ঢাকা ০৫:৩৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫

টাইফয়েড নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন জরুরি কেন?

  • আপডেট সময় : ০৭:০৪:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫
  • ৩ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

ড. মো. আজিজুর রহমান

মানুষ আদিকাল থেকেই ভয়ানক সব জীবাণুর সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে। এ যুদ্ধে কখনো মানুষ জয়ী হয়, কখনো জীবাণু জয়ী হয়। আমাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবেই রয়েছে খুব শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কিন্তু রোগ তৈরিকারী জীবাণুগুলো সুকৌশলে সে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ফাঁকি দিয়ে জটিল রোগ বাধিয়ে ফেলে। ফলে মানুষ বিভিন্ন রোগে ভোগে, অঙ্গহানি হয় অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু হয়।

আশার কথা হলো জীবাণুঘটিত প্রায় সব রোগই (টাইফয়েড জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এইডস, ডেঙ্গু, হেপাটাইটিস, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি) প্রতিরোধযোগ্য। সঠিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা, হাসপাতালে সংক্রমণ বিস্তার প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঠিকভাবে অনুসরণ করা, নিরাপদ পানি ও খাদ্য খাওয়া, খাবার আগে ও খাদ্য তৈরির সময় ভালো করে হাত ধোয়া, টয়লেট ব্যবহারের পর হাত ধোয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, মশার বিস্তার রোধ করা, অনিরাপদ যৌন সঙ্গম পরিহার করা—এ কয়টি উপায়ে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসঘটিত প্রায় সব রোগই প্রতিরোধ করা সম্ভব।

জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধের আরেকটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হলো টিকা বা ভ্যাকসিন। টিকা বা ভ্যাকসিন কোনো নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে একধরনের ইমিউন মেমরি তৈরির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অনেকগুণে বাড়িয়ে দেয়, ফলে, সে রোগের কোনো জীবাণু শরীরে প্রবেশের সাথে সাথে প্রচুর অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে সে জীবাণুকে ধ্বংস করে ফেলে।

ভ্যাকসিন ব্যবহারের মাধ্যমে কয়েকটি রোগ পৃথিবী থেক নির্মূল হয়ে গেছে। যেমন- গুটি বসন্ত, পোলিও। ভ্যাকসিন কিছু রোগের সংক্রমণ মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। যেমন- হাম, জার্মান হাম, মাম্পস, জলাতঙ্ক, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস বি, ইনফ্লুয়েঞ্জা বি, ডেঙ্গু, মেনিজাইটিস, টাইফয়েড জ্বর। এসব ভ্যাকসিনের ফলে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে।

টাইফয়েড জ্বর কী: টাইফয়েড জ্বর বা সাধারণভাবে ‘টাইফয়েড’ একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ। স্যালমোনেলা এন্টারিকা সেরোটাইপ টাইফি বা স্যালমোনেলা টাইফি নামক এক ধরনের গ্রাম-নেগেটিভ রড আকৃতির ব্যাকটেরিয়া দিয়ে টাইফয়েড জ্বর হয়। এ ব্যাকটেরিয়াটি ফিক্যল-ওরাল রুট অর্থাৎ মানুষের মল-মূত্র দিয়ে দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়।

স্যালমোনেলা এন্টারিকার আরো তিনটি সেরোটাইপ আছে। প্যারাটাইফি সেরোটাইপগুলো দিয়ে যে রোগ হয় তাকে প্যারাটাইফয়েড জ্বর বলে। প্যারাটাইফয়েড জ্বর টাইফয়েড জ্বরের মতো অতোটা ভয়ানক নয়।

প্যারাটাইফি সেরোটাইপের তুলনায় টাইফি সেরোটাইপ অনেক বেশি ভয়ানক হওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো টাইফি সেরোটাইপের আউটার মেমব্রেনের অবস্থিত ক্যাপসুলে ভিআই অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি। এ ভিআই অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি স্যালমোনেলা টাইফিকে আমাদের রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কারণে টাইফি সেরোটাইপঘটিত টাইফয়েড জ্বর অনেক বেশি সংক্রমণক্ষম ও ক্ষতিকর।

টাইফয়েড জ্বরের প্রধান লক্ষণ হলো উচ্চমাত্রার জ্বর (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট), অবসাদ, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া। টাইফি ও প্যারাটাইফি সেরোটাইপ- উভয়ই অন্ত্রে আক্রমণ করে প্রদাহ, ক্ষত বা ঘা এবং অনেক সময় অন্ত্রে ছিদ্র তৈরি করতে পারে। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না হলে টাইফি সেরোটাইপ শরীরের অন্য অংশে তথা লিভার, ফুসফুস, প্লীহা, গল ব্লাডারে ছড়িয়ে পড়ে রোগীর মারাত্মক ক্ষতি করে দিতে সক্ষম।

টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েডের জীবাণু শরীরে প্রবেশের ৫-১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাই কোন উৎস থেকে টাইফয়েড সংক্রমিত হয়েছে, তা নির্ণয় করা সহজ নয়।

বিশ্বে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্তের হার কেমন এবং কারা বেশি আক্রান্ত হয়: ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর বিখ্যাত ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০২১ সালে বিশ্বে টাইফয়েড ও প্যরাটাইফয়েড মিলিয়ে প্রায় ৯৩ লক্ষ মানুষ আন্ত্রিক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল, যার মধ্যে মারা গিয়েছিলো প্রায় এক লাখ মানুষ। অন্য বয়সের তুলনায় ৫-১৫ বছরের শিশুদের টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ছিল বেশি।

টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েড আক্রান্তের অধিকাংশই এশিয়া এবং আফ্রিকার অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় হয়। উন্নত দেশগুলো খাবার পানির মান উন্নয়ন ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নের ফলে বহু বছর আগেই টাইফয়েডে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় শূন্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। সে দেশগুলোয় যে অল্প সংখ্যক টাইফয়েড রোগী ধরা পড়ে তাদের প্রায় সবারই এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোয় ভ্রমণের ইতিহাস রয়েছে।

ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশে আন্ত্রিক জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ লাখ; যার মধ্যে ৮ হাজার ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। দেশে টাইফয়েডে মৃত্যুর প্রায় ৬৮ শতাংশ ছিল শিশু।

সঠিক চিকিৎসা না পেলে টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীর প্রায় ২০ শতাংশ মৃত্যুবরণ করতে পারে। তবে সঠিক চিকিৎসা পেলেও ১-৪ শতাংশ টাইফয়েড রোগীর মৃত্যু হয়।

টাইফয়েডের চিকিৎসা কী: টাইফয়েড চিকিৎসায় কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে রয়েছে সিপ্রোফ্লক্সাসিন, লেভোফ্লক্সাসিন, অফ্লক্সাসিন, সেফট্রায়াক্সন, সেফোট্যাক্সিম, সেফিক্সিম, অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও মেরোপেনেম। আমাদের দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহার ও অপব্যবহারের কারণে প্রথম তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক অনেক আগেই রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে। তবে, অনেক দেশে টাইফয়েডের ফার্স্ট-লাইন চিকিৎসা হিসেবে সিপ্রোফ্লক্সাসিন এখনো কার্যকর।

রক্ত পরীক্ষায় টাইফয়েড নিশ্চিত হলে চিকিৎসকের কর্তব্য হলো চিকিৎসায় কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকরী তা সাস্পেটিবিলিটি টেস্টের মাধ্যমে নির্ণয় করা। তবে সাস্পেটিবিলিটি টেস্টের রিপোর্ট ছাড়াই বেশিরভাগ চিকিৎসক ধারণার উপরে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। সম্ভবত এর পেছনে রিপোর্ট পেতে দেরি হওয়া, আস্থার অভাব ও দেশের সব জায়গায় সাস্পেটিবিলিটি টেস্টের সুবিধা না থাকা কারণ থাকতে পারে।

২০২৫ সালের জুলাই মাসে ঊসবৎমরহম ওহভবপঃরড়ঁং উরংবধংবং জার্নালে একটি প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ বলছে, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের কয়েক জায়গায় সেফট্রায়াক্সন-রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েডের জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছে। ভয়ানক হলো, সেফট্রায়াক্সন-রেজিস্ট্যান্টের জন্য দায়ী নষধঈঞঢ-গ-১৫ নামক একটি জিন ঢ়ঈজঙই১ নামক এক ধরনের প্লাজমিডের মধ্যে পাওয়া গেছে যেটি এক ব্যাকটেরিয়া থেকে আরেক ব্যাকটেরিয়ায় স্থানান্তরযোগ্য। ফলে জটিল টাইফয়েড চিকিৎসার এ পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকরী অ্যান্টিবায়োটিকটিও এখন ঝুঁকির মধ্যে।

সেফট্রায়াক্সন-রেজিস্ট্যান্ট এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট (ঢউজ) টাইফয়েড চিকিৎসায় এখন বাকি রইলো অ্যাজিথ্রোমাইসিন এবং মেরোপেনেম। তবে ২০২৩ সালে ঊষরভব জার্নাল প্রকাশিত একটি গবেষণার ফলাফল বলছে আমাদের দেশে ইতিমধ্যে অ্যাজিথ্রোমাইসিন-রেজিস্ট্যান্ট স্যালমোনেলা টাইফি ছড়িয়ে পড়েছে। দেশে অ্যাজিথ্রোমাইসিনের মারাত্মক অপব্যবহার যে এর প্রধান কারণ এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই টাইফয়েড চিকিৎসায় এখন ‘অ্যান্টিবায়োটিক সাস্পেটিবিলিটি টেস্ট’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গ্রাম নেগেটিভ এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট সংক্রমণের চিকিৎসায় শেষ ভরসা মেরোপেনেম। এ জন্য টাইফয়েডের চিকিৎসায় মেরোপেনেমের ব্যবহার শুরুর পূর্বে অন্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বিশেষ করে অ্যাজিথ্রোমাইসিন কার্যকরী কিনা তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কেননা গবেষণার ফল বলছে, সেফট্রায়াক্সন-রেজিস্ট্যান্ট এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েড চিকিৎসায় অ্যাজিথ্রোমাইসিন এখনো কার্যকর।

মেরোপেনেম-রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েড জীবাণুর আবির্ভাব এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই শেষ ভরসার অ্যান্টিবায়োটিকটি অকার্যকর হয়ে গেলে এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েডের চিকিৎসায় আর কোনো বিকল্প থাকবে না।

টাইফয়েড ভ্যাকসিন কত প্রকারের এবং কবে অনুমোদিত হয়েছে: বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েডের সংখ্যা খুব দ্রুত বেড়ে চলেছে। অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েড বিস্তার কমানোর একটি অন্যতম উপায় হলো ভ্যাকসিন ব্যবহার; যাতে টাইফয়েডের সংক্রমণ না হয় এবং অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করতে না হয়।

টাইফয়েডের প্রথম ভ্যাকসিনটি আবিষ্কার হয় প্রায় ১৩০ বছর আগে। কিন্তু সেটি তেমন কার্যকরী ছিলনা এবং কিছু ঝুঁকিও ছিল। পরে ১৯৮০-এর দশকে আরও দুটি টাইফয়েড ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়। একটি মুখে খাওয়ার উপযোগী ঞু২১ধ ভ্যাকসিন এবং আরেকটি ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগযোগ্য ভিআই-পিএস ভ্যাকসিন। এ দুটি ভ্যাকসিন বেশ নিরাপদ, এখনো ব্যবহৃত হয় কিন্তু এগুলোর কার্যকারিতা কম, দুই তিন বছরের বেশি কাজ করে না এবং দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে কার্যকরী নয়। এরপর ২০০৫-২০১০ সালে ভারত, চীন ও যুক্তরাজ্যে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণার ফলে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (ঞঈঠ) নামে এক ধরনের নতুন প্রজন্মের ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয় যেটি সফল ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর ভারতের বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানি ভারত বায়োটেক ঞুঢ়নধৎ-ঞঈঠ নামে বাজারজাত করে। ঞুঢ়নধৎ-ঞঈঠ ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়।

টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন বর্তমানে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ। যেমন- পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে, মালাউই, লাইবেরিয়া জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে পাকিস্তান, যারা ২০১৯ সালে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন অন্তর্ভুক্ত করে।

টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন কি নিরাপদ: টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন বেশ কার্যকরী এবং নিরাপদ। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও আফ্রিকার দেশ মালাউইয়ের পরিচালিত বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল বলছে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন ঞুঢ়নধৎ-ঞঈঠ জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ টাইফয়েড থেকে প্রায় ৮০-৯০ ভাগ সুরক্ষা দিয়ে থাকে। এটি ছয় মাস বয়সের শিশুরাও নিরাপদে নিতে পারে। ঞুঢ়নধৎ-ঞঈঠ অর্থাৎ টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিনের বড় সুবিধা হলো এর একটি ডোজ কমপক্ষে পাঁচ বছর কার্যকরী থাকে এবং কোন বড় ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে আইসিডিডিআর’বি, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে সবচেয়ে বড় গবেষণা পরিচালিত হয় ২০১৮-২০২০ সালে। উক্ত গবেষণার ফলাফল ২০২১ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিখ্যাত সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়।

উক্ত গবেষণায় ৯ মাস থেকে ১৬ বছর বয়সি ৩০ হাজার ৮৮২ শিশুর ওপর এক ডোজ ঞুঢ়নধৎ-ঞঈঠ প্রয়োগের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখানো হয়েছে ঞুঢ়নধৎ-ঞঈঠ ৮০-৯০ ভাগ শিশুকে টাইফয়েড থেকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম হয়েছে।

গত ১২ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার ইউনিসেফ, এধার, ঃযব ঠধপপরহব অষষরধহপব এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় আনুষ্ঠানিকভাবে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন কর্মসূচির উদ্বোধন করেছে এবং এ কর্মসূচির মাধ্যমে ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী প্রায় ৫০ মিলিয়ন শিশুকে এক ডোজ জীবনরক্ষাকারী টিসিভি টিকা দেয়া লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

সফলভাবে এ কর্মসূচি সম্পন্ন হলে দেশের শিশুরা টাইফয়েডের বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েডের ঝুঁকি থেকে অনেকটাই মুক্ত হবে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, মনে রাখা দরকার টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন শতভাগ কার্যকর নয় এবং ১০-২০ শতাংশ শিশু ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও টাইফয়েডের ঝুঁকিতে থাকবে। আর এ ভ্যাকসিনটি প্রায় পাঁচ বছর সুরক্ষা দেবে। তাই পাঁচ বছর পরে বুস্টার ডোজ দেওয়া না হলে এটি আর কার্যকর নাও থাকতে পারে। তবে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিনের বুস্টার নিয়ে এখনো কোনো গবেষণা পরিচালিত হয়নি।

টাইফয়েড নির্মূলে ভ্যাকসিন কর্মসূচি একটি কার্যকরী উপায় হলেও এটি স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। নিরাপদ পানি ও খাদ্য এবং উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা টাইফয়েড নিয়ন্ত্রণের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা। তবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ আফ্রিকার গরিব ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় যে ভয়াবহভাবে অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েড ছড়িয়ে পড়েছে তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিনই এখন সবচেয়ে নিরাপদ ও দ্রুততম উপায়।

লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ছবি সংগৃহীত

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

টাইফয়েড নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন জরুরি কেন?

আপডেট সময় : ০৭:০৪:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫

ড. মো. আজিজুর রহমান

মানুষ আদিকাল থেকেই ভয়ানক সব জীবাণুর সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে। এ যুদ্ধে কখনো মানুষ জয়ী হয়, কখনো জীবাণু জয়ী হয়। আমাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবেই রয়েছে খুব শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কিন্তু রোগ তৈরিকারী জীবাণুগুলো সুকৌশলে সে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ফাঁকি দিয়ে জটিল রোগ বাধিয়ে ফেলে। ফলে মানুষ বিভিন্ন রোগে ভোগে, অঙ্গহানি হয় অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু হয়।

আশার কথা হলো জীবাণুঘটিত প্রায় সব রোগই (টাইফয়েড জ্বর, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এইডস, ডেঙ্গু, হেপাটাইটিস, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি) প্রতিরোধযোগ্য। সঠিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা, হাসপাতালে সংক্রমণ বিস্তার প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঠিকভাবে অনুসরণ করা, নিরাপদ পানি ও খাদ্য খাওয়া, খাবার আগে ও খাদ্য তৈরির সময় ভালো করে হাত ধোয়া, টয়লেট ব্যবহারের পর হাত ধোয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, মশার বিস্তার রোধ করা, অনিরাপদ যৌন সঙ্গম পরিহার করা—এ কয়টি উপায়ে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসঘটিত প্রায় সব রোগই প্রতিরোধ করা সম্ভব।

জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধের আরেকটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হলো টিকা বা ভ্যাকসিন। টিকা বা ভ্যাকসিন কোনো নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে মানুষের শরীরে একধরনের ইমিউন মেমরি তৈরির মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অনেকগুণে বাড়িয়ে দেয়, ফলে, সে রোগের কোনো জীবাণু শরীরে প্রবেশের সাথে সাথে প্রচুর অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে সে জীবাণুকে ধ্বংস করে ফেলে।

ভ্যাকসিন ব্যবহারের মাধ্যমে কয়েকটি রোগ পৃথিবী থেক নির্মূল হয়ে গেছে। যেমন- গুটি বসন্ত, পোলিও। ভ্যাকসিন কিছু রোগের সংক্রমণ মারাত্মকভাবে কমিয়ে দিয়েছে। যেমন- হাম, জার্মান হাম, মাম্পস, জলাতঙ্ক, ধনুষ্টংকার, হেপাটাইটিস বি, ইনফ্লুয়েঞ্জা বি, ডেঙ্গু, মেনিজাইটিস, টাইফয়েড জ্বর। এসব ভ্যাকসিনের ফলে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে।

টাইফয়েড জ্বর কী: টাইফয়েড জ্বর বা সাধারণভাবে ‘টাইফয়েড’ একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ। স্যালমোনেলা এন্টারিকা সেরোটাইপ টাইফি বা স্যালমোনেলা টাইফি নামক এক ধরনের গ্রাম-নেগেটিভ রড আকৃতির ব্যাকটেরিয়া দিয়ে টাইফয়েড জ্বর হয়। এ ব্যাকটেরিয়াটি ফিক্যল-ওরাল রুট অর্থাৎ মানুষের মল-মূত্র দিয়ে দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়।

স্যালমোনেলা এন্টারিকার আরো তিনটি সেরোটাইপ আছে। প্যারাটাইফি সেরোটাইপগুলো দিয়ে যে রোগ হয় তাকে প্যারাটাইফয়েড জ্বর বলে। প্যারাটাইফয়েড জ্বর টাইফয়েড জ্বরের মতো অতোটা ভয়ানক নয়।

প্যারাটাইফি সেরোটাইপের তুলনায় টাইফি সেরোটাইপ অনেক বেশি ভয়ানক হওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো টাইফি সেরোটাইপের আউটার মেমব্রেনের অবস্থিত ক্যাপসুলে ভিআই অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি। এ ভিআই অ্যান্টিজেনের উপস্থিতি স্যালমোনেলা টাইফিকে আমাদের রোগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেমের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কারণে টাইফি সেরোটাইপঘটিত টাইফয়েড জ্বর অনেক বেশি সংক্রমণক্ষম ও ক্ষতিকর।

টাইফয়েড জ্বরের প্রধান লক্ষণ হলো উচ্চমাত্রার জ্বর (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট), অবসাদ, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া। টাইফি ও প্যারাটাইফি সেরোটাইপ- উভয়ই অন্ত্রে আক্রমণ করে প্রদাহ, ক্ষত বা ঘা এবং অনেক সময় অন্ত্রে ছিদ্র তৈরি করতে পারে। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না হলে টাইফি সেরোটাইপ শরীরের অন্য অংশে তথা লিভার, ফুসফুস, প্লীহা, গল ব্লাডারে ছড়িয়ে পড়ে রোগীর মারাত্মক ক্ষতি করে দিতে সক্ষম।

টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েডের জীবাণু শরীরে প্রবেশের ৫-১৪ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়। তাই কোন উৎস থেকে টাইফয়েড সংক্রমিত হয়েছে, তা নির্ণয় করা সহজ নয়।

বিশ্বে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্তের হার কেমন এবং কারা বেশি আক্রান্ত হয়: ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর বিখ্যাত ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০২১ সালে বিশ্বে টাইফয়েড ও প্যরাটাইফয়েড মিলিয়ে প্রায় ৯৩ লক্ষ মানুষ আন্ত্রিক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল, যার মধ্যে মারা গিয়েছিলো প্রায় এক লাখ মানুষ। অন্য বয়সের তুলনায় ৫-১৫ বছরের শিশুদের টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা ছিল বেশি।

টাইফয়েড ও প্যারাটাইফয়েড আক্রান্তের অধিকাংশই এশিয়া এবং আফ্রিকার অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় হয়। উন্নত দেশগুলো খাবার পানির মান উন্নয়ন ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নের ফলে বহু বছর আগেই টাইফয়েডে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় শূন্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। সে দেশগুলোয় যে অল্প সংখ্যক টাইফয়েড রোগী ধরা পড়ে তাদের প্রায় সবারই এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোয় ভ্রমণের ইতিহাস রয়েছে।

ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশে আন্ত্রিক জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ লাখ; যার মধ্যে ৮ হাজার ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। দেশে টাইফয়েডে মৃত্যুর প্রায় ৬৮ শতাংশ ছিল শিশু।

সঠিক চিকিৎসা না পেলে টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীর প্রায় ২০ শতাংশ মৃত্যুবরণ করতে পারে। তবে সঠিক চিকিৎসা পেলেও ১-৪ শতাংশ টাইফয়েড রোগীর মৃত্যু হয়।

টাইফয়েডের চিকিৎসা কী: টাইফয়েড চিকিৎসায় কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে রয়েছে সিপ্রোফ্লক্সাসিন, লেভোফ্লক্সাসিন, অফ্লক্সাসিন, সেফট্রায়াক্সন, সেফোট্যাক্সিম, সেফিক্সিম, অ্যাজিথ্রোমাইসিন ও মেরোপেনেম। আমাদের দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিব্যবহার ও অপব্যবহারের কারণে প্রথম তিনটি অ্যান্টিবায়োটিক অনেক আগেই রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে। তবে, অনেক দেশে টাইফয়েডের ফার্স্ট-লাইন চিকিৎসা হিসেবে সিপ্রোফ্লক্সাসিন এখনো কার্যকর।

রক্ত পরীক্ষায় টাইফয়েড নিশ্চিত হলে চিকিৎসকের কর্তব্য হলো চিকিৎসায় কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকরী তা সাস্পেটিবিলিটি টেস্টের মাধ্যমে নির্ণয় করা। তবে সাস্পেটিবিলিটি টেস্টের রিপোর্ট ছাড়াই বেশিরভাগ চিকিৎসক ধারণার উপরে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। সম্ভবত এর পেছনে রিপোর্ট পেতে দেরি হওয়া, আস্থার অভাব ও দেশের সব জায়গায় সাস্পেটিবিলিটি টেস্টের সুবিধা না থাকা কারণ থাকতে পারে।

২০২৫ সালের জুলাই মাসে ঊসবৎমরহম ওহভবপঃরড়ঁং উরংবধংবং জার্নালে একটি প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ বলছে, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের কয়েক জায়গায় সেফট্রায়াক্সন-রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েডের জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছে। ভয়ানক হলো, সেফট্রায়াক্সন-রেজিস্ট্যান্টের জন্য দায়ী নষধঈঞঢ-গ-১৫ নামক একটি জিন ঢ়ঈজঙই১ নামক এক ধরনের প্লাজমিডের মধ্যে পাওয়া গেছে যেটি এক ব্যাকটেরিয়া থেকে আরেক ব্যাকটেরিয়ায় স্থানান্তরযোগ্য। ফলে জটিল টাইফয়েড চিকিৎসার এ পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকরী অ্যান্টিবায়োটিকটিও এখন ঝুঁকির মধ্যে।

সেফট্রায়াক্সন-রেজিস্ট্যান্ট এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট (ঢউজ) টাইফয়েড চিকিৎসায় এখন বাকি রইলো অ্যাজিথ্রোমাইসিন এবং মেরোপেনেম। তবে ২০২৩ সালে ঊষরভব জার্নাল প্রকাশিত একটি গবেষণার ফলাফল বলছে আমাদের দেশে ইতিমধ্যে অ্যাজিথ্রোমাইসিন-রেজিস্ট্যান্ট স্যালমোনেলা টাইফি ছড়িয়ে পড়েছে। দেশে অ্যাজিথ্রোমাইসিনের মারাত্মক অপব্যবহার যে এর প্রধান কারণ এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই টাইফয়েড চিকিৎসায় এখন ‘অ্যান্টিবায়োটিক সাস্পেটিবিলিটি টেস্ট’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গ্রাম নেগেটিভ এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট সংক্রমণের চিকিৎসায় শেষ ভরসা মেরোপেনেম। এ জন্য টাইফয়েডের চিকিৎসায় মেরোপেনেমের ব্যবহার শুরুর পূর্বে অন্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বিশেষ করে অ্যাজিথ্রোমাইসিন কার্যকরী কিনা তা নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কেননা গবেষণার ফল বলছে, সেফট্রায়াক্সন-রেজিস্ট্যান্ট এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েড চিকিৎসায় অ্যাজিথ্রোমাইসিন এখনো কার্যকর।

মেরোপেনেম-রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েড জীবাণুর আবির্ভাব এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই শেষ ভরসার অ্যান্টিবায়োটিকটি অকার্যকর হয়ে গেলে এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েডের চিকিৎসায় আর কোনো বিকল্প থাকবে না।

টাইফয়েড ভ্যাকসিন কত প্রকারের এবং কবে অনুমোদিত হয়েছে: বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েডের সংখ্যা খুব দ্রুত বেড়ে চলেছে। অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েড বিস্তার কমানোর একটি অন্যতম উপায় হলো ভ্যাকসিন ব্যবহার; যাতে টাইফয়েডের সংক্রমণ না হয় এবং অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করতে না হয়।

টাইফয়েডের প্রথম ভ্যাকসিনটি আবিষ্কার হয় প্রায় ১৩০ বছর আগে। কিন্তু সেটি তেমন কার্যকরী ছিলনা এবং কিছু ঝুঁকিও ছিল। পরে ১৯৮০-এর দশকে আরও দুটি টাইফয়েড ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়। একটি মুখে খাওয়ার উপযোগী ঞু২১ধ ভ্যাকসিন এবং আরেকটি ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রয়োগযোগ্য ভিআই-পিএস ভ্যাকসিন। এ দুটি ভ্যাকসিন বেশ নিরাপদ, এখনো ব্যবহৃত হয় কিন্তু এগুলোর কার্যকারিতা কম, দুই তিন বছরের বেশি কাজ করে না এবং দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে কার্যকরী নয়। এরপর ২০০৫-২০১০ সালে ভারত, চীন ও যুক্তরাজ্যে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণার ফলে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (ঞঈঠ) নামে এক ধরনের নতুন প্রজন্মের ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয় যেটি সফল ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর ভারতের বিখ্যাত ওষুধ কোম্পানি ভারত বায়োটেক ঞুঢ়নধৎ-ঞঈঠ নামে বাজারজাত করে। ঞুঢ়নধৎ-ঞঈঠ ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায়।

টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন বর্তমানে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ। যেমন- পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ে, মালাউই, লাইবেরিয়া জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে পাকিস্তান, যারা ২০১৯ সালে জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন অন্তর্ভুক্ত করে।

টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন কি নিরাপদ: টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন বেশ কার্যকরী এবং নিরাপদ। ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও আফ্রিকার দেশ মালাউইয়ের পরিচালিত বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল বলছে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন ঞুঢ়নধৎ-ঞঈঠ জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ টাইফয়েড থেকে প্রায় ৮০-৯০ ভাগ সুরক্ষা দিয়ে থাকে। এটি ছয় মাস বয়সের শিশুরাও নিরাপদে নিতে পারে। ঞুঢ়নধৎ-ঞঈঠ অর্থাৎ টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিনের বড় সুবিধা হলো এর একটি ডোজ কমপক্ষে পাঁচ বছর কার্যকরী থাকে এবং কোন বড় ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে আইসিডিডিআর’বি, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে সবচেয়ে বড় গবেষণা পরিচালিত হয় ২০১৮-২০২০ সালে। উক্ত গবেষণার ফলাফল ২০২১ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিখ্যাত সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়।

উক্ত গবেষণায় ৯ মাস থেকে ১৬ বছর বয়সি ৩০ হাজার ৮৮২ শিশুর ওপর এক ডোজ ঞুঢ়নধৎ-ঞঈঠ প্রয়োগের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখানো হয়েছে ঞুঢ়নধৎ-ঞঈঠ ৮০-৯০ ভাগ শিশুকে টাইফয়েড থেকে সুরক্ষা দিতে সক্ষম হয়েছে।

গত ১২ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার ইউনিসেফ, এধার, ঃযব ঠধপপরহব অষষরধহপব এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় আনুষ্ঠানিকভাবে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন কর্মসূচির উদ্বোধন করেছে এবং এ কর্মসূচির মাধ্যমে ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী প্রায় ৫০ মিলিয়ন শিশুকে এক ডোজ জীবনরক্ষাকারী টিসিভি টিকা দেয়া লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

সফলভাবে এ কর্মসূচি সম্পন্ন হলে দেশের শিশুরা টাইফয়েডের বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েডের ঝুঁকি থেকে অনেকটাই মুক্ত হবে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, মনে রাখা দরকার টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন শতভাগ কার্যকর নয় এবং ১০-২০ শতাংশ শিশু ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও টাইফয়েডের ঝুঁকিতে থাকবে। আর এ ভ্যাকসিনটি প্রায় পাঁচ বছর সুরক্ষা দেবে। তাই পাঁচ বছর পরে বুস্টার ডোজ দেওয়া না হলে এটি আর কার্যকর নাও থাকতে পারে। তবে টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিনের বুস্টার নিয়ে এখনো কোনো গবেষণা পরিচালিত হয়নি।

টাইফয়েড নির্মূলে ভ্যাকসিন কর্মসূচি একটি কার্যকরী উপায় হলেও এটি স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। নিরাপদ পানি ও খাদ্য এবং উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা টাইফয়েড নিয়ন্ত্রণের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা। তবে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ আফ্রিকার গরিব ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় যে ভয়াবহভাবে অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট টাইফয়েড ছড়িয়ে পড়েছে তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিনই এখন সবচেয়ে নিরাপদ ও দ্রুততম উপায়।

লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ছবি সংগৃহীত