ঢাকা ০১:২৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৯ জুলাই ২০২৫

জাহাজবোঝাই ‘বিষাক্ত’ সার নিয়ে কলম্বো-বেইজিং টানাপোড়েন

  • আপডেট সময় : ১১:৩৩:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২১
  • ৯৫ বার পড়া হয়েছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষ চীন থেকে মাল নিয়ে আসা একটি জাহাজকে তাদের জলসীমা ত্যাগ করতে বলার পরও জাহাজটি তা মানতে রাজি নয়; তারা বন্দর থেকে সরে গেলেও লঙ্কান জলসীমাতেই অবস্থান করছে। কিন্তু কেন?
উত্তর হচ্ছে- জাহাজটির নিয়ে আসা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি চালান কলম্বো আর বেইজিংয়ের মধ্যে বিরাট ঝামেলা পাকিয়ে দিয়েছে। দুই মিত্র দেশের টানাপোড়েন একটি ব্যাংক-কে কালো তালিকাভুক্ত করেছে; শ্রীলঙ্কার কৃষক আর বিজ্ঞানীদেরও তাঁতিয়ে রেখেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
যে জাহাজকে ঘিরে এত কিছু, সেই হিপো স্পিরিট সেপ্টেম্বরে চীন থেকে ২০ হাজার টন জৈব সার নিয়ে শ্রীলঙ্কার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। মে মাসে লঙ্কার সরকার হুট করেই দেশকে বিশ্বের প্রথম সম্পূর্ণ জৈব কৃষির দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে সব রাসায়নিক সারের আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কলম্বো এরপর চীনা কোম্পানি কিংদাও সিউইন বায়োটেক গ্রুপের কাছ থেকে ৯৯ হাজার টন জৈব সার কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। তার প্রথম চালানের সার নিয়ে হিপো স্পিরিট শ্রীলঙ্কায় আসে।
সবই তো ঠিক ছিল, তাহলে গোল বাধলো কোথায়?
ঝামেলা দেখা দিল সারের মান নিয়ে। শ্রীলঙ্কার বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে সার এসেছে, তা শস্যের উপকারে আসার বদলে ক্ষতি করতে পারে। “আমাদের নমুনা পরীক্ষা বলছে এই সার জীবাণুমুক্ত নয়। আমরা এগুলোর মধ্যে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া পেয়েছি যেগুলো গাজর ও আলুর মতো শস্যের জন্য ক্ষতিকর,” বলেছেন শ্রীলঙ্কার কৃষি বিভাগের মহাপরিচালক ড. অজন্তা ডি সিলভা। হিপো স্পিরিটের মালামাল যেহেতু শ্রীলঙ্কার জৈব সুরক্ষার জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তাই এগুলোকে গ্রহণ করা যায় না বলে মত বিজ্ঞানীদের।
এই সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কিংদাও সিউইন। তারা শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অযৌক্তিকভাবে ‘বিষাক্ত, আবর্জনা, দূষিত’ এবং অন্যান্য অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করে ‘চীনা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও চীন সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টের’ অভিযোগ আনে। “শ্রীলঙ্কার ন্যাশনাল প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিন সার্ভিসের (এনপিকিউ) অবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা এবং তা থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক প্রাণী ও উদ্ভিদ কোয়ারেন্টিন কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়,” বিবৃতিতে বলে কোম্পানিটি। এ নিয়ে বিতর্ক বাড়ার এক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার একটি আদালত দেশে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা সারের জন্য রাষ্ট্রমালিকানাধীন পিপলস ব্যাংকের যে ৯০ লাখ ডলার দেওয়ার কথা, তা আটকে দেয়।
এর পাল্টায় কলম্বোর চীন দূতাবাস ব্যাংকটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে।
কিংদাও সিউইন পাওনা টাকা তো চেয়েছেই এর পাশাপাশি তারা শ্রীলঙ্কান এনপিকিউর কাছে তাদের ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করায়’ ৮০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণও দাবি করেছে। একদিকে ডাঙ্গায় এসব চলছে, অন্যদিকে হিপো স্পিরিটও শ্রীলঙ্কার জলসীমা ছাড়ছে না। শ্রীলঙ্কার বন্দর কর্তৃপক্ষ অক্টোবরের শেষদিকে জাহাজটিকে মালামাল খালাসে অনুমতি না দিলে হিপো স্পিরিট কলম্বো উপকূল থেকে সরে গিয়ে দক্ষিণের হাম্বানটোটা বন্দরের দিকে রওনা দেয় বলে জানায় স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো। নৌযানের চলাচল পর্যবেক্ষণকারী একটি ওয়েবসাইটে জাহাজটিকে এখন শ্রীলঙ্কার দক্ষিণপশ্চিম উপকূলের কাছে দেখা গেছে। বার্তা স্পষ্ট- চীনের কোম্পানিটি তার মাল ফেরত নিতে ইচ্ছুক নয়। তবে চীন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকদফা বৈঠকের পর শ্রীলঙ্কার এক প্রতিমন্ত্রী শশীন্দ্র রাজাপাকসে জানিয়েছেন, দুইপক্ষই সারের নতুন নমুনা তৃতীয় পক্ষের কোনো ল্যাবে পরীক্ষার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে।
“আমাদেরকে এমনটা করতে বাধ্য করা হয়নি। তারা অনুরোধ করেছিল তাই হচ্ছে। তবে এখন যে চালান জলসীমায় আছে, সেটি শ্রীলঙ্কায় নামবে না,” বলেছেন তিনি। নতি স্বীকারে রাজি নন ডি সিলভাও।
তিনি বলেছেন, “আমরা কোম্পানিটিকে (কিংদাও সিউইন) বলেছি তারা তাদের মালামাল ফিরিয়ে নিক এবং অন্য একটি ব্যাচের তাজা নমুনা পাঠাক। যদি সেটি মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষায় উৎরে যায়, তাহলে অবশ্যই তারা সারের আরেকটি চালান পাঠাতে পারবে,” বলেছেন লঙ্কান কৃষি বিভাগের এ মহাপরিচালক। বিবিসি জানিয়েছে, চালানটি ফিরিয়ে নিলে কিংদাও সিউইন এবং চীন সরকারকে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। চীনা এ কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে জৈব সার রপ্তানি করে। এদিকে সার না পেয়ে ক্ষেপে আছে শ্রীলঙ্কার কৃষকরাও। সরকার হুট করে রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করে ভুল করেছে বলেও মত তাদের।
কৃষকদের আন্দোলনের মুখে এবং চা শিল্পের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে শ্রীলঙ্কার সরকার পরে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ তুলেও নিয়েছে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জাহাজবোঝাই ‘বিষাক্ত’ সার নিয়ে কলম্বো-বেইজিং টানাপোড়েন

আপডেট সময় : ১১:৩৩:০০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ নভেম্বর ২০২১

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষ চীন থেকে মাল নিয়ে আসা একটি জাহাজকে তাদের জলসীমা ত্যাগ করতে বলার পরও জাহাজটি তা মানতে রাজি নয়; তারা বন্দর থেকে সরে গেলেও লঙ্কান জলসীমাতেই অবস্থান করছে। কিন্তু কেন?
উত্তর হচ্ছে- জাহাজটির নিয়ে আসা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি চালান কলম্বো আর বেইজিংয়ের মধ্যে বিরাট ঝামেলা পাকিয়ে দিয়েছে। দুই মিত্র দেশের টানাপোড়েন একটি ব্যাংক-কে কালো তালিকাভুক্ত করেছে; শ্রীলঙ্কার কৃষক আর বিজ্ঞানীদেরও তাঁতিয়ে রেখেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
যে জাহাজকে ঘিরে এত কিছু, সেই হিপো স্পিরিট সেপ্টেম্বরে চীন থেকে ২০ হাজার টন জৈব সার নিয়ে শ্রীলঙ্কার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল। মে মাসে লঙ্কার সরকার হুট করেই দেশকে বিশ্বের প্রথম সম্পূর্ণ জৈব কৃষির দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে সব রাসায়নিক সারের আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কলম্বো এরপর চীনা কোম্পানি কিংদাও সিউইন বায়োটেক গ্রুপের কাছ থেকে ৯৯ হাজার টন জৈব সার কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। তার প্রথম চালানের সার নিয়ে হিপো স্পিরিট শ্রীলঙ্কায় আসে।
সবই তো ঠিক ছিল, তাহলে গোল বাধলো কোথায়?
ঝামেলা দেখা দিল সারের মান নিয়ে। শ্রীলঙ্কার বিজ্ঞানীরা বলছেন, যে সার এসেছে, তা শস্যের উপকারে আসার বদলে ক্ষতি করতে পারে। “আমাদের নমুনা পরীক্ষা বলছে এই সার জীবাণুমুক্ত নয়। আমরা এগুলোর মধ্যে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া পেয়েছি যেগুলো গাজর ও আলুর মতো শস্যের জন্য ক্ষতিকর,” বলেছেন শ্রীলঙ্কার কৃষি বিভাগের মহাপরিচালক ড. অজন্তা ডি সিলভা। হিপো স্পিরিটের মালামাল যেহেতু শ্রীলঙ্কার জৈব সুরক্ষার জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তাই এগুলোকে গ্রহণ করা যায় না বলে মত বিজ্ঞানীদের।
এই সিদ্ধান্তে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কিংদাও সিউইন। তারা শ্রীলঙ্কার গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অযৌক্তিকভাবে ‘বিষাক্ত, আবর্জনা, দূষিত’ এবং অন্যান্য অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করে ‘চীনা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও চীন সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টের’ অভিযোগ আনে। “শ্রীলঙ্কার ন্যাশনাল প্ল্যান্ট কোয়ারেন্টিন সার্ভিসের (এনপিকিউ) অবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা এবং তা থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক প্রাণী ও উদ্ভিদ কোয়ারেন্টিন কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়,” বিবৃতিতে বলে কোম্পানিটি। এ নিয়ে বিতর্ক বাড়ার এক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার একটি আদালত দেশে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা সারের জন্য রাষ্ট্রমালিকানাধীন পিপলস ব্যাংকের যে ৯০ লাখ ডলার দেওয়ার কথা, তা আটকে দেয়।
এর পাল্টায় কলম্বোর চীন দূতাবাস ব্যাংকটিকে কালো তালিকাভুক্ত করে।
কিংদাও সিউইন পাওনা টাকা তো চেয়েছেই এর পাশাপাশি তারা শ্রীলঙ্কান এনপিকিউর কাছে তাদের ‘ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করায়’ ৮০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণও দাবি করেছে। একদিকে ডাঙ্গায় এসব চলছে, অন্যদিকে হিপো স্পিরিটও শ্রীলঙ্কার জলসীমা ছাড়ছে না। শ্রীলঙ্কার বন্দর কর্তৃপক্ষ অক্টোবরের শেষদিকে জাহাজটিকে মালামাল খালাসে অনুমতি না দিলে হিপো স্পিরিট কলম্বো উপকূল থেকে সরে গিয়ে দক্ষিণের হাম্বানটোটা বন্দরের দিকে রওনা দেয় বলে জানায় স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো। নৌযানের চলাচল পর্যবেক্ষণকারী একটি ওয়েবসাইটে জাহাজটিকে এখন শ্রীলঙ্কার দক্ষিণপশ্চিম উপকূলের কাছে দেখা গেছে। বার্তা স্পষ্ট- চীনের কোম্পানিটি তার মাল ফেরত নিতে ইচ্ছুক নয়। তবে চীন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকদফা বৈঠকের পর শ্রীলঙ্কার এক প্রতিমন্ত্রী শশীন্দ্র রাজাপাকসে জানিয়েছেন, দুইপক্ষই সারের নতুন নমুনা তৃতীয় পক্ষের কোনো ল্যাবে পরীক্ষার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে।
“আমাদেরকে এমনটা করতে বাধ্য করা হয়নি। তারা অনুরোধ করেছিল তাই হচ্ছে। তবে এখন যে চালান জলসীমায় আছে, সেটি শ্রীলঙ্কায় নামবে না,” বলেছেন তিনি। নতি স্বীকারে রাজি নন ডি সিলভাও।
তিনি বলেছেন, “আমরা কোম্পানিটিকে (কিংদাও সিউইন) বলেছি তারা তাদের মালামাল ফিরিয়ে নিক এবং অন্য একটি ব্যাচের তাজা নমুনা পাঠাক। যদি সেটি মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষায় উৎরে যায়, তাহলে অবশ্যই তারা সারের আরেকটি চালান পাঠাতে পারবে,” বলেছেন লঙ্কান কৃষি বিভাগের এ মহাপরিচালক। বিবিসি জানিয়েছে, চালানটি ফিরিয়ে নিলে কিংদাও সিউইন এবং চীন সরকারকে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। চীনা এ কোম্পানিটি যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে জৈব সার রপ্তানি করে। এদিকে সার না পেয়ে ক্ষেপে আছে শ্রীলঙ্কার কৃষকরাও। সরকার হুট করে রাসায়নিক সার আমদানি বন্ধ করে ভুল করেছে বলেও মত তাদের।
কৃষকদের আন্দোলনের মুখে এবং চা শিল্পের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে শ্রীলঙ্কার সরকার পরে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ তুলেও নিয়েছে।