আবু বকর মুহাম্মদ মুঈন উদ্দীন
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জুলাই অভ্যুত্থান এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যদিও এটি রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে আড়ালে রাখা হয়েছে, তবু জনগণের চেতনায় এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক প্রতীক হয়ে আছে। ১৯৭০ দশকের রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীকরণ, দুর্নীতি ও প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়, তখনই রাজপথে নামে একদল তরুণ, শ্রমিক, কৃষক ও প্রগতিশীল শক্তি। জুলাইয়ের সেই অভ্যুত্থান মূলত প্রতীকী বিদ্রোহ ছিল একনায়কতন্ত্র, শোষণ ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে।
অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রের বিরুদ্ধে জমে থাকা জনঅসন্তোষ, রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট, শিক্ষাব্যবস্থার সংকট এবং নিপীড়নের শাসনব্যবস্থা। জুলাইয়ের সেই রাজপথ রক্তাক্ত হয়েছিল, প্রাণ দিয়েছিল বহু সাহসী মানুষ। অনেকেই কারা-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, অনেকে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন চিরদিনের জন্য। তবে ইতিহাসের এক নির্মম পরিহাস হলো-এই ঘটনার অনেক নায়ক আজ বিস্মৃতির আড়ালে, আর সেই চেতনা আজ রাজনৈতিক মুনাফার হাতিয়ার।
চেতনা কীভাবে পণ্য হয়ে গেলো: আমাদের রাজনীতির এক বড় দুর্ভাগ্য হলো- যেখানে চেতনা হওয়ার কথা ছিল নীতি ও আদর্শের মানদণ্ড, সেখানে চেতনাই এখন হয়ে উঠেছে প্রদর্শনের বিষয়। জুলাই অভ্যুত্থানও এর ব্যতিক্রম নয়। বড় বড় ব্যানার, সেøাগান, মঞ্চের বক্তৃতা আর ফেসবুক-ইউটিউবের ফাঁপা বুলি-সব মিলিয়ে জুলাই এখন এক ধরনের ব্র্যান্ড। যে ব্র্যান্ডের পেছনে লুকিয়ে থাকে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কিছু গোষ্ঠী বা দল এই চেতনাকে নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা প্রমাণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এনসিপির ভাষ্য অনুযায়ী, যে তাদের দলে নাম লেখাবে, সে হবে ‘জুলাইযোদ্ধা’; আর যে আসবে না, সে ডিপস্টেইটের দালাল। এই মডেল নতুন কিছু নয়, এটি সেই পুরনো বৃত্তেরই পুনরাবৃত্তি।
এক সময় বলা হতো, আওয়ামী লীগের মেশিনে ঢুকলে বের হতো মুক্তিযোদ্ধা আর ঢুকতে না চাইলেই সে রাজাকার। আজ বলা হচ্ছে, এনসিপির লাইনে না থাকলে সে রাষ্ট্রের শত্রু। রাজনৈতিক চেতনা কখনো এভাবে একচেটিয়া হতে পারে না। চেতনা সর্বজনীন। এটি কোনো দল বা গোষ্ঠীর পুঁজিতে পরিণত হওয়ার কথা নয়।
ইতিহাস বিকৃতি ও প্রজন্মের বিভ্রান্তি: জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে যে বিকৃত ইতিহাস তৈরি হয়েছে, তা নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে। যেখানে জুলাইয়ের মূল চেতনা ছিল শোষণবিরোধিতা, ন্যায়ের পক্ষে লড়াই, মানুষের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা-সেখানে এখন শুনি সস্তা স্লোগান, দেখি ক্ষমতা পাওয়ার প্রতিযোগিতা। আজকের প্রজন্ম যখন ইতিহাস জানতে চায়, তখন তারা পায় সাজানো গল্প, বিকৃত ব্যাখ্যা। অথচ ইতিহাসের কাজ হলো প্রশ্ন জাগানো, সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো শেখানো। তা না করে ইতিহাসকে বানানো হচ্ছে ক্ষমতার হাতিয়ার।
জর্জ অরওয়েল তার কালজয়ী উপন্যাস ‘১৯৮৪’তে লিখেছিলেন- Who controls the past controls the future. Who controls the present controls the pas। আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতাও আজ সেই অরওয়েলের বয়ানে মিলে যাচ্ছে।
রাজনীতি ও চেতনার মানসিকতা: আমাদের রাজনীতি ক্রমেই হয়ে উঠছে নিছক এক মেশিন। এখানে নীতি নেই, আছে কৌশল; আদর্শ নেই, আছে সেøাগান। যে মেশিন একপাশে ঢুকালে বের হয় চেতনাধারী আর ঢুকতে না চাইলেই সে হয়ে যায় শত্রু। বিভিন্ন রাজনীতি সেই একই মডেলের পুনরাবৃত্তি। চেতনাকে কেন্দ্র করে দলীয়করণ, প্রতীকী প্রদর্শন আর শত্রু সৃষ্টি করা এর বৈশিষ্ট্য। আর এই প্রক্রিয়ায় চেতনা হারায় তার সর্বজনীনতা, হারায় নৈতিক উচ্চতা। আলবার্ট কামু লিখেছিলেন, The only way to deal with an unfree world is to become so absolutely free that your very existence is an act of rebellion। আমাদের সেই বিদ্রোহ প্রয়োজন- ভুয়া চেতনার মুখোশ খুলে সত্য ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়ানোর বিদ্রোহ।
রাজনৈতিক পণ্যায়নের ফল কী: রাজনীতিকে যখন চেতনার বাজারে পরিণত করা হয়, তখন তা দুই বিপজ্জনক ফল বয়ে আনে। প্রথমত, ন্যায়ের লড়াই হয়ে যায় কেবল প্রদর্শনী, বাস্তব কোনো পরিবর্তন হয় না। দ্বিতীয়ত, মানুষের প্রকৃত ইতিহাস জানার পথ বন্ধ হয়ে যায়, কারণ সব ইতিহাসই হয়ে ওঠে কোনো দলের বা গোষ্ঠীর একচেটিয়া গল্প। আজ জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা বাঁচাতে হলে দরকার এই বাজারি দোকান বন্ধ করা। দরকার চেতনাকে ফিরিয়ে আনা তার মূল জায়গায়-মানুষের লড়াইয়ে, ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় উচ্চারণে।
আমাদের দায়: জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের শিক্ষা দেয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহসের কথা। কিন্তু সেই শিক্ষা আমরা ভুলে যাচ্ছি। আমরা চেতনাকে পরিণত করেছি পণ্যতে। আমরা ইতিহাসকে বানিয়েছি ক্ষমতার বাণিজ্যের অংশ। সত্যিকার অর্থে যদি জুলাইয়ের চেতনাকে বাঁচাতে চাই, তাহলে আগে এই চেতনাবাজি বন্ধ করতে হবে। দল বা গোষ্ঠীর নন, চেতনা হতে হবে মানুষের। আমাদের প্রত্যেককে নিজেদের ভেতরের সেই ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর মানুষটিকে জাগাতে হবে। আত্মজাগরণই প্রকৃত রাজনীতি। অন্যকে জাগাতে সাহায্য করার চেয়ে বড় কাজ আর নেই। সেই বিশ্বাস নিয়েই আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
উল্লেখযোগ্য উক্তি ও রেফারেন্স-
জর্জ অরওয়েল, ১৯৮৪: Who controls the past controls the future. Who controls the present controls the past.
আলবার্ট কামু: The only way to deal with an unfree world is to become so absolutely free that your very existence is an act of rebellion.
লেখক : সংগঠক, বাংলাদেশ গঠনতান্ত্রিক আন্দোলন
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ