ঢাকা ০৯:০৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫

জান্নাতি নারীদের মর্যাদা ও হুরদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব

  • আপডেট সময় : ০৮:১৪:০৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫
  • ৮ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

 

মুফতি আ. জ. ম. ওবায়দুল্লাহ্

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন স্থানে জান্নাতের হুরদের সম্মান, রূপ-সৌন্দর্য ও গঠন-প্রকৃতির ব্যাপক প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সৌন্দর্য ও মর্যাদা বিবেচনায় দুনিয়ার নেককার স্ত্রীগণ হুরদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য লাভ করবেন। এ ব্যাপারে ‘আল-মুজামুল কাবীর’-এ হজরত উম্মে সালামা (রা.) থেকে একখানা হাদিস বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, আমি একদা রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করলাম- ইয়া রাসূলাল্লাহ, কারা বেশি শ্রেষ্ঠ জান্নাতের হুর না পৃথিবীর নেককার নারী?

(এ প্রশ্ন সৃষ্টি হলো কেন? দুনিয়ার নারীদের তো সৃষ্টি করা হয়েছে পচা মাটি দিয়ে; যাদের থেকে মলমূত্র বের হয়। পক্ষান্তরে জান্নাতের হুরদের মেশকে আম্বর, জাফরান, কাপুর দ্বারা তৈরী করা হয়েছে। যারা দুনিয়ার মধ্যে নিজেদের আঙ্গুল বের করলে পুরো পৃথিবী সুঘ্রাণে ভরে যাবে। পৃথিবীকে মোহিত করে তুলবে তার সুবাস! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা? তবুও রাসুল (সা.)-কে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে?)।

রাসুল (সা.) উত্তরে বললেন, ‘হে উম্মে সালামা! পৃথিবীর সৎ নারী জান্নাতের হুর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যেমনিভাবে পোশাকের অভ্যন্তরীণ অপেক্ষা বাইরের অংশ বেশি আকর্ষণীয় ও সৌন্দর্যময়।’

উম্মে সালামা (রা.) তখন এর কারণ জানতে চাইলেন। নবীজি (সা.) বললেন, কারণ হলো- পৃথিবীর মুমিনা নারীরা সালাত আদায় করেন, সিয়াম পালন করেন এবং তারা ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহতাআলার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেন। আল্লাহতাআলা তাদের চেহারাকে আলোকিত করবেন এবং তাদের আচ্ছাদিত করবেন রেশম দ্বারা। তাদের চেহারা হবে উজ্জ্বল চাঁদের মতো; আর তাদের পোশাকের রং হবে সবুজাভ এবং তারা সোনার অলঙ্কার পরবে। তারা মিষ্টি মধুর কণ্ঠে গান গেয়ে গেয়ে বলবে, ‘আমরা সেসব নারী- যারা চিরতরুণী, অবিনশ্বর। আমাদের আবাস্থল চির আরামপ্রদ এবং আমরা কখনোই কষ্টের সম্মুখীন হবো না। আমরা কখনই আমাদের সংগীকে ছেড়ে যাব না। আমরা সদা হাস্যোজ্জ্বল। সেসব পুরুষদের জন্য সুখবর! আমরা যাদের সংগী হবো, যারা আমাদের সঙ্গী হবে’ [তাবারানী আল-মুজামুল কাবীর, হাদিস-৮৭০]।

এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, উপরোক্ত হাদীসে নামাজ, রোজা ইত্যাদি উল্লেখ করার পর আলাদাভাবে ইবাদতের কথা বলার কী প্রয়োজন? উত্তর হলো- আমরা কেবল নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদিকে ইবাদত মনে করি, অন্য কাজগুলোকে ইবাদত মনে করি না। আসলে ব্যাপারটি কিন্তু তা নয়। আমরা যে ব্যবসা-বাণিজ্য, আয়-রোজগার ও দুনিয়ার বিভিন্ন কাজে সময় ব্যয় করি; তার সব কিছু যদি আল্লাহর হুকুম মেনে করি এবং হালালকে প্রাধান্য দিয়ে হারাম থেকে বেঁচে থাকি; তাহলে তাও তখন আল্লাহর ইবাদতে পরিণত হয়ে যায়।

সুতরাং হাদিসের যেখানে ইবাদতের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, এর অর্থ হবে- পুরা জীবন বন্দেগিতে পরিণত করা। আর তা হবে আল্লাহর ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমে।

সর্বোপরি দুনিয়ার নেককার স্ত্রীদের নামাজ, রোজা, ইবাদত সবই হবে আল্লাহর জন্য। বিনিময়ে আল্লাহ আল্লাহ পাক তাদের চেহারায় নূর দেবেন। তাদের অপরূপ শরীরে রেশম জুড়ে দেবেন। নিখাঁদ স্বর্ণের অলংকার সজ্জিত করবেন। সুঘ্রাণ বিস্তারকারী আংটি পরাবেন। এমনিভাবে তাদের আংটি থেকে ছড়ানো স্নিগ্ধতায় পরিবেশ সুরভিত হয়ে যাবে।

এ ব্যাপারে আল্লাহর প্রিয় বন্ধু মানবকুলের সর্দার মুহাম্মদ (সা.) বলেন, তাদের এমন আংটি দেয়া হবে; যা থেকে খুশবু ছড়াবে, সে আংটিগুলো হবে মতির তৈরি।

মোট কথা, দুনিয়ার জান্নাতি স্ত্রীরা হবেন হুরদের সর্দার এবং হুররা তাদের সেবিকা হিসেবে নিয়োজিত থাকবে। এ ব্যাপারে তিরমিজি শরীফে এসেছে, নিম্নমানের জান্নাতিদের জন্য ৮০ হাজার খাদেম থাকবে- যারা মনিমুক্তার ন্যায় বিচরণ করবে এবং তাদের আদেশ পালনে নিয়োজিত থাকবে। এটা নারী এবং পুরুষ সবার জন্যই থাকবে। আর জান্নাত হবে হিংসা-বিদ্বেষহীন; যেখানে স্বামীর অধিক পরিমাণ হুর দেখেও নারীদের কোনো প্রকার হিংসা হবে না, বরং তারা হবে কামিনী, পুর্ণযৌবনা, সমবয়স্কা ও স্বামী অনুরাগী [তিরমিজি শরীফ]।

জান্নাতের হুররা অত্যদিক সৌন্দর্যে মোড়ানো থাকবে। আর এতেও জান্নাতে মুসলিম নারীদের মর্যাদা ও সৌন্দর্য হবে তাদের অনেক উপরে। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, দুনিয়ার এসব নারীদের জন্য যারা স্বামী হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের মর্যাদা কতই না উত্তম ও শ্রেষ্ঠ!

এই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব চিন্তা করতে হলে কেবল কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত হুরদের বর্ণনা দেখুন আর চিন্তা করুন যে, হুরদের সৌন্দর্য ও মর্যাদা যদি এতো অধিক হয়; তাহলে দুনিয়ার নেককার স্ত্রীদের সৌন্দর্য ও মর্যাদা আরো কত অধিক হবে! আবার চিন্তা করুন- দুনিয়ার নেককার স্ত্রী এবং হুরদের সৌন্দর্য ও মর্যাদা যদি এতো অধিক হয়; তাহলে তাদের স্বামী তথা জান্নাতি পুরুষদের সৌন্দর্য, সম্মান ও মর্যাদা কতো অধিক হবে; তা আসলেই চিন্তা করে উপলব্ধি করা যায় না।

জান্নাতি নারী ও হুরদের মধ্যে সংলাপ: জান্নাতে যদিও কোনো ঝগড়া বা তর্ক-বিতর্কের স্থান নেই; তবুও তথায় হুররা ও দুনিয়ার নেককার স্ত্রীদের মধ্যে একটা বিতর্ক বা সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে; যা ইমাম কুরতুবী (রহ.) তার স্বীয় তাফসিরে কুরতুবিতে উল্লেখ করেছেন। আর তাদের সে বিতর্ক গতানুগতিক কোনো ঝগড়া নয় বা হিংসা-বিদ্বেষমূলক কোনো তর্ক নয়; বরং তা হবে মধুর সংলাপ বা মধুর বিতর্ক-আলাপন- যেহেতু জান্নাতে কোনোক্রমেই হিংসা-বিদ্বেষমূলক বিতর্ক বা ঝগড়া সংঘটিত হবে না।

বিষয়টি একটু উদাহরণ দিয়ে বললে বুঝতে অনেক সহজ হবে। যেমন দুনিয়ায় অনেক সময় দেখা যায়, অন্তরঙ্গ বন্ধু-বান্ধব একত্র হয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হাস্য-রসের সাথে তর্ক-বিতর্ক ও আলাপচারিতায় লিপ্ত হয়, উদ্দেশ্য গতানুগতিক কোন ঝগড়া নয়; বরং এর মধ্য দিয়ে তারা একটু আনন্দ ও তৃপ্তি অনুভব করে সময় কাটায়।

ঠিক তেমনি জান্নাতি নারী ও হুরদের মধ্যেও অনুরূপ মধুর সংলাপ বা বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে। বিতর্কের প্রথম পর্যায়ে হুররা জান্নাতি নারীদের উদ্দেশ্যে বলবেন, আমরা তোমাদের থেকে শ্রেষ্ঠ। কারণ আমরা সৃষ্টির সূচনা হতে আজ অবধি চিরযৌবনা ও কুমারী ছিলাম, এখনো আছি ও চিরদিন থাকবো, কখনো বার্ধক্যে উপনীত হইনি এবং হবোও না, মৃত্যু আমাদেরকে কখনো স্পর্শ করেনি ও করবেও না। আমরা চিরকৃতজ্ঞ, আমরা কখনো অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিনি এবং করবোও না। আমরা চির বন্ধু, স্থায়ী বন্ধনে আবদ্ধ। আমাদের কখনো বিচ্ছেদ হবে না।

দুনিয়াবাসীদের মধ্যে উপরের চারটি দোষই রয়েছে; চাই পুরুষ হোক বা নারী হোক- সকলের মধ্যেই আছে। আমরা দুনিয়াবাসী বৃদ্ধ হই, আপোষে আমাদের বিবাদ-বিসংবাদ হয়, আমাদের বিচ্ছেদও ঘটে, আর আমাদের সকলের মৃত্যু ছাড়া তো কোন গতি নেই।

সবই সত্য। তবুও ইমানদার জান্নাতি নারীরা উত্তরে বলবে- আমরা নামাজ কায়েম করেছি, তোমরা নামাজ পড়োনি। আমরা সিয়াম পালন করেছি, তোমরা সিয়াম সাধনা করোনি। আমরা অজু করেছি, তোমরা কখনো অজু করোনি। আমরা আল্লাহর নামে দান-খয়রাত করেছি, তোমরা তো কখনো আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করোনি। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, শেষ পর্যন্ত ঈমানদার মহিলারাই বিজয়ী হবে [তাফসিরে কুরতুবি-১৭/১৬১, তাফসিরে কুশাইরি-৭/৩৬৫]।

জান্নাতি নারীরা হুরদের ওপর বিজয়ী হলো কেন? নিশ্চয়ই ইমান, তাকওয়া, সতিত্ব ও পবিত্রতা রক্ষা করার কারণে। উল্লেখিত কারণেই আল্লাহ তাআলা জান্নাতি নারীদের সম্মান বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। আর সেসব হুরদেরকে জান্নাতি নারীদের খাদেমা বা চাকরানী বানিয়ে দিয়েছেন।

একজন আরবি কবি খুব সুন্দরভাবে এ ঘটনাকে নিজের কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন; যার ভাবার্থ হলো- হুররা বলবে, তোমরা তো দুনিয়ার সংকীর্ণতা অতিক্রম করেছো, কবরের অন্ধকার অতিক্রম করেছো, মাটির দেহকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে এসেছো। আর আমাদের জন্ম জান্নাতে, জান্নাতুল ফিরদাউস আমাদের বিচরণ ভূমি। চিরস্থায়ী রাজ-প্রাসাদ আমাদের আবাসস্থল।

তাদের কথার উত্তরে জান্নাতি নারীরা বলবে- আমাদের প্রভুই তো আমাদের মৃত্যু দিয়েছেন, তোমরা তো দাওনি। এজন্য আমরা আল্লাহর প্রশংসা করি। আচ্ছা বল তো দেখি, আমাদের পিতা কি আদম (আ.) নন? যার সামনে সব ফেরেশতারা সেজদায় লুটে পড়েছিল। আমাদের পিতাকে ফেরেশতাকুল সেজদা করেছে- এ দৃশ্য সবাই দেখেছে।

রাত-দুপুরে যখন আঁধার ছেয়ে যায়, তারকাগুলোর আলো মন্দা হয়ে যায়, তখন চুপি চুপি উঠে জায়নামাজে দাঁড়ানো এবং আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসানোর মজাই আলাদা; তোমরা তা বুঝবে কী করে! আমাদের সে ইবাদত কেউ না দেখলেও স্বয়ং আল্লাহ তা দেখেন। সে স্বাদ শুধু আমরাই বুঝি। রাতে উঠে আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানোর মজা এক ধরনের; আর জান্নাতের মজা অন্য ধরনের। চুপি চুপি আল্লাহর কাছে কান্নাকাটির স্বাদ আর জান্নাতের স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন; দুটো এক নয়। তোমরা সে স্বাদ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত।

আচ্ছা ইবাদত-বন্দেগির কথা যদি বাদও দিই, আমরা তো সে মাতৃজাতি- যাদের উদর হয়ে নবী-রাসুলদের আগমন, তারা তো তোমাদের উদরে আসেনি। আমাদের কোলে আম্বিয়ায়ে কেরাম লালিত-পালিত হয়েছেন। আমরা তো আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছি। শুধু কি তাই? আল্লাহর প্রিয় নবী ও প্রিয় বন্ধুর ইহজগতে পদার্পণ আমাদের মাধ্যমেই। আবার আমাদের কোলেই তিনি লালিত-পালিত হয়েছেন।

বিতর্ক চলছে তো চলছেই। কিন্তু ফয়সালা দেবে কে? স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরশে আজিমের ওপর থেকে ফয়সালা দেবেন স্বীয় প্রিয় ইমানদার বান্দিদের পক্ষে। সুবহানাল্লাহ!

লেখক: কবি, প্রবন্ধকার ও গবেষক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জান্নাতি নারীদের মর্যাদা ও হুরদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব

আপডেট সময় : ০৮:১৪:০৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫

 

মুফতি আ. জ. ম. ওবায়দুল্লাহ্

পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন স্থানে জান্নাতের হুরদের সম্মান, রূপ-সৌন্দর্য ও গঠন-প্রকৃতির ব্যাপক প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সৌন্দর্য ও মর্যাদা বিবেচনায় দুনিয়ার নেককার স্ত্রীগণ হুরদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য লাভ করবেন। এ ব্যাপারে ‘আল-মুজামুল কাবীর’-এ হজরত উম্মে সালামা (রা.) থেকে একখানা হাদিস বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, আমি একদা রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করলাম- ইয়া রাসূলাল্লাহ, কারা বেশি শ্রেষ্ঠ জান্নাতের হুর না পৃথিবীর নেককার নারী?

(এ প্রশ্ন সৃষ্টি হলো কেন? দুনিয়ার নারীদের তো সৃষ্টি করা হয়েছে পচা মাটি দিয়ে; যাদের থেকে মলমূত্র বের হয়। পক্ষান্তরে জান্নাতের হুরদের মেশকে আম্বর, জাফরান, কাপুর দ্বারা তৈরী করা হয়েছে। যারা দুনিয়ার মধ্যে নিজেদের আঙ্গুল বের করলে পুরো পৃথিবী সুঘ্রাণে ভরে যাবে। পৃথিবীকে মোহিত করে তুলবে তার সুবাস! কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা? তবুও রাসুল (সা.)-কে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে?)।

রাসুল (সা.) উত্তরে বললেন, ‘হে উম্মে সালামা! পৃথিবীর সৎ নারী জান্নাতের হুর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যেমনিভাবে পোশাকের অভ্যন্তরীণ অপেক্ষা বাইরের অংশ বেশি আকর্ষণীয় ও সৌন্দর্যময়।’

উম্মে সালামা (রা.) তখন এর কারণ জানতে চাইলেন। নবীজি (সা.) বললেন, কারণ হলো- পৃথিবীর মুমিনা নারীরা সালাত আদায় করেন, সিয়াম পালন করেন এবং তারা ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহতাআলার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করেন। আল্লাহতাআলা তাদের চেহারাকে আলোকিত করবেন এবং তাদের আচ্ছাদিত করবেন রেশম দ্বারা। তাদের চেহারা হবে উজ্জ্বল চাঁদের মতো; আর তাদের পোশাকের রং হবে সবুজাভ এবং তারা সোনার অলঙ্কার পরবে। তারা মিষ্টি মধুর কণ্ঠে গান গেয়ে গেয়ে বলবে, ‘আমরা সেসব নারী- যারা চিরতরুণী, অবিনশ্বর। আমাদের আবাস্থল চির আরামপ্রদ এবং আমরা কখনোই কষ্টের সম্মুখীন হবো না। আমরা কখনই আমাদের সংগীকে ছেড়ে যাব না। আমরা সদা হাস্যোজ্জ্বল। সেসব পুরুষদের জন্য সুখবর! আমরা যাদের সংগী হবো, যারা আমাদের সঙ্গী হবে’ [তাবারানী আল-মুজামুল কাবীর, হাদিস-৮৭০]।

এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, উপরোক্ত হাদীসে নামাজ, রোজা ইত্যাদি উল্লেখ করার পর আলাদাভাবে ইবাদতের কথা বলার কী প্রয়োজন? উত্তর হলো- আমরা কেবল নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদিকে ইবাদত মনে করি, অন্য কাজগুলোকে ইবাদত মনে করি না। আসলে ব্যাপারটি কিন্তু তা নয়। আমরা যে ব্যবসা-বাণিজ্য, আয়-রোজগার ও দুনিয়ার বিভিন্ন কাজে সময় ব্যয় করি; তার সব কিছু যদি আল্লাহর হুকুম মেনে করি এবং হালালকে প্রাধান্য দিয়ে হারাম থেকে বেঁচে থাকি; তাহলে তাও তখন আল্লাহর ইবাদতে পরিণত হয়ে যায়।

সুতরাং হাদিসের যেখানে ইবাদতের প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, এর অর্থ হবে- পুরা জীবন বন্দেগিতে পরিণত করা। আর তা হবে আল্লাহর ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্যের মাধ্যমে।

সর্বোপরি দুনিয়ার নেককার স্ত্রীদের নামাজ, রোজা, ইবাদত সবই হবে আল্লাহর জন্য। বিনিময়ে আল্লাহ আল্লাহ পাক তাদের চেহারায় নূর দেবেন। তাদের অপরূপ শরীরে রেশম জুড়ে দেবেন। নিখাঁদ স্বর্ণের অলংকার সজ্জিত করবেন। সুঘ্রাণ বিস্তারকারী আংটি পরাবেন। এমনিভাবে তাদের আংটি থেকে ছড়ানো স্নিগ্ধতায় পরিবেশ সুরভিত হয়ে যাবে।

এ ব্যাপারে আল্লাহর প্রিয় বন্ধু মানবকুলের সর্দার মুহাম্মদ (সা.) বলেন, তাদের এমন আংটি দেয়া হবে; যা থেকে খুশবু ছড়াবে, সে আংটিগুলো হবে মতির তৈরি।

মোট কথা, দুনিয়ার জান্নাতি স্ত্রীরা হবেন হুরদের সর্দার এবং হুররা তাদের সেবিকা হিসেবে নিয়োজিত থাকবে। এ ব্যাপারে তিরমিজি শরীফে এসেছে, নিম্নমানের জান্নাতিদের জন্য ৮০ হাজার খাদেম থাকবে- যারা মনিমুক্তার ন্যায় বিচরণ করবে এবং তাদের আদেশ পালনে নিয়োজিত থাকবে। এটা নারী এবং পুরুষ সবার জন্যই থাকবে। আর জান্নাত হবে হিংসা-বিদ্বেষহীন; যেখানে স্বামীর অধিক পরিমাণ হুর দেখেও নারীদের কোনো প্রকার হিংসা হবে না, বরং তারা হবে কামিনী, পুর্ণযৌবনা, সমবয়স্কা ও স্বামী অনুরাগী [তিরমিজি শরীফ]।

জান্নাতের হুররা অত্যদিক সৌন্দর্যে মোড়ানো থাকবে। আর এতেও জান্নাতে মুসলিম নারীদের মর্যাদা ও সৌন্দর্য হবে তাদের অনেক উপরে। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, দুনিয়ার এসব নারীদের জন্য যারা স্বামী হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে, তাদের মর্যাদা কতই না উত্তম ও শ্রেষ্ঠ!

এই মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব চিন্তা করতে হলে কেবল কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত হুরদের বর্ণনা দেখুন আর চিন্তা করুন যে, হুরদের সৌন্দর্য ও মর্যাদা যদি এতো অধিক হয়; তাহলে দুনিয়ার নেককার স্ত্রীদের সৌন্দর্য ও মর্যাদা আরো কত অধিক হবে! আবার চিন্তা করুন- দুনিয়ার নেককার স্ত্রী এবং হুরদের সৌন্দর্য ও মর্যাদা যদি এতো অধিক হয়; তাহলে তাদের স্বামী তথা জান্নাতি পুরুষদের সৌন্দর্য, সম্মান ও মর্যাদা কতো অধিক হবে; তা আসলেই চিন্তা করে উপলব্ধি করা যায় না।

জান্নাতি নারী ও হুরদের মধ্যে সংলাপ: জান্নাতে যদিও কোনো ঝগড়া বা তর্ক-বিতর্কের স্থান নেই; তবুও তথায় হুররা ও দুনিয়ার নেককার স্ত্রীদের মধ্যে একটা বিতর্ক বা সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে; যা ইমাম কুরতুবী (রহ.) তার স্বীয় তাফসিরে কুরতুবিতে উল্লেখ করেছেন। আর তাদের সে বিতর্ক গতানুগতিক কোনো ঝগড়া নয় বা হিংসা-বিদ্বেষমূলক কোনো তর্ক নয়; বরং তা হবে মধুর সংলাপ বা মধুর বিতর্ক-আলাপন- যেহেতু জান্নাতে কোনোক্রমেই হিংসা-বিদ্বেষমূলক বিতর্ক বা ঝগড়া সংঘটিত হবে না।

বিষয়টি একটু উদাহরণ দিয়ে বললে বুঝতে অনেক সহজ হবে। যেমন দুনিয়ায় অনেক সময় দেখা যায়, অন্তরঙ্গ বন্ধু-বান্ধব একত্র হয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হাস্য-রসের সাথে তর্ক-বিতর্ক ও আলাপচারিতায় লিপ্ত হয়, উদ্দেশ্য গতানুগতিক কোন ঝগড়া নয়; বরং এর মধ্য দিয়ে তারা একটু আনন্দ ও তৃপ্তি অনুভব করে সময় কাটায়।

ঠিক তেমনি জান্নাতি নারী ও হুরদের মধ্যেও অনুরূপ মধুর সংলাপ বা বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে। বিতর্কের প্রথম পর্যায়ে হুররা জান্নাতি নারীদের উদ্দেশ্যে বলবেন, আমরা তোমাদের থেকে শ্রেষ্ঠ। কারণ আমরা সৃষ্টির সূচনা হতে আজ অবধি চিরযৌবনা ও কুমারী ছিলাম, এখনো আছি ও চিরদিন থাকবো, কখনো বার্ধক্যে উপনীত হইনি এবং হবোও না, মৃত্যু আমাদেরকে কখনো স্পর্শ করেনি ও করবেও না। আমরা চিরকৃতজ্ঞ, আমরা কখনো অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিনি এবং করবোও না। আমরা চির বন্ধু, স্থায়ী বন্ধনে আবদ্ধ। আমাদের কখনো বিচ্ছেদ হবে না।

দুনিয়াবাসীদের মধ্যে উপরের চারটি দোষই রয়েছে; চাই পুরুষ হোক বা নারী হোক- সকলের মধ্যেই আছে। আমরা দুনিয়াবাসী বৃদ্ধ হই, আপোষে আমাদের বিবাদ-বিসংবাদ হয়, আমাদের বিচ্ছেদও ঘটে, আর আমাদের সকলের মৃত্যু ছাড়া তো কোন গতি নেই।

সবই সত্য। তবুও ইমানদার জান্নাতি নারীরা উত্তরে বলবে- আমরা নামাজ কায়েম করেছি, তোমরা নামাজ পড়োনি। আমরা সিয়াম পালন করেছি, তোমরা সিয়াম সাধনা করোনি। আমরা অজু করেছি, তোমরা কখনো অজু করোনি। আমরা আল্লাহর নামে দান-খয়রাত করেছি, তোমরা তো কখনো আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করোনি। হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, শেষ পর্যন্ত ঈমানদার মহিলারাই বিজয়ী হবে [তাফসিরে কুরতুবি-১৭/১৬১, তাফসিরে কুশাইরি-৭/৩৬৫]।

জান্নাতি নারীরা হুরদের ওপর বিজয়ী হলো কেন? নিশ্চয়ই ইমান, তাকওয়া, সতিত্ব ও পবিত্রতা রক্ষা করার কারণে। উল্লেখিত কারণেই আল্লাহ তাআলা জান্নাতি নারীদের সম্মান বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। আর সেসব হুরদেরকে জান্নাতি নারীদের খাদেমা বা চাকরানী বানিয়ে দিয়েছেন।

একজন আরবি কবি খুব সুন্দরভাবে এ ঘটনাকে নিজের কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন; যার ভাবার্থ হলো- হুররা বলবে, তোমরা তো দুনিয়ার সংকীর্ণতা অতিক্রম করেছো, কবরের অন্ধকার অতিক্রম করেছো, মাটির দেহকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে এসেছো। আর আমাদের জন্ম জান্নাতে, জান্নাতুল ফিরদাউস আমাদের বিচরণ ভূমি। চিরস্থায়ী রাজ-প্রাসাদ আমাদের আবাসস্থল।

তাদের কথার উত্তরে জান্নাতি নারীরা বলবে- আমাদের প্রভুই তো আমাদের মৃত্যু দিয়েছেন, তোমরা তো দাওনি। এজন্য আমরা আল্লাহর প্রশংসা করি। আচ্ছা বল তো দেখি, আমাদের পিতা কি আদম (আ.) নন? যার সামনে সব ফেরেশতারা সেজদায় লুটে পড়েছিল। আমাদের পিতাকে ফেরেশতাকুল সেজদা করেছে- এ দৃশ্য সবাই দেখেছে।

রাত-দুপুরে যখন আঁধার ছেয়ে যায়, তারকাগুলোর আলো মন্দা হয়ে যায়, তখন চুপি চুপি উঠে জায়নামাজে দাঁড়ানো এবং আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসানোর মজাই আলাদা; তোমরা তা বুঝবে কী করে! আমাদের সে ইবাদত কেউ না দেখলেও স্বয়ং আল্লাহ তা দেখেন। সে স্বাদ শুধু আমরাই বুঝি। রাতে উঠে আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানোর মজা এক ধরনের; আর জান্নাতের মজা অন্য ধরনের। চুপি চুপি আল্লাহর কাছে কান্নাকাটির স্বাদ আর জান্নাতের স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন; দুটো এক নয়। তোমরা সে স্বাদ থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত।

আচ্ছা ইবাদত-বন্দেগির কথা যদি বাদও দিই, আমরা তো সে মাতৃজাতি- যাদের উদর হয়ে নবী-রাসুলদের আগমন, তারা তো তোমাদের উদরে আসেনি। আমাদের কোলে আম্বিয়ায়ে কেরাম লালিত-পালিত হয়েছেন। আমরা তো আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মত হওয়ার গৌরব অর্জন করেছি। শুধু কি তাই? আল্লাহর প্রিয় নবী ও প্রিয় বন্ধুর ইহজগতে পদার্পণ আমাদের মাধ্যমেই। আবার আমাদের কোলেই তিনি লালিত-পালিত হয়েছেন।

বিতর্ক চলছে তো চলছেই। কিন্তু ফয়সালা দেবে কে? স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরশে আজিমের ওপর থেকে ফয়সালা দেবেন স্বীয় প্রিয় ইমানদার বান্দিদের পক্ষে। সুবহানাল্লাহ!

লেখক: কবি, প্রবন্ধকার ও গবেষক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ