- সালেহ উদ্দিন আহমদ
জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান আবারো ‘নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা’র একই কৌশল অবলম্বন করলেন। ১৯৪৭ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত, কোনো অনির্দিষ্ট দিনে জামায়াতে ইসলামী যদি কোনো অনির্দিষ্ট অপরাধ করে থাকে এবং কোনো অনির্দিষ্ট ব্যক্তির মনে যদি অনির্দিষ্ট কোনো আঘাত দিয়ে থাকে, সেই জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন তিনি।
ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে অনেক অনির্দিষ্টতা বিদ্যমান। এই অনির্দিষ্টভাবে বিশাল পরিসরে ক্ষমা চাওয়াকে বলা হয় ‘ব্লাঙ্কেট এপোলোজি’ বা কম্বলে ক্ষমা। এই ঢালাও ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে যারা আন্তরিকতা বা অকপটতা খুঁজবেন, তারা বোধ হয় হতাশ হবেন।
প্রথমে আমরা বুঝতে চেষ্টা করি, শফিকুর রহমান ক্ষমা চাইবেনই বা কেন? জামায়াত কি সত্যিই কোনো দোষ করেছে যে তাকে ক্ষমা চাইতে হবে? বাংলায় একটা প্রবাদ আছে-‘ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাই না।’ এই ‘আমি কলা খাই না’র মধ্যে যে অপরাধবোধের আভাস লুকিয়ে আছে, সেটাই ঠিক করে জানান দেয় অপরাধ কোথায়।
জামায়াতের বর্তমান আমির আগের আমিরদের চেয়ে অনেক বিষয়ে খোলামেলা ও অপ্রচলিত মত প্রকাশ করেন। তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন, ছাত্রজীবনে জাসদের রাজনীতি করেছেন। তিনি বলেছেন, একাত্তরে জামায়াতের কার্যকলাপ তিনি দেখেননি। ডাকসু নির্বাচনের সময় ছাত্রলীগের ভেতর থেকে ছাত্রশিবির বের হওয়ার পর জামায়াতের আমিরের জাসদ করাকেও গুপ্ত রাজনীতির অংশ বলে মন্তব্য করা হচ্ছে দেখছি। সে যাই হোক, আমরা বরং জামায়াতের আমিরের ক্ষমা চাওয়া প্রসঙ্গেই থাকি। একাত্তরে তিনি জামায়াতের কার্যকলাপ দেখেননি, যেমন- পলাশীর প্রান্তরে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা আমরা কেউই দেখিনি। আমরা যেমনভাবে পলাশী প্রান্তরের যুদ্ধ নিয়ে পড়েছি, শফিকুর রহমানও নিশ্চয়ই তেমনভাবে বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাস পড়েছেন। অনেকে বলবেন, ইতিহাসের অপরাধবোধ থেকেই তিনি বারবার ক্ষমা চাইতে এগিয়ে আসছেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, ক্ষমা চাইতে গিয়ে একাত্তরকে তিনি সযত্নে এড়িয়ে যান, যেন ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায়টি তার কাছে নো-টাচ জোন।
ব্লাঙ্কেট এপোলোজি বা কম্বলে ক্ষমা কী? আমি আমার এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) টুলকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। এআই উত্তর দিল-‘ব্লাঙ্কেট এপোলোজি চাওয়া একটি কপট ও কৌশলী প্রচেষ্টা, যা কোনো নির্দিষ্ট অপরাধ লুকানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ধরনের ক্ষমা চাওয়ার মধ্যে জবাবদিহিতার ঘাটতি থাকে এবং নির্দিষ্ট অন্যায়-অনাচার থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেওয়া হয়।’ সরলভাবে বলতে গেলে, এই ধরনের ক্ষমা কম্বলের আড়ালে কিছু নির্দিষ্ট অপরাধ লুকিয়ে রাখে। জামায়াতের আমির যে ক্ষমা চাইছেন তা আন্তরিক নাকি শব্দের ফুলঝুরিতে অপরাধ লুকানোর চেষ্টা এই প্রশ্ন অবশ্যই তোলা যেতে পারে।
জামায়াতে ইসলামী আমির শফিকুর রহমান ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত জামায়াতের কারণে যে কোনো জায়গায়, যে কোনো ব্যক্তির ওপর যে কোনো দুর্ভোগ নেমে এসেছে, তার জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। ২২ অক্টোবর, নিউইয়র্কে এবং এর আগে এ বছরেরই ২৭ মে ঢাকায় ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।
নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে শফিকুর বলেন, “আজ, আমি আবারো প্রকাশ্যে ঘোষণা করছি যে-১৯৪৭ সাল থেকে ২০২৫ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত…এখন নিউইয়র্কে রাত ৮:১১ মিনিট-আমাদের দ্বারা সৃষ্ট সকল দুর্ভোগের জন্য, যার ওপর, যেখানেই হোক, আমরা নিঃশর্ত ক্ষমা চাইছি।”
জামায়াতে ইসলামী আমির আরো বলেন, “কিছু লোক বলে, আপনি যদি কোনো নির্দিষ্ট অপরাধ নাও করে থাকেন, তবুও আপনার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য ছিল না। আপনি অন্তত ক্ষমা চাইতে পারেন।” এই দ্বিতীয় বাক্যেই স্পষ্ট-তিনি মনে করেন জামায়াত কোনো অপরাধ করেনি। শুধু কিছু লোক মনে করছে কোথাও একটা রাজনৈতিক ভুল ছিল, আর তার জন্যই তিনি ক্ষমা চাচ্ছেন।
এখানেই দেখা যাচ্ছে, পুরো ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটা কি রাজনৈতিক মনে হচ্ছে না? এটা অপরাধের স্বীকারোক্তি নয়, বরং জনমতের চাপে কৌশলগত অভিনয় করছেন মাত্র।
জামায়াতে ইসলামীর আমির বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের প্রতি জামায়াতের সমর্থন সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ১৯৭১ সালে জামায়াত মনে করেছিল, পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখা প্রয়োজন।
তার এই পর্যবেক্ষণ অনেকটাই ঠিক এবং জামায়াতের এই সিদ্ধান্ত হয়তো নির্দোষভাবে মেনে নেওয়া যেত, ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের জন্য তারা অপরাধ না করতো। আমাদের দাদা-নানা অনেকেই তখন ‘পাকিস্তান ভাঙার’ বিরুদ্ধে ছিলেন। তাদের মতো জামায়াত যদি মনে করতো, পূর্ব পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের অংশ থাকাই ভালো, এতে কোনো অপরাধ ছিল না। যা তখন হয়তো রাজনৈতিক ভুল মনে হতো, তা সময়ের বিবর্তনে বিলীনও হয়ে যেত।
পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন থাকা এমনিতে কোনো অপরাধ বা অপকর্ম নয়। কিন্তু সমর্থনকারীরা যদি অপরাধমূলক কাজে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, যারা গণহত্যা চালিয়েছে, লুণ্ঠন, গণধর্ষণ করেছে, তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে একই অপরাধ না করতো, তাহলে তাদের ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন অপরাধ বিবেচনা করা হতো না। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মিলেমিশে জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে যেই ধরনের অপরাধ করেছে, সেই সব অপরাধ কেবল ক্ষমা চাওয়াতেই শেষ হয়ে যায় না। অথচ জামায়াতে ইসলামীর আমির ক্ষমা চাওয়ার নামেও শব্দের কারসাজি করছেন।
শুধুমাত্র ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের প্রতি তাদের সমর্থনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশে কাউকে কখনো কোনোভাবে দায়ী করা হয়নি, এমনকি সামাজিকভাবেও দোষী সাব্যস্ত হতে হয়নি। কিন্তু যারা পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করে তাদের বীভৎস অন্যায় কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন, তারা সত্যিকারের অপরাধী। পাকিস্তানের প্রতি তাদের সমর্থন আমাদের মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ জনগণ, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যু ঘটিয়েছে, ধর্ষণের শিকার হয়েছে আমাদের মা-বোনেরা এবং বিরাটসংখ্যক জনসাধারণ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে গিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরেছে। দেশজুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
একাত্তরে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস এবং শান্তিরক্ষী কমিটি আকাশ থেকে অবতীর্ণ হয়নি। এই সব বাহিনী মূলত জামায়াতের ছত্রচ্ছায়ায় গঠিত হয়েছে এবং তারা পাকিস্তানি বাহিনীর নির্দয় কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেছে। ১৯৭১ সালের এই ঘটনাগুলো ছিল নির্দিষ্ট সময়ের, নির্দিষ্ট স্থানের এবং দেশের আনাচে-কানাচে হত্যা ও আক্রমণের শিকার বহু লোক ও পরিবারও খুব নির্দিষ্ট। যারা অপরাধ করেছে তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোরও-নিশ্চিতভাবে নির্দিষ্টভাবে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ক্ষমা চাওয়ার সংস্কৃতিটা আমাদের দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত এবং বর্তমানে ভারতে পলাতক বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমে লিখিত প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার সময়ের খুন-খারাপি ও অন্যায় কর্মকাণ্ড নিয়ে কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করেননি এবং কোনো ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছাও দেখাননি।
এখন আমরা আরেকটি পরিস্থিতি ভাবতে পারি-ধরুন এক সপ্তাহ পরে শেখ হাসিনা একটি বিবৃতি দিলেন, যেখানে তিনি বললেন, “১৯৭২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যদি কোনো অপরাধ করে বা কারো মনে ব্যথা দিয়ে থাকে, তার জন্য আমরা নিঃস্বার্থভাবে ক্ষমা চাইছি।”
প্রশ্ন হলো, কে এই ক্ষমা গ্রহণ করবে? তার এই ব্লাঙ্কেট ক্ষমা প্রার্থনা কেউ গ্রহণ করবে না। সরকারও এর ফলে তার বা তার মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা প্রত্যাহার করবে না। এআই যেমন বলেছিল-অপরাধকে ঢাকা দেওয়ার জন্যই ব্লাঙ্কেট বা কম্বলে ক্ষমা চাওয়া হয়। সুতরাং এর দ্বারা ক্ষমা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
সাধারণভাবে ব্লাঙ্কেট ক্ষমা চাওয়ার সবচেয়ে বড় ভুল কী? শব্দের কারসাজির মাধ্যমে নিজেদের ভুল বা অন্যায় লুকানোর চেষ্টা। কিন্তু যারা ক্ষমা চান, তারা বুঝতে পারেন না যে, এই শব্দচয়নই অন্যায় বা ভুলগুলোকে নতুনভাবে জনগণের মনে জাগিয়ে দেয়। সুতরাং এই কম্বলে ক্ষমা চাওয়ার ফল হিতে বিপরীত হয়।
জামায়াতে ইসলামী একাত্তরে যে অপরাধ করেছে, তা ক্ষমার যোগ্য কিনা এই প্রশ্ন তো থেকেই যায়। তারপরও, যদি জামায়াত একাত্তরের ভুল ও অন্যায়ের জন্য নির্দিষ্টভাবে স্পষ্ট ক্ষমা চাইতে না পারে, তাহলে তাদের এইসব ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে চুপ থাকাই ভালো। বারবার ক্ষমা চাওয়ার এই চর্চা জনগণকে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আরো সন্দিহান করে তোলে। এটি শুধু জামায়াতের বর্তমান নেতাদের জন্যই কষ্টকর নয়, দেশের জনগণকেও কষ্ট দেয় এবং সাধারণ মানুষের বুদ্ধিমত্তাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে। আর যারা পাকিস্তানি বাহিনীর হামলার প্রত্যক্ষ শিকার ছিলেন, তাদের পরিবারবর্গের কথা তো বলাই বাহুল্য-এমনকি তাদের বেদনা ও ক্ষত কখনো কোনো ক্ষমা প্রার্থনার মধ্যে ঢাকা পড়বার নয়।
জামায়াতের আরেকটি উপায় আছে-তারা একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতার জন্য জাতির কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইতে পারে। কোনো শব্দের মারপ্যাঁচ নয়, সময়ের অস্পষ্টতা নয়; অকপট ও শুদ্ধভাবে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারে-এটা অন্তত আন্তরিক হবে এবং এক সময় বাংলাদেশের মানুষ তাদের আন্তরিকতার জন্য হয়তো তাদেরকে ক্ষমাও করবে।
তার আগপর্যন্ত ১৯৭১ জামায়াতের জন্য একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হিসেবে থাকবে-সঠিক পরিবেশে বিস্ফোরণের অপেক্ষায়। বিএনপি ১৯৭১ সালে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে কিছুটা সোচ্চার; এনসিপিও মনে হচ্ছে জামায়াতের কক্ষপথ থেকে এখন দূরে সরে যাচ্ছে। তাদের নেতারা সাম্প্রতিককালে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনায় তীব্রতর হচ্ছেন।
আসন্ন নির্বাচনে এনসিপি যদি বিএনপির সঙ্গে জোটভুক্ত হয় তাহলে তারা জামায়াতকে কোণঠাসা করতে, অবধারিতভাবে একাত্তরের নৃশংসতা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতাকে জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। সেটাই হবে জামায়াতের জন্য আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ।
তখন কোনো সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনাই তেমন কাজে দেবে না-অনেক দেরি হয়ে যাবে। তবে এখনো জামায়াতের সুযোগ রয়েছে শব্দের কারসাজি বাদ দিয়ে, প্রত্যক্ষ ও স্পষ্ট করে ক্ষমা চাওয়ার।
বিজ্ঞানী বেনজামিন ফ্র্যাংকলিনের একটি উক্তি মনে রাখতে হবে-‘কখনো অজুহাত দিয়ে ক্ষমা চাওয়াকে নষ্ট করবে না।’ জামায়াতে ইসলামী যদি কোনো অজুহাত ছাড়া একাত্তরের অপরাধের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষমা চায়, তাহলে তাদের রাজনীতিতে পথচলা আরো সুগম হতেও পারে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলামিস্ট
সানা/আপ্র/০১/১১/২০২৫

















