ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সরকার মুহাম্মদ শামসুদ্দিন : জুলাই-আগস্ট ২৪ বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত দ্বিতীয় স্বাধীনতার আনন্দ ফুরাতে না ফুরাতেই একটার পর একটা ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ের মতো বাংলাদেশের জন্য আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য যেন এক একটা পাহাড়সম বাধা। লক্ষ্য একটাই, যে কোনোভাবেই এই সরকারকে স্থিতিশীল হতে দেওয়া যাবে না এবং এই সরকারকে খুব দ্রুত অজনপ্রিয় করে তুলতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করে বোঝাতে হবে যে, পতিত সরকারই ভালো ছিল। আর এরকম পরিস্থিতি না হলে প্রতিবিপ্লবের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হবে না। প্রতিবিপ্লব কোন পক্ষ ঘটাতে চাইবেন, এটা নিশ্চয়ই সকলের জানা- তারা হলো পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার, তাদের দেশি ও বিদেশি দোসররা।
প্রতিবিপ্লবী পক্ষটি যে মোটেই দুর্বল নয়, এটা সবাই জানে। জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আওয়ামী সমর্থক (কম বা বেশি হতে পারে) দেশ থেকে পালিয়ে যায় নাই বা রাতারাতি পরিবর্তনও হয়ে যান নাই। তাদের নেতাদের অর্থের যেমন অভাব নেই, তেমনি তাদের অর্থের যোগানদাতাদেরও অভাব নাই। জনপ্রশাসন, বিভিন্ন বাহিনী, বিভিন্ন সংস্থা ইত্যাদির বিভিন্ন স্তরে তাদের প্রেতাত্মারা লুকিয়ে আছে- এটাও অনস্বীকার্য। তাছাড়া তাদের বিদেশি মদদদাতা ও সাহায্যকারীদের ষড়যন্ত্রের জাল যে অনেক বিস্তৃত – এইগুলোতো একটার পর একটা সংকট সৃষ্টি থেকেই স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু এই প্রতিবিপ্লব কে রুখবে?
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে আমি, আপনি, আমরা সবাই, সব ছাত্রজনতা, এ দেশের জনগোষ্ঠী। বিপ্লবের ম্যান্ডেট, গণঅভ্যুত্থানের ম্যান্ডেট তথা আমাদের সকলের ম্যান্ডেট নিয়ে নির্বাচিত এই অন্তর্র্বতী সরকার। এই ম্যান্ডেটের এবং এই বিশাল ছাত্র-জনতার শক্তিতে বলীয়ান হলেও তারা সরকার পরিচালনায় অনভিজ্ঞ, তারা টিম হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য পায়নি সময় এবং প্রথম থেকেই চলছে তাদের প্রতিবিপ্লবীদের মুহূর্মুহ আক্রমণ ও ষড়যন্ত্রের জালে বিধস্ত করার অপচেষ্টা। তাদের ওপর রয়েছে ‘দেশের জন্মলগ্ন থেকে সৃষ্ট সকল দুর্নীতি, দুরাচার ও দুঃস্বপ্ন দূর করে সুশাসনের নজির স্থাপন করে ভবিষ্যৎ স্বাপ্নিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা’ এর মত প্রত্যাশার চাপ। এমন বাংলাদেশের ভিত্তি গড়ে দিয়ে যাওয়া যেখানে
কোনোদিন ফ্যাসিবাদী সরকারের পুনর্জন্ম হবে না, আমাদের ভোট আমরা দেব, দুর্নীতি, অবিচার, গুম, খুন ও নির্যাতন-নিপীড়ন থাকবে না। কার্যকরী আইন-শৃঙ্খলা ও সবল অর্থনীতি চালু হবে এবং স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে মাথা উঁচু করে চলবো। এসব প্রত্যাশার চাপ ছাড়াও সরকারের ওপর অর্পিত হয়েছে নিম্নবর্ণিত বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত কোনো অভিজ্ঞ নতুন রাজনৈতিক সরকারকেও সরকার পরিবর্তনের পরে এমন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় না।
নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার যখন গঠিত হয় তখন তাদের অতীতে একসাথে একই লক্ষ্যে কাজ করার, রাজনীতি ও আন্দোলন করার সুবাদে তারা একটি সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ টিম পেয়ে যান। তাছাড়া তাদের পেছনে থাকে অনেক অভিজ্ঞতা ও পূর্ব প্রস্তুত করা লক্ষ্য ও কর্মসূচি। কিন্তু এই ধরনের একটি অন্তর্র্বতী সরকারের পেছনে এসবের কিছুই থাকে না। এমনকি তারা একটি টিম হিসেবে গড়ে ওঠার সময়ও পাননি।
সরকার গঠনের সাথে সাথেই তাদের ওপর অর্পিত হয়েছে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, গ্রেফতার ও বিচার করা। বিপ্লব ও আন্দোলনের বিরোধিতার ফলে ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনীকে পুর্নগঠন। পুলিশ বাহিনীর নির্লিপ্ততা, অনুপস্থিতি, ভীতি, নেতৃত্বশূন্যতা ইত্যাদির কারণে ভেঙে পড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, ভাঙচুর, ডাকাতি, মব জাস্টিসের মতো বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা। বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সকল বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রেতাত্মাদের সরিয়ে এদের পেশাদারিত্বের আলোকে ঢেলে সাজানো। সম্ভাব্য প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রস্ততি নেওয়া। বন্ধু রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমর্থন অর্জনসহ বন্ধুত্ব রক্ষা ও সম্পদ অর্জনের ডিপ্লোম্যাসি বজায় রাখা।
ভঙ্গুর ব্যাংক ব্যবস্থাসহ সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন এবং পাচার করে দেওয়া লক্ষ কোটি টাকা ফেরত আনার প্রচেষ্টা গ্রহণ। আনসার আন্দোলন, গার্মেন্টস শিল্প কারখানাসহ অন্যান্য শিল্প কারখানা ভাঙচুর ও বন্ধ করার অপচেষ্টা, পার্বত্য জেলাগুলোকে অশান্ত করাসহ সৃষ্ট অসংখ্য আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ। দেশের পূর্বাঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা। বর্তমানে অসহনীয় দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধির কারসাজির খেলায় খাদ্য নিরাপত্তাকে অনিরাপদ করে দিয়ে প্রতিবিপ্লবের হাতছানি দেখানোর মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা। পরপর অয়েল ট্যাংকার/ডিপোতে আগুন লাগানোসহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মচারীদের আন্দোলন ও বিদ্যুৎ শাটডাউনের মতো কর্মসূচি দিয়ে পতিত সরকার কর্তৃক সৃষ্ট নাজুক জ্বালানি নিরাপত্তাকে ভেঙে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের মতো চ্যালেঞ্জ। এগুলো ছাড়াও এই সরকারের জন্য রয়েছে রাজনৈতিক বহুবিধ চাপ।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের প্রত্যক্ষ সহযোগী অনেক রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। দ্রুত নির্বাচনের দাবি রাজনৈতিক সুবিধা বিবেচনায় তাদের কাছে অত্যন্ত সঙ্গত। যত দ্রুত ক্ষমতায় আসীন হওয়া যায় ততই মঙ্গল। শুধু ১৭ বছর ক্ষমতার স্বাদ পাননি এবং অনেক নির্যাতিত অত্যাচারিত হয়েছেন সেটিই নয়; বরং তাদের জন্যও সম্ভাব্য প্রতিবিপ্লব অথবা সময়ের পরিক্রমায় পুনর্বাসিত আওয়ামী লীগ অথবা তৃতীয় কোনো শক্তির অভ্যুদয় একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক ও সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই, এই সরকার দুর্বল, তারা সংকটগুলো সমাধানে ব্যর্থÑ এই রকম একটা আখ্যান বা পরিস্থিতি এই পক্ষটিকেও দ্রুত নির্বাচনের দাবি আদায়ে সুবিধা দিতে পারে। তাছাড়া রাজনৈতিক পক্ষগুলোর নির্বাচনের দিন-ক্ষণ ঘোষণা বা রোড ম্যাপ দেওয়ার দাবিসহ অন্যান্য অনেক চাপ মোকাবিলা ও তাদের ঢ়বৎপবঢ়ঃরড়হ ম্যানেজমেন্ট করার দায়িত্ব পালনের চাপ তো এই সরকারের রয়েছেই।
তাছাড়া রয়েছে বিভিন্ন যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি দাওয়া নিয়ে অসংখ্য দল-সংস্থা-গোষ্ঠীর অহরহ শাহবাগে জমায়েত ও রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে দেওয়া। এমনকি সাকিব আল হাসানকে নিয়ে ইস্যু সৃষ্টির প্রচেষ্টা।
এখানেই কি শেষ? মোটেই না। আমাদের ধরে নিতে হবে যে, প্রতিবিপ্লবী পক্ষ প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্রের ঘুটি চালবে, আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে অস্থিতিশীল করতে থাকবে। এহেন পরিস্থিতি ও এতসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেও এবং তাদের সরকার পরিচালনায় পূর্ব -অভিজ্ঞতা না থাকলেও, এই সরকারকেই প্রতিবিপ্লবীদের বিরুদ্ধে জয়ী হতে হবে এবং আমাদের লক্ষ্য ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ আমাদের কারও এই বিষয়ে দ্বিমত নেই যে, এই সরকার ব্যর্থ হওয়া মানে পুরো বিপ্লব ব্যর্থ হওয়া এবং ফ্যসিবাদের পুনরুত্থান। রাজনৈতিক কিছু অংশের দাবি আছে যে, অন্তর্র্বতীকালীন বর্তমান সরকারের সকল সংস্কারের ম্যান্ডেট নেই, নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারই সেইসব সংস্কার করবেন। আমাদের স্বপ্নের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের ভিত্তি হিসেবে প্রয়োজনীয় সব সংস্কার বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দলীয় মতাদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে থেকে করে যাবেন- এটাই বিপ্লবের অন্যতম চেতনা। তাই এই সরকারকে তা পারতেই হবে।
এই সরকার দুর্বল ও অনভিজ্ঞ-এই ধরনের কথা বলে প্রতিবিপ্লবীদের উৎসাহিত করার আগে আমাদের মনে রাখা উচিত যে, সরকারের শক্তির উৎস হলো জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনাধারী ফ্যাসিস্ট সরকারবিরোধী সমগ্র জনতা। এর চেয়ে বড় শক্তি আর কার থাকতে পারে? আর এদের মধ্যে অভিজ্ঞতা খুঁজতে হলে পাঁচ বছর পরপর এই ধরনের সরকার আনতে হবে- যা আমরা মোটেই চাই না।
প্রফেসর আলী রীয়াজের একটি বিশ্লেষণ থেকে যদি বলি, ফ্যাসিজমের পুনরুত্থান রোধে বাংলাদেশের বিগত ১৫ বছরের ফ্যাসিজমের চারটি পিলারের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পিলারগুলো হলো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি, রফবড়ষড়মরপধষ যবমবসড়হু, গণমাধ্যম এবং ভারত সরকারের প্রভাব। এই চারটি পিলারের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য দরকার।
ফ্যাসিজম সৃষ্টির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো ভেঙে প্রয়োজনীয় সংস্কার; যা রাজনৈতিক বা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে হতে হবে। আওয়ামী প্রভাবিত পরাধীন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইতিহাস বিকৃতি করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আওয়ামী লীগীকরণ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেবতার পর্যায়ে স্থাপন করে যে আদর্শগত যবমবসড়হু সৃষ্টি করা হয়েছে, তা ভেঙে দিয়ে প্রকৃত স্বাধীনতার চেতনাকে জাতীয় মূল মূল্যবোধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে গণমাধ্যমকে ব্যবসাবৃত্তির বৃত্তের বাইরে নিয়ে আসা, হলুদ সাংবাদিকতা বন্ধ করা এবং সাংবাদিকতার সর্বক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য সকল আইনগত সংস্কার এবং যথাযথ পরিচর্চা।
ভারত সরকারের তাঁবেদারি ও তাদের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন এবং সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠা ও চলতে দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নির্বাচিত জনগণের সরকার, সবক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসহ জাতীয় মূল্যবোধের চর্চা এবং জাতীয় ঐক্য। বিপ্লবের প্রেক্ষপট, বিপ্লবের চেতনা ও বিপ্লবের জন্য সব আত্মত্যাগ এবং প্রতিবিপ্লব সফল হলে এর ভয়ঙ্কর দিক সম্পর্কে সবাইকে সচেতন ও অবগত রাখা।
বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় ঐক্য ও ইচ্ছা শক্তি সৃষ্টি। কঠোর হাতে প্রতিবিপ্লবীদের দমন। আওয়ামী লীগসহ ফ্যাসিজমের সহযোগী সকল শক্তি, চেতনা বা ধারণা যেন কোনোভাবেই পুনর্বাসিত না হয়Ñ এদিকে কঠোর পর্যবেক্ষণ রক্ষাসহ প্রয়োজনীয় সকল জাতীয় স্বার্থবিরোধী অপপ্রচার বা গুজব রটানোকে নিরুৎসাহিত করা। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে, তা হলো বিপ্লব শেষ হয়ে যায়নি। বিপ্লবকে আমি যদি চারটি পর্যায়ে ভাগ করিÑ প্রথম পর্যায়: ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারী সরকারের উৎখাত, বিপ্লবের ধারাবাহিকতার সরকার গঠন ও প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুতি; দ্বিতীয় পর্যায়: প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা সুসংহত করা, ফ্যাসিস্ট সরকার আর তার দোসরদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি আনা, প্রয়োজনীয় সকল সংস্কারের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নির্বাচনের রোড ম্যাপ প্রস্তুত; তৃতীয় পর্যায়: প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা সুসংহত রেখে ফ্যাসিস্ট সরকার আর তার দোসরদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আসা, যতটুকু সম্ভব জাতীয় ঐক্যমতের মধ্য দিয়ে সংস্কার সম্পন্ন করণ এবং সংস্কার প্রক্রিয়াকে কার্যকরী করা এবং চতুর্থ পর্যায়: সুস্থ ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং বিপ্লবের চেতনা সমুন্নতে নির্বাচিত সরকারের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ ও তাদের ওপর চাপ বজায় রাখা। সেই অর্থে, বিপ্লব মাত্র দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।
এই বিপ্লব কে শেষ করবে? শুধুই কি সরকার? না, ছাত্র-জনতা আমরা সকলে। প্রতিবিপ্লব রুখতে, দেশে স্থিতিশীলতা আনতে, মানুষের স্বপ্ন পূরণে এবং বিপ্লবের চূড়ান্ত সফলতা ঘরে তুলতে সরকার পক্ষের জন্য সামরিক বাহিনী ও রাজনৈতিক পক্ষের সহযোগিতা যে অবশ্যম্ভাবী – এটা সহজেই বোধগম্য। কিন্তু ইদানীং একটি ধারণার সৃষ্টি, জোর গুজব বা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অভ্যন্তরীণ বহুমুখী সংকট সমাধানের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে সামরিক বাহিনী সেনাশাসন জারি বা ১/১১ টাইপ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং ফ্যাসিস্ট সরকারকে পুনর্বাসন করতে পারে। গুজব যে কারণেই ছড়ানো হোক, সেনাশাসন জারি বাস্তবতার আলোকে অসম্ভব। বিপ্লবের স্বাদ পাওয়া ছাত্র-জনতা যারা মৃত্যুর মুখোমুখি হতে ভয় পায় না, রক্তের দাগ যাদের মনে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে তারা এরকম শাসন সহজে মেনে নেবে, সেনাবাহিনীকে তাদের মুখোমুখি হতে হবে নাÑ এই রকম ভাবা অত্যন্ত দুষ্কর। তাছাড়া বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিকভাবে এটা কখনোই গ্রহণযোগ্য হবে না। সেনাশাসন কখনো দেশ ও জনগণের মঙ্গল করতে পারে না- এর চেয়ে বড় সত্য যেমন কিছু নেই, তেমনি তারা সেনাশাসন দিয়ে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারকে পুনর্বাসন করবে এটাও অকল্পনীয়। প্রতিবিপ্লব বা ফ্যাসিস্ট সরকারের পুনর্বাসন এই দেশ ও জনগণের জন্য যে কত ভয়াবহ হতে পারে- সেটা নিশ্চয়ই সহজে অনুমেয়। কিন্তু এই ধরনের অপপ্রচার বা গুজব সরকার ও বাহিনীগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রতিবিপ্লব বা ফ্যাসিজমের পুনরুত্থান বন্ধে, দেশের উন্নয়নে, বিপ্লবকে চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে দিতে সরকার, সামরিক ও রাজনৈতিক পক্ষটির পাশাপাশি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে গণ ও সামাজিক মাধ্যম। গণ ও সামাজিক মাধ্যম ‘সবকিছু হাতের মুঠোয় ও অবাধ তথ্য প্রবাহের’ যুগে গণ ও সামাজিক মাধ্যম জনমত গঠন করে, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে ও জনগণের মধ্য প্রয়োজিনীয় প্রেষণা সৃষ্টি করে বিপ্লবের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে ও বিপ্লবকে চূড়ান্ত সাফল্যের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সরকারকে সমর্থন দিয়ে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে পারে। জুলাই-আগস্ট বিপ্লব সংগঠিত ও সার্থক করতে ছাত্র-জনতাকে প্রভাবিত করার সিংহভাগ কৃতিত্ব যেমনটি সামাজিক মাধ্যম নিতে পারে, তেমনি গণ ও সামাজিক মাধ্যমগুলো প্রতিবিপ্লবের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুসংহত করা ও বজায় রাখার অনুকূলে জনমতকে প্রভাবিত করে বিপ্লবকে চূড়ান্ত সাফল্য এনে দিতে পারে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ, আলোচনা ও সমালোচনার মাধ্যমে তারা যেমন জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে পারে, তেমনি পারে সরকার পক্ষকে প্রতিবিপ্লবীদের বিপক্ষে জয়ী হতে সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে একতাবদ্ধ রাখতে। আবার তারাই পারে বাক স্বাধীনতা ও অবাধ তথ্য প্রবাহের আশ্রয়ে জাতীয় স্বার্থবিরোধী সকল ষড়যন্ত্রকে উসকে দিতে, সামরিক ও রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে সরকার পক্ষের মুখোমুখি করে দিতে এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করে সরকারকে দ্রুত অজনপ্রিয় করে প্রতিবিপ্লব ডেকে আনতে।
ইংরেজিতে একটা কথা আছেÑ ংরভঃরহম রহঃবষষরমবহপব ভৎড়স রহভড়ৎসধঃরড়হ রং সড়ংঃ ফরভভরপঁষঃ ঃযরহম। আর অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও অসচেতন জনগোষ্ঠীকে প্রায় সবার হাতে থাকা মোবাইল এবং প্রায় সবার ঘরে থাকা ক্যাবল টেলিভিশনের কল্যাণে তথ্য বিভ্রাট ও মিথ্যার বেসাতি দিয়ে বিভ্রান্ত করা মোটেই কঠিন নয়। আর আমাদের বাংলা ভাষায় তো রহঃবষষরমবহপব ও রহভড়ৎসধঃরড়হ-এর আলাদা বাংলা অর্থই নেই। আমিই আতঙ্কে আঁতকে উঠি যখন প্রতিদিনই ইউটিউব বা ফেসবুকের কল্যাণে দেখি এইতো সামরিক শাসন জারি হয়ে যাচ্ছে, শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ঢুকে গেছে, প্রফেসর ইউনূস পদত্যাগ করে চলে গেছেন ইত্যাদি এবং আরও কত মনের মাধুরী মাখনো অনেক কল্প কথা। ভাবি তাহলে গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষগুলো যে কতটুকু অস্বস্তিতে আছেন।
লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক