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য অত্যাবশ্যক।
পশ্চিমাদের এজেন্ট হিসাবে কাজ করতে গিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও তাদের সহযোগীরা দুর্নীতির যে ধারণাসূচক প্রবর্তন করেছে তা বৈশ্বিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ঝঃধভভধহ অহফবৎংংড়হ ও চধঁষ ঐবুড়িড়ফ তাদের ঞযব চড়ষরঃরপং ড়ভ চবৎপবঢ়ঃরড়হ: টংব ধহফ অনঁংব ড়ভ ঞৎধহংঢ়ধৎবহপু ওহঃবৎহধঃরড়হধষ’ং অঢ়ঢ়ৎড়ধপয ঃড় গবধংঁৎরহম ঈড়ৎৎঁঢ়ঃরড়হ শিরোনামের প্রবন্ধে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের অবৈজ্ঞানিক ও ত্রুটিপূর্ণ কার্যপদ্ধতি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশেও টিআইবির মনগড়া ও ত্রুটিপূর্ণ গবেষণা নিয়ে নানা সমালোচনা ও বিতর্ক হয়েছে। কয়েক বছর আগে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের পর আদালত গবেষণা সংক্রান্ত নথিপত্র জমা দিতে বললে টিআইবি তাদের গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদকে ‘পুতুল নাচের নাট্যশালা’ হিসেবে মন্তব্য করে টিআইবি তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। কঠোর পরিশ্রম ব্যতিরেকে বিদেশি দানা-পানিতে বিলাসী জীবনযাপন করলে এমন ‘বেমক্কা’ মন্তব্য বেরিয়ে আসা অস্বাভাবিক নয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে টিআইবির এমনই এক বেমক্কা গবেষণা তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। টিআইবি বলেছে, নির্বাচনে শেষের এক ঘণ্টায় ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ ভোটসহ মোট ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়া বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তথ্যটি কেবল বিভ্রান্তিকরই নয়, অসত্যও বটে। নির্বাচন কমিশন ভোটের প্রথম চার ঘণ্টায় ১৭.১৫ শতাংশ ভোট পড়ার তথ্য দিয়েছিল (দুয়েকটি পত্রিকায় ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ উল্লেখ রয়েছে)। এই হার অস্বাভাবিক নয়। একদিকে ছিল তীব্র শীত, অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে ভোট বর্জনকারীরা নির্বাচন প্রতিহত করতে ট্রেনে-বাসে জঙ্গি আক্রমণ করেছে। বিশেষ করে ভোটের অব্যবহিত আগে বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনে পুড়িয়ে নিরীহ-নিরপরাধ মানুষ হত্যা করেছে ও ভোটের আগের রাতে ভোটকেন্দ্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করেছে। নির্বাচনের দিন সকাল বেলায় ভোটকেন্দ্রের পাশে একজনের লাশ পাওয়া গেছে। এসব নাশকতা ও নৃশংসতা ভোটারদের মনস্তত্ত্বে তাৎক্ষণিক ভীতির সঞ্চার করেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন ও নির্বাচনের পরে বিএনপি-জামায়াত যে নৃশংসতা ঘটিয়েছে তা মানুষের স্মৃতিতে আজও জ্বল জ্বল করছে। ভোটার উপস্থিতিতে এসবের প্রভাব পড়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। মানুষের কাছে ভোটের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।
যাহোক, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ দেখতে পায় নজিরবিহীন নিরাপত্তায় অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে ক্রমশই বাড়তে থাকে ভোটারদের আগ্রহ ও ভোটার উপস্থিতি। দুপুর গড়িয়ে বিকালে ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ততক্ষণে বিএনপির অনেক সমর্থকও তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। ভোট হয়ে যাচ্ছে দেখে তাদেরও একটি অংশ ভোটে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু কিছু ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া পরিকল্পিতভাবে কেবল সকালের ভোটের চিত্র বারবার তাদের মিডিয়ায় উপস্থাপন করে নির্বাচনকে ভোটারবিহীন প্রমাণ করার অপচেষ্টা চালিয়েছে।
টিআইবিও ওই দলভুক্ত। তাই অসত্য তথ্য দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা করছে। বিকাল তিনটায় কমিশনের সচিব জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছিলেন, ঢাকা বিভাগে ভোট পড়েছে ২৫ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ২৭ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ৩২ শতাংশ, সিলেট বিভাগে ২২ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৯ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ২৬ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ২৬ শতাংশ এবং বরিশাল বিভাগে ৩১ শতাংশ। আট বিভাগের প্রদত্ত ভোটের হার গড় করলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ২৭.২৫ শতাংশ।
ইসি সচিব ওই সময় বলেছিলেন, ‘কয়েকটা উপজেলার কেন্দ্রে তথ্য হালনাগাদ নাও হতে পারে, সে কারণে এই সংখ্যাটা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ সংখ্যাটা বেড়ে ২৭.২৫-এর পরিবর্তে ২৮ শতাংশ হলে নির্বাচনে শেষের এক ঘণ্টায় ভোটের হার ১৩.৮ শতাংশ। আর ২৯ শতাংশ হলে শেষের এক ঘণ্টায় ভোটের হার হবে ১২.৮ শতাংশ।
কোনোভাবেই ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ নয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। ওই নির্বাচনে ভোটদানের হার ছিল প্রায় ৮৮ শতাংশ। যদি ধরে নিই, শীতের সকালে প্রথম চার ঘণ্টা ৯ শতাংশ হারে ভোট পড়েছে তাহলে ১২টা পর্যন্ত ভোট পড়েছিল ৩৬ শতাংশ। আর পরবর্তী ৪ ঘণ্টায় ভোট পড়েছে ৫২ শতাংশ অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ভোট পড়ার হার ছিল ১৩ শতাংশ।
আমি আমার পিতার চারটি নির্বাচনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে দায়িত্ব নিয়ে বলছি, মফস্বলের ভোটারদের একটি অংশ দুপুরের খাবার খেয়ে বিকালে ভোট দিতে আসে। তারা বিলম্বে ভোট দিতে আসে এই প্রস্তুতি নিয়ে যে ভোটের ফলাফল জেনে ঘরে ফিরবেন। তাই শেষ বিকালে ভোটারের ব্যাপক চাপ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে টিআইবি’র গবেষণাকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েক বছর আগে আমি একটা কলাম লিখেছিলাম। টিআইবি’র গবেষণা প্রতিবেদন দেখে আমার একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। এক গবেষক তেলাপোকা নিয়ে গবেষণার করার মনস্থ করলেন। তেলাপোকার ছয় জোড়া পায়ের প্রথম জোড়া কেটে ছেড়ে দিয়ে বললেন ‘গো’। তেলাপোকা ছুটে চললো। দ্বিতীয় জোড়া পা কেটে বললেন ‘গো’। এবারও একজোড়া পায়ে ভর করে কষ্ট করে তেলাপোকা এগোতে থাকে। অবশিষ্ট পা দুটো কেটে বললেন ‘গো’। পা-বিহীন তেলাপোকা আর এগোতো পারে না। গবেষক সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন, তেলাপোকার সব পা কাটলে সে কানে শুনতে পায় না।
টিআইবি বলেছে, নির্বাচন কমিশন একতরফা নির্বাচনের ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়নের অন্যতম অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রশাসন অনুরূপভাবে একই ‘অ্যাজেন্ডা’র সহায়ক ভূমিকায় ব্যবহৃত হয়েছে। একটি গল্প শুনেছিলাম- প্রচ- শীতের গভীর রাত। নদীর দু’পারে মানুষের পানি ব্যবহারের শব্দ শোনা যায়। একজন বুজুর্গ রাতের নামাজ আদায় করতে নদীর পানিতে ওজু করতে এসেছেন। অন্যজন সারা রাত চুরি করে শরীর ধৌত করতে এসেছেন। চোর মনে মনে ভাবছে ওই লোকটিও তার মতো বড় চোর। আর বুজুর্গ লোকটি ভাবছে ওই পাড়ের লোকটি না জানি কত বড় বুজুর্গ। যারা অন্য রাষ্ট্রের গোপন ‘এজেন্ডা’ বাস্তবায়নের সারথী, তারা অন্যকেও ওইরূপ মনে করবে এটা অস্বাভাবিক নয়। টিআইবি বলেছে, নির্বাচনের আইনগত বৈধতা নিয়ে কোনও চ্যালেঞ্জ হয়তো হবে না, তবে এ সাফল্য রাজনৈতিক শুদ্ধাচার, গণতান্ত্রিক ও নৈতিকতার মানদ-ে চিরকাল প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে। নির্বাচনে অবাধ, অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নিশ্চিতের যে পূর্বশর্ত থাকে, তা দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রতিপালিত হয়নি। টিআইবি মনে করছে, সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের সম্ভাব্য সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে যতটুকু আগ্রহ থাকবে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হবে শুদ্ধাচার ও নৈতিকতার মানদ-ে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন এবং তার প্রভাব। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের জরিপের ফলাফল উদ্ধৃত করছি-
এক. সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, আওয়ামী লীগ যে নতুন সরকার গঠন করবে, তার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল। আপনিও কি তা-ই মনে করেন? জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬২ শতাংশ না, আর ৩৬ শতাংশ হ্যাঁ বলেছেন।
দুই. হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের সদস্যদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন ও সহিংসতা সুষ্ঠু ভোটের অঙ্গীকার ক্ষুণ্ন করেছে। আপনিও কি তা-ই মনে করেন? উত্তরদাতাদের ৬৬ শতাংশ না বলেছেন, আর ৩২ শতাংশ হ্যাঁ বলেছেন।
তিন. সহিংসতা ও বিরোধীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করেছে বলে মনে করছেন চার মার্কিন সিনেটর। আপনিও কি তা-ই মনে করেন? জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৩ শতাংশ না ও ১৬ শতাংশ হ্যাঁ বলেছেন।
চার. বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, নির্বাচন জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বর্জন করেছে। আপনিও কি তাই মনে করেন? বিএনপি নেতার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন ৪১.৯৩ শতাংশ আর না বলেছেন ৫৭.৪৫ শতাংশ।

টিআইবির কথা শুনলে মনে হয় আওয়ামী লীগ শরণার্থীদের দল, এ দেশে তাদের কোনও ভিত্তি নেই। সব মানুষ বিএনপিকে সমর্থন করে যারা স্বাধীনতার স্থপতিকে মানে না, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মানে না। যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেছে, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটিয়েছে। যাদের জোট, ভোট ও সরকারের সঙ্গী স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী, তাদের কথায় কেউ ভোট দিতে যায়নি।
সবাই বিএনপির সঙ্গে থাকলে গণবিস্ফোরণ হলো না কেন? মিয়ানমারে জনতার শক্তির কাছে জান্তার বিমান হামলা, স্থল হামলা কিছুই পেরে উঠছে না। প্রকৃত সত্যিটা হলো আওয়ামী লীগ গণমানুষের দল। এই দল দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশের যা কিছু অর্জন তার প্রায় সবটুকুই আওয়ামী লীগের হাত ধরে হয়েছে। ৪১.৮ শতাংশ ভোট কোনোভাবেই অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বিএনপি যতদিন নির্বাচনে আসবে না, ততদিন দেশে কোনও নির্বাচন হবে না, এমন কোনও সুযোগ আছে কি?
নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তা ও সাহসিকতায় সামান্য কিছু ব্যত্যয় বাদ দিলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে মন্তব্য করে প্রশংসা করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, কানাডা, জাপান, চীন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রিত বিদেশি পর্যবেক্ষকরা।
এসব বিদেশি পর্যবেক্ষক বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের পরিবেশের ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনা প্রক্রিয়ার প্রশংসা করেছেন। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্য রয়েছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্পষ্ট করে ঘোষণা দিয়েছেন, ভোটের হার ৪১.৮ শতাংশ, সন্দেহ হলে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। তিনি বলেন, “কারো যদি কোনো সন্দেহ, দ্বিধা থাকে, ইউ ক্যান চ্যালেঞ্জ ইট। যদি মনে করেন, এটাকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাদের অসততা, যদি মনে করেন, তাহলে সেটাকে আপনারা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।”
আমার জানা মতে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ঘোষণাকে টিআইবি চ্যালেঞ্জ জানায়নি। নির্বাচন কমিশন কিংবা আদালতে কোনও অভিযোগও দায়ের করেনি। ৬০টি দেশের সরকার-রাষ্ট্র প্রধান এবং জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশের নবগঠিত সরকার ও জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এমন পরিপ্রেক্ষিতে টিআইবির বেমক্কা গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্যে মতলববাজি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গবেষণা প্রতিবেদন ঘিরে তাই শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।