বিশেষ প্রতিনিধি : বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সেই বিখ্যাত গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’-এর গীতিকার তিনি। এ ছাড়া অসংখ্য দেশাত্ববোধকসহ সব ধারার গানের কিংবদন্তি গীতিকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ার আর নেই। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’, ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’- এর মতো অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা মাজহারুল আনোয়ারের বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে তার পুত্রবধূ শাহানা মির্জা জানান। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে এসিডিটির সমস্যায় ভুগছিলেন। আমরা গতকাল (শনিবার) ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। রক্ত পরীক্ষা করানো হয়েছিল, আজ (রোববার) আরও কিছু পরীক্ষা করার কথা ছিল।” শাহানা জানান, ভোরে হঠাৎ অসুস্থতা বেড়ে গেলে তার শ্বশুরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানান, তার পালস পাওয়া যাচ্ছে না। ভোর সাড়ে ছ’টার দিকে নিজ বাসার বাথরুমে জ্ঞান হারান তিনি। চিকিৎসকদের ধারণা, তিনি স্ট্রোক করেছিলেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ারে মৃত্যুতে সংস্কৃতি অঙ্গনসহ সংশ্লিষ্ট মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এ গীতিকার, পরিচালকের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার তালেশ্বর গ্রামে। ষাটের দশকে যখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র, মাজহারুল আনোয়ার লেখেন তার প্রথম গান ‘বুঝেছি মনের বনে রঙ লেগেছে’। নাজমূল হুদা বাচ্চুর সুরে সেই গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন ফরিদা ইয়াসমিন। মাজহারুল আনোয়ার ১৯৬৪ সাল থেকে রেডিও পাকিস্তানের জন্য গান লেখা শুরু করেন। সে সময় গানপ্রতি মিলতো ৫০ টাকা। সেই দিয়ে তার পেশাদার গীতিকারের জীবন শুরু। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকে টেলিভিশনের জন্যও নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। বলা হয়, তার লেখা গানের সংখ্যা প্রায় ২১ হাজার। রেডিও ও টেলিভিশনে ব্যস্ততার মধ্যেই ১৯৬৫ সালে চলচ্চিত্রের অঙ্গনে ডাক পড়ে মাজহারুল আনোয়ারের। সুভাষ দত্তের আয়না ও অবশিষ্ট সিনেমায় তার ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’ গানটি শ্রোতার হৃদয়ে আজও অমলিন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে রুনা লায়লার গাওয়া প্রথম গান ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে বল কি হবে’ মাজহারুল আনোয়ারেরই লেখা।
১৯৭০ সালে ‘জয় বাংলা’ সিনেমার জন্য (পরে নাম বদলে হয় সংঘাত) মাজহারুল আনোয়ার লেখেন মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রেরণাদায়ী গান ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’। আনোয়ার পারভেজের সুরে সেই গানকেই পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা সংগীত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’ আর ‘একবার যেতে দে না’- এই তিনটি গান বিবিসির এক জরিপে ২০ শতকের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নেয়। ষাটের দশক থেকে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের গানে খ্যাতি পাওয়া প্রায় সব শিল্পীই কখনও না কখনও মাজহারুল আনোয়ারের লেখা গান কণ্ঠে তুলেছেন। সেসব গানে এসেছে প্রেম আর বিরহ, দ্রোহ আর দেশপ্রেম, জীবন আর মৃত্যুচিন্তার কথা। চোখের নজর এমনি কইরা, তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়, তুমি আরেকবার আসিয়া যাও মোরে, সাতটি রঙের মাঝে আমি মিল খুঁজে না পাই, অনেক সাধের ময়না আমার, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, চলে আমার সাইকেল, সবাই তো ভালোবাসা চায়সহ মাজহারুল আনোয়ারের লেখা অসংখ্য গান বাংলাদেশের মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল থাকবে বহুকাল।
১৯৬৭ সালে চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হওয়ার পর কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান লেখাতেও দক্ষতা দেখান মাজহারুল আনোয়ার। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নান্টু ঘটক’ ১৯৮২ সালে মুক্তি পায়। তার পরিচালিত ও প্রযোজিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা চল্লিশের বেশি। এর মধ্যে রয়েছে শাস্তি, স্বাধীন, শর্ত, সমর, ক্ষুধা, তপস্যা, উল্কা, পরাধীন, পাষাণের প্রেম,জীবনের গল্প, এই যে দুনিয়া, অগ্নিশিখা, জিঞ্জির, আনারকলি, বিচারপতির মত সিনেমা।
পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে সরকার ২০০২ সালে একুশে পদক এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়। ১৯৭২ সালে তিনি পেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট স্বর্ণপদক। চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির সভাপতি, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জুরি বোর্ডের সদস্য, সেন্সরবোর্ড সদস্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। অসংখ্য কালজয়ী গানের এই রচয়িতা গীতিকবি সংঘের আজীবন সদস্য ছিলেন। পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একাধিকবার বাচসাস পুরস্কার, বিজেএমই অ্যাওয়ার্ড, ডেইলি স্টার কর্তৃক লাইফ টাইম অ্যাওয়ার্ডসহ তার অর্জিত পুরস্কারের সংখ্যা ১১০।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা জাসাসেরও উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। স্ত্রী জোহরা গাজী, ছেলে সারফরাজ আনোয়ার এবং মেয়ে দিঠি আনোয়ারকে রেখে গেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। কণ্ঠশিল্পী দিঠি আনোয়ার এখন আছেন দেশের বাইরে। তিনি ফিরলে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের দাফন হবে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
রাষ্ট্রের কাছে আর কিছু চাওয়ার নেই; গাজী মাজহারুল আনোয়ার পুত্র : বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে দর্শক-শ্রোতাদের মুঠো মুঠো ভালোবাসা কুড়িয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রীয়ভাবে নানা সম্মান পেয়েছেন এই শিল্পী। এ বিষয়ে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের পুত্র উপল বলেন, ‘একাত্তর পরবর্তী সব সরকার আমার বাবাকে সম্মান দিয়েছেন। আমার পরিবার কৃতজ্ঞ। রাষ্ট্রের কাছে আর কোনো কিছু চাওয়ার নেই।’
আজ শহীদ মিনারে রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা, মায়ের কবরে দাফন : গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মরদেহ রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমাগারে রাখা হয়েছে। জানাজা ও দাফন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আজ সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) বাদ আসর বনানী কবরস্থানে কবিকে দাফন করা হবে। তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন তার পুত্র উপল। তিনি জানান, সোমবার সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মরদেহ নেওয়া হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে তাকে রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা ‘গার্ড অব অনার’ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে সংস্কৃতি অঙ্গন ও সাধারণ মানুষেরা শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এরপর গীতিকবির মরদেহ নেওয়া হবে চলচ্চিত্রের আঁতুড়ঘর বিএফডিসিতে। সেখানে বাদ জোহর অনুষ্ঠিত হবে তার প্রথম জানাজা। সেই সঙ্গে সিনেমা সংশ্লিষ্টরা কিংবদন্তিকে শ্রদ্ধা জানাবেন। বাদ আসর গুলশানের আজাদ মসজিদে রাখা হবে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মরদেহ। সেখানে অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় জানাজা। এরপর বনানী কবরস্থানে তার মা খোদেজা বেগমের কবরে তাকে সমাহিত করা হবে।
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কিছু কালজয়ী গান : তাঁর লেখা গানের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি, পৃথিবীতে যা বিরল। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-‘জয় বাংলা বাংলার জয়/ কোটি প্রাণ একসাথে জেগেছে অন্ধ রাতে…’ ‘হে বন্ধু বঙ্গবন্ধু’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল’, ‘যদি আমাকে জানতে সাধ হয়’, ‘বউ যায়গো পালকি চড়ে…দুরুম দুরুম গ্রেনেড ফুটছে, কাঁপছে তার বুক, মুক্তির নেশায় তবুও সে উন্মুখ।’ ‘বাছারে বাছা তুই আরেকটা দিন বাড়িতে থেকে যা, উড়কি ধানের মুড়ি এখনো হয়নি শেষ, এমনই করে রাখত ধরে আমার মা’, ‘আমায় একটি ক্ষুদিরাম দাও বলে কাঁদিস নে মা…’ ‘
বিপুল জনপ্রিয়তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গানগুলো-‘আছেন আমার মুক্তার, আছেন আমার বারিস্টার’, ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে, আমি বলি কমে’, ‘আউল বাউল লালনের দেশে মাইকেল জ্যাকসন আইলোরে…’ ‘সাধকে মনমোহন হরি গোপীজন, মন চায় বাঁশরী’ প্রভৃতি।
‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানের গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ারের জীবনাবসান
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ