ঢাকা ১১:০২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

ঝুঁকিপর্ণ শিশুশ্রমে অধিকার লঙ্ঘন

  • আপডেট সময় : ০৭:৪৯:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫
  • ৪ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ সংবাদদাতা : ২০১৫ সালে খুলনায় গ্যারেজে কাজ করতো ১৩ বছরে কিশোর রাকিব। কাজ পরিবর্তন করায় গ্যারেজের লোকেরা তাকে নগ্ন করে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করে। কম্প্রেসারের বাতাসের চাপে রাকিবের অন্ত্র ও ফুসফুস ফেটে যায়। ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে স্পিনিং মিলের ওয়ার্কশপের কর্মী ১৩ বছরের ইয়ামিনকেও একইভাবে হত্যা করা হয়। ২০২২ সালেও গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে আরও দুটি অনুরূপ ঘটনা ঘটে। শিশুদের প্রতি এই নির্মমতা ঘটেই চলছে। শিশুহত্যার এসব ঘটনা কেবল ফৌজদারি অপরাধই নয়, বরং দেশে শিশুশ্রমের ভয়াবহ চিত্রও উন্মোচন করে। শহর ও গ্রামাঞ্চলে পরিবহন ওয়ার্কশপ, গ্যারেজ, সিএনজি ফিটিং, ঢালাই কারখানাসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে হাজার হাজার শিশু প্রতিদিন জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অল্প বয়সী শিশুরা কাজ করছে ভারী যন্ত্রপাতির সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে।

জানা যায়, ওয়ার্কশপে কর্মরত শিশুদের বেশিরভাগের বয়সই ৮ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। ধোয়ামোছা থেকে শুরু করে চাকায় হাওয়া দেওয়া, সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়া সবই করতে হয় তাদের। অথচ দিন শেষে মজুরি মাত্র ১০০-১৫০ টাকা, কিংবা মাসিক বেতন সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং ইউনিসেফের যৌথভাবে পরিচালিত ২০২২ সালের জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী, দেশে শ্রমজীবী শিশুর (এদের মধ্যে সবাই শিশু শ্রমিক হিসেবে না হলেও কোনও না কোনোভাবে কাজ করছে) সংখ্যা আনুমানিক ৩৫.৪ লাখ, যার মধ্যে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী মোট শিশু শ্রমিক (যারা স্কুলে না গিয়ে কিংবা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজ করছে) রয়েছে প্রায় ১৭ লাখ ৭৬ হাজার। তাদের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ শিশু মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে শিশুশ্রমের হার অন্যতম সর্বোচ্চ। জানা গেছে, এসব পরিবারের সদস্যরা অনেকেই একবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন পার করেন।

ফলে পরিবারের খরচ চালাতে শিশুরাও হয়ে ওঠে উপার্জনের মাধ্যম। কেউ কেউ নিজের ইচ্ছাতেই পড়ালেখা ছেড়ে কাজে নেমে পড়ে। তাদের চোখে ভবিষ্যৎ মানে পরের দিনের খাবার, পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করা, কিংবা পরনের সুন্দর পোশাক, অথবা নিজের ছোট্ট কোনও শখ পূরণের বাসনা। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার গ্যারেজে গিয়ে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি ওয়ার্কশপেই গড়ে ২-৩ জন শিশু শ্রমিক রয়েছে। ওয়ার্কশপ মালিকরা জানান, শিশুরা সহজে কাজ শিখে ফেলে, মজুরি কম, তাই তাদের রাখা সুবিধাজনক। রাজধানীর মিরপুরের ‘এস অ্যান্ড এস বাইক ওয়ার্কশপ’-এ কাজ করে ১৫ বছরের কিশোর শাহরিয়ার জয়। ‘গ্রিন ঢাকা এডুকেট’ নামে একটি স্থানীয় স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে সে। সকাল ১০টায় কাজে আসে, ১২টায় চলে যায়। আবার সন্ধ্যা ৭টায় আসে, রাত ১০টায় বাসায় ফেরে। ১১ বছর বয়স থেকে কাজ করছে শাহরিয়ার জয়। প্রথমে মজুরিভিত্তিক কাজ করলেও বর্তমানে মাসে ২০০০ টাকা বেতন পায় সে। তার বাবা পেশায় একজন নিরাপত্তাকর্মী, আর মা অন্যের বাসায় রান্নার কাজ করেন। জয় জানায়, তার আয়ের টাকায় যেমন নিজে খরচ চলে, তেমনই পরিবারকেও সহায়তা করে। শাহরিয়ার জয়ের ভাষ্য, ‘যখন কাজ শুরু করি, পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না।

পরে একটা গ্যারেজে আইসা নিজেই কাজ নিই। তারপর থেকে এই কাজেই আছি।’ সে জানায়, ‘শুরুতে কষ্ট হইতো, কাজে ভুল করলে ওস্তাদ থাপ্পড় দিতো। গ্যারেজের বড় ভাইয়েরা সব সময় খোঁচাখুঁচি কইরা দুষ্টুমি করতো। গাড়ি ধোয়া লাগতো, তখন ঠান্ডা লাগলেও কাজ বন্ধ করা যাইতো না। এখন কোনও সমস্যা হয় না। তবে কাজের জায়গায় সবাই ভালো ব্যবহার করলে আরও ভালো লাগে।’ খিলগাঁওয়ে বাইকের গ্যারেজে কাজ করে ১১ বছরের রাজু। বাবা আপাতত কিছুই করছেন না। মা স্থানীয় এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। কিছু দিন স্থানীয় কিন্ডারগার্টেনে পড়াশোনা করলেও অভাবের কারণে এখন আর স্কুলে যাচ্ছে না রাজু। রাজুর বক্তব্য, ‘বাসা থেকেই এখানে কাজের জন্য দিছে। আরও পোলাপাইন আছে, খারাপ লাগে না। খালি বাইক ওয়াশ করি। ভালো লাগে, বাসায় গিয়া রাইতে যখন মার কাছে টাকা দেই, মা টাকাটা রাইখা দেয়।’ স্কুলে না পড়ার কারণ জানতে চাইলে সে বলে, ‘বেতন দিতে পারে না বাসা থেকে। স্কুলের সবার মা টিফিনের জন্য টাকা দেয়, আনা-নেওয়া করে। আমার তো কেউ নাই, এর জন্য আমারও স্কুল ভালো লাগে না।’ মিরপুর ৬০ ফিটে একটি ওয়ার্কশপে কাজ করছে ১৩ বছর বয়সী শিশু আল-আমিন। দুই বছর হলো ঢাকায় পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছে সে। শিক্ষার আগ্রহ থাকলেও আর্থিক অনটনের কারণে তা আর হয়ে উঠছে না। আল-আমিন জানায়, ‘কাজ করতে খারাপ লাগে না। লেখাপড়ার ইচ্ছা ছিল। লেখাপড়া শিখতে পারলে হয়তো অন্য কিছু করতাম। এখন এই কাজ শিখতেছি। বাসায় টাকা দেই। ঢাকায় থাকতে হলে তো কাজ করে থাকতে হবে।’ এমন অসংখ্য জয়, রাজু, আল-আমিন ছড়িয়ে আছে দেশের প্রতিটি ওয়ার্কশপে, কারখানায়, এমনকি বাসাবাড়ির কাজেও। তারা নির্যাতিত হয়, বঞ্চিত হয়, আর কখনও কখনও প্রাণও হারায়।

বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে কোনও শিশুকে শ্রমে নিয়োগ দেওয়া আইনিভাবে অপরাধ। বাস্তবে আইন কার্যকর হয় না বললেই চলে। বিশেষ করে পরিবহন খাত ও ওয়ার্কশপে শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনও নজরদারি নেই। সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘‘শিশুশ্রম বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো ইনফরমাল সেক্টরের বিস্তার। কলকারখানা ও ফ্যাক্টরির মতো ফরমাল সেক্টরে এখন শিশুশ্রম নিয়ে নজরদারি বাড়লেও ইনফরমাল সেক্টরে তা কার্যকর নয়। যদিও ওয়ার্কশপগুলো পরিদর্শনের এখতিয়ার কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের, কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই বললে চলে। ফলে এসব শিশু নজরদারির বাইরে থেকে যায়। অপরদিকে অধিদফতর লোকবলের ‘অভাবকে’ বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘পর্যাপ্ত ডে কেয়ার বা শিশুদের দেখভালের ব্যবস্থা না থাকায় কর্মজীবী বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের গ্যারেজে দিতে বাধ্য হন। এসব জায়গা শুধু কাজ শেখার জন্য নয়, বরং নিরাপদ থাকার স্থান বলেও বিবেচনা করেন অভিভাবকরা।’ ‘আবার গ্যারেজ মালিকরা বলেন, তারা নিতে চায় না, অভিভাবকরাই দিয়ে যান। ফলে সুরক্ষা নিশ্চিতের বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। এতে শিশুরা শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়, যা তারা পরিবারকেও জানাতে পারে না ভয়ের কারণে, যুক্ত করেন আল মামুন।

শিশুশ্রম বন্ধে কেবল আইন প্রয়োগই যথেষ্ট নয় এ সমস্যার টেকসই সমাধান পেতে হলে আইনের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং শিশুদের জন্য নিরাপদ বিকল্প কর্মসংস্থান ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করাও জরুরি- বলছেন শিশু অধিকার কর্মীরা।
অধিকারকর্মীদের মতে, ওয়ার্কশপ ও কলকারখানাগুলোকে যেহেতু কোনও না কোনও কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে চালাতে হয়— বিশেষ করে সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়, তাই এসব প্রতিষ্ঠানে শিশুশ্রম বন্ধে প্রশাসনিকভাবে কিছু শর্ত আরোপ করা যেতে পারে। যেমন, ট্রেড লাইসেন্স প্রদানের সময় যদি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় শিশুদের নিয়োগ করা যাবে না, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো একটি স্পষ্ট বার্তা পাবে—শিশুদের বিষয়ে সংবেদনশীল হতে হবে। তারা আরও বলেন, কোথাও শিশুশ্রমের ঘটনা ঘটলে শ্রম অধিদফতর বা কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের উচিত—দ্রুত মামলা দায়ের করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে এমন একটি বার্তা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও সচেতন হয় এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

এছাড়াও, শিশু অধিকার কর্মীরা মনে করেন, স্বল্প আয়ের এলাকাগুলোতে শিশুদের জন্য এমন সুরক্ষিত কেন্দ্র স্থাপন জরুরি, যেখানে শ্রমজীবী অভিভাবকদের সন্তানেরা শুধু পড়াশোনাই নয়, পুরোদিন নিরাপদে থাকতে পারে। কারণ এসব শিশুর পিতা-মাতারা দেশের অর্থনীতিতে শ্রম দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন, আর তাদের সন্তানদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে প্রয়োজন কঠোর নজরদারি, নিয়মিত তদারকি ও আর্থিক জরিমানার ব্যবস্থা। পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য উপবৃত্তি, স্কুলমুখী কর্মসূচি এবং বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ প্রদান করতে হবে, যেন তারা শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) সভাপতি ড. হামিদুল হক বলেন, ‘বর্তমানে শ্রেণিভেদে শিশুদের প্রতি বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে। যারা সচেতন, তারা চেষ্টা করেন তাদের সন্তানকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দিতে। অপরদিকে, যেসব পরিবারের পক্ষে নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের খরচ চালানোই কঠিন হয়ে পড়ে, সেখানে দেখা যায়, শিশুরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। বরং এসব শিশু অনেক সময় পরিবারে উপার্জনের একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে। ফলে শিশুটির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তার ভবিষ্যৎ থমকে যায়।’ সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘শিশুদের সুরক্ষার জন্য বিশেষভাবে নজরদারির আওতায় আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই শিশুরা প্রত্যেকেই এক একজন সম্ভাবনা। তাদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারলে, তারা যেমন দক্ষ জনবলে রূপান্তরিত হতে পারবে, তেমনই হয়ে উঠবে সচেতন নাগরিক।’

 

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ঝুঁকিপর্ণ শিশুশ্রমে অধিকার লঙ্ঘন

আপডেট সময় : ০৭:৪৯:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

বিশেষ সংবাদদাতা : ২০১৫ সালে খুলনায় গ্যারেজে কাজ করতো ১৩ বছরে কিশোর রাকিব। কাজ পরিবর্তন করায় গ্যারেজের লোকেরা তাকে নগ্ন করে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করে। কম্প্রেসারের বাতাসের চাপে রাকিবের অন্ত্র ও ফুসফুস ফেটে যায়। ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জে স্পিনিং মিলের ওয়ার্কশপের কর্মী ১৩ বছরের ইয়ামিনকেও একইভাবে হত্যা করা হয়। ২০২২ সালেও গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে আরও দুটি অনুরূপ ঘটনা ঘটে। শিশুদের প্রতি এই নির্মমতা ঘটেই চলছে। শিশুহত্যার এসব ঘটনা কেবল ফৌজদারি অপরাধই নয়, বরং দেশে শিশুশ্রমের ভয়াবহ চিত্রও উন্মোচন করে। শহর ও গ্রামাঞ্চলে পরিবহন ওয়ার্কশপ, গ্যারেজ, সিএনজি ফিটিং, ঢালাই কারখানাসহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে হাজার হাজার শিশু প্রতিদিন জড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অল্প বয়সী শিশুরা কাজ করছে ভারী যন্ত্রপাতির সঙ্গে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে।

জানা যায়, ওয়ার্কশপে কর্মরত শিশুদের বেশিরভাগের বয়সই ৮ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। ধোয়ামোছা থেকে শুরু করে চাকায় হাওয়া দেওয়া, সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়া সবই করতে হয় তাদের। অথচ দিন শেষে মজুরি মাত্র ১০০-১৫০ টাকা, কিংবা মাসিক বেতন সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং ইউনিসেফের যৌথভাবে পরিচালিত ২০২২ সালের জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী, দেশে শ্রমজীবী শিশুর (এদের মধ্যে সবাই শিশু শ্রমিক হিসেবে না হলেও কোনও না কোনোভাবে কাজ করছে) সংখ্যা আনুমানিক ৩৫.৪ লাখ, যার মধ্যে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী মোট শিশু শ্রমিক (যারা স্কুলে না গিয়ে কিংবা পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজ করছে) রয়েছে প্রায় ১৭ লাখ ৭৬ হাজার। তাদের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ শিশু মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে শিশুশ্রমের হার অন্যতম সর্বোচ্চ। জানা গেছে, এসব পরিবারের সদস্যরা অনেকেই একবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন পার করেন।

ফলে পরিবারের খরচ চালাতে শিশুরাও হয়ে ওঠে উপার্জনের মাধ্যম। কেউ কেউ নিজের ইচ্ছাতেই পড়ালেখা ছেড়ে কাজে নেমে পড়ে। তাদের চোখে ভবিষ্যৎ মানে পরের দিনের খাবার, পরিবারের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করা, কিংবা পরনের সুন্দর পোশাক, অথবা নিজের ছোট্ট কোনও শখ পূরণের বাসনা। ঢাকার বিভিন্ন এলাকার গ্যারেজে গিয়ে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি ওয়ার্কশপেই গড়ে ২-৩ জন শিশু শ্রমিক রয়েছে। ওয়ার্কশপ মালিকরা জানান, শিশুরা সহজে কাজ শিখে ফেলে, মজুরি কম, তাই তাদের রাখা সুবিধাজনক। রাজধানীর মিরপুরের ‘এস অ্যান্ড এস বাইক ওয়ার্কশপ’-এ কাজ করে ১৫ বছরের কিশোর শাহরিয়ার জয়। ‘গ্রিন ঢাকা এডুকেট’ নামে একটি স্থানীয় স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে সে। সকাল ১০টায় কাজে আসে, ১২টায় চলে যায়। আবার সন্ধ্যা ৭টায় আসে, রাত ১০টায় বাসায় ফেরে। ১১ বছর বয়স থেকে কাজ করছে শাহরিয়ার জয়। প্রথমে মজুরিভিত্তিক কাজ করলেও বর্তমানে মাসে ২০০০ টাকা বেতন পায় সে। তার বাবা পেশায় একজন নিরাপত্তাকর্মী, আর মা অন্যের বাসায় রান্নার কাজ করেন। জয় জানায়, তার আয়ের টাকায় যেমন নিজে খরচ চলে, তেমনই পরিবারকেও সহায়তা করে। শাহরিয়ার জয়ের ভাষ্য, ‘যখন কাজ শুরু করি, পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না।

পরে একটা গ্যারেজে আইসা নিজেই কাজ নিই। তারপর থেকে এই কাজেই আছি।’ সে জানায়, ‘শুরুতে কষ্ট হইতো, কাজে ভুল করলে ওস্তাদ থাপ্পড় দিতো। গ্যারেজের বড় ভাইয়েরা সব সময় খোঁচাখুঁচি কইরা দুষ্টুমি করতো। গাড়ি ধোয়া লাগতো, তখন ঠান্ডা লাগলেও কাজ বন্ধ করা যাইতো না। এখন কোনও সমস্যা হয় না। তবে কাজের জায়গায় সবাই ভালো ব্যবহার করলে আরও ভালো লাগে।’ খিলগাঁওয়ে বাইকের গ্যারেজে কাজ করে ১১ বছরের রাজু। বাবা আপাতত কিছুই করছেন না। মা স্থানীয় এক ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। কিছু দিন স্থানীয় কিন্ডারগার্টেনে পড়াশোনা করলেও অভাবের কারণে এখন আর স্কুলে যাচ্ছে না রাজু। রাজুর বক্তব্য, ‘বাসা থেকেই এখানে কাজের জন্য দিছে। আরও পোলাপাইন আছে, খারাপ লাগে না। খালি বাইক ওয়াশ করি। ভালো লাগে, বাসায় গিয়া রাইতে যখন মার কাছে টাকা দেই, মা টাকাটা রাইখা দেয়।’ স্কুলে না পড়ার কারণ জানতে চাইলে সে বলে, ‘বেতন দিতে পারে না বাসা থেকে। স্কুলের সবার মা টিফিনের জন্য টাকা দেয়, আনা-নেওয়া করে। আমার তো কেউ নাই, এর জন্য আমারও স্কুল ভালো লাগে না।’ মিরপুর ৬০ ফিটে একটি ওয়ার্কশপে কাজ করছে ১৩ বছর বয়সী শিশু আল-আমিন। দুই বছর হলো ঢাকায় পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছে সে। শিক্ষার আগ্রহ থাকলেও আর্থিক অনটনের কারণে তা আর হয়ে উঠছে না। আল-আমিন জানায়, ‘কাজ করতে খারাপ লাগে না। লেখাপড়ার ইচ্ছা ছিল। লেখাপড়া শিখতে পারলে হয়তো অন্য কিছু করতাম। এখন এই কাজ শিখতেছি। বাসায় টাকা দেই। ঢাকায় থাকতে হলে তো কাজ করে থাকতে হবে।’ এমন অসংখ্য জয়, রাজু, আল-আমিন ছড়িয়ে আছে দেশের প্রতিটি ওয়ার্কশপে, কারখানায়, এমনকি বাসাবাড়ির কাজেও। তারা নির্যাতিত হয়, বঞ্চিত হয়, আর কখনও কখনও প্রাণও হারায়।

বাংলাদেশের শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে কোনও শিশুকে শ্রমে নিয়োগ দেওয়া আইনিভাবে অপরাধ। বাস্তবে আইন কার্যকর হয় না বললেই চলে। বিশেষ করে পরিবহন খাত ও ওয়ার্কশপে শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনও নজরদারি নেই। সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘‘শিশুশ্রম বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো ইনফরমাল সেক্টরের বিস্তার। কলকারখানা ও ফ্যাক্টরির মতো ফরমাল সেক্টরে এখন শিশুশ্রম নিয়ে নজরদারি বাড়লেও ইনফরমাল সেক্টরে তা কার্যকর নয়। যদিও ওয়ার্কশপগুলো পরিদর্শনের এখতিয়ার কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের, কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই বললে চলে। ফলে এসব শিশু নজরদারির বাইরে থেকে যায়। অপরদিকে অধিদফতর লোকবলের ‘অভাবকে’ বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘পর্যাপ্ত ডে কেয়ার বা শিশুদের দেখভালের ব্যবস্থা না থাকায় কর্মজীবী বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের গ্যারেজে দিতে বাধ্য হন। এসব জায়গা শুধু কাজ শেখার জন্য নয়, বরং নিরাপদ থাকার স্থান বলেও বিবেচনা করেন অভিভাবকরা।’ ‘আবার গ্যারেজ মালিকরা বলেন, তারা নিতে চায় না, অভিভাবকরাই দিয়ে যান। ফলে সুরক্ষা নিশ্চিতের বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। এতে শিশুরা শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়, যা তারা পরিবারকেও জানাতে পারে না ভয়ের কারণে, যুক্ত করেন আল মামুন।

শিশুশ্রম বন্ধে কেবল আইন প্রয়োগই যথেষ্ট নয় এ সমস্যার টেকসই সমাধান পেতে হলে আইনের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং শিশুদের জন্য নিরাপদ বিকল্প কর্মসংস্থান ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করাও জরুরি- বলছেন শিশু অধিকার কর্মীরা।
অধিকারকর্মীদের মতে, ওয়ার্কশপ ও কলকারখানাগুলোকে যেহেতু কোনও না কোনও কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে চালাতে হয়— বিশেষ করে সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়, তাই এসব প্রতিষ্ঠানে শিশুশ্রম বন্ধে প্রশাসনিকভাবে কিছু শর্ত আরোপ করা যেতে পারে। যেমন, ট্রেড লাইসেন্স প্রদানের সময় যদি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় শিশুদের নিয়োগ করা যাবে না, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো একটি স্পষ্ট বার্তা পাবে—শিশুদের বিষয়ে সংবেদনশীল হতে হবে। তারা আরও বলেন, কোথাও শিশুশ্রমের ঘটনা ঘটলে শ্রম অধিদফতর বা কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের উচিত—দ্রুত মামলা দায়ের করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে এমন একটি বার্তা দেওয়া প্রয়োজন, যাতে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও সচেতন হয় এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

এছাড়াও, শিশু অধিকার কর্মীরা মনে করেন, স্বল্প আয়ের এলাকাগুলোতে শিশুদের জন্য এমন সুরক্ষিত কেন্দ্র স্থাপন জরুরি, যেখানে শ্রমজীবী অভিভাবকদের সন্তানেরা শুধু পড়াশোনাই নয়, পুরোদিন নিরাপদে থাকতে পারে। কারণ এসব শিশুর পিতা-মাতারা দেশের অর্থনীতিতে শ্রম দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন, আর তাদের সন্তানদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে প্রয়োজন কঠোর নজরদারি, নিয়মিত তদারকি ও আর্থিক জরিমানার ব্যবস্থা। পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য উপবৃত্তি, স্কুলমুখী কর্মসূচি এবং বিনামূল্যে শিক্ষা উপকরণ প্রদান করতে হবে, যেন তারা শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) সভাপতি ড. হামিদুল হক বলেন, ‘বর্তমানে শ্রেণিভেদে শিশুদের প্রতি বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে। যারা সচেতন, তারা চেষ্টা করেন তাদের সন্তানকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দিতে। অপরদিকে, যেসব পরিবারের পক্ষে নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের খরচ চালানোই কঠিন হয়ে পড়ে, সেখানে দেখা যায়, শিশুরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। বরং এসব শিশু অনেক সময় পরিবারে উপার্জনের একটি মাধ্যম হয়ে ওঠে। ফলে শিশুটির সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তার ভবিষ্যৎ থমকে যায়।’ সেভ দ্য চিলড্রেনের শিশু সুরক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘শিশুদের সুরক্ষার জন্য বিশেষভাবে নজরদারির আওতায় আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, এই শিশুরা প্রত্যেকেই এক একজন সম্ভাবনা। তাদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারলে, তারা যেমন দক্ষ জনবলে রূপান্তরিত হতে পারবে, তেমনই হয়ে উঠবে সচেতন নাগরিক।’