নিজস্ব প্রতিবেদক: জুলাই আন্দোলনের বছর পার না হতেই মানুষ কেন বলছে, জুলাইয়ের স্পিরিট হারাতে বসেছে, তা বোঝা জরুরি বলে মনে করেন লেখক ও চিন্তক সলিমুল্লাহ খান।
এ আন্দোলন নিয়ে আরো বেশি বই প্রকাশ করার কথাও বলেছেন তিনি।
শনিবার (২৬ এপ্রিল) ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) থেকে প্রকাশিত একটি গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এসে তিনি এ মনোভাব তুলে ধরেন। রাজধানীর ফার্মগেটে ইউপিএলের প্রধান কার্যালয়ে এ অনুষ্ঠান হয়।
শিবলী আজাদ ও মিনহাজুল ইসলাম সম্পাদিত গ্রন্থটির নাম ‘পনেরো সমন্বয়কের সাক্ষাৎকার’। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া এ ১৫ সমন্বয়ক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সলিমুল্লাহ খান বলেন, এ বই যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে আমার দ্বিমত নেই। জুলাই আন্দোলন নিয়ে আরো বই হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ ছিল বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে, আর এবারের আন্দোলন হয়েছে দেশের শক্তির বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের যে মূল মন্ত্র ছিল- তা হল সাম্য ও মানবিক মর্যাদা। সেই মূল মন্ত্রই আবার উচ্চারিত হয়েছে জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে।
সলিমুল্লাহ খান বলেন, জুলাই আন্দোলনে অনেক শিক্ষক দাঁড়িয়েছিলেন, তার চেয়েও বেশি শিক্ষক বিরোধিতা করেছিলেন। জুলাই আন্দোলনকে পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাগ না করার কথাও বলেন তিনি।
বইটি প্রসঙ্গে ইউপিএল বলছে, জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলি শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা নয়, বরং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসে একটি অসাধারণ সংযোজন।
ফ্যাসিবাদী সরকার ও তার সব রাষ্ট্রীয় কলকব্জার বিরুদ্ধে কীভাবে এ আন্দোলনটি গড়ে উঠলো, কীভাবে মরিয়া প্রতিরোধ গড়ে উঠলো, সেই অনুসন্ধানের একটি প্রয়াস এই সাক্ষাৎকারের সংকলনটি।
বৈষম্যবিরোধী সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ জন সমন্বয়কের নিজের মুখ থেকেই অজস্র প্রশ্নের উত্তর আমরা এ গ্রন্থে জানা যাবে বলেও জানায় ইউপিএল।
অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, সাধারণভাবেই অনেকে বলছেন, এ আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছেন, নানা শ্রেণির মানুষ অংশ নিয়েছেন। তারা কেন অংশ নিয়েছেন, সেটা বোঝা খুব জরুরি। নানা রকম সম্পর্কের জায়গা থেকে অনেকে যোগ দিয়েছেন। কোনো বাবা-মা এসেছেন, সন্তান রাস্তায় আছে বলে, মানে সন্তানের পাশে দাঁড়াতে। অপেক্ষাকৃত জুনিয়ররা এ আন্দোলনে যোগ দিয়ে সিনিয়রদের যোগ দিতে বাধ্য করেছেন যে প্রক্রিয়ায়, এটাও বোঝা জরুরি।
জুলাই আন্দোলন যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিল, সেই বৈষম্যই এখন আন্দোলনকে হাইজ্যাক করে নিচ্ছে। আট মাসেই দেখা গেল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে ‘ব্রাহ্মণ’, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি হয়েছে ‘শূদ্র’, আর নারীরা হয়েছে ‘নমশূদ্র’। এ ধরনের বৈষম্য কেবল সেই স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীকেই শক্তিশালী করছে।
-জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা
জুলাই আন্দোলন যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিল, সেই বৈষম্যই এখন আন্দোলনকে হাইজ্যাক করে নিচ্ছে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা।
তিনি বলেন, আট মাসেই দেখা গেল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে ‘ব্রাহ্মণ’, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি হয়েছে ‘শূদ্র’, আর নারীরা হয়েছে ‘নমশূদ্র’। এ ধরনের বৈষম্য কেবল সেই স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীকেই শক্তিশালী করছে।
আন্দোলন কোনোভাবেই সফল হত না, যদি নারীরা পথে না আসত। যদি বেরসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পথে না আসত এবং সাধারণ মানুষ পথে না আসত।
এ আন্দোলন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা পাল্টে দিয়েছে জানিয়ে এ শিক্ষক বলেন, আমাদের সমাজে কিছু ধারণা ছিল, যে সমাজের একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির ছেলেমেয়েরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এখানে যারা পড়েন, তাদের রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণা নেই। সে ধারণাটা জুলাই আন্দোলনে পাল্টে গেছে।
এই আন্দোলনের আরেকটি বিশেষ দিক হল নারীর অংশগ্রহণ। তাদের ছাড়া এ আন্দোলন সফল হত না। ছাত্র-জনতা ‘ডিসকোর্স’ দিয়ে মূলত নারীর অংশগ্রহণকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
বাদ দেওয়ার রাজনীতির বিরুদ্ধেই জুলাই আন্দোলনের স্পিরিট ছিল জানিয়ে স্নিগ্ধা বলেন, প্রথমে নারীকে তার কৃতিত্ব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। পরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি একটি চক্র, এর মধ্য দিয়েই জুলাই স্পিরিটকেই বাদ দেওয়া হচ্ছে। বইটিতে নারী সমন্বয়কের ভূমিকা আরো বেশি থাকা উচিত ছিল বলেও মনে করেন স্নিগ্ধা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ফারহান হাসান বর্ণ বলেন, জুলাই আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে ভূমিকা রেখেছে, তারা পরবর্তী সময়ে মূল্যায়ন পায়নি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সব সময় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে কোণঠাসা করে রাখে।
আমরা সব রকম বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, কিন্তু এখন এসে দেখছি আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। জুলাই আন্দোলনের রক্তের ওপর দিয়ে যাদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসিয়েছি, তারা জুলাইয়ের স্পিরিটকে বা আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে পারছে না।
বইয়ের সম্পাদক শিবলী আজাদ ও মিনহাজুল ইসলাম এবং ইউপিএল সংশ্লিষ্টরা অনেকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।