- মুস্তাফিজুর রহমান রূপম
“মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্য, অতএব কথা না-দেওয়াই সব চেয়ে নিরাপদ।”
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হৈমন্তী’ গল্পের পিতা-পুত্রীর মধ্যে কথোপকথনের বহুল পরিচিত এই সংলাপটি মনে করিয়ে দিলেন বাসদ নেতা রাজেকুজ্জামান রতন। হৈমন্তী তার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, বাবা ওর কথা রাখবে কিনা? উত্তরে বাবা বললেন, “মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্য, অতএব কথা না-দেওয়াই সব চেয়ে নিরাপদ।” তিন দশকের পরিচিত রতন ভাইয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, জুলাই সনদ নিয়ে-যাকে খোদ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজও একই সঙ্গে জাতীয় সনদ বলেও অভিহিত করেছেন। অবশ্য সেই সঙ্গে জুলাই ঘোষণা নিয়েও আলোচনা চলছে।
রতন ভাইয়ের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, সেটা গত ৩০ জুন প্রায় সন্ধ্যেবেলার কথা। তিনি আমাদের উত্তর-জনপদের দিনাজপুর শহরে এসেছিলেন ‘সাঁওতাল হুল’ দিবসে অতিথি হয়ে। সেদিন ছিল ১৭০তম হুল দিবস। ১৮৮৫ সালের এই দিনে তৎকালীন বাংলার সাঁওতাল জনগোষ্ঠী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের বিদ্রোহ করেছিল, যা ইতিহাসে সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত এবং সাঁওতালরা দিবসটি ‘সাঁওতাল হুল’ বলে থাকে।
হুল শব্দের অর্থ ‘বিদ্রোহ’, সাঁওতালদের সঙ্গে আলাপে আমার মনে হয়েছে হুল শব্দটিকে মুক্তির যুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধও বলা চলে। যদিও সাঁওতালদের মুক্তির ওই যুদ্ধ ব্যর্থ হয়েছিল। ওই বিদ্রোহের বীরযোদ্ধা সিধু ইংরেজদের গুলিতে নিহত হন। তার ভাই কানু, যাকে সাঁওতালরা কানহু বলে ডাকে, তাকে বিদ্রোহ সংগঠিত করবার দায়ে ফাঁসি দেওয়া হয়। সিধু, কানু, চাঁদ, ভৈরব, ফুলো ও ঝানো মুর্মুর নেতৃত্বে গড়া হুল শুধুমাত্র ভারত নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল আন্দোলনের উদাহরণ। বিদ্রোহের দুই শীর্ষ নেতা সিধু ও কানুর বোন ফুলো বা ফুলমণি মুর্মুকে ব্রিটিশ সেপাইরা নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করে লাশ রেললাইনে ফেলে রেখে গিয়েছিল। শাসকের শোষণ, অত্যাচার, বঞ্চনার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাওয়া এই সংগ্রামী ভাই-বোনদের স্মরণে দিনাজপুর কাহারোল উপজেলার কান্তনগর মোড়ে কান্তজীউ মন্দিরে যাওয়ার পথে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছিল। জুলাই অভ্যুত্থানে বিজয় অর্জনের দিন গত বছর ৫ আগস্টে সেই ভাস্কর্যটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
জুলাই সনদ কী সুশাসনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবে?
উত্তরটা আসলে হ্যাঁ বা না দিয়ে দেওয়া কঠিন।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট এখন আর কেবল মতভিন্নতার সংকট নয়-
এটি হয়ে উঠেছে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক বয়ানের যুদ্ধক্ষেত্র।
১৭০তম হুল দিবস স্মরণে দিনাজপুর ইন্সটিটিউট মাঠে বাসদ আয়োজিত জনসভায় এখনও ভাস্কর্যটি পুননির্মাণ না করায় আক্ষেপ জানানো হয়েছে। ৩০ জুন শেষ বিকেলে জনসভায় গিয়ে দেখলাম রাজেকুজ্জামান রতন বক্তব্য রাখছেন-তিনি বরাবরই সুবক্তা। মুগ্ধ হয়ে শুনলাম তার বক্তব্য। শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলের প্রায় দেড় দশক বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে এই বাসদই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে। আন্দোলনে থাকা অন্য বামপন্থীদের অবদানকে অস্বীকার করার কোনো ইচ্ছে আমার এই বক্তব্যে নেই, আমি যেমনটা দেখেছি, অনুভব করেছি, সেটাই বললাম। হাসিনার পতনের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে দলটিকে ক্ষুব্ধ মনে হলো, অন্তত রাজেকুজ্জামান রতনের বক্তব্যে সেই ক্ষোভের প্রকাশ দেখেছি।
জনসভা শেষ হলে রতন ভাইয়ের সঙ্গে চা সহযোগে বেশ কিছু সময় আড্ডা দেওয়ার সুযোগ হয়। এক পর্যায়ে জুলাই সনদ নিয়ে জানতে চাইলে মৃদু হেসে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পের উদ্ধৃতিটি দিলেন। সেই সঙ্গে বললেন নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের কথা–১৯ নভেম্বর তিন জোটের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়েছিল। একাত্তরে স্বাধীনতার আগেই ৬ দফা এবং ১১ দফা ঘোষণার কথা স্মরণ করেন। তার কথায়, যে কোনো অভ্যুত্থান, বিপ্লব হয় আকাঙ্ক্ষা থেকে। স্বপ্ন থেকে। বেশির ভাগ স্বপ্ন অবাস্তবায়িত রয়ে যায়। চব্বিশের অভ্যুত্থানে দেড় দশকের সমস্ত ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল হাসিনা সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে। যেহেতু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকেই গণ অভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয়েছিল, তাই জুলাই সনদ রচিত হলে তা হতে হবে বৈষম্যবিরোধী এবং সাম্যের ভিত্তিতে। সাম্যের কথা উঠলে চলে আসে নজরুলের কবিতার কথা–“গাহি সাম্যের গান–মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।” সমাজে যদি এই সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে?
কিন্তু বিপ্লব বারবার বেহাত হয়ে যায়। সরল মন নিয়ে যারা আন্দোলনে যায়, তাদের কেউ কেউ শহীদ হয়, বাকিরা ঘরে ফিরে আসে। ফিরে যায় নিজ নিজ কাজে। আর যারা ধূর্ত তাদের ভোল পাল্টে যায়। এই আমি মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর আগে যার জন্ম, যে আমার বড় হওয়া মুক্তিযুদ্ধে সঙ্গে, তার যদি মনে হয় ‘৫৪ বছর কেটে গেল হায় সুশাসন দেখিনি কভু’ তবে কি মিথ্যে বলা হয়ে যাবে?
জুলাই সনদ কী সুশাসনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবে? উত্তরটা আসলে হ্যাঁ বা না দিয়ে দেওয়া কঠিন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট এখন আর কেবল মতভিন্নতার সংকট নয়-এটি হয়ে উঠেছে পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক বয়ানের যুদ্ধক্ষেত্র। এই যুদ্ধক্ষেত্রের কেন্দ্রে এখন দুটি সনদ-জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদকে অভিন্ন সনদ বলে ধরে নেওয়া হলেও আগেই বলেছি জুলাই ঘোষণাপত্র বলে কিছু একটা বাকি রয়ে যায়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বিবিসি বাংলার সঙ্গে জুলাই ও জাতীয় সনদ নিয়ে স্পষ্ট করেই বলেছেন। তার বক্তব্য “এটা আসলে জাতীয় সনদ। আবার জুলাই সনদ এই অর্থে, যাতে জুলাই সনদ বললে আগামীতে বোঝা যাবে ২০২৪ জুলাইয়ে কি ঘটেছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে এই সনদ করতে হয়েছে।”
তবে জুলাই ঘোষণাপত্র বলে কিছু একটা বাকি রয়ে যায় এবং জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের গড়া নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ইতোমধ্যে এ নিয়ে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে। জুলাই সনদ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশ্রুতি’ রক্ষা করতে না পারার অভিযোগ এনেছে তারা। কমিশন ঘোষিত সময়ের মধ্যে জুলাই সনদ না হলে আগামী ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে জুলাইয়ের ইশতেহার ও ঘোষণাপত্র প্রকাশের কথাও বলছে দলটি। পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক বয়ানের যুদ্ধক্ষেত্রটা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন পণ্ড করার চেষ্টা গিয়ে ঠেকে কিনা সংশয় দেখা দিয়েছে এখন।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৩১ ডিসেম্বর জুলাই প্রোক্লেমেশন বা গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল। তখনও এনসিপি নামক নতুন রাজনৈতিক দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটেনি এবং ভবিষ্যতে যাদের নেতৃত্বে এনসিপি গঠিত হবে, তারা অন্তর্বর্তী সরকারের আশ্বাসে সেই অবস্থান থেকে সরে এসেছিল। তখন সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথাও বলা হয়েছিল, যা নিয়ে পরে সরকারের তরফে আলাপ হয়নি আর।
এখন ঐকমত্য কমিশন বলছে, জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ দুটি একেবারেই আলাদা বিষয়। কেননা সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সনদ বা সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি হবে, সেটি জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ। তারা বলছে, জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র তৈরির কাজ ঐকমত্য কমিশনের নয়, সেটি সরকার ও রাজনৈতিক দল মিলে করবে। শুধুমাত্র জুলাই সনদ প্রস্তুত করবে ঐকমত্য কমিশন। বলে রাখা ভালো এই ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস, যদিও কার্যত আমরা সহ-সভাপতি আলী রীয়াজকে নেতৃত্ব দিতে দেখছি।
জুলাই ও জাতীয় সনদের লক্ষ্য অভিন্ন বলা হলেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এটি এখনও রাজনৈতিক ঐকমত্যে পরিণত হয়নি। অথচ এর মধ্যেই উচ্চারিত হচ্ছে নির্বাচনের সময়সূচি। এই বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠে-সনদের সংস্কার প্রস্তাব ও ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কোনটি মুখ্য, কোনটি মুখোশ?
গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জুলাই সনদের কথা বলেছেন। তার ভাষায়, ‘জুলাই সনদ হলো একটি প্রতিশ্রুতি’-একটি জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র নির্মাণের অঙ্গীকার, যেখানে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার ঐকমত্যকে লিখিতভাবে তুলে ধরা হবে।
এই বক্তব্যে যে সম্ভাবনার ইঙ্গিত আছে, বাস্তবতা তার কতটুকু প্রতিফলন ঘটাতে পারবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
মূলত, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে ১১টি কমিশন গঠন করে। এসব কমিশনের মাধ্যমে গঠনতন্ত্র, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন খাত নিয়ে সুপারিশ তৈরি করা হয়। ঐকমত্য কমিশন পরে এই সুপারিশগুলোকে ভিত্তি করে গত কয়েক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসে।
এ পর্যন্ত ১৬৬টি সুপারিশ চিহ্নিত করে এগুলোর ওপর ভিত্তি করে আলোচনা চালানো হয়। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ মোট ৩০টির মতো রাজনৈতিক দল এ আলোচনায় অংশ নেয়। এটিই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি বিরল মুহূর্ত-যেখানে পারস্পরিক বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও এত সংখ্যক দল এক টেবিলে বসে সংস্কারের রূপরেখা নিয়ে মতবিনিময় করেছে।
ঐকমত্য কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এই ১৬৬টি সুপারিশের মধ্যে ৮০টিরও বেশি প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো সমন্বিতভাবে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, প্রায় অর্ধেকের বেশি ক্ষেত্রে নীতিগত একমত হওয়া সম্ভব হয়েছে-এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি।
এর বাইরে কমিশন আরো প্রায় ২০টি প্রস্তাবকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, এ ২০টির মধ্যে এখন পর্যন্ত ৫টি বিষয়ে স্পষ্টভাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তবে ৬ থেকে ৭টি বিষয়ে এখনও মতৈক্য হয়নি।
এই প্রক্রিয়াটিকে নিছক কাগুজে কাজ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বরং এটি আগামী দিনের নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সংস্কারের একটি বটগাছের চারা রোপণের প্রয়াস। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত ‘জুলাই সনদ’ কি বাস্তব কোনো রূপ নিতে পারবে? নাকি এটি কেবল একটি প্রতীকী ঘোষণায় রূপান্তরিত হবে?
আরেকটি প্রশ্ন-জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণার মধ্যে পার্থক্য কী?
তবে এখানেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি-এই সনদ ও জুলাই ঘোষণা চূড়ান্তকরণ এবং ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন-এগুলো কি একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত? যদি সনদ ঘোষণার পরও এনসিপিসহ ইসলামপন্থীরা জুলাই ঘোষণা কেন করা হচ্ছে না, এমন অভিযোগ এনে প্রত্যাখান করে তখন বিএনপির অবস্থান কি হবে?
এই প্রশ্নটিই এখন রাজনীতির মূল জট ও জটিলতা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার আলোচনা শেষে স্পষ্ট ভাষায় বলে ফেলেছেন, “সব বিষয়েই যদি ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে শতভাগ একমত হতে হয়, তবে আলোচনার কি প্রয়োজন ছিল?”
এই এক বাক্যেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে সনদের কাঠামো। আলোচনা কি শুধুই সম্মতি আদায়ের উপায়? বিরোধ কি এখানে শুধুই অপ্রয়োজনীয় ‘ডিসেন্ট’? নাকি প্রকৃত আলোচনা মানেই মতপার্থক্য থেকে যৌক্তিক সমঝোতা নির্মাণ?
এই প্রশ্ন রাজনৈতিক বাস্তবতায় আরো জরুরি হয়ে দাঁড়ায় যখন দেখা যায়, রাজনীতির মাঠে সক্রিয় সবচেয়ে বড় দল বিএনপির মধ্যে কিছু মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে মনস্তাত্ত্বিক বাধা এখনও বিদ্যমান। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিতকরণ কিংবা সাংবিধানিক নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘দলীয় নিয়ন্ত্রণ’ শিথিল করার মতো বিষয়ে দলটি দ্বিধান্বিত-এই দ্বিধাই আগামী নির্বাচনের পথকেই অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা রয়ে যায়।
অন্তর্বর্তী সরকার তাদের বক্তব্যে বলছে-আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে একটি নতুন নির্বাচন আয়োজন সম্ভব যদি একটি ‘গণগ্রাহ্য, সমঝোতাভিত্তিক রূপরেখা’ চূড়ান্ত হয় আগস্টের মধ্যেই। অর্থাৎ জাতীয় সনদকে একটি সম্ভাব্য ‘প্রাক-নির্বাচনি চুক্তি’র বেসলাইন হিসেবে বিবেচনা করছে তারা।
মুখ্যত এনসিপি, পরোক্ষে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের মতো রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান হচ্ছে-এই সনদকে তাদের চূড়ান্ত চাহিদা (সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি) পূরণের অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করা। কাজেই সনদের রূপ ও বাস্তবায়নের সময়সীমা নিয়ে স্পষ্ট রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি না হলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠান নতুন করে অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে।
লেখক: কলামিস্ট