ঢাকা ০৪:১৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫

জাতীয় নিরাপত্তা: বিভ্রান্তিতে জাতি

  • আপডেট সময় : ০৮:৪৬:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৮ মে ২০২৫
  • ১১ বার পড়া হয়েছে

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহেদুর রহমান, এনডিসি, পিএসসি (অব.)

দেশের অভ্যন্তরে ও আঞ্চলিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বহুল আলোচিত-সমালোচিত মানবিক করিডর, মিয়ানমারের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আরাকান আর্মির উত্থান, সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘাত এবং সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে কথিত বিরোধ বা ভুল বোঝাবুঝি জাতিকে, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী শ্রেণি এবং সাধারণ মানুষকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এসব বিষয়ে সেমিনার ও গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করছে। মিডিয়াও ঘটনাগুলো বিশ্লেষণে ব্যস্ত।

সরকারের অবস্থান সম্পর্কে কিছু বিষয় স্পষ্ট হলেও কিছু বিষয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে; কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরোধপূর্ণ মন্তব্যে সরকারের অভ্যন্তরীণ সমন্বয় নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। স্বল্পমেয়াদে জাতীয় নিরাপত্তা এবং দীর্ঘমেয়াদে ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে জনগণ উদ্বিগ্ন। এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আসে, আসলে কী কী বিষয় এ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যা জাতিকে দোদুল্যমান অবস্থায় ফেলেছে?

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বরাবরই অসম ছিল, যেখানে বাংলাদেশ একটি আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রের ভূমিকায় ছিল, কেবল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়কাল ছাড়া। রাষ্ট্রপতি জিয়া ভারতের তৎকালীন মোরারজি দেশাই সরকারের সঙ্গে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন (১৯৭৭-১৯৭৯)। কিন্তু যখনই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে স্বতন্ত্র সত্তা হিসাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করলেন, তখন থেকেই ভারত বৈরী সম্পর্কের দিকে এগিয়ে গেল।

১৯৭১ সাল থেকে ভারত শুধু আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রেখেছে, দেশের জনগণের সঙ্গে প্রকৃত কোনো সম্পর্ক গড়ে তোলেনি। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ভারত তার প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে ভারতীয় কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশিদের ক্ষোভ রয়েছে। জুলাই বিপ্লবের সময় ও পরবর্তী সময়ে ভারতের আচরণ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, তারা শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। ভারত যখন বলে যে, তারা কেবল নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে, তখন এটি বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতি চরম অবজ্ঞার প্রতিফলন।

বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদান বন্ধ করা, স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রদান, কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রদান, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পুশব্যাক, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মিথ্যা অভিযোগ, ভারতের জন্য মনোনীত বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে স্বীকৃতি না দেওয়া, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন অফিসে চরমপন্থি হিন্দু সংগঠনের হামলা- এসব ভারতীয় মনোভাবের স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ।

বাংলাদেশবিরোধী মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া তথ্য প্রচারে ভারতীয় মিডিয়া সদা ব্যস্ত। স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেক সংস্থাগুলো জানিয়েছে, ৪০টিরও বেশি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান এ প্রচারণায় জড়িত। অথচ গত ১৬ বছর ধরে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের এবং ভারতের প্রশংসাকারী বুদ্ধিজীবীরা আজ নিশ্চুপ।
রাজনৈতিক অঙ্গনে সংস্কার সংক্রান্ত অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সাধারণ জনতা ‘কেন প্রয়োজন’, ‘কোন পর্যন্ত প্রয়োজন’, ‘কে করবে’, ‘কখন করবে’- এ ধরনের কিছু মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে সার্বক্ষণিক বিতর্কে মগ্ন। রাজনৈতিক দলগুলো লিখিতভাবে তাদের প্রস্তাব পেশ করেছে।

সংস্কার প্রশ্নে মতপার্থক্য হ্রাস করার লক্ষ্যে এবং সর্বগ্রহণযোগ্য অবস্থানে পৌঁছার জন্য জাতীয় ঐক্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসছে। তবে এ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ অনুপস্থিত। সব পদক্ষেপ যেন রাজধানীকেন্দ্রিক। বিভাগ, জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে কোনো উন্মুক্ত আলোচনা হয়নি। জনগণের সম্পৃক্ততা ব্যতীত কেমন করে একটি দেশকে কিংবা তার শাসন ও পরিচালনা পদ্ধতির পরিবর্তন আনা সম্ভব? কিছু রাজনীতিকের বক্তব্য-‘সাধারণ মানুষ কি সংস্কার বোঝে?’-জনগণের প্রতি অবজ্ঞার পরিচায়ক।

গত কয়েক মাসে কয়েকটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা স্পষ্ট নয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো জুলাই বিপ্লবের নেতাকর্মীদের নিয়ে গঠিত ‘ন্যাশনাল সিটিজেন্স পার্টি’ (এনসিপি)। মানুষ তাদের কাছে পরিবর্তনের প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু দল গঠনের পরই দলটি গতি হারিয়ে ফেলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, এ দলটির রাজনৈতিক দর্শন কী? বয়স, লিঙ্গ ও ধর্ম নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা কী? সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় কি ভবিষ্যৎ চিত্র তারা উপস্থাপন করছেন? ঢাকা এবং কিছু শহর ছাড়া গ্রাম-গ্রামান্তরে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে দলটি ব্যর্থ হয়েছে।

সম্প্রতি তাদের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ফেসবুকে দলটির সাত দফা দর্শন উপস্থাপন করেন। দলটি মূলত কিছু ন্যারেটিভ তৈরি করতে পেরেছে এবং যার প্রতিক্রিয়ায় প্রধান রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য দলও নৃত্যরত। জামায়াতে ইসলামী সতর্ক বিবৃতি দিচ্ছে, মাঝে-মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে খুশি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের ভূমিকা নিয়ে তারা এখনো দুঃখ প্রকাশ করেনি বা ক্ষমা চায়নি।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতারা পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন, আর তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ফ্যাসিস্টদের ছেড়ে দেওয়া জায়গা দখলে ব্যস্ত। বিএনপি ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে নির্বাচন দাবি করলেও বাস্তবে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে আগ্রহী নয়।

নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষিত সময়সীমা (সবচেয়ে আগে ডিসেম্বর ২০২৫, সর্বোচ্চ জুন ২০২৬) বিএনপিকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ইউরোপীয় কমিশনও নির্বাচন প্রসঙ্গে ঠান্ডা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনার পরিণতি এখনো স্পষ্ট নয়। জাতি জল্পনা-কল্পনায় মগ্ন, অর্থনীতিতে চলছে অনিশ্চয়তা, ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে শম্বুকগতিতে, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ কম, ব্যাংকগুলো নগদ টাকার তারল্য নিয়ে মহাবিপদে।

সরকারের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর এবং সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে বিভাজনের গুজবও পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। কেউ বলছে ভুল বোঝাবুঝি, কেউ বলছে সরকার এবং সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার। সার্বিক পরিস্থিতি দেশকে নাজুক করেছে ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাই সংস্কার ও নির্বাচনের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য এই সংকট মুহূর্তে খুবই জরুরি। একই সঙ্গে আমাদের দক্ষিণ-পূর্বের প্রতিবেশী মিয়ানমারে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।

ইউনাইটেড লিগ অফ আরাকানের সামরিক শাখা আরাকান আর্মি ইতোমধ্যে সিতওয়ে ও কাইউকফু ছাড়া রাখাইন রাজ্যের ৯০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে মানবিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা সংকট আবারও প্রকট হচ্ছে। লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির এ আধিপত্য আরাকান আর্মির প্রতি ভারত ও চীনের সমর্থন পেতে সহায়ক হয়েছে।

মিয়ানমারে চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। চীন অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি, অবকাঠামো নির্মাণ, গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছে। নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে মিয়ানমারে সম্পূর্ণ বিনিয়োগের পরিমাণ নিশ্চিত করা যায়নি। অনুমিত হয় যে, মিয়ানমারে অবকাঠামো, গ্যাস-তেল, বিদ্যুৎসহ বহু খাতে ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। ৭৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন কাইউকফু থেকে রাখাইন, মাগওয়ে, মান্দালয়, শান হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত বিস্তৃত এবং প্রতি বছরে ৫.২ বিলিয়ন ঘন মিটার গ্যাস বহনে সক্ষম। তেলবাহী পাইপলাইন বছরে ১২ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত তেল বহনে সক্ষম।

চীন মিয়ানমার প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অস্ত্র, সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে এবং যৌথ উদ্যোগে প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি নির্মাণ করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তার কৌশলগত স্বার্থের কারণে মিয়ানমারে প্রবহমান ঘটনাবলি প্রভাবিত হয়। চীন, তার স্বার্থ রক্ষার জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

মিয়ানমারের উত্তরের প্রতিবেশী ভারতেরও কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। ভারতও মিয়ানমারে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট এবং ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প, ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ট্রাইল্যাটেরাল হাইওয়ে, গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানে ১.৭৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। তারা ২০২৩ সালে ৫১ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। সীমান্ত নিরাপত্তা ও বিনিয়োগ রক্ষায় ভারত মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে। মিজোরামের এক সংসদ সদস্য সম্প্রতি মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বিদ্রোহী চীনাল্যান্ড কাউন্সিলের সঙ্গে বৈঠক করতে মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করেন।

রাখাইন রাজ্যের বিপর্যস্ত জনগণের জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কথিত মানবিক করিডর গঠনের বিষয়টি যখন আলোচনায় আসে, তখন এসব প্রশ্নের জটিলতা আরও বেড়ে যায়। ২০২৪ সালের শেষদিকে গোপনে আলোচনা শুরু হয়, আর ২০২৫ সালের শুরুতে বিষয়টি বেগবান হয়। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির (ওঈজঈ) সংজ্ঞা অনুযায়ী মানবিক করিডর সশস্ত্র সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর মধ্যে এমন এক চুক্তি; যার মাধ্যমে বেসামরিক জনগণের নিরাপদ চলাচল, মানবিক সহায়তা পৌঁছানো এবং আহত বা নিহতদের সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

জাতিসংঘ সনদে মানবিক করিডরের বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ নেই। টঘঞঊজগ-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘নিরাপদ মানবিক করিডর হলো জরুরি সহায়তা পৌঁছানোর একটি পথ। এতে স্পষ্ট করা হয়, এসব কার্যক্রম জাতিসংঘের অধীন পরিচালিত হয়।

এ বিষয়টি জনসমক্ষে এলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) একটি সেমিনারে এটিকে ‘করিডর’ না বলে ‘চ্যানেল’ হিসাবে অভিহিত করেন। বস্তুতপক্ষে চ্যানেল বলে কিছু নেই। গত ২৭ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, জাতিসংঘের প্রস্তাবিত রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পাঠাতে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে একটি করিডর চালুর প্রস্তাবে কিছু শর্তসাপেক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নীতিগতভাবে রাজি হয়েছে। তবে শর্তগুলোর বিস্তারিত তিনি প্রকাশ করেননি।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা বাংলাদেশের মূল স্বার্থ। তবে অন্তর্নিহিত ঝুঁকি রয়েছে। এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ২২টি মানবিক করিডর স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে কেবল ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার মধ্যকার একটি করিডর সফল হয়েছে। বাকি সব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে কি তাদের ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে? ভারতের তিনটি রাজ্য-মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও মণিপুরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন রয়েছে।

মিয়ানমারের মান্দালয় অঞ্চল, কাচিন ও শান রাজ্যে বিপুলসংখ্যক জাতিগত চীনা বাস করে। ফলে আরাকান আর্মি বা অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার যে কোনো প্রচেষ্টা চীন, ভারত ও মিয়ানমারকে উদ্বিগ্ন করবে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলও এর নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হবে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ বর্তমানে একটি কৌশলগত ঘেরাবন্দির মধ্যে রয়েছে।

বিগত প্রায় ১৬ বছরের অপশাসন ফ্যাসিজমমুক্ত হয়ে বাংলাদেশ এখন একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু জাতীয় ঐক্যের অভাব এবং পতিত সরকারের ধারাবাহিক অপপ্রচার দেশের দুর্বলতা ও শঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশীদের সম্পৃক্ত না করে এককভাবে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক হবে কি? এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রশ্ন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং জনগণের সম্পৃক্ততা অত্যাবশ্যক। পুরো জাতি এখন এক বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে।

লেখক: গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জাতীয় নিরাপত্তা: বিভ্রান্তিতে জাতি

আপডেট সময় : ০৮:৪৬:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৮ মে ২০২৫

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহেদুর রহমান, এনডিসি, পিএসসি (অব.)

দেশের অভ্যন্তরে ও আঞ্চলিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বহুল আলোচিত-সমালোচিত মানবিক করিডর, মিয়ানমারের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আরাকান আর্মির উত্থান, সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘাত এবং সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে কথিত বিরোধ বা ভুল বোঝাবুঝি জাতিকে, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী শ্রেণি এবং সাধারণ মানুষকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এসব বিষয়ে সেমিনার ও গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করছে। মিডিয়াও ঘটনাগুলো বিশ্লেষণে ব্যস্ত।

সরকারের অবস্থান সম্পর্কে কিছু বিষয় স্পষ্ট হলেও কিছু বিষয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে; কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরোধপূর্ণ মন্তব্যে সরকারের অভ্যন্তরীণ সমন্বয় নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। স্বল্পমেয়াদে জাতীয় নিরাপত্তা এবং দীর্ঘমেয়াদে ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে জনগণ উদ্বিগ্ন। এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আসে, আসলে কী কী বিষয় এ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যা জাতিকে দোদুল্যমান অবস্থায় ফেলেছে?

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বরাবরই অসম ছিল, যেখানে বাংলাদেশ একটি আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রের ভূমিকায় ছিল, কেবল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়কাল ছাড়া। রাষ্ট্রপতি জিয়া ভারতের তৎকালীন মোরারজি দেশাই সরকারের সঙ্গে পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন (১৯৭৭-১৯৭৯)। কিন্তু যখনই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশকে স্বতন্ত্র সত্তা হিসাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করলেন, তখন থেকেই ভারত বৈরী সম্পর্কের দিকে এগিয়ে গেল।

১৯৭১ সাল থেকে ভারত শুধু আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা রেখেছে, দেশের জনগণের সঙ্গে প্রকৃত কোনো সম্পর্ক গড়ে তোলেনি। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ভারত তার প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে ভারতীয় কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে বাংলাদেশিদের ক্ষোভ রয়েছে। জুলাই বিপ্লবের সময় ও পরবর্তী সময়ে ভারতের আচরণ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, তারা শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। ভারত যখন বলে যে, তারা কেবল নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে, তখন এটি বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতি চরম অবজ্ঞার প্রতিফলন।

বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদান বন্ধ করা, স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রদান, কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রদান, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পুশব্যাক, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার মিথ্যা অভিযোগ, ভারতের জন্য মনোনীত বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে স্বীকৃতি না দেওয়া, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন অফিসে চরমপন্থি হিন্দু সংগঠনের হামলা- এসব ভারতীয় মনোভাবের স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ।

বাংলাদেশবিরোধী মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া তথ্য প্রচারে ভারতীয় মিডিয়া সদা ব্যস্ত। স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেক সংস্থাগুলো জানিয়েছে, ৪০টিরও বেশি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান এ প্রচারণায় জড়িত। অথচ গত ১৬ বছর ধরে ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের এবং ভারতের প্রশংসাকারী বুদ্ধিজীবীরা আজ নিশ্চুপ।
রাজনৈতিক অঙ্গনে সংস্কার সংক্রান্ত অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সাধারণ জনতা ‘কেন প্রয়োজন’, ‘কোন পর্যন্ত প্রয়োজন’, ‘কে করবে’, ‘কখন করবে’- এ ধরনের কিছু মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে সার্বক্ষণিক বিতর্কে মগ্ন। রাজনৈতিক দলগুলো লিখিতভাবে তাদের প্রস্তাব পেশ করেছে।

সংস্কার প্রশ্নে মতপার্থক্য হ্রাস করার লক্ষ্যে এবং সর্বগ্রহণযোগ্য অবস্থানে পৌঁছার জন্য জাতীয় ঐক্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসছে। তবে এ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ অনুপস্থিত। সব পদক্ষেপ যেন রাজধানীকেন্দ্রিক। বিভাগ, জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে কোনো উন্মুক্ত আলোচনা হয়নি। জনগণের সম্পৃক্ততা ব্যতীত কেমন করে একটি দেশকে কিংবা তার শাসন ও পরিচালনা পদ্ধতির পরিবর্তন আনা সম্ভব? কিছু রাজনীতিকের বক্তব্য-‘সাধারণ মানুষ কি সংস্কার বোঝে?’-জনগণের প্রতি অবজ্ঞার পরিচায়ক।

গত কয়েক মাসে কয়েকটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা স্পষ্ট নয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো জুলাই বিপ্লবের নেতাকর্মীদের নিয়ে গঠিত ‘ন্যাশনাল সিটিজেন্স পার্টি’ (এনসিপি)। মানুষ তাদের কাছে পরিবর্তনের প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু দল গঠনের পরই দলটি গতি হারিয়ে ফেলেছে। প্রশ্ন উঠেছে, এ দলটির রাজনৈতিক দর্শন কী? বয়স, লিঙ্গ ও ধর্ম নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনগণকে সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা কী? সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় কি ভবিষ্যৎ চিত্র তারা উপস্থাপন করছেন? ঢাকা এবং কিছু শহর ছাড়া গ্রাম-গ্রামান্তরে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে দলটি ব্যর্থ হয়েছে।

সম্প্রতি তাদের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ফেসবুকে দলটির সাত দফা দর্শন উপস্থাপন করেন। দলটি মূলত কিছু ন্যারেটিভ তৈরি করতে পেরেছে এবং যার প্রতিক্রিয়ায় প্রধান রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য দলও নৃত্যরত। জামায়াতে ইসলামী সতর্ক বিবৃতি দিচ্ছে, মাঝে-মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে খুশি করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের ভূমিকা নিয়ে তারা এখনো দুঃখ প্রকাশ করেনি বা ক্ষমা চায়নি।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের নেতারা পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন, আর তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ফ্যাসিস্টদের ছেড়ে দেওয়া জায়গা দখলে ব্যস্ত। বিএনপি ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে নির্বাচন দাবি করলেও বাস্তবে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে আগ্রহী নয়।

নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষিত সময়সীমা (সবচেয়ে আগে ডিসেম্বর ২০২৫, সর্বোচ্চ জুন ২০২৬) বিএনপিকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ইউরোপীয় কমিশনও নির্বাচন প্রসঙ্গে ঠান্ডা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনার পরিণতি এখনো স্পষ্ট নয়। জাতি জল্পনা-কল্পনায় মগ্ন, অর্থনীতিতে চলছে অনিশ্চয়তা, ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে শম্বুকগতিতে, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ কম, ব্যাংকগুলো নগদ টাকার তারল্য নিয়ে মহাবিপদে।

সরকারের সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর এবং সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে বিভাজনের গুজবও পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। কেউ বলছে ভুল বোঝাবুঝি, কেউ বলছে সরকার এবং সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার। সার্বিক পরিস্থিতি দেশকে নাজুক করেছে ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাই সংস্কার ও নির্বাচনের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্য এই সংকট মুহূর্তে খুবই জরুরি। একই সঙ্গে আমাদের দক্ষিণ-পূর্বের প্রতিবেশী মিয়ানমারে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।

ইউনাইটেড লিগ অফ আরাকানের সামরিক শাখা আরাকান আর্মি ইতোমধ্যে সিতওয়ে ও কাইউকফু ছাড়া রাখাইন রাজ্যের ৯০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে মানবিক বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা সংকট আবারও প্রকট হচ্ছে। লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ বর্তমানে দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির এ আধিপত্য আরাকান আর্মির প্রতি ভারত ও চীনের সমর্থন পেতে সহায়ক হয়েছে।

মিয়ানমারে চীনের বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। চীন অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি, অবকাঠামো নির্মাণ, গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছে। নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাবে মিয়ানমারে সম্পূর্ণ বিনিয়োগের পরিমাণ নিশ্চিত করা যায়নি। অনুমিত হয় যে, মিয়ানমারে অবকাঠামো, গ্যাস-তেল, বিদ্যুৎসহ বহু খাতে ২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। ৭৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন কাইউকফু থেকে রাখাইন, মাগওয়ে, মান্দালয়, শান হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত বিস্তৃত এবং প্রতি বছরে ৫.২ বিলিয়ন ঘন মিটার গ্যাস বহনে সক্ষম। তেলবাহী পাইপলাইন বছরে ১২ মিলিয়ন টন অপরিশোধিত তেল বহনে সক্ষম।

চীন মিয়ানমার প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অস্ত্র, সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে এবং যৌথ উদ্যোগে প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি নির্মাণ করছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তার কৌশলগত স্বার্থের কারণে মিয়ানমারে প্রবহমান ঘটনাবলি প্রভাবিত হয়। চীন, তার স্বার্থ রক্ষার জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

মিয়ানমারের উত্তরের প্রতিবেশী ভারতেরও কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। ভারতও মিয়ানমারে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট এবং ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প, ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ট্রাইল্যাটেরাল হাইওয়ে, গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানে ১.৭৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। তারা ২০২৩ সালে ৫১ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। সীমান্ত নিরাপত্তা ও বিনিয়োগ রক্ষায় ভারত মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে। মিজোরামের এক সংসদ সদস্য সম্প্রতি মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বিদ্রোহী চীনাল্যান্ড কাউন্সিলের সঙ্গে বৈঠক করতে মিয়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করেন।

রাখাইন রাজ্যের বিপর্যস্ত জনগণের জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কথিত মানবিক করিডর গঠনের বিষয়টি যখন আলোচনায় আসে, তখন এসব প্রশ্নের জটিলতা আরও বেড়ে যায়। ২০২৪ সালের শেষদিকে গোপনে আলোচনা শুরু হয়, আর ২০২৫ সালের শুরুতে বিষয়টি বেগবান হয়। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির (ওঈজঈ) সংজ্ঞা অনুযায়ী মানবিক করিডর সশস্ত্র সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর মধ্যে এমন এক চুক্তি; যার মাধ্যমে বেসামরিক জনগণের নিরাপদ চলাচল, মানবিক সহায়তা পৌঁছানো এবং আহত বা নিহতদের সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

জাতিসংঘ সনদে মানবিক করিডরের বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ নেই। টঘঞঊজগ-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘নিরাপদ মানবিক করিডর হলো জরুরি সহায়তা পৌঁছানোর একটি পথ। এতে স্পষ্ট করা হয়, এসব কার্যক্রম জাতিসংঘের অধীন পরিচালিত হয়।

এ বিষয়টি জনসমক্ষে এলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) একটি সেমিনারে এটিকে ‘করিডর’ না বলে ‘চ্যানেল’ হিসাবে অভিহিত করেন। বস্তুতপক্ষে চ্যানেল বলে কিছু নেই। গত ২৭ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, জাতিসংঘের প্রস্তাবিত রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পাঠাতে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে একটি করিডর চালুর প্রস্তাবে কিছু শর্তসাপেক্ষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নীতিগতভাবে রাজি হয়েছে। তবে শর্তগুলোর বিস্তারিত তিনি প্রকাশ করেননি।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা বাংলাদেশের মূল স্বার্থ। তবে অন্তর্নিহিত ঝুঁকি রয়েছে। এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ২২টি মানবিক করিডর স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে কেবল ইথিওপিয়া ও ইরিত্রিয়ার মধ্যকার একটি করিডর সফল হয়েছে। বাকি সব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে কি তাদের ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করা হয়েছে? ভারতের তিনটি রাজ্য-মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও মণিপুরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন রয়েছে।

মিয়ানমারের মান্দালয় অঞ্চল, কাচিন ও শান রাজ্যে বিপুলসংখ্যক জাতিগত চীনা বাস করে। ফলে আরাকান আর্মি বা অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার যে কোনো প্রচেষ্টা চীন, ভারত ও মিয়ানমারকে উদ্বিগ্ন করবে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলও এর নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হবে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ বর্তমানে একটি কৌশলগত ঘেরাবন্দির মধ্যে রয়েছে।

বিগত প্রায় ১৬ বছরের অপশাসন ফ্যাসিজমমুক্ত হয়ে বাংলাদেশ এখন একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু জাতীয় ঐক্যের অভাব এবং পতিত সরকারের ধারাবাহিক অপপ্রচার দেশের দুর্বলতা ও শঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে প্রতিবেশীদের সম্পৃক্ত না করে এককভাবে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক হবে কি? এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রশ্ন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং জনগণের সম্পৃক্ততা অত্যাবশ্যক। পুরো জাতি এখন এক বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে।

লেখক: গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ