নিজস্ব প্রতিবেদক : আমিনবাজারের বড়দেশী এলাকার তুরাগ নদীর পাড়ে বসে কাঁদছিল শিশু তামিম। তার জন্য ঝালমুড়ির ঠোঙা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা শরিফুল ইসলাম। শিশুটির কান্না কিছুতেই থামছিল না। সে দিনভর অপেক্ষা করেছে। এখন মা, বোন আর ভাইকে ছাড়া সে কিছুতেই ফেরত যাবে না। কিন্তু শরিফুল অসহায়। ছয় মাস গ্রামে থেকে গেরস্থালি করেন, আর ছয় মাস ঢাকায় এসে কয়লার ঘাটে কাজ করেন। কয়েক বছর এভাবেই চলছিল শরিফুলের।
গতকাল শনিবার সকালে স্ত্রী রুপায়ন খাতুন আর চার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে কাজে যাওয়ার জন্য ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উঠেছিলেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকাটি তুরাগ নদীতে ডুবে যায়। শরিফুল আর তার দুই ছেলে কোনোমতে উঠতে পারলেও স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে আর উঠতে পারেনি।
শরিফুলের এক ছেলে আরমানের লাশ উদ্ধার হয়েছে। স্ত্রী রূপায়ণ ও দুই বছরের মেয়ে জেসমিনের খোঁজ সন্ধ্যায়ও মেলেনি। তামিম নদীর পাড়ে শরিফুলের সঙ্গে আছে। আরেক ছেলে সালমানের পা কাটা গেছে নৌকার পাখার আঘাতে। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আহত ছেলের কাছে যাওয়ার ফুরসত পাচ্ছেন না শরিফুল। ঢাকায় তুরাগের আমিনবাজার প্রান্তে সকালে ডুবে যাওয়া ট্রলারটির পাঁচ যাত্রীর লাশ দিনভর অভিযানে উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। সন্ধ্যায় অভিযান স্থগিত করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক দিনমণি শর্মা বলেন, তাদের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এখনও দুজন নিখোঁজ।
ট্রলারটি নদীর ওপারে গাবতলী যাচ্ছিল। আর এর অধিকাংশ যাত্রীই ছিলেন শ্রমিক কিংবা তাদের পরিবারের সদস্য।
কাঁদতে কাঁদতে শরিফুল বলেন, তারা ভাড়া থাকেন বড়দেশী গ্রামে আর কাজ করেন গাবতলীর দ্বীপনগর কয়লাঘাটে। বাচ্চারা প্রতিদিন বড়দেশী গ্রামের ভাড়া বাসাতেই থাকে। শনিবার সকালে কী মনে করে তাদের মা রূপায়ণ সন্তানদেরও সঙ্গে নিয়েছিল। ওই নৌকায় শরিফুলের শ্যালিকা সোয়ালা এবং তার শিশুপুত্র ইমরানও ছিল। তাদের দুজনেরই লাশ পাওয়া গেছে। আমিনবাজার নৌ পুলিশ ফাঁড়িতে রাখা লাশের পাশে বসে কাঁদছিলেন আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা তাসলিমা, দুই বোন সোয়ালা ও রূপায়নকে হারিয়ে।
তাসলিমা বলেন, তাদের বাড়ি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলায়। বছরের ৬ মাস তারা ঢাকায় থেকে কয়লাঘাটে কাজ করেন, আর ৬ মাস বাড়িতে কৃষিকাজ করেন। কয়লাঘাটে কাজ হয় আট টুকরি ২০ টাকা দরে। অর্থাৎ জাহাজ থেকে আট টুকরি কয়লা নামালে বা উঠালে ২০ টাকা পাওয়া যায়। এভাবেই দিনভেদে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হত তাদের। ঘর ভাড়া ২০০০ টাকা। খাওয়া খরচ ও প্রতিদিন নৌকা পারাপার বাবদ ২০ টাকা বাদে মাস শেষে তাদের হাতে সামান্য কিছু টাকাও জমত। এ টাকা নিয়েই গ্রামে ফিরে কৃষি কাজ শুরু করতেন তারা।
তাসলিমা বলেন, এই মৌসুমে দুই মাস আগেই তারা তিন বোন ঢাকায় আসেন। এক মাসের ঘর ভাড়া দিতে পেরেছেন। আর এক মাসের ঘর ভাড়া ১০ তারিখে দেওয়ার কথা ছিল। তার আগেই এ নৌ দুর্ঘটনা ঘটল।
একই নৌকায় ছিলেন তাসলিমার আরেক বোনের স্বামী মাহফুজুল ইসলাম। মাহফুজুল গাবতলীর দ্বীপনগর কয়লাঘাটে বেলচা চালান।
কীভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটল- জানতে চাইলে মাহফুজুল বলেন, প্রতিদিনের মতোই খাবারের বাটিটা সঙ্গে নিয়ে ভোর ৫টার দিকে নৌকায় উঠে বসে ছিলেন তারা। নৌকায় ১৮ জন ছিল। নৌকার ইঞ্জিন চালুর আগে স্রোতের টানে এটি কিছু দূরে সরে যায়। ইঞ্জিন চালু হতেই মাঝি নৌকার হাল এমনভাবে ঘোরান যে নৌকাটি সরাসরি একটি চলন্ত একটি বালুবাহী জাহাজের (বাল্কহেড) নিচে চলে যায়।
মাহফুজুল বলেন, পানিতে পড়ার পর তিনি তলিয়ে গিয়েছিলেন। তখন মাথার উপর দিয়ে বালুবাহী জাহাজটিকে চলে যেতে দেখেন। ভেসে ওঠার পরই জাহাজের প্রোপেলারের পানির ঝাপটায় অনেক দূরে সরে যান। এরপর তিনি কোনো রকমে কূলে ওঠেন। “মনে হয় মাথার উপর দিয়া কেয়ামত গেলো গা,” বলেন বেঁচে যাওয়া এই যাত্রী।