প্রত্যাশা ডেস্ক: রিকশার সামনের সিটে হেলে পড়ে আছে নিথর এক তরুণ। কয়েক কদম দূরে ট্যাংকের ওপর থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হচ্ছে আরেকটি লাশ। পাশেই ভ্যানে সাজানো লাশের স্তূপ। এদিকে এক পাশে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আবু সাঈদ আর মুগ্ধ বলছে-পানি লাগবে, পানি।
গা ছমছম করা এ দৃশ্যগুলো বাস্তব নয়, তবে হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মতো এক মঞ্চায়ন। আলো-ছায়ার খেলায়, শব্দ আর আবহে এতটাই জীবন্ত করে তোলা হয়েছে, যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে জুলাইয়ের রক্তাক্ত সেই দিনগুলোতে।
শুক্রবার (১ আগস্ট) থেকে রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজন করে ‘জুলাই জাগরণ’ নামের ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক উৎসব। আয়োজনে ফুটে উঠেছে ২০২৪ সালের সেই রক্তাক্ত জুলাইয়ের প্রতিরোধ, শহীদের আর্তনাদ এবং জনতার পদচারণার প্রতিচ্ছবি। শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে রক্তাক্ত ইতিহাসের মঞ্চায়ন, সবকিছুতেই ছিল ব্যতিক্রমী আবেগ। আয়োজকরা বলছেন, এটি কোনো সাধারণ সাংস্কৃতিক আয়োজন নয়। এটি জুলাই বিপ্লবের প্রতি আবেগের ক্ষুদ্র বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এর মাধ্যমে তারা প্রতিবাদের পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন। সেইসঙ্গে ছিল ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের চোখে তুলে ধরার চেষ্টা।
শিশুদের জন্য এক ভিন্ন রকম আয়োজন: ‘জুলাই জাগরণ’ নামের এ আয়োজনে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য যেমন সাংস্কৃতিক উপস্থাপনা রাখা হয়েছে, শিশুদের জন্যও করা হয়েছে রঙিন আয়োজন। বাহারি রাইড, খেলাধুলা-ছোটাছুটি ছাড়াও রয়েছে বায়োস্কোপ। সবমিলিয়ে বর্ণিল এক আলোকসজ্জায় মুখর করে তোলা হয়েছে উদ্যানের একাংশ। পাঁচ বছর বয়সী তাহমিনা এসেছিল তার মা নুসরাত জাহানের সঙ্গে। নুসরাত বললেন, ‘আমার মেয়ে এখানে এসে গান, খেলাধুলা, বায়োস্কোপ দেখল। আমি আবার ইতিহাসের অংশটাও দেখলাম– দুই প্রজন্মের জন্যই একসঙ্গে কিছু শেখার ও বোঝার জায়গা হয়েছে আজ।’
বাবার সঙ্গে ঘুরতে আসা দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইফুল্লাহ বলেন, ‘এখানে এসেই শুরুতে পুরো আয়োজনটা ঘুরে দেখেছি। দেখে মনে হয়েছে পুরো আয়োজনটা সাজানো হয়েছে জুলাই বিপ্লবের স্মরণে। আমরা রংপুরের আবু সাঈদের কথা শুনেছি, এখানে এসে তার প্রসারিত দু’হাতের চিত্রায়ন দেখেছি। রিকশা আর ভ্যানের ওপর লাশ দেখেছি। আমরা জানি, ওটা সত্যিকারের লাশ না কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সত্যিই কারো ভাই পড়ে আছে। তখন ভয় পেয়েছিলাম।’
পাশ থেকে এক মা বললেন, ‘বাচ্চারা খেলছে, গাইছে-ভালো লাগছে। কিন্তু এই অনুষ্ঠান আমাদের মনে করিয়ে দিলো স্বাধীনতা শুধু আনন্দে পাওয়া যায় না, এর পেছনে কষ্ট থাকে, লাশ থাকে।’ মনিরুল ইসলাম নামক আরেক দর্শনার্থী বলেন, ‘জুলাই জাগরণ আয়োজনের মূল লক্ষ্য ছিল সেই ভয়াবহতার স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা। কিন্তু আয়োজকরা এটিকে করেছেন বহুমাত্রিক। শিশুদের জন্য রাখা হয়েছে রাইড, বায়স্কোপ, বেলুন, মুখে চিত্রাঙ্কনসহ নানা আয়োজন। সবমিলিয়ে আমাদেরও ভালো লাগছে, বাচ্চারাও আনন্দ করছে।’
চার দিনের উৎসবে ফুটে উঠেছে বহু দিনের গল্প: ‘জুলাই জাগরণ’ নামের এ আয়োজন চলবে চারদিন। এ আয়োজনে পুরো জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের দিনগুলো ফুটে উঠেছে। দর্শনার্থীরা বলছেন, হয়ত আয়োজনটা চতুর্থ দিনে গিয়ে শেষ হয়ে যাবে কিন্তু যারা এই অসাধারণ আয়োজনটা করেছে, তারা ও আয়োজনটি আমার মতো অনেকের মনে জায়গা করে নিয়েছে চিরকালের মতো।
আয়োজন প্রসঙ্গে ফখরুদ্দিন আহমেদ নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, কিন্তু এত হৃদয়ছোঁয়া কোনো রাজনৈতিক শিল্পমঞ্চ কখনো দেখিনি। প্রতিটি চরিত্র যেন জীবন্ত, আমি শুধু দেখিনি, ভেতর থেকে নাড়া লেগেছে।’
তিনি বলেন, ‘দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়ানো আবু সাঈদ আর মুগ্ধর পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দৃশ্যটা ছিল খুবই নীরব অথচ শক্তিশালী। দর্শকদের চোখে চোখে পানি দেখেছি। এটি সত্যিই দীর্ঘদিন মনে রাখার মতো একটা আয়োজন।’ মো. রিয়াজুল ইসলাম নামের আরেক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের সময় দেশে থাকার সৌভাগ্য হয়নি, মোবাইলে-টিভিতে সেই বিপ্লব দেখেছি। কিন্তু এখানে এসে যেন সেই সময়টায় ফিরে গেলাম। আর মনে হচ্ছিল আমি এখন সেই জুলাইয়ের দিনগুলোতেই আছি। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ছেলে-মেয়েগুলোর অভিনয় আমার চোখে জল এনে দিয়েছে।’
ইতিহাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই আয়নাঘর: জুলাই জাগরণ উৎসবের অন্যতম শক্তিশালী উপস্থাপনাগুলোর একটি ছিল ‘আয়নাঘর’– যেখানে তুলে ধরা হয়েছে এক ভয়াবহ, অথচ নীরব বাস্তবতা। একসময়ের আলোচিত এই নির্যাতন কেন্দ্রটি শেখ হাসিনার শাসনামলে বিরোধী রাজনীতির নামে নিপীড়নের প্রতীক হয়ে ওঠে। মঞ্চে অন্ধকারে মোড়ানো একটি ঘরের ভেতর বসে থাকা মানুষেরা কথা বলছেন না, চিৎকার করছেন না– তবু সেই নীরবতা গায়ের রোম দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। দর্শক বুঝতে পারছেন, কী ভয়াবহতা নিয়ে এসেছে এই নিস্তব্ধতা।
‘এই দৃশ্যগুলো কাল্পনিক না, বাস্তব। আমি জানি আয়নাঘরের কথা কিন্তু এখানে এসে একেবারে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম কী ভয়ংকর ছিল সেটা’, বলছিলেন আয়োজনে আসা শিক্ষক হাসান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘শুধু রাজনৈতিক নেতা নয়, একজন মানুষকে বছরের পর বছর এভাবে অদৃশ্য করে রাখা সভ্য সমাজে কল্পনাও করা যায় না।’ স্কুলছাত্রী জারিনের চোখেও ছিল বিস্ময় ও ভয়। ‘আমি ভাবছিলাম এগুলো সিনেমার মতো কিন্তু মা বললো এগুলো একদম সত্যি ঘটেছে। তখন ভয় লেগেছিল’, বলে সে।
শুধু সাংস্কৃতিক উৎসব নয়, জাতির স্মৃতি-জাগরণের আয়োজন: সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর প্রচার সম্পাদক সাইফুল মামুন বলেন, ‘জুলাই জাগরণ শুধু একটি সাংস্কৃতিক উৎসব নয়, এটি জাতির স্মৃতি-জাগরণের আয়োজন। আমরা ইতিহাসকে শুধুই বলে যেতে চাইনি, চেয়েছি মানুষ যেন ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখে, উপলব্ধি করে এবং নিজের ভেতরে এক নতুন প্রশ্ন জাগায়– আমরা কীভাবে এখানে এলাম আর কোথায় যাচ্ছি?’ তিনি বলেন, ‘আয়নাঘর থেকে রক্তাক্ত জুলাই-আগস্ট অথবা শহীদদের প্রতিকৃতি– প্রতিটি উপস্থাপন ছিল আমাদের এক অন্তর থেকে জন্ম নেওয়া আত্মপ্রকাশ। এই মঞ্চে যে কণ্ঠ উঠেছে তা শুধু সংগীতের বা আবৃত্তির নয়, তা ছিল প্রতিরোধের, মমতার আর দায়বদ্ধতার কণ্ঠ।’ সাইফুল মামুন আরো বলেন, ‘আমরা যারা আয়োজন করেছি, তাদের কাছে এটি শুধুই একটি চার দিনের আয়োজন নয়। এটি ছিল একটি শুদ্ধ আত্মচর্চা, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা। যারা এই আয়োজনে এসেছেন, তারা হয়ত এখানে একটি মুহূর্ত কাটিয়েছেন কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি তারা ফিরে গেছেন গভীরতর প্রশ্ন, ব্যথা ও বোধ নিয়ে। এটাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য।’