ঢাকা ০৭:৩০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট ২০২৫

জীবন যেখানে যেমন

  • আপডেট সময় : ১১:৩৫:৩১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২
  • ১৫৬ বার পড়া হয়েছে

ফারজানা কাশেমী : পঁচাশি (৮৫) বছর বয়সি কোনো এক বৃদ্ধা মাকে তার ছেলের বউ আর নাতি, নাতনি মিলে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। জীবনের ভার, অসহায়ত্ব আর নির্মমতার চোরাবালি এই বৃদ্ধা মাকে যে পরিস্থিতিতে উপনীত করেছে তা সময়ের কঠিনত্ব অথবা অদৃষ্টের উপহাস। জীবন আর বেঁচে থাকার আয়োজন যেন আজ তার কাছে অভিশাপ। সহায়, সম্পত্তিহীন এই বৃদ্ধা মা অস্পষ্ট দিকরেখায় ঠাঁই হারিয়েছে। কোথায় তার ঠিকানা হবে তার আপনজনরা ভাবেনি।
জীবনের কিছু পরিস্থিতি মানুষকে বুঝিয়ে দেয় দুর্দিনে কেউ আপন হয় না। মানুষের জীবন পরিবর্তন হয় পরিবর্তিত জীবনে সংকুলান হয় না। মানুষের চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষগুলো যেন কচুরিপানা বা শ্যাওলা। কোনো এক সময় হারিয়ে যায়। মানুষের কোনো বন্ধু হয় না। একজন মানুষ অন্য মানুষের প্রয়োজনসর্বস্ব; তার বেশি কিছু নয়। মানুষ নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় জীব। জীবনের রঙ বদলানোর সাথে সাথে ধূলিকণার মতো উড়ে যায় তার চারপাশের রঙিন পোশাকে ঘেরা মানুষগুলো। কাঁচের দেয়ালের মতো ভেঙে যায় মানুষের যতœ, বিশ্বাসে গড়া সম্পর্ক। জীবন যখন রঙ বদলায়, মানুষের ফিকে সম্পর্কগুলো তখন এলোমেলো হাওয়ায় উড়ে যায়। তবুও সম্পর্কের মিথ্যে বেসাতি আট পৌরে জীবনকে ছুঁয়ে যায়-কখনো ভালোবাসায়, আবার কখনো আবেগে অথবা ঘৃণার ভয়াল ছোবলে। জীবনের দায়-দায়িত্ব, সহমর্মিতা, বোধ, বিবেক, বিবেচনা হয়তো সব জীবনের সঞ্চারণ না। মুষ্টিমেয় কিছু জীবন মূল্যবোধের ধারক আর বাহক হয়। সেই জীবনের পরিশেষে হয়তো আফসোস হয়-এই কি ছিল প্রাপ্তি!
প্রতিদানের জন্য জীবন তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করে না। তবুও ক্লান্ত শরীর, দেহ, মনে প্রশান্তি আশা করে মানুষ। মানুষকে ঘিরে যত আয়োজন, অনুভূতি, তার চারপাশ থেকে ন্যূনতম বিবেচনাবোধের সঞ্চার মানুষ মনে মনে প্রত্যাশা করে।
বিধিবাম; যাদের জন্য মানুষ দুঃখ-কষ্ট-ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে, তাদের রোষানলেই মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হয়। হয়তো এটাই জীবনের নিয়ম অথবা নিয়মের জীবন। দুর্দিনে ভারাক্রান্ত মানুষকে বিসর্জনে উস্কে দিতে সহায়ক হয় তার আশপাশের মানুষ। চিত্রপটে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় আবার কখনো। যে ভিন্নতা মুগ্ধতার-মায়ার-দায়িত্বের প্রতিস্থাপন। আশি ঊর্ধ্ব বাবাকে পরম যতেœ আগলে রাখার সবিনয় চেষ্টা করে কিছু সন্তান। যেন সম্পর্কের পূর্ণতা। চিকিৎসা, সেবায় বিন্দুমাত্র ত্রুটিহীনতা যেখানে চোখে পড়ে না। পরম যতেœর পরও বাস্তবতায় মানুষগুলো বিদায় নেয় মহাকালের নিয়মে। হেরে যায় সময়ের স্রোতে।
ভিন্ন ভিন্ন ফ্রেমে বাঁধা মানুষের জীবনের গল্প। কোন গল্প করুণত্বের, অসহায়ত্ব আর অপমানের দায়ভার। আবার কখনো কিছু জীবন একই সম্পর্কের মাত্রা নির্ণয় করে ভিন্নভাবে নির্মিত গল্পনাট্যে। একজন বিপতœীক মানুষ, স্ত্রী বিয়োগে স্ত্রীর কবর করেছেন তার উঠোনের কাছেই। আজ প্রায় ষোল বছর প্রতিদিন একইভাবে সে তার স্ত্রীর কবরের আশপাশে ঘুরে ফিরে বেড়ায় ভিন্ন কর্মকা-ে। কখনো কুরআন শরীফ তিলোয়াত অথবা কবর জিয়ারতের কার্যক্রমে আবর্তিত হয় এই মানুষটার প্রতিদিনকার চেনা রুটিন।
পক্ষান্তরে, স্ত্রী নিখোঁজ হওয়ায় স্থানীয় থানায় জিডি করেন কোনো স্বামী। স্ত্রীর ভাইকে হুমকি প্রদান করে বোনকে খুঁজে দিতে। কিছুদিন পরে সেই স্বামী গ্রেফতার হন স্ত্রী হত্যার দায়ে। একই ফ্রেমে বাঁধা সম্পর্কের কত মোড়ক। বৈচিত্র্য আর অভিনবত্বের ছড়াছড়ি। জীবন যেনো চিত্রনাট্য। চিত্রপটে মানুষভেদে ভিন্ন দৃশ্যায়ন। কিছু চিত্রপট মুগ্ধতা আর ভালোবাসার পরম আরাধ্য। কিছু চিত্রপট ভিন্নতায় কুৎসিত, কদাকার দন্ত বিকশিত পৈশাচিক।
জীবনে কাম্য কি ছিল, প্রাপ্তি কি হয়, তা অবস্থাভেদে পরিলক্ষিত হয়। কখনো কখনো ইট, কাঠের গুঁড়ি থেকে পশুর দানবীয় আচরণ প্রদর্শিত জীবন ফ্রেমের গল্পে। প্রতিটি জীবন গল্প। তবে সব গল্পতো সুন্দর নয়। কিছু গল্পের আবেশে জীবন সমাদৃত। কিছু গল্পের মোড়ক বীভৎস নরকাগ্নি।
লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

জীবন যেখানে যেমন

আপডেট সময় : ১১:৩৫:৩১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২

ফারজানা কাশেমী : পঁচাশি (৮৫) বছর বয়সি কোনো এক বৃদ্ধা মাকে তার ছেলের বউ আর নাতি, নাতনি মিলে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। জীবনের ভার, অসহায়ত্ব আর নির্মমতার চোরাবালি এই বৃদ্ধা মাকে যে পরিস্থিতিতে উপনীত করেছে তা সময়ের কঠিনত্ব অথবা অদৃষ্টের উপহাস। জীবন আর বেঁচে থাকার আয়োজন যেন আজ তার কাছে অভিশাপ। সহায়, সম্পত্তিহীন এই বৃদ্ধা মা অস্পষ্ট দিকরেখায় ঠাঁই হারিয়েছে। কোথায় তার ঠিকানা হবে তার আপনজনরা ভাবেনি।
জীবনের কিছু পরিস্থিতি মানুষকে বুঝিয়ে দেয় দুর্দিনে কেউ আপন হয় না। মানুষের জীবন পরিবর্তন হয় পরিবর্তিত জীবনে সংকুলান হয় না। মানুষের চারপাশে ঘিরে থাকা মানুষগুলো যেন কচুরিপানা বা শ্যাওলা। কোনো এক সময় হারিয়ে যায়। মানুষের কোনো বন্ধু হয় না। একজন মানুষ অন্য মানুষের প্রয়োজনসর্বস্ব; তার বেশি কিছু নয়। মানুষ নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় জীব। জীবনের রঙ বদলানোর সাথে সাথে ধূলিকণার মতো উড়ে যায় তার চারপাশের রঙিন পোশাকে ঘেরা মানুষগুলো। কাঁচের দেয়ালের মতো ভেঙে যায় মানুষের যতœ, বিশ্বাসে গড়া সম্পর্ক। জীবন যখন রঙ বদলায়, মানুষের ফিকে সম্পর্কগুলো তখন এলোমেলো হাওয়ায় উড়ে যায়। তবুও সম্পর্কের মিথ্যে বেসাতি আট পৌরে জীবনকে ছুঁয়ে যায়-কখনো ভালোবাসায়, আবার কখনো আবেগে অথবা ঘৃণার ভয়াল ছোবলে। জীবনের দায়-দায়িত্ব, সহমর্মিতা, বোধ, বিবেক, বিবেচনা হয়তো সব জীবনের সঞ্চারণ না। মুষ্টিমেয় কিছু জীবন মূল্যবোধের ধারক আর বাহক হয়। সেই জীবনের পরিশেষে হয়তো আফসোস হয়-এই কি ছিল প্রাপ্তি!
প্রতিদানের জন্য জীবন তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করে না। তবুও ক্লান্ত শরীর, দেহ, মনে প্রশান্তি আশা করে মানুষ। মানুষকে ঘিরে যত আয়োজন, অনুভূতি, তার চারপাশ থেকে ন্যূনতম বিবেচনাবোধের সঞ্চার মানুষ মনে মনে প্রত্যাশা করে।
বিধিবাম; যাদের জন্য মানুষ দুঃখ-কষ্ট-ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে, তাদের রোষানলেই মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হয়। হয়তো এটাই জীবনের নিয়ম অথবা নিয়মের জীবন। দুর্দিনে ভারাক্রান্ত মানুষকে বিসর্জনে উস্কে দিতে সহায়ক হয় তার আশপাশের মানুষ। চিত্রপটে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় আবার কখনো। যে ভিন্নতা মুগ্ধতার-মায়ার-দায়িত্বের প্রতিস্থাপন। আশি ঊর্ধ্ব বাবাকে পরম যতেœ আগলে রাখার সবিনয় চেষ্টা করে কিছু সন্তান। যেন সম্পর্কের পূর্ণতা। চিকিৎসা, সেবায় বিন্দুমাত্র ত্রুটিহীনতা যেখানে চোখে পড়ে না। পরম যতেœর পরও বাস্তবতায় মানুষগুলো বিদায় নেয় মহাকালের নিয়মে। হেরে যায় সময়ের স্রোতে।
ভিন্ন ভিন্ন ফ্রেমে বাঁধা মানুষের জীবনের গল্প। কোন গল্প করুণত্বের, অসহায়ত্ব আর অপমানের দায়ভার। আবার কখনো কিছু জীবন একই সম্পর্কের মাত্রা নির্ণয় করে ভিন্নভাবে নির্মিত গল্পনাট্যে। একজন বিপতœীক মানুষ, স্ত্রী বিয়োগে স্ত্রীর কবর করেছেন তার উঠোনের কাছেই। আজ প্রায় ষোল বছর প্রতিদিন একইভাবে সে তার স্ত্রীর কবরের আশপাশে ঘুরে ফিরে বেড়ায় ভিন্ন কর্মকা-ে। কখনো কুরআন শরীফ তিলোয়াত অথবা কবর জিয়ারতের কার্যক্রমে আবর্তিত হয় এই মানুষটার প্রতিদিনকার চেনা রুটিন।
পক্ষান্তরে, স্ত্রী নিখোঁজ হওয়ায় স্থানীয় থানায় জিডি করেন কোনো স্বামী। স্ত্রীর ভাইকে হুমকি প্রদান করে বোনকে খুঁজে দিতে। কিছুদিন পরে সেই স্বামী গ্রেফতার হন স্ত্রী হত্যার দায়ে। একই ফ্রেমে বাঁধা সম্পর্কের কত মোড়ক। বৈচিত্র্য আর অভিনবত্বের ছড়াছড়ি। জীবন যেনো চিত্রনাট্য। চিত্রপটে মানুষভেদে ভিন্ন দৃশ্যায়ন। কিছু চিত্রপট মুগ্ধতা আর ভালোবাসার পরম আরাধ্য। কিছু চিত্রপট ভিন্নতায় কুৎসিত, কদাকার দন্ত বিকশিত পৈশাচিক।
জীবনে কাম্য কি ছিল, প্রাপ্তি কি হয়, তা অবস্থাভেদে পরিলক্ষিত হয়। কখনো কখনো ইট, কাঠের গুঁড়ি থেকে পশুর দানবীয় আচরণ প্রদর্শিত জীবন ফ্রেমের গল্পে। প্রতিটি জীবন গল্প। তবে সব গল্পতো সুন্দর নয়। কিছু গল্পের আবেশে জীবন সমাদৃত। কিছু গল্পের মোড়ক বীভৎস নরকাগ্নি।
লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট অব বাংলাদেশ