নিজস্ব প্রতিবেদক : কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা দিতে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ নেই বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও ব্যাংকগুলো দাবি করছে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় তাদেরকে ঋণ দেওয়া যাচ্ছে না। জানা গেছে, সরকার ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন ঋণ সুবিধা দিতে দুই হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কীম নামে এই তহবিলের আওতায় জামানত ছাড়াই প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চার শতাংশ সুদে এই ঋণের সুযোগ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে এই পর্যন্ত ৩৭টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান চুক্তিবদ্ধ হলেও এই সুবিধা দিয়েছে মাত্র ১২টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাকি ২৫টি চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান এখনো এই সুবিধা চালু করেনি। সিজিএস সুবিধা চালু না করা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে জনতা, রূপালি, বিকেবি, বেসিক, পূবালী, মার্কেন্টাইল, এক্সিম ব্যাংক এশিয়া, মিউচুয়াল ট্রাষ্ট, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স, এনআরবি, প্রিমিয়ার ইউনিয়ন, ডাচ্ বাংলা, স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, সোস্যাল ইসলামী, সাউথ ইস্ট, আইপিডিসি, অগ্রণী এসএমই, আল আরাফাহ ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, মেঘনা, মধুমতি, এনসিসি, এনআরবিসি ব্যাংক। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সিজিএস সুবিধা চালু করা হলেও চুক্তিবদ্ধ ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানগুলো শুধুমাত্র পরিচিত এবং আগে থেকেই সুবিধাপ্রাপ্ত নিজস্ব গ্রাহকদেরকে এ সুবিধা দিলেও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত নতুন কোন গ্রাহকদেরকে সিজিএস সুবিধা দিচ্ছে না। চুক্তিবদ্ধ এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সিজিএস সুবিধা চালু না করার কারণ হিসাবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিজিএস বিষয়টি নতুন হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক এই বিষয়ে পর্যাপ্ত গাইডলাইন এবং প্রজ্ঞাপন জারি করলেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এর পরিচালনা পদ্ধতি সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত নয়। শুধু তাই নয়, প্রতিটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শাখাগুলোতে নিবেদিত এবং প্রশিক্ষিত কর্মকর্তা নিয়োজিত রাখার কথা বললেও সেটি না করা গ্যারান্টি আবেদন কম সংখ্যক হওয়ার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া, ব্যাংকিং খাতে জামানতবিহীন ঋণ প্রদানের মানসিকতা না থাকা, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের মধ্যে সিজিএস সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা এবং প্রশিক্ষণ না থাকা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যবাধকতা আরোপ না করা, ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা না থাকাকে দায়ী করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, যাদের জামানত নেই তারা যাতে সিজিএসের আওতায় ঋণ পেয়ে ভালো ব্যবসা করতে পারে সে জন্য এই তহবিল করা হয়েছে। এই তহবিলের আওতায় ঋণ বিতরণের পরিমাণ বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তারপরেও ঋণ বিতরণের পরিমাণ খুব বেশি বাড়ছে না।
সূত্র মতে, সিএমএসএমই খাতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিতরণ করা জামানতবিহীন ঋণের ঝুঁকি বহনের জন্য ২০২০ সালের ২৭ জুলাই দুই হাজার কোটি টাকার একটি স্কিম গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তহবিলের পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা হলেও এর বিপরীতে ৬ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঋণের গ্যারান্টি দেওয়া যাবে। এই স্কিমের আওতায় বিতরণ করা কোনো ঋণ খেলাপি হলে তার ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। এই স্কিমে সহায়তা দিতে বিদেশি সহযোগী সংস্থাগুলোও যুক্ত হচ্ছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, করোনা মহামারিতে সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে প্রয়োজনীয় জামানত দিতে পারেন না। ফলে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকলেও জামানত না থাকায় তারা ঋণ পাচ্ছে না। এসব দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক দুই হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করে। এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্টে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম (সিজিএস) ইউনিটও গঠন করা হয়েছে। ঋণ বিতরণের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম ম্যানুয়াল-২০২০ প্রণয়ন করা হয়। সেই আলোকে ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে এ স্কিমের আওতায় ঋণ বা বিনিয়োগ গ্যারান্টির পরিমাণ সর্বনি¤œ দুই লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গ্যারান্টির মেয়াদ ধরা হয়েছে এক বছর। পরবর্তীতে সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের চাহিদা বিবেচনা করে আরো বেশি গ্রাহককে সুবিধা দিতে ২৫ হাজার টাকার ঋণকেও ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর একজন গ্রাহকের সর্বোচ্চ এক কোটি টাকার ঋণ এই স্কিমের সুবিধা পাবে। এর আগে এই স্কিমের আওতায় সর্বনি¤œ ২ লাখ টাকা ও সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকার ঋণে গ্যারান্টি সুবিধা ছিল। আরও বেশি গ্রাহককে গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া, ১০ টাকা, ৫০ ও ১০০ টাকার হিসাবধারী প্রান্তিক, ভূমিহীন কৃষক, নি¤œ আয়ের পেশাজীবী, স্কুল ব্যাংকিং হিসাবধারী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য গঠিত পুন:অর্থায়ন স্কিমের উদ্যোক্তাদেরও ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের আওতায় আনা হয়েছে। এদিকে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে এই খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আবারও ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি ২২) ঋণ অনুমোদন হয়েছে ৪ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ঋণ পেয়েছেন ২ হাজার ৪৩৭ জন নারী উদ্যোক্তা। এসব ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ, তবে এর মধ্যে সরকার ৫ শতাংশ ভর্তুকি দিচ্ছে।
জামানতবিহীন ঋণে ব্যাংকগুলোর অনাগ্রহ
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ