নিজস্ব প্রতিবেদক: বইকে বলা হয় জ্ঞানের প্রতীক। আর দেশের বৃহত্তম সেই বইয়ের মার্কেট নীলক্ষেত হকার্স মার্কেট। ৯টি আলাদা মার্কেট মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ’-এর পাশ থেকে শুরু করে নীলক্ষেত বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন মার্কেটগুলোকে এক নামে ‘নীলক্ষেত হকার্স মার্কেট’ বলে চেনে সবাই।
এ মার্কেটের দোকানিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশেপাশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের শিক্ষা সংক্রান্ত সব পণ্যসহ আনুষঙ্গিক পণ্য সরবরাহ করে। হাজারের ওপর বইয়ের দোকান, শতাধিক ফটোকপি-প্রিন্টের দোকান, খাবার-পোশাকের দোকানসহ অন্যান্য দোকান রয়েছে আরো হাজারখানেক।
সংবাদসংস্থা বাংলা ট্রিবিউন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নীলক্ষেত বইয়ের মার্কেটে সবসময়ই থাকে সাধারণ মানুষের ভিড়। দোকানগুলো একটার সাথে আরেকটা সম্পূর্ণ লেগে থাকায় যেকোনও সময় ঘটতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। একটি দোকানে আগুন লাগলে ছড়িয়ে যেতে পারে পুরো মার্কেটে।
জানা গেছে, এর আগে কয়েকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও অগ্নিনির্বাপণের জন্য মার্কেটগুলোতে এখনও নেওয়া হয়নি কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা। কয়েকটি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকলেও অনেক আগেই শেষ হয়েছে মেয়াদ। নেই পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থাও। ফলে আগুন লাগলে নেভানোর মতো পর্যাপ্ত ব্যবস্থাই নেই মার্কেটটিতে। নেই কোনো ফায়ার এক্সিটও।
গত শনিবার (১ মার্চ) নীলক্ষেত হকার্স মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, হযরত বাকুশাহ, ইসলামিয়াসহ ৮ থেকে ৯টি মার্কেট মিলে গঠিত এই মার্কেটে প্রতিটি দোকান একটি আরেকটির সাথে লেগে আছে। গলিগুলোতে একজনের বেশি পাশাপাশি হাঁটার জায়গা নেই। এমনকি খালি চোখে বোঝারও উপায় নেই এখানে একাধিক মার্কেট রয়েছে। পুরো মার্কেট ঘুরে মোট ১৪টি অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের দেখা মিললেও কোনোটিরই মেয়াদ ছিল না। মার্কেটের ভেতরে রয়েছে একাধিক খাবার হোটেলও। রান্নাও করা হয় মার্কেটের ভেতরেই।
দোকানিরা বলছেন, মাঝেমধ্যেই এখানে ছোট ছোট আগুনের ঘটনা ঘটে। তবে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিভিয়ে ফেলা যায়। তবে বড় দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা মার্কেটে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগবে না। সব জায়গায় বিদ্যুতের তার, দোকানগুলোর মধ্যে কোনো গ্যাপ না থাকায় মুহূর্তেই সব জায়গায় আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া ভেতরে খাবারের দোকান থেকে এর আগেও বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
দোকানিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মার্কেটটিতে কোনো ফায়ার এক্সিট নেই। আগুন লাগলে ছোট ছোট এই গলি দিয়েই সবাইকে মালামাল নিয়ে বের হতে হয়। তাৎক্ষণিকভাবে খাওয়ার পানির লাইন থেকেই পানি সংগ্রহ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই।
বাকুশা মার্কেটে প্রিন্ট ও ফটোকপির দোকান রয়েছে ফারুক হোসাইনের। তিনি বলেন, এখানে বড় ধরনের আগুন লাগলে বাঁচার রাস্তা খুব কম। মালামাল তো পরের হিসাব জীবন নিয়ে বের হওয়াটাই কষ্ট হয়ে যাবে। অনেক বেশি দোকান ও গায়ে গায়ে অবস্থানের কারণে দাবানলের মতো আগুন ছড়িয়ে যাবে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কোনো ধরনের কার্যকরী ব্যবস্থাই আমাদের নেই।
একই কথা বলেন একাধিক দোকানি। বই ব্যবসায়ী জাহিদ ইকরাম বলেন, করোনার সময় আগুন নেভানোর যন্ত্রগুলো বসানো হয়েছে। এখন কোনোটিরই মেয়াদ নেই। আবার পর্যাপ্ত যন্ত্রও নেই। এখানে আগুন লাগলে ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হবেন। পাশাপাশি জীবনের নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই।
হযরত বাকুশা হকার্স মার্কেট সমবায় সমিতির সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন মোহন আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমরা জানি আগুন নেভানোর জন্য এখানে পর্যাপ্ত কোনো ব্যবস্থাই নেই। যেহেতু হকার্স মার্কেট তাই দোকানগুলোও একটা আরেকটার সাথে লাগানো এবং সব জায়গায় এলোমেলো বিদ্যুতের তার ঝুলছে। এখানে আগুন লাগলে সেটি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হবে। তবে আমরা সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকি যাতে আগুন না লাগে। ছোট ছোট আগুনের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে। সেটা আমরা প্রাথমিকভাবেই নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলি। বড় কোনো ঘটনা ঘটছে না।
তিনি বলেন, দেশে যখন বড় বড় আগুনের ঘটনা ঘটেছে আমরা তৎক্ষণাৎ ৩০টি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র এনে মার্কেটের বিভিন্ন খুঁটিতে লাগিয়ে দিয়েছি এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছি যে কীভাবে সেটি ব্যবহার করতে হয়। আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করছি আমাদের দিক থেকে। এছাড়া আমরা রাতেও সিকিউরিটি গার্ডসহ কয়েকজন দোকানিকে দোকান খোলা রাখার অনুমতি দেই যাতে তারা রাতে কোথাও আগুনের ঘটনা ঘটলে দ্রুত নিভিয়ে ফেলতে পারে। এসব প্রস্তুতির মধ্য দিয়েই মার্কেট চলছে।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক বন্ধের দিনও খোলা ছিল নীলক্ষেত বইয়ের মার্কেট। সন্ধ্যা ৭টা ৪৮ মিনিটে আগুন লাগে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ৮টি ইউনিট কাজ করে সেসময় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। খাবারের দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে সেসময় ধারণা করা হয়। কেউ কেউ আবার ধারণা করেছিলেন, বইয়ের দোকান থেকেই আগুনের সূত্রপাত।