প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম : সম্প্রতি বিদেশে পালিয়ে যাবার হিড়িক পড়েছিল। বিমানবন্দর দিয়ে উঁচুদরের সব মানুষ বৈধপথে পালাতে গিয়ে আটকা পড়ে যাচ্ছিলেন। তাদের অনেকের নামে মামলা থাকায় আইনি ব্যবস্থায় কারাগারে পাঠানোর প্রবণতাই বেশি ছিল। কিন্তু বিমানবন্দর দিয়ে বেশি অর্থসম্পদ সংগে নিতে গেলে ধরাপড়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। সেটি আঁচ করে সীমান্ত পথে দালালদের মাধ্যমে অবৈধভাবে প্রতিবেশী দেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন অনেকে। সংগে নিচ্ছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা-পয়সা, ডলার, রুপি আরো অনেক কিছু। কিন্তু অর্থ সংগে নিয়ে দালাল ধরে সীমান্ত পথে বিদেশে পাড়ি জমানো মোটেই নিরাপদ হচ্ছে না। তার কিছু বাস্তব উদাহরণ একদিকে গল্প তৈরির খোরাক যোগাচ্ছে অন্যদিকে পলায়নকারীদের জীবনের মূল্যকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছে। বেওয়ারিশ লাশ হয়ে সংবাদের শিরোনাম হচ্ছেন অনেকে।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের লাশ উদ্ধারের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে জানিয়েছিল ভারতের মেঘালয় পুলিশ। গত ২৬ আগস্ট পূর্ব জৈন্তিয়া পাহাড়ের দোনা ভোই গ্রাামের একটি সুপারি বাগান থেকে ইসহাক আলী খান পান্নার অর্ধগলিত মৃতদেহ উদ্ধার করে দেশে ফেরত আনা হয়। ওই এলাকাটি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালানোর সঙ্গে পান্নার সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ডলার ছিল বলে দাবি করেছে তার স্বজনরা।
‘ইউনাইটেড নিউজ অব ইন্ডিয়া (ইউএনআই) লিখেছে, পান্নার কাছে প্রায় দুই কোটি ডলার ছিল বলে তার স্বজনরা দাবি করেছেন। তবে জৈন্তিয়া পাহাড় জেলা পুলিশের প্রধান বলেন একটি রিস্টওয়াচ ছাড়া আর কিছু উদ্ধার করা যায়নি। তার ভাগ্নে ২৪ আগস্ট দাবি করেছিলেন- ‘তার মামার সঙ্গে থাকা অন্যরা জানিয়েছেন, ওইদিন সকালে শিলংয়ে একটি পাহাড় থেকে পা পিছলে পড়ে মারা গেছেন তার মামা।’
কথা হলো, আমরা পকেটে বিশ হাজার টাকা নিয়ে দিনের বেলায় চলতে গেলেও বারবার পকেটে হাত চেপে দেখি। দুই কোটি ডলার মানে ১০০ ডলারের ২০০টা বান্ডিল, প্রায় ২৫০ কোটি টাকা যা আলাদিনের চেরাগকে হার মানিয়েছে। তিনি কেমনে নিরাপত্তাহীন জঙ্গলের মধ্যে রাতের বেলা যাচ্ছিলেন? তার কাছে এত ডলার কীভাবে এলো? তিনি কি ব্যবসা করতেন যে. এত টাকা নিয়ে পালাচ্ছিলেন? সেই কাহিনিও অজানা। তাই তদন্ত হওয়া দরকার। ডলারের লোভে উনার সফর সঙ্গীরা উনাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে থাকতে পারে। তারপর তারা পাহাড় থেকে পা ফসকিয়ে পড়ে যাওয়ার নাটকও সাজাতে পারে।
অনেকে মনে করছেন, ডলারের জন্য তাকে হত্যা করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যে, এই অস্থির সময়ে ভারতে বর্ডারের দালাল এবং বিএসএফ এর লোকেরা মওকা বুঝে বাংলাদেশ থেকে পলায়নকারীদের কাছ থেকে বিরাট অংকের টাকা পয়সা আত্মসাৎ করছে!
চোরাচালান বা রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের অনেকে ভারত হয়ে অন্যে দেশে পাড়ি দেওয়া বা ভারতে কিছুদিন থাকার আশায় ভারতের কতিপয় দালালের সঙ্গে চুক্তি করে থাকে। ভারতের কতিপয় দালাল তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে এই নেতাদের সর্বহারা করে সব লুটিয়ে হয়তো তাদের হত্যা করে, না হয় বিচারপতি মানিকদের মতো কোনো জঙ্গলে ফেলে চলে যায়। এভাবে পলাতক নেতাদের আমও যায় ছালাও যায়; কারো সর্বনাশ আবার পৌষ মাস শুরু হয়!
সম্প্রতি আরেকটি সাড়া জাগানো ঘটনার সংবাদ জাতিকে বিস্মিত করেছে। ভারতের জঙ্গলে কলাপাতায় শুয়ে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের একজন সাবেক বিচারপতি! স্থানীয় দালাল সাদ্দামের সহায়তায় সীমান্তপথ ব্যবহার করে ভারতে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। কত টাকা চুক্তিতে আসছেন জানতে চাইলে মানিক বলেন, ‘১৫ হাজার টাকা কন্ট্রাক্টে (চুক্তি) আসছি, সেটা ওদের দিছি। কিন্তু ওই দুই ছেলে আমাকে মাইরা ধইরা সব নিয়া গেছে। ইন্ডিয়ার ভেতরে…।’ সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দনা সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে আটক করে বিজিবি। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, বিচারপতি মানিক জঙ্গলের ভেতরে কলাগাছের পাতায় শুয়ে আছেন। পাচারকারীরা তার সঙ্গে থাকা বিপুল পরিমাণ টাকা ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে কলা পাতার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চলে যায়। ওই রাতে বিচারপতি মানিক জঙ্গলে একাই রাত কাটান। এক সময় তিনি বলেন, ‘আমি বিচারপতি’ অমুক। ‘প্রশাসনের ভয়ে আমি দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেছি’। তার কাছে নগদ কত টাকা ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আজকে ৪০ হাজার টাকার মতো ছিল। কাল ৬০-৭০ লাখ টাকার মতো ছিল, দুই ছোকরা নিয়ে গেছে। মোবাইল ফোনসহ সবকিছুই নিয়ে গেছে।’
সাবেক বিচারপতির বিরুদ্ধে জিয়া পরিবার নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের জেরে অভিযোগে মামলা করা হয়। জানা গেছে, ‘তিনি ২০২২ সালের ৩ অক্টোবর চ্যানেল আই’র টকশো ‘মেট্রোসেম টু দ্য পয়েন্টে’ জিয়াউর রহমানকে রাজাকার এবং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিহিত করেন। গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ এক সেমিনারে তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রবেশকারী।’
গ্রেপ্তারের দিন বিকালেই বিচারপতিকে আদালতে তোলা হয়। এক সময় আদালত চত্বরে তার ওপর বিক্ষুব্ধ জনতা ডিম, জুতা নিক্ষেপ করে। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধরা হামলা চালালে তিনি গুরুতর আহত হন। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি তাকে জরুরি ভিত্তিতে সিলেটের ওসমানী হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার শারীরিক অবস্থার উন্নতির দিকে জানালে বিভ্রান্তি দূর হয়।
অন্যদিকে ভারতে আমাদের একজন সাবেক সংসদ সদস্য খুনের পরিকল্পনায় সাবেক দুই এমপি ও দুই বড় ব্যবসায়ী! স্বর্ণ চোরাচালানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাউকে ভাগ দিতেন না আনার। এই খুন হওয়া সাবেক সাংসদ ও ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় আনার জন্য প্রচেষ্টা চলছে।
কথা হলো, আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের পছন্দ কার অনেক টাকা খরচ করার ক্ষমতা আছে। অনেকের লাঠিয়াল বাহিনী রয়েছে। কিন্তু সমাজের ভালো মানুষদের টাকা ও লাঠিয়াল বাহিনী থাকে না। ফলে সামাজের অনেক দুষ্ট মানুষ নেতা নির্বাচিত হন, এর ফলে তারা ধান্দা, চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি ও খুন খারাবিতে জড়িয়ে পড়েন। তাই ভবিষ্যতে সাংসদ নির্বাচিত করতে টাকার বিনিময়ে নমিনেশন প্রদান নীতির পরিবর্তন করতে হবে।
দেশের অর্থনৈতিক যে ভাঙ্গন তার জন্য এদের সিন্ডিকেট দায়ী। এরকম দশভাগ লোকের কাছে দেশের আশিভাগ অর্থ কুক্ষিগত রয়েছে। এরকম আরো অনেকে রাতারাতি বিত্তশালী হয়ে গেছে। তদন্ত করে এদের সব অর্থ দেশের উন্নয়নের কাজে লাগানো উচিত।
এই দেশে এমপি মানে ক্ষমতাসীনদের পেশিশক্তি তারা প্রায় সব আসনে সরকারে পেশিশক্তি হিসেবে মাস্তান পুষে এলাকা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে। ক্ষমতাসীন সরকারের চাটুকারিতা করলেই তাদের সব কর্মকাণ্ড বৈধ হয়ে যায়। চুরি, দুর্নীতি করে অর্থপাচার করলে কোন দোষ ধরা হতো না ওদের। তাই তো এখন তাদের এই করুণ দশা হয়েছে। এত টাকা, এত ডলার সঙ্গে নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ, এত পরিমাণ অর্থপাচার ইত্যাদি মানুষ ততটা বিশ্বাস করতো না। কিন্তু এখন এটাই বাস্তবতা। এ জন্যই তো পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আমলের ১৮ লাখ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণের বোঝার কথা এখন আরেক পরিহাস।
এভাবে চোরতন্ত্র কায়েম হয়ে পড়ায় দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এস আলম গং ব্যাংকের টাকা উঠিয়ে নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ভাগাভাগি করে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে থাকে। অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে পড়ে। সাধারণ ব্যাংকে টাক রাখা অনিরাপদ হয়ে উঠে। ঘরে ঘরে কেনা শুরু হয় সিন্দুক। ঘুসখোর আমলা, নেতা ও লোভী ব্যবসায়ীরা ডিজিটাল সিন্দুক কিনে ঘরে টাকা জমা করা শুরু করেন।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের তীব্রতা দেখার পর দেশ থেকে পালাতে থাকেন অতি চালাক-চতুরেরা। কিন্তু যারা মনে করেছিলেন ছাত্রদের এসব আন্দোলনে কিছু হবে না-তারা ৫ আগস্টের পর বিপদে পড়লে সীমান্ত পথে টাকার থলে পিঠে নিয়ে পালাতে থাকেন। দলে দলে ধরা পড়ে যান বিজিবির হাতে। সীমান্তের চোরাকারকাবারী ও দালালদের খপ্পরে পড়ে টাকা, ডলার হারিয়ে পাগল হয়ে যান।
দালালরা বাংলাদেশের জঙ্গলে কলাপাতা বিছিয়ে শুইয়ে দিয়ে ভারতে রাখার কথা বলে টাকা-পয়সা নিয়ে সটকে পড়লেও বিচারপতি সেটা বুঝতে না পেরে বোকা বনে শুইয়ে প্রলাপ করেন- ‘আমি বাংলাদেশে ফেরত যাবার জন্য কি ভারতে এসেছি?’ এটাই নিয়তির খেলা। এটাই এখন বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির কুফল, লেজুড়বৃত্তির বিচার ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের পরিণাম ও ভঙ্গুর অর্থনীতির করুণ গল্প।
মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর পর কেউ মাটির নিচে দেহরাখার চিরস্থায়ী শয্যা পান। কেউ ছাইভস্ম হয়ে বাতাসে, কেউবা পানিতে মিশে যান। কাউকে পাখি দ্বারাও খাওয়ানো হয়! পরকালে মুক্তির আশায় একেক ধর্মে একেক দাফনের রীতি-নীতি প্রচলিত রয়েছে। তবে মৃত্যুর পর যে কারো জমানো অর্থ মুর্দার নিজের প্রয়োজনে অর্থহীন হয়ে পড়ে। এটা জীবদ্দশায় সবাই জানেন। তবুও অবৈধ অর্থ অর্জন করে জমানোর ব্যাপারে অনেকের হুঁশ থাকে না। তাই বেঁচে থাকা অবস্থাতেই তাদের অনেকের সম্পদ অন্যদের জন্য উদাহরণ হিসেবে, গল্পকাহিনী হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে জায়গা করে নেয়।
ভালো সব মানুষের ভালো কৃতকর্মকে মানুষ গ্রহণ করে দোয়া করে আর মন্দদেরকে আরো বেশি অভিশাপ দেয়। তাই এসব ঘটনা ভবিষ্যতে বেঁচে থাকা অন্যদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি হোক। এ থেকে শিক্ষা সবার জীবনে কাজে লাগুক।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।