ড. নিজামউদ্দিন জামি : শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইমামুল কবীর শান্ত-এর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ (৩০ মে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ) যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০২০ সালের এ দিনে করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি পরলোকগমন করেন। এ উপলক্ষ্যে শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি ও সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস মাসব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। রচনা প্রতিযোগিতা, শান্তমেলা আয়োজন, বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পাঠাগার ও সুপেয় পানির সংস্থান, গরিবদের মাঝে খাবার বিতরণ, খতমে কোরআন, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, কবর জিয়ারত, পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং আলোচনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
মো. ইমামুল কবীর শান্ত’র পারিবারিক পরিচয় : মো. ইমামুল কবীর শান্ত ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার নাখালপাড়ায় এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পৈত্রিক নিবাস খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর গ্রামে। পিতা মরহুম দীন মোহাম্মদ লস্কর [ডি এম লস্কর] (মৃত্যু ৪ এপ্রিল ১৯৯১), মা মাহমুদা খাতুন (মৃত্যু ৩০ জুন ১৯৮৪)। দাদা ছিলেন খাদেম লস্কর, দাদি মোমেনা বেগম। তিন ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। বড় ভাই প্রফেসর মো. হুমায়ুন কবীর, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইমামুল কবীর শান্ত ও ছোট ভাই ডা. মো. আহসানুল কবির (দুলাল)। বোনদের মধ্যে অধ্যাপক মনোয়ারা বেগম (প্রয়াত), সাহানা মোস্তাফিজ, আঞ্জুমান আরা বেগম, আফরোজা বেগম, দিলরুবা বেগম। পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল ছিলেন। তিনি প্রায়শ বলতেন, ‘যে স্যাক্রিফাইস করতে পারে, সেই সুখী।’ ভাইবোনদের বিয়েশাদি প্রায় তিনিই দিয়েছিলেন।
মো. ইমামুল কবীর শান্ত’র ছেলেবেলা : মো. ইমামুল কবীর শান্ত ছোটবেলা থেকেই খুব শান্ত প্রকৃতির ছিলেন। সাধারণ চলাফেরা করতেন। ঢাকার তেজগাঁওয়ের মিশনারি স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। স্কুলে যাবার পথে তিনি রেল লাইনের দু’ধারে গরিব-দুখী, অসহায় ও মেহনতি মানুষের দুর্বিষহ জীবন খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তখনই তাঁদের প্রতি মমত্ববোধ জেগেছিল, জেগেছিল প্রশ্ন- ‘মানুষ কেন গরিব?’ সেই থেকে তিনি এর সমাধানের পথে হেঁটেছেন আমৃত্যু। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি চে’গুয়েভারার আত্মজীবনী পড়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ছাত্রজীবনে বাম (ছাত্র ইউনিয়ন) রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। পরে মাদার তেরেসার জীবনাদর্শে দীক্ষিত হয়ে মানবিক সমাজ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন।
মো. ইমামুল কবীর শান্ত ও মুক্তিযুদ্ধ : বঙ্গবন্ধুর ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে মো. ইমামুল কবীর শান্ত মাত্র ১৭ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেন। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। অন্যান্য অনেকের মতো তরুণ শান্তও স্বাধীনতার উদ্দীপনায় এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখেছিলেন। স্বাধীনতার পর বাংলা মায়ের সন্তানরা মায়ের কোলে ফিরে গেলেও শান্ত ফেরেননি। মাকে তিনি বলেছিলেন, ‘মা, আমার যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি।’ তাঁর যেন আরো কিছু করার বাকি আছে! তিনি স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
১১ মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যু : একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা বিজয় উদযাপন করতে যখন দলে দলে ঢাকায় ফেরেন, তখনই ঘটে যায় এক হৃদয়বিদারক ঘটনা! বুড়িগঙ্গায় নৌকাডুবিতে মো. ইমামুল কবীর শান্তর সেক্টরের ১১ মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু ঘটনাস্থলেই শাহাদাতবরণ করেন। এ ঘটনা তাঁর জীবনব্যাপী কষ্টের কারণ হয়েছিল। সেই বন্ধু-মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি ধরে রাখতে আজিমপুর কবরস্থানে জায়গা কিনে নিজ উদ্যোগে তিনি ‘শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ’ নির্মাণ করেন। প্রতিষ্ঠা করেন ‘শহিদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি ফাউন্ডেশন।’ প্রতিবছর ১৭ ডিসেম্বর ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ পালন করে আসছে শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন। এ অনুষ্ঠানে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীসহ দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী, ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও অধ্যাপকরা এতে অংশগ্রহণ করে থাকেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইমামুল কবীর শান্ত বলতেন, ‘আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা, শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা।’ তাই তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুতির পূর্ণ বাস্তবায়নে।
জাতির পিতা হত্যাকা- ও শান্ত’র দেশত্যাগ : স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার পর বাঙালির স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা যেন এক নিমিষেই ম্লান হয়ে যায়! বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রথম মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন যুদ্ধজয়ী মো. ইমামুল কবীর শান্ত। দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকের ন্যায় তরুণ শান্তও সেদিন অশান্ত এবং বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। সে মিছিলে গুলি চালিয়ে পুলিশ অনেককে হত্যা করে। ভাগ্যক্রমে যাঁরা বেঁচেছিলেন, মো. ইমামুল কবীর শান্ত তাঁদের একজন। কিন্তু তৎকালীন সামরিক সরকারের হামলা-মামলা, জেল-জুলুম, আত্মগোপনসহ নানা নির্যাতনে অতীষ্ঠ হয়ে পাহাড়সম বেদনা বুকে নিয়ে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুসহ মো. ইমামুল কবীর শান্ত দেশত্যাগ করেন। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এ অভাগা দেশে আর কখনোই ফিরে আসবেন না। ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে তিনি জার্মানিতে স্থায়ী হন। প্রায় অর্ধযুগ কেটে যায় সেখানে। যতই দিন যাচ্ছে, ততই তাঁর অভিমানের বরফ গলতে থাকে। কারণ জার্মানিদের জীবনধারা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, উজ্জীবিত করেছিল। তাঁর উপলব্ধিতে আসে ‘দুদুটি বিশ^যুদ্ধে পরাজিত হয়েও জার্মানিরা যদি বিশে^র বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারবো না? আমরা তো বিজয়ী জাতি!’ জার্মান জাতি কর্মমুখী, সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক শিক্ষায় বেশ সমৃদ্ধ। তারা সর্বঅর্থে যোদ্ধা জাতি। সে মন্ত্র বলেই অতীতের সমস্ত গ্লানি ও ব্যর্থতাকে মুছে দিতে তারা দিনরাত পরিশ্রম করে। দেশ ও জীবন গঠনে তাদের কোনো ক্লান্তি নেই। তিনি আরো উপলব্ধি করেছিলেন, সঠিক নেতৃত্ব পেলে বাঙালিরাও একদিন ঘুরে দাঁড়াবে, সোনা ফলাবে। বাঙালির অতীত ইতিহাস ও বীরত্বগাথা থেকে তিনি সেই সঞ্জীবনী শক্তি অর্জন করেন। বায়ান্নের ভাষা-আন্দোলন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেই তিনি পথের দিশা খুঁজে পেয়েছিলেন। এভাবে প্রবল আত্মবিশ^াসে বলীয়ান হন তিনি। কর্মবীর মো. ইমামুল কবীর শান্ত প্রায়শ বলতেন, ‘পৃথিবীতে কোনো পরিশ্রমী জাতিই পিছিয়ে নেই।’ জার্মানির অনুরূপ একটি ‘শিক্ষা-মডেল’ মাথায় নিয়ে যাবতীয় অভিমান পেছনে ফেলে দেশমাতৃকার টানে অবশেষে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠা : দেশে এসে তিনি নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হন। জার্মানির অনুরূপ শিক্ষা-পদ্ধতি চালু করতে হলে অনেক টাকার দরকার; কিন্তু কোথায় পাবেন সে টাকা? অনেক ভেবেচিন্তে ব্যবসায় মনস্থির করলেন তিনি। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ নভেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন ‘সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস’। দিনরাত পরিশ্রম করে অল্পসময়ে প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে যান সফলতার শীর্ষে। দেশের প্রথম দ্রুত ও বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুন্দরবন কুরিযার সার্ভিস দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের আস্থা ও ভালোবাসায় সুন্দরবন দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও কুরিয়ার ব্যবসা বিস্তৃত করেছে। মো. ইমামুল কবীর শান্তর ত্যাগ, সততা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি।
শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন : কুরিয়ার ব্যবসায় সফলতার পর তিনি গড়ে তোলেন অরাজনৈতিক, সেবাধর্মী ও মানবকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান ‘শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন’। যার অধীনে প্রায় দু’ডজন ব্যবসা ও শিক্ষাসহায়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দশ হাজারের অধিক লোক কাজ করছে। ফাউন্ডেশনভুক্ত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান-পরিচিতি যথাস্থানে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি : ‘শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠার পর তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রতি মনোযোগী হন। জার্মানি থেকে যে স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফেরেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সে স্বপ্ন অনেকটা ধরা দেয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইতোপূর্বে তিনি গড়ে তোলেন ‘শান্ত-মারিয়াম একাডেমি’ ও ‘শান্ত-মারিয়াম ইনস্টিটিউট’। এ প্রতিষ্ঠান দুটির সফলতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাঁর আত্মীয়-ঘনিষ্ঠজন এবং শিক্ষানুরাগীদের সহায়তায় ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন এ অঞ্চলের অদ্বিতীয় কর্মমুখী, সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ উচ্চ বিদ্যাপীঠ ‘শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’। ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় নীতিমালা অনুসারে এটি ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। ব্যতিক্রমী বিষয় ও নতুনত্বের কারণে শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠানটি অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পা রাখে। বর্তমানে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। স্থাপত্য শিল্পের অনন্য সৌন্দর্যে পরিকল্পিত ও নির্মিত প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী ক্যাম্পাস উত্তরার ১৭ নম্বর সেক্টরে বিস্তৃত পরিসরে অবস্থিত। তিনটি ফ্যাকাল্টির অধীনে মোট ১৮টি আধুনিক ও ব্যতিক্রমী বিষয়ে উচ্চশিক্ষা প্রদান করে শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয় আশানুরূপ সফলতা পেয়েছে। এ বিশ^বিদ্যালয় ঈৎবধঃরাব উবংঃরহধঃরড়হ ড়ভ ঞযব ঘধঃরড়হ হিসেবে অভিনন্দিত হয়েছে সর্বমহলে।
শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন এর অন্যান্য প্রতিষ্ঠান : (ক) শান্ত-নিবাস : এটি শান্ত-নিকেতনের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর উত্তরা দক্ষিণখানে বিশাল পরিসরে গরিব-দুখী, জেলখানা ও পতিতালয়ে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের থাকা-খাওয়া নিশ্চিত করে কর্মমুখী শিক্ষা দিয়ে আগামী দিনের সুনাগরিক গড়াই এর লক্ষ্য।
(খ) ক্রিয়েটিভ দ্য আর্ট গ্যালারি : শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন ও বিশ^বিদ্যালয় যেহেতু সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান, সেহেতু শিল্প-সাহিত্যের বোদ্ধাদের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক তৈরি এবং দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করে প্রতিষ্ঠানটি। এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে। নতুন উৎসাহে তা পুনরায় শুরু হয় ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে।
(গ) আর্ট হাট অ্যান্ড আর্ট গ্যালারি : ২০০৪ থেকে এর যাত্রা শুরু হয়। ফাউন্ডেশন ও বিশ^বিদ্যালয়ের নবীন শিল্পীদের সাথে স্থানীয়দের পরিচিত করে তুলতে এ প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়। এছাড়া রয়েছে-(ঘ) ক্রিয়েটিভ দ্য আর্ট মল। (ঙ) ক্রিয়েটিভ ম্যানিকুইন্স। (চ) ক্রিয়েটিভ ফার্নিচার।
(ছ) শান্ত-মারিয়াম প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হাতেকলমে শিক্ষাদানের নিমিত্তে শিক্ষাসহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি পরিচালিত।
(জ) দৈনিক আজকের প্রত্যাশা : স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি ও গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণে শিক্ষাসহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর যাত্রা। আরও রয়েছে-(ঝ) শান্ত-মারিয়াম সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভ মিডিয়া। (ঞ) শান্ত-মারিয়াম ডিজাইনার্স অ্যান্ড বিল্ডার্স। (ট) শান্ত-মারিয়াম ফ্যাশনস্। (ঠ) শান্ত-মারিয়াম নিট কম্পোজিট। (ড) শান্ত-মারিয়াম রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভ স্কিলস ইত্যাদি।
মো. ইমামুল কবীর শান্ত’র শিক্ষাদর্শন : বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইমামুল কবীর শান্ত যথার্থ অর্থে একজন শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তাঁর শিক্ষাদর্শন তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর। কর্মমুখী, সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার প্রতি তিনি পুরোজীবনটাই বিনিয়োগ করে গেছেন! তিনি প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার বিপরীতে কর্মমুখী শিক্ষাকে উৎসাহিত করেছেন। বলা যায় এর জন্য অনেক বড় ত্যাগও স্বীকার করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার যুগে তিনি ‘শিক্ষিত বেকার’ বা ‘ডিগ্রি-কালচার’-এর দিকে ধাবিত না হয়ে কর্মজীবী শিক্ষিত সমাজ গড়ে তোলার পক্ষে মত দিয়েছেন। শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি ছিল স্বচ্ছ ও নির্ভুল। তার পদক্ষেপ ও কার্যক্রমে তা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সহশিক্ষার প্রতি তিনি বিশেষ যতœবান ছিলেন। উন্নত বিশে^র মতো ২৫-২৬ বছরের পরিবর্তে ১৮-১৯ বছরে শিক্ষার্থীদের ‘ইয়ারলস’ না করে কর্মে প্রবেশ করার যে ফর্মুলা তিনি দিয়েছেন, তা সময়োপযোগী এবং বিজ্ঞানসমর্থিত। তাতে সাত থেকে আট বছর তথা কোটি কোটি কর্মঘণ্টা সাশ্রয় হয় শিক্ষার্থীর তথা দেশের। এর অর্থনৈতিক মূল্যও অপরিসীম।
মো. ইমামুল কবীর শান্ত’র সংস্কৃতি-চিন্তা : মো. ইমামুল কবীর শান্ত উদারনৈতিক মতবাদে বিশ্বাস করতেন। তিনি সাম্প্রদায়িক চিন্তার বহু ঊর্র্ধ্বে বসবাস করতেন। সংস্কৃতি চেতনায় তিনি ঋদ্ধ ছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতি শিক্ষাকে যেমন অনিবার্য করা হয়েছে, তেমনি তাঁর প্রতিষ্ঠানে ঠাঁই হয়েছে জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির কর্মীর। তিনি বলতেন, ‘ধর্ম মানুষের বিশ্বাস, আর সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষ-মানুষের বন্ধন।’ তিনি মনে করতেন কেবল শিক্ষিত হলে চলে না, সংস্কৃতিবানও হতে হয়, তবেই মানুষ পূর্ণতা পায়। তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসায় কর্মমুখী শিক্ষা না থাকায় যেমন সন্ত্রাসবাদ তৈরি হচ্ছে, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও তেমনি সাংস্কৃতিক শিক্ষার অভাবে ধর্মীয় গোঁড়ামিতে জড়িয়ে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিচ্ছে।’ তাই তিনি সব বিষয়ে কর্মমুখী, সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা দানের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছিলেন।
মো. ইমামুল কবীর শান্ত’র ৪ কর্মপদ্ধতি : ক. মানব সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার : তিনি বলতেন ‘বাংলাদেশের মানুষ কষ্টসহিষ্ণু।’ প্রকৃতির নানা প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষ প্রতিটি মুহূর্তে টিকে আছে। আরো বলতেন, ‘বাঙালি পরিশ্রমী ও মেধাবী জাতি।’ বাঙালির মেধা ও শ্রম পৃথিবী স্বীকৃত। বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজার অবারিত। সত্যি তাই, প্রায় এক কোটির অধিক বাঙালি বিশে^র বিভিন্ন দেশে কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। আমাদের রিজার্ভ ফান্ড এখন ৫০ হাজার ডলারের কাছাকাছি। তাই সুষ্ঠু, সুন্দর, যুগোপযোগী পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে যদি বাঙালিকে এগিয়ে নেয়া যায়, তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাঙালিরা পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেবে। পৃথিবীতে এখন মানব সম্পদের চেয়ে বড় কোনো সম্পদ নেই।
খ. প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার : প্রাকৃতিক সম্পদ সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমা ও দান। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদের সম্ভাবনা প্রচুর। আমাদের দেশ মিঠা পানির দেশ, এদেশের মাটি উর্বর। পাখির বিষ্টা থেকেও এখানে গাছ উৎপন্ন হয়। আমাদের পাট বিশ্বস্বীকৃত ‘সোনালি আঁশ’। বস্ত্র নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে মহাশক্তি চীনের সাথে। চামড়া, চা, রাবার, বাঁশ, বেত, জাহাজশিল্প প্রভৃতিতে বাংলাদেশ সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। তেল, কয়লা, গ্যাস সম্ভাবনাও প্রচুর। এসব প্রাকৃতিক সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশ অচিরেই ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তাই তিনি প্রাকৃতিক সম্পদের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করতে দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
গ. সংস্কৃতি শিক্ষার লালন ও বিকাশ : সংস্কৃতি ছাড়া মানুষ মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারে না। শিক্ষার পরিপূরক হচ্ছে সংস্কৃতি। সংস্কৃতিবিহীন শিক্ষা প্রায় অমানবিকই হয়। শুধু ‘হলি-আর্টিজান ট্র্যাজেডি’ই নয়, এদেশের জঙ্গিবাদ উত্থানের গোড়ায়ও রয়েছে দেশজ সংস্কৃতির প্রতি বিরূপতা ও বিমুখতা। বিশ্বমানবকে আপন করে নেয়ার দীক্ষা সংস্কৃতি যতটা দিতে পারে, অন্য কিছু ততটা পারে না। এর প্রমাণ আমরা হরহামেশাই দেখছি। তাই একটি জাতিকে সার্বিক দিক দিয়ে গড়ে তুলতে হলে সাংস্কৃতিক শিক্ষা অনিবার্য, অপরিহার্য।
ঘ. অনলাইন বা দূরশিক্ষণ পদ্ধতি : মো. ইমামুল কবীর শান্ত খুবই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। এ শতকের শুরুতেই তিনি অনলাইনের গুরুত্ব বিবেচনা করে শিক্ষাদানের মাধ্যম করেছিলেন। দেশের বৃহত্তর জনসমাজকে শিক্ষার আওতায় আনতে এবং উচ্চশিক্ষা বিস্তারে যুঁতসই বাহন হিসেবে অনলাইনকে বেছে নিয়েছিলেন প্রায় দু’দশক আগে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন সরকার এ দূরশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। অথচ আজকের বিশ্বে অনলাইন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। করোনা মহামারিতে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজই সম্পাদিত হয়েছে। দূরদর্শী ও উদ্ভাবনী চিন্তার জন্যে তিনি নতুন করে আবার সামনে এলেন। এ জন্য তাঁর জাতীয় স্বীকৃতি-সম্মাননার দাবি জানিয়ে আসছে শান্ত-মারিয়াম পরিবার।
স্বপ্নদ্রষ্টার মৃত্যু ও নতুন নেতৃত্ব : ‘মৃত্যু মানে নতুন পথে যাত্রা’। হ্যাঁ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইমামুল কবীর শান্ত ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি নিজেকে একজন ‘যোদ্ধা’ মনে করতেন। জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ কাঁধে নিয়ে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন এবং দেশ গড়ার মহানব্রতে নিজেকে উৎসর্গ করেন। মো. ইমামুল কবীর শান্ত’র অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিতে ‘শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন’র দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁরই অনুজপ্রতিম ডা. মো. আহসানুল কবির। শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁরই নিকটাত্মীয় এবং বন্ধু শিল্পী ও অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হক। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস (প্রা.) লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তাঁরই আস্থাভাজন ভাগ্নে প্রকৌশলী শেখ তানভীর আহমেদ রনি। শান্ত-মারিয়াম পরিবারের সর্বস্তরের সদস্যদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কর্মবীর মো. ইমামুল কবীর শান্ত’র অসমাপ্ত কাজ দ্রুততা ও বিশ^স্ততার সাথে এগিয়ে চলেছে।
শান্ত মারিয়াম ফাউন্ডেশন এর চলমান প্রকল্পসমূহ : ক. শান্ত-নিবাসের কার্যক্রম পূর্ণমাত্রায় এগিয়ে চলছে। ৪০ জন এতিম শিশুর থাকা, খাওয়া, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদনসহ সকলপ্রকার সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। শান্ত-মারিয়াম স্কুল অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির মাধ্যমে এটি পরিচালিত হচ্ছে।
খ. শান্ত-নিবাসের দ্বিতীয় বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে রয়েছে।
গ. গাজীপুরের সিনাবহে অবস্থিত শান্ত-নিকেতনে ‘ইমামুল কবীর মসজিদ’ এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজও ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে।
ঘ. তাঁর সমৃদ্ধ জীবন ও কর্মের স্মৃতি রক্ষার্থে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইমামুল কবীর শান্ত জাদুঘর’ এর কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।
ঙ. বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইমামুল কবীর শান্ত’র বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম আজকের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটিসহ আরো চারটি প্রতিষ্ঠানে ‘শান্ত স্মৃতিকর্ণার’ স্থাপন করা হয়েছে।
চ. স্মৃতিবৃত্তি : ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইমামুল কবীর শান্ত স্মৃতিবৃত্তি’র নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। শান্ত-মারিয়াম বিশ^বিদ্যালয়ের গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে এ বৃত্তি প্রদান করা হয়।
ছ. মানবসেবা ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান ‘আল মারকাযুল হাসপাতাল’ ও ‘শান্তি ফাউন্ডেশন’র মতো স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে নগদ টাকা ও চিকিৎসা উপকরণ দেয়া হয়েছে।
জ. শীতার্তদের সাহায্য : খুলনা, গাইবান্ধা ও নীলফামারী জেলায় শীতার্তদের মাঝে কম্বল, সুয়েটার, ওষুধ, হ্যান্ডস্যানিটাইজার ও মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে।
ঝ. দৈনিক ও সাপ্তাহিক গরিব-দুঃস্থদের মাঝে আর্থিক সহায়তা ও খাদ্য বিতরণ করা হয়। এছাড়াও মরহুম ইমামুল কবীর শান্ত এবং তাঁর প্রয়াত মা-বাবার আত্মার শান্তি ও পরিবার-পরিজনের সুখ-শান্তি কামনা করে পবিত্র রমজান মাসব্যাপী কোরআন খতম, মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করা হয়।
শেষ কথা : কর্মই মানুষকে বড় করে তোলে। সৃজনশীলতা মানুষকে করে সমৃদ্ধ আর সংস্কৃতি মানুষকে পরিশীলিত করে পূর্ণতা দেয়। এর সবটা ধারণ করেছিলেন মো. ইমামুল কবীর শান্ত। এ দেশে বেসরকারি পর্যায়ে প্রথম জীবনমুখী, সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব তাঁরই। তিনি যখন কাজ শুরু করেন, তখন এ সম্পর্কে অনেকের ধারণাই ছিল না। নানা প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে কর্মবীর মো. ইমামুল কবীর শান্ত একে একে অলাভজনক, মানবকল্যাণমুখী এবং সৃজনশীল প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তোলেন পরম মমতায়। চ্যালেঞ্জিং সত্ত্বেও ব্যতিক্রমী কাজে তিনি উৎসাহী ও পারদর্শী ছিলেন, যা আমাদের দেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে মো. ইমামুল কবীর শান্ত’র অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। একজন মানবতাবাদী, সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে চিরকাল তিনি মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করবেন, এটাই প্রত্যাশা। যেখানে থাকুন, ভালো থাকুন। জয় হোক কর্মের, জয় হোক সুন্দরের।
লেখক : শিক্ষক, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, ঢাকা।