নিজস্ব প্রতিবেদক: জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোট প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো আবারো দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এটি নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা, এর মাধ্যমে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে। তাদের দাবি, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দলগুলো।
মূলত সনদ বাস্তবায়নে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজের বক্তব্যকে কেন্দ্র করেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ১০৬ ধারা অনুসরণের কথা বলেছেন।
গতকাল বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের মধ্যাহ্ন বিরতিতে ব্রিফিংয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। অবশ্য বিএনপি ও জামায়াত নেতারা এ নিয়ে এখনও মন্তব্য করেননি।
এনসিপি: জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে আমরা ১০৬ ধারা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত চাই না। আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাই। তা এই সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনার পর আমাদের মতামত জানাবো।’
এবি পার্টি: আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘সাংবিধানিক আদেশ বা গণভোটের প্রস্তাবকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখতে চাই। বিশেষ করে আমরা আগে থেকেই গণভোটের কথা বলেছি। সেটি নির্বাচনের আগে হোক বা পরে হোক। গণভোট হতে হবে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না হলে হবে না। কারণ, যেখানে এখনই বিষয়টি নিয়ে মতবিরোধ, সেখানে পরবর্তী সরকার করবে কিনা সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে।’ তিনি মনে করেন, নির্বাচন যত দেরি হবে- বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি ততই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এলডিপি: লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির মহাসচিব অ্যাডভোকেট রেদোয়ান আহমেদ বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে কমিশন বিশেষজ্ঞদের মতামত বিষয়ে কথা বলেছেন। নতুন করে জুলাই ঘোষণার ২২ নম্বর অনুচ্ছেদ সামনে আনা হয়েছে। অথচ এর কোনো সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেই।’ তিনি আরো বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে ১০৬ অনুযায়ী আদালতের নির্দেশনার ভিত্তিতে। এটি আমাদের সংবিধানকে পাশ কাটানোর চেষ্টা। এটার পক্ষে আমরা নেই। পরবর্তী নির্বাচন হবে, আমরা সেটাই চাই। নতুন কোনো আদেশের বিষয় চাই না। তিনি বলেন, যেসব প্রস্তাব সাংবিধানিক না, তা সরকার আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারে। সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদে কার্যকর হতে পারে।
গণঅধিকার পরিষদ: গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে আবারো বিভাজনের দিকে উসকে দিয়েছে। সরকার নিজেরা সিদ্ধান্ত না নিয়ে আবারো দলগুলোর দিকে বল ঠেলে দিয়েছে। দায় নিতে চাচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশের প্রস্তাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এটি সরকারের কথা নয়। এ নিয়ে হয়তো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আরো আলোচনা হবে। তিন প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘যদি জনগণ এটি না মানে তাহলে কী হবে। আওয়ামী লীগের যারা ভোট দেবে তাদের ঠেকানো কঠিন।’
রাশেদ খান বলেন, সর্বসম্মতিক্রমে যা বাস্তবায়ন হয়, তাতে আমাদের আপত্তি নেই। সরকার আবার দলগুলোর মধ্যে বিভাজন উসকে দিচ্ছে। সরকার দায় নিতে চায় না। তিনি মনে করেন, এভাবে সময় বাড়তে থাকলে আওয়ামী লীগের ফিরে আসা সহজ হবে। তাই সবাইকে ছাড় দিতে হবে। সংস্কার ও বিচার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত। বিষয়গুলো সরকারকে দেখতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলন: গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী বিশেষজ্ঞদের মতামতে সাংবিধানিক আদেশ ও গণভোটের কথা বলা হচ্ছে। বলা হয়েছে জুলাই ঘোষণার ২২-এর ধারা অনুযায়ী এটি করা হবে। অথচ ২৫-এর ধারা অনুযায়ী এটি স্ববিরোধিতা। আবার গণভোটের কথা বলা হচ্ছে। আমরা মনে করি, বিদ্যমান সরকার যেভাবে ১০৬ অনুচ্ছেদে অনুযায়ী ক্ষমতায় আছেন, সে রকম একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কিনা। এরপর একটি অধ্যাদেশ হতে পারে। তিনি বলেন, ‘এমন কোনো পথ নেওয়া উচিত নয়, যাতে বুঝা যায় তা কোনো কর্তৃত্বের মাধ্যমে হচ্ছে। এ বিষয়ে ঐকমত্য হওয়া দরকার।’
জেএসডি: জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘আইনি ভিত্তি না দিয়ে করলে সনদ বাস্তবায়ন কঠিন হবে। এক্ষেত্রে ১০৬ অনুসরণ করা যেতে পারে। তবে এর সুরক্ষার জন্য যে পদ্ধতির কথাই বলা হোক আমরা সেটির পক্ষে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ: জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি বলেন, ‘সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো আগামী সংসদে পাস করতে হবে। আর একমত হওয়া বিষয়গুলো অধ্যাদেশের মাধ্যমে করতে হবে। তা ছাড়াও সংবিধানের ১০৬ অনুযায়ী প্রয়োজনে সনদ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। আমরা মনে করি গণভোট সমস্যা আরো বাড়াবে।’
বাসদ (মার্কসবাদী): বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা বলেন, ‘গণভোটের বিষয়টি সংবিধানে নেই। এটি নির্বাচিত সংসদ করবে। আমরা সনদ বাস্তবায়ন চাই। তবে সুরক্ষার জন্য এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন কেউ চ্যালেঞ্জ না করতে না পারে।’
ভাসানী জনশক্তি পার্টি: ভাসানী জনশক্তি পার্টির মহাসচিব আবু ইউসুফ সেলিম বলেন, ‘সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জুলাই ঘোষণার ২২ ধারা ২৫-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমরা মনে করি, ১০৬ ধারা অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট মতামত দেবেন। আর পরবর্তী সংসদ তা কার্যকর করবে।’
সানা/আপ্র/১৭/০৯/২০২৫