নিজস্ব প্রতিবেদক: গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। নাগরিক সামাজিক সংস্থাটি বলছে, খুন, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, আন্দোলন, লুটপাট, অরাজকতা চলছেই। পুলিশের নির্লিপ্ততা ও দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ পেশাদারিত্বের ঘাটতি রয়েছে। একইসঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সোমবার (৪ আগস্ট) রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে টিআইবির সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত ‘নতুন বাংলাদেশ: কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছরের ওপর পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব কথা জানানো হয়।
এনসিপি ‘কিংস পার্টি’, তাদের দুজন সরকারে
টিআইবির ফেলো শাহজাদা এম আকরাম বলেন, গত এক বছরে পুলিশে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- অব্যাহতি, পদোন্নতি, পদায়ন ও বদলি। পুলিশ বাহিনীতে মৌলিক সংস্কারের পরিবর্তে কেবল পদোন্নতি, পদায়ন ও বদলির বিষয়ে মনোযোগ ছিল। তিনি আরো বলেন, ২০২৫ এর ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত সব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ পরিচালনা করে ২১ দিনে সারা দেশে ১২ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করেছে।
টিআইবির ফেলো বলেন, আন্দোলনে নেতিবাচক ভূমিকার কারণে পুলিশের ভাবমূর্তির পতন হয়েছে। আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতায় (মব জাস্টিস) গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনার আশঙ্খাজনক বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মবকে ক্ষুব্ধ মানুষের ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে অভিহিত করেছে। ‘মব’ তৈরি করে দাবি আদায়ের প্রবণতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাবি আদায়ে সফল হয়েছে।
শাহজাদা এম আকরাম বলেন, ঢালাওভাবে মামলায় আসামি হিসেবে নাম দেওয়া, গ্রেফতার বাণিজ্যের অভিযোগ, রাজনৈতিক চাপ বাড়লে গ্রেফতার বৃদ্ধির অভিযোগ রয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু অব্যাহত আছে। আন্দোলন দমন করতে পুলিশের কার্যক্রমে বৈষম্য কোনো পক্ষের প্রতি নমনীয় মনোভাব, কোনো পক্ষের ওপর নির্যাতন লক্ষ্য করা গেছে।
এনসিপি ‘কিংস পার্টি’, তাদের দুজন সরকারে: গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত হওয়া রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল বা কিংস পার্টি গঠন করা হয়েছে। এই কিংস পার্টি কারা—এ প্রশ্ন করেন একজন সাংবাদিক। জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটা গোপন করার কিছুই নেই। এটি জাতীয় নাগরিক পার্টি, তার সম্পর্কে বলা হয়েছে যে কিংস পার্টি। কারণ, এর সঙ্গে সহযোদ্ধা বা সহযাত্রী হিসেবে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে দুজন সরকারে এখন আছেন। সে হিসেবে কিংস পার্টি।’
৫ আগস্টের পরবর্তী রাজনৈতিক যাত্রা অশুভ ছিল বলে মন্তব্য করেন ইফতেখারুজ্জামান। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘ওই দিন বিকেল থেকেই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের একাংশ দলবাজি, চাঁদাবাজি, মামলা–বাণিজ্য শুরু করে এবং গত এক বছর ধরে তা আরো বেড়েছে। এমনকি দলের উচ্চপর্যায় থেকে ব্যবস্থা নিয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। এর ফলে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের জন্মলগ্ন থেকে একই রোল মডেল অনুসরণ করেছে। দখলবাজি, চাঁদাবাজির মধ্যে নিজেদের নিমজ্জিত করে আত্মঘাতী পথে অগ্রসর হয়েছে।’
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১১ মাসে দেশে ৪৭১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় মোট ১২১ জন নিহত এবং ৫ হাজার ১৮৯ জন আহত হয়েছেন। এসব রাজনৈতিক সহিংসতার ৯২ শতাংশের সঙ্গে বিএনপি, ২২ শতাংশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ, ৫ শতাংশের সঙ্গে জামায়াত এবং ১ শতাংশের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টি জড়িত ছিল বলেও গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। টিআইবির পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়েছে, সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের দখলে থাকা ঢাকা শহরের ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ২ কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া সিলেটের কোয়ারি ও নদ-নদী থেকে পাথর লুটপাট; সেতু, বাজার, ঘাট, বালুমহাল, জলমহাল ইত্যাদির ইজারা নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছে। করা হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক মামলা। ‘মব’ তৈরি, সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন, থানা ঘেরাও ও বিক্ষোভ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো হয়েছে বলে টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।
১১ মাসে পুলিশের বিরুদ্ধে ৭৬১ মামলা হয়েছে: গণ-অভ্যুত্থানে হত্যায় জড়িত বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়েছে। সরকার পতন-পরবর্তী ১১ মাসে সারা দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে ৭৬১টি মামলায় আসামি এক হাজার ১৬৮ পুলিশ। এর মধ্যে ৬১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
টিআইবির ফেলো শাহজাদা এম আকরাম বলেন, ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী, হত্যার ইন্ধনদাতা ও নির্দেশদাতাদের বিরুদ্ধে সারা দেশে মামলা দায়ের হয়েছে। দায়েরকৃত মামলা এক হাজার ৬০২টি (হত্যা মামলা ৬৩৮টি) পতিত সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আনুমানিক ৮৭ জন গ্রেফতার রয়েছেন। ৭০ শতাংশ মামলার তদন্তে ‘সন্তোষজনক অগ্রগতি’ রয়েছে। ৬০-৭০টি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে। তিনি আরো বলেন, এক বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এরমধ্যে অভিযোগ ৪২৯টি ও মামলা ২৭টি। শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জন আসামির মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ৭৩ জন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের আগেই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজে ধীরগতি আছে। জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় জড়িতদের বিচারপ্রক্রিয়া চলমান আছে। শাহজাদা এম আকরাম বলেন, শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠিত, বিচার শুরু হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় (১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত) সারা দেশে দায়ের করা প্রায় সব হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ফেলো মো. জুলকারনাইন, ফারহানা রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ