ড. মতিউর রহমান : বর্তমান বিশ্বে যখন প্রযুক্তি, অর্থনীতি এবং সমাজের এক নতুন দিগন্ত খুলে যাচ্ছে, তখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রজন্ম তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং প্রয়োগে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত প্রজন্ম হলো জেনারেশন জেড। জেনারেশন জেড বলতে সাধারণত ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিদের বোঝানো হয়। এই প্রজন্মের সদস্যরা বিশ্বে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল যুগে জন্মগ্রহণ করেছে এবং বড় হয়েছে, যার কারণে তারা প্রযুক্তির প্রতি বিশেষভাবে উদাসীন নয় বরং অত্যন্ত আগ্রহী এবং দক্ষ। তারা তথ্যপ্রযুক্তির গতি, সামাজিক মিডিয়ার প্রভাব, এবং বিশ্বায়নের ধারণাগুলির মধ্যে বেড়ে উঠেছে, যা তাদের চিন্তাভাবনা, কর্মসংস্থান পদ্ধতি এবং জীবনধারার উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
জেনারেশন জেড-এর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাদের ডিজিটাল দক্ষতা এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার সক্ষমতা। তারা সোশ্যাল মিডিয়া, স্মার্টফোন, এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীজুড়ে সংযুক্ত থাকার সুযোগ পায় এবং এই প্রযুক্তি তাদের জীবনধারা এবং পেশাগত বিকাশে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। তবে, এই প্রজন্মের সদস্যদের মধ্যে কিছু বিষয়ও পরিলক্ষিত হয়, যেমন তাদের অধিকাংশই সৃজনশীল, উদ্যোক্তা মনোভাবাপন্ন এবং টেকসই উন্নয়ন ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি সচেতন।
বাংলাদেশে জেনারেশন জেড-এর উপস্থিতি ও প্রভাব বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই দেশের শ্রমবাজারে প্রযুক্তির সংযোজন এবং শিল্পখাতের আধুনিকায়ন চলমান। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মসংস্থান সুযোগ এবং সামাজিক পরিবর্তনের ধারায় এই প্রজন্মের চাহিদা ও অবদান ত্বরান্বিত হতে চলেছে। ডিজিটাল অর্থনীতি, অনলাইন কর্মসংস্থান, এবং নতুন ধরনের কাজের সুযোগের দিকে তরুণ প্রজন্মের মনোযোগ বেশি। ফলে, জেনারেশন জেড বাংলাদেশে একটি নতুন কর্মসংস্থান সম্ভাবনার সূচনা করছে, যেখানে প্রযুক্তি, উদ্ভাবনী ধারণা এবং সৃজনশীলতা প্রাধান্য পাচ্ছে।
জেনারেশন জেড এর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তাদের অত্যাধুনিক ডিজিটাল দক্ষতা এবং প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ। এই প্রজন্মটি এমন একটি যুগে বড় হয়েছে যেখানে প্রযুক্তি প্রতিদিনই নতুন নতুন মাত্রা যোগ করছে। স্মার্টফোন, ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তারা পৃথিবীকে খুব সহজেই একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত রাখতে সক্ষম।
ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক শুধুমাত্র ব্যবহারিক নয়, বরং তারা প্রযুক্তির বিভিন্ন দিকের প্রতি গভীর আগ্রহী এবং এর উন্নয়নে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চায়। ফলে, তারা দ্রুত নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে পারে এবং তাদের জীবনধারাকে এই প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করতে শিখে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে, তারা প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন ধরনের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে, যা পূর্ববর্তী প্রজন্মের জন্য ছিল অজ্ঞাত। এছাড়া জেনারেশন জেড-এর মধ্যে সৃজনশীলতা এবং উদ্যোক্তা মানসিকতা একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে উঠে এসেছে। এই প্রজন্মটি প্রথাগত চাকরি ও দাপ্তরিক পরিবেশের বাইরে নতুন ধরনের কাজের সুযোগ খোঁজে। তারা নিজের উদ্যোগে কিছু তৈরি করতে, সমস্যা সমাধান করতে এবং নতুন ব্যবসা শুরু করতে আগ্রহী। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজ করা, স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করা বা স্বাধীনভাবে কাজ করা তাদের মধ্যে এক ধরনের উৎসাহ তৈরি করেছে। তাদের উদ্যোক্তা মানসিকতা সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তন ও ব্যবসায়ের নতুন ধারণার দিকে প্রবণতা সৃষ্টি করেছে, যা একদিকে যেমন তাদের ব্যক্তিগত বিকাশ ঘটাচ্ছে, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে।
টেকসই উন্নয়ন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি জেনারেশন জেড-এর মনোভাবও তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তারা পরিবেশ সংরক্ষণ, সমতা, মানবাধিকার এবং সমাজে ন্যায়ের প্রতি গভীর মনোযোগী। এমনকি তারা যে কোনও বাণিজ্যিক উদ্যোগে সামাজিক মূল্য এবং পরিবেশগত দায়বদ্ধতা সমান গুরুত্ব দেয়। উদাহরণস্বরূপ, তারা যেসব পণ্য বা পরিষেবা ব্যবহার করে, তা পরিবেশের ওপর তাদের প্রভাবের বিষয়ে সচেতন থাকে এবং তাদের ক্রয় সিদ্ধান্তে এই বিষয়গুলোর গুরুত্ব দেয়। সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং নৈতিকভাবে সঠিক কাজ করার ইচ্ছা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবন এবং চিন্তাভাবনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই প্রজন্মের সদস্যরা কর্মক্ষেত্রে নতুন ধরনের চিন্তা ও পরিবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে। তারা প্রথাগত অফিস পরিবেশের চেয়ে অধিকতর নমনীয় ও ফ্লেক্সিবল কাজের পরিবেশ চায়। হাইব্রিড বা দূরবর্তী কাজ, সৃজনশীলতা ভিত্তিক প্রকল্প এবং কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতা তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। পরিবর্তিত পৃথিবী এবং প্রযুক্তির সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য তারা সর্বদা খোলামেলা এবং অভিযোজনযোগ্য মনোভাব পোষণ করে। এই পরিবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গি তাদের কর্মস্থলে নতুন ধারণা, উদ্ভাবন এবং দক্ষতার প্রতি খোলামেলা মনোভাব তৈরি করে, যা ভবিষ্যতের কর্মসংস্থান পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের শ্রমবাজার বর্তমান সময়ে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, যেখানে প্রযুক্তির অগ্রগতি, অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক সংযোগের প্রভাব স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলি বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থান ব্যবস্থা নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে আঙ্গিক পরিবর্তন করছে।
প্রযুক্তির ভূমিকা শ্রমবাজারের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে দেখা যাচ্ছে। অটোমেশন এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (অও) এর সাহায্যে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি, কাজের ধরনেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। অটোমেশন পদ্ধতিগুলি যেসব ক্ষেত্রে প্রচলিত ছিল, সেসব ক্ষেত্রে এখন কম সময়, কম খরচে আরও উন্নত কাজ করা সম্ভব হচ্ছে। উৎপাদন, পরিসেবা এবং অন্যান্য শিল্পের বিভিন্ন খাতে অটোমেশন ব্যবহারের ফলে শ্রমিকের কাজের ধরণও পাল্টে যাচ্ছে। পাশাপাশি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর ব্যবহারও বিশ্বব্যাপী শিল্পখাতগুলোর উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে। এই প্রযুক্তিগুলির মাধ্যমে ডিজিটাল কর্মসংস্থান বাড়ছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের দক্ষতার প্রয়োজন হচ্ছে যেমন সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং, কাস্টমার সাপোর্ট ইত্যাদি। তাই প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিকে জোর দেয়া হচ্ছে, যাতে শ্রমিকরা নতুন ধরনের কাজের জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
বাংলাদেশে কৃষি থেকে শিল্পখাতে স্থানান্তর একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক পরিবর্তন। যেখানে একসময় কৃষি ছিল প্রধান কর্মসংস্থান ক্ষেত্র, এখন শিল্পখাতের বিকাশ এই ধারাকে পরিবর্তন করছে। শ্রমিকরা কৃষি থেকে শিল্পখাতে স্থানান্তরিত হচ্ছেন, বিশেষত তৈরি পোশাক, নির্মাণ, ইলেকট্রনিক্স, ওয়ার্কফোর্স আউটসোর্সিং এবং অন্যান্য শিল্প খাতে। এছাড়াও, সেবা খাতের বৃদ্ধি বাংলাদেশের শ্রমবাজারের একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, ব্যাংকিং, হোটেল ও পর্যটন সেবার ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। সেবা খাতের এই সমপ্রসারণ দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করছে এবং নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশে নতুন উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপ সংস্কৃতির উত্থানও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সৃজনশীলতা এবং উদ্যোক্তা মানসিকতার বৃদ্ধি, তাদের স্টার্টআপ শুরু করার ইচ্ছা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ব্যবসায়িক উদ্যোগ গ্রহণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এই প্রবণতাকে সমর্থন দিচ্ছে, যেমন বিভিন্ন উদ্যোগে আর্থিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক প্রদান করা হচ্ছে। তরুণ উদ্যোক্তারা যেমন নতুন প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহী, তেমনি তারা সামাজিক দায়বদ্ধতা ও টেকসই উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, যা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করছে।
বিশ্বায়নের প্রভাবও বাংলাদেশের শ্রমবাজারের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংযোগ বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে আরও গ্লোবাল করে তুলছে। বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে যেমন তৈরি পোশাক শিল্পের সমপ্রসারণ ঘটেছে, তেমনি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে যুক্ত হয়ে শ্রমিকরা বিভিন্ন ধরনের সুযোগ লাভ করছে। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এবং যোগাযোগের মাধ্যমে বিদেশি বাজারে কাজ করার সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেমন ফ্রিল্যান্সিং, দূরবর্তী কাজ, ডিজিটাল মার্কেটিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি।
এই আন্তর্জাতিক সংযোগ বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে আরও বৈশ্বিক ও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলছে, যার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারের সাথে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে মেলবন্ধন তৈরি হচ্ছে।
বর্তমানে জেনারেশন জেড বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে, বিশেষত তথ্য প্রযুক্তি, সফটওয়্যার, ডিজিটাল মার্কেটিং, স্টার্টআপ ব্যবসা এবং দক্ষতা ভিত্তিক কাজের মাধ্যমে। বাংলাদেশেও এই প্রজন্মের সদস্যরা তাদের দক্ষতা ও আগ্রহের ভিত্তিতে নতুন ধরনের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করছে, যা দেশের শ্রমবাজারের উন্নয়ন ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে।
তথ্য প্রযুক্তি, সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল মার্কেটিং হলো জেনারেশন জেড-এর জন্য অন্যতম প্রধান কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র।
এই প্রজন্মের সদস্যরা ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে অত্যন্ত দক্ষ, এবং তারা সহজেই নতুন প্রযুক্তি শিখতে এবং ব্যবহার করতে পারে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ডিজিটাল সেবার চাহিদা বাড়ছে, বিশেষ করে ই-কমার্স, অনলাইন মার্কেটিং, ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবস্থাপনায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে। তরুণরা এই ক্ষেত্রগুলোর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে এবং নিজেদের ডিজিটাল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে।
স্টার্টআপ এবং উদ্যোক্তা ব্যবসাও জেনারেশন জেড-এর জন্য নতুন কর্মসংস্থানের একটি উৎস হয়ে উঠেছে। তারা নিজের উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করার দিকে আগ্রহী এবং ব্যবসায়িক ধারণা, প্রযুক্তি ব্যবহার, নতুন পণ্য বা সেবা তৈরি করতে সক্ষম।
স্টার্টআপ সংস্কৃতি এবং উদ্যোক্তা মনোভাব বাংলাদেশে একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে, যেখানে তরুণরা বিপণন, প্রযুক্তি, আর্থিক পরামর্শ এবং অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করছে। সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এই উদ্যোগগুলিকে সহায়তা প্রদান করছে, যেমন উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ, ফান্ডিং এবং সঠিক পরামর্শের মাধ্যমে। এর ফলে, জেনারেশন জেড একটি শক্তিশালী উদ্যোক্তা শক্তিতে পরিণত হচ্ছে, যা শ্রমবাজারে বিপ্লব ঘটাতে সহায়তা করছে।
পরিবেশগত এবং সামাজিক উদ্যোগগুলোর প্রতি জেনারেশন জেড-এর আগ্রহও বাড়ছে, যেখানে তারা টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশ রক্ষা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করতে চায়। তরুণরা এখন শুধু অর্থনৈতিক লাভের জন্যই কাজ করছে না, বরং তারা এমন উদ্যোগে অংশ নিতে চায় যা সমাজের কল্যাণে কাজে আসে।
এই প্রজন্মের সদস্যরা বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ, সামাজিক কার্যক্রম এবং নৈতিক ব্যবসায় মনোযোগ দিচ্ছে। তারা আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে চাইছে এবং নিজেদের কাজে সামাজিক ও পরিবেশগত দায়িত্বের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর ফলে, সামাজিক উদ্যোগ এবং পরিবেশবান্ধব ব্যবসায় নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত হবে।
দক্ষতাভিত্তিক কাজ এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে কাজের সুযোগও জেনারেশন জেড-এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীজুড়ে, বিশেষ করে বাংলাদেশে, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দূরবর্তী কাজের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তরুণরা তাদের দক্ষতা ব্যবহার করে ফ্রিল্যান্সিং, গ্রাফিক ডিজাইন, কনটেন্ট রাইটিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, অনলাইন টিউটরিং এবং অন্যান্য সেবা প্রদান করছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যেমনÑ টঢ়ড়িৎশ, ঋরাবৎৎ, ঋৎববষধহপবৎ, ঞড়ঢ়ঃধষ ইত্যাদি তাদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যেখানে তারা বৈশ্বিক গ্রাহকদের সেবা প্রদান করতে পারছে। দক্ষতা ভিত্তিক কাজের এই সুযোগ জেনারেশন জেড-এর সদস্যদের তাদের আগ্রহ এবং সক্ষমতার ভিত্তিতে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে, যা শুধু স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও তাদের প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি করেছে।
জেনারেশন জেড দেশের শ্রমবাজারে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করলেও, তাদের সামনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যা তাদের পেশাগত এবং ব্যক্তিগত অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
এই চ্যালেঞ্জগুলি শুধুমাত্র জেনারেশন জেড নয়, বরং পুরো দেশের শ্রমবাজারের সামগ্রিক উন্নয়নকেও প্রভাবিত করছে।
দক্ষতার ঘাটতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন প্রয়োজন অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধকতা। যদিও জেনারেশন জেড প্রযুক্তি এবং ডিজিটাল দক্ষতায় যথেষ্ট আগ্রহী, তবে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত পরিকাঠামো এখনও পরিপূর্ণভাবে গড়ে উঠেনি। বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে পুরনো এবং সেকেলে, যা তাদের আধুনিক চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে বাধা সৃষ্টি করছে।
উদাহরণস্বরূপ, তথ্য প্রযুক্তি, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং, এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে বর্তমানে শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং কোর্সের অভাব রয়েছে। এই কারণে জেনারেশন জেড-এর সদস্যরা তাদের পূর্ণ ক্ষমতা অনুযায়ী শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারছে না, যা তাদের কর্মসংস্থান ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
কর্মসংস্থান ব্যবস্থায় বৈষম্য এবং অস্থিরতা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে একটি বড় সমস্যা। পুরনো ব্যবস্থা এবং চাকরি পাওয়ার প্রথাগত উপায়গুলির মাধ্যমে অনেক তরুণই তাদের কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাচ্ছে না। তাছাড়া, চাকরির ক্ষেত্রে লিঙ্গ, জাতিগত এবং আঞ্চলিক বৈষম্যও প্রকট হয়ে উঠছে। পুরনো নিয়োগ প্রক্রিয়াগুলি এখনো প্রচলিত, যেখানে ব্যক্তিগত সংযোগ এবং সিস্টেমের মাধ্যমে চাকরি পাওয়া যায়।
এই অবস্থায়, জেনারেশন জেড যাদের দক্ষতা ও নতুন চিন্তা থাকতে পারে, তারা অনেক সময়ই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
উপরন্তু কর্মসংস্থান ব্যবস্থা এখনো অস্থির এবং অপ্রত্যাশিত, যা অনেক তরুণকে ভয়ভীতি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়।
পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং দেশীয় অবকাঠামোগত দুর্বলতা বাংলাদেশের শ্রমবাজারে আরও কিছু সমস্যা তৈরি করছে। দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যেমন পরিবর্তনশীল, তেমনি অর্থনৈতিক মন্দা, মূল্যস্ফীতি, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এসব কারণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে বাধা পাচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠিত সংস্থাগুলিতে কর্মী নিয়োগের পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে অবকাঠামোগত দুর্বলতা, যেমন যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং আইটি সেবার পর্যাপ্ত উন্নতি না হওয়া, কাজের সুযোগ এবং দক্ষতা উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এসব দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে, জেনারেশন জেড-কে তাদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সাফল্য লাভ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা বর্তমানে জেনারেশন জেড-এর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বায়নের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য আরও বেশি প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে ফ্রিল্যান্সিং এবং ডিজিটাল কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ থেকে আসে কঠোর প্রতিযোগিতা। ভারতের মতো দেশ যেখানে প্রযুক্তিগত দক্ষতার স্তর উন্নত এবং শ্রমবাজার আরও বড়, সেখানে বাংলাদেশের তরুণদের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা আরও কঠিন হয়ে উঠছে। অভ্যন্তরীণ বাজারেও, অনেক সময় চাকরির জন্য অপ্রত্যাশিত প্রতিযোগিতা দেখা যায়, যেখানে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রের কাজের জন্য অনেক বেশি আবেদন জমা পড়ে, কিন্তু সুযোগের পরিমাণ কম থাকে। এই ধরনের প্রতিযোগিতা জেনারেশন জেড-এর সদস্যদের পেশাগত অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
জেনারেশন জেডের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ এবং তাদের দক্ষতার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রজন্মের সদস্যরা যাতে তাদের দক্ষতা এবং সৃজনশীলতার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে, সে জন্য প্রয়োজন শিক্ষার উন্নয়ন, উদ্যোক্তা সংস্কৃতির বিকাশ, ডিজিটাল সংযোগ এবং সরকারের কার্যকর নীতির বাস্তবায়ন।
কর্মসংস্থান বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশে শিক্ষার মান এবং সিলেবাসে পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি।
নতুন প্রযুক্তি, সৃজনশীলতা এবং উদ্যোগের প্রতি আগ্রহী তরুণদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দক্ষতা ভিত্তিক প্রশিক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্রযুক্তিগত, ডিজিটাল এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের প্রশিক্ষণ প্রদান করে জেনারেশন জেডকে বিভিন্ন শিল্পখাতে দক্ষ ও প্রস্তুত করা যেতে পারে। এটি শুধু তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবে, বরং বাংলাদেশকে একটি দক্ষ কর্মী বাহিনীর দিকেও এগিয়ে নিয়ে যাবে, যা বিশ্বের যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে।
উদ্যোক্তা মনোভাব এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিকাশে সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সরকারের উচিত উদ্যোক্তাদের জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে তারা সহজে নতুন ব্যবসা শুরু করতে পারবে। উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ, ফান্ডিং এবং বাজারে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। উদ্যোক্তাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কর সুবিধা, সহজলভ্য ঋণ এবং আইনি সহায়তা প্রদান করলে, জেনারেশন জেড তাদের উদ্যোগে সফল হতে পারবে। এর পাশাপাশি, স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উদ্যোক্তা শিক্ষা এবং ব্যবসা পরিচালনার প্রশিক্ষণও আরও বাড়ানো উচিত।
ডিজিটাল সংযোগের মাধ্যমে তরুণরা শুধু স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারে। সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা। জেনারেশন জেড তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতার ভিত্তিতে অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করতে পারবে। দেশের ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নত করতে সরকারি উদ্যোগ এবং সেবার মান বৃদ্ধির মাধ্যমে, বাংলাদেশের তরুণরা বিশ্বের যেকোনো বাজারে তাদের স্থান প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শ্রমবাজারের আধুনিকায়নে সরকারের নানা ধরনের নীতি এবং সংস্কার আনা জরুরি। প্রথমত, সরকারকে দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামগুলোতে বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে তরুণরা প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, শ্রমিকদের জন্য একটি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে তাদের কর্মজীবনের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়। তৃতীয়ত, সরকারের উচিত নতুন শিল্প এবং উদ্যোক্তা খাতে প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য প্রণোদনা দেওয়া, যাতে তরুণরা নতুন নতুন উদ্যোগে বিনিয়োগ করতে পারে। অবশেষে, দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করাও গুরুত্বপূর্ণ, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং শিল্পখাতের প্রসারে সহায়ক হবে।
এইভাবে, বাংলাদেশে ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান পরিকল্পনা এবং সংশ্লিষ্ট নীতিগত সংস্কার তরুণদের জন্য একটি উন্নত এবং সুষ্ঠু শ্রমবাজার গড়তে সাহায্য করবে, যেখানে তারা তাদের দক্ষতা এবং সৃজনশীলতার পূর্ণ ব্যবহার করতে সক্ষম হবে।
জেনারেশন জেড এর দক্ষতা এবং মানসিকতা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান খাতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। এই প্রজন্ম ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং নতুন ধারণায় পারদর্শী, তাদের উদ্যোক্তা মানসিকতা এবং সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি দেশীয় শ্রমবাজারকে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দিতে পারে। তাদের প্রযুক্তি, সামাজিক দায়বদ্ধতা, এবং সৃজনশীল চিন্তার মাধ্যমে বাংলাদেশের কর্মসংস্থান ক্ষেত্রে নয়া বিপ্লব আসতে পারে। তবে, তাদের এই সম্ভাবনার পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষার মান এবং প্রশিক্ষণের উন্নয়নের মাধ্যমে।
ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে বিদ্যমান।
যেখানে প্রযুক্তির উদ্ভাবন, নতুন শিল্পের বৃদ্ধি, এবং উদ্যোক্তা সংস্কৃতির বিকাশ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে, সেখানে দক্ষতার ঘাটতি, বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অস্থিরতা কিছু চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করছে। এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে সরকারের দায়িত্ব আরও বড় হয়ে উঠেছে।
সঠিক পরিকল্পনা ও নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল।
যদি সরকার শিক্ষা ব্যবস্থায় দক্ষতা ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, উদ্যোক্তা সংস্কৃতির বিকাশ, এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজের সুযোগ তৈরি করে, তবে জেনারেশন জেড তাদের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি, দেশের অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা উন্নত করলে, বাংলাদেশের শ্রমবাজার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে এবং এই প্রজন্মের জন্য বহুমাত্রিক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
সুতরাং, জেনারেশন জেড-কে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সুযোগ প্রদান এবং সরকারের নীতি সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি নতুন অধ্যায় রচনা করতে পারবে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী