ঢাকা ০৩:৫৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

জাতিসংঘে নেতানিয়াহুর ভাষণের সময় প্রতিবাদ, বেরিয়ে যান অনেক প্রতিনিধি

  • আপডেট সময় : ০১:১০:৩৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ১৯ বার পড়া হয়েছে

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ভাষণের পর শুক্রবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরের কাছে বিক্ষোভ করেন ফিলিস্তিনপন্থীরা - ছবি রয়টার্স

প্রত্যাশা ডেস্ক: ফিলিস্তিনে চলমান আগ্রাসনের জন্য বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এ সময় অনেক দেশের প্রতিনিধিরা প্রতিবাদ জানিয়ে অধিবেশন কক্ষ বর্জন করেন। ভাষণ ঘিরে বিক্ষোভ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কেও।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের চতুর্থ দিন ছিল শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর)। এদিন নেতানিয়াহুর ভাষণ শুরু হতে না হতেই প্রতিবাদ জানাতে থাকেন অনেক দেশের প্রতিনিধিরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রায় সব আরব ও মুসলিম দেশ, আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি। একপর্যায়ে তাঁরা অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন (ওয়াকআউট)। এ সময় অধিবেশন কক্ষে নেতানিয়াহু সামনে আসনগুলো ফাঁকা দেখা যায়।

বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অধিবেশন কক্ষ ত্যাগের সময় সেখানে থাকা অনেকে হাততালি দেন। পরিষদের সভাপতি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বললেও, তাতে কাজ দেয়নি।

জাতিসংঘের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্য, গাজা সংঘাত, ইরানসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। ঠিক এই সময়ে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের বাইরে গাজায় সংঘাত বন্ধ এবং হামাসের হাতে বন্দী জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে চলছিল বিক্ষোভ। এর আয়োজন করেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ইসরায়েলি ও ইহুদিরা। এদিন ফিলিস্তিনের পক্ষেও নিউইয়র্কে বিক্ষোভ হয়।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েল থেকে নিউইয়র্ক পৌঁছান নেতানিয়াহু। সেখানে ম্যানহাটান এলাকায় যে হোটেলে তিনি অবস্থান করছেন, তার বাইরেও বিক্ষোভ করেছেন ইসরায়েলি প্রবাসীরা। এ সময় তাঁদের ‘যুদ্ধ বন্ধ করুন’, ‘তাঁদের (জিম্মি) সবাইকে মুক্ত করুন’ স্লোগান দিতে শোনা যায়। ড্রামের শব্দের তালে তালে অনেকেই বলছিলেন, ‘সামরিকভাবে এর (সংঘাত) সমাধান হবে না।’

এবারের জাতিসংঘের অধিবেশনে গাজা সংকট বড় গুরুত্ব পেয়েছে। মঙ্গলবার অধিবেশন শুরুর আগে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য–ফ্রান্সসহ পশ্চিমা ১০ দেশ। অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশের নেতা। যেমন জাতিগত নিধনের অভিযোগে নেতানিয়াহুকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) তোলার দাবি করেছেন চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিক।

ইতিমধ্যে আইসিজেতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনের অভিযোগে মামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। আর গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আইসিসি। সে কারণে নিউইয়র্ক যাওয়ার পথে ফ্রান্সের আকাশসীমা এড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর উড়োজাহাজ। তবে যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু ইসরালের সবচেয়ে বড় মিত্র আর আইসিসির সদস্য নয়, তাই সেখানে তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার শঙ্কা নেই।

নেতানিয়াহুর সাফাই: সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নেতানিয়াহুর ভাষণের বড় অংশ ছিল গাজায় চলমান সংঘাত নিয়ে। দুই বছর ধরে গাজায় চলমান ইসরায়েলি নৃশংসতার পক্ষে সাফাই তুলে ধরেন তিনি। এই সময়ে উপত্যকাটিতে ইসরায়েলি বাহিনী সাড়ে ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করলেও, নেতানিয়াহু দাবি করেন, জাতিগত নিধনের সঙ্গে জড়িত নয় তাঁর দেশ।

গাজায় ইসরায়েলের জাতিগত নিধনের বিষয়টি উঠে এসেছে জাতিসংঘের গঠন করা একটি স্বাধীন কমিশনের তদন্তে। একে ‘মিথ্যা অভিযোগ’ আখ্যা দিয়ে জাতিসংঘে নেতানিয়াহু বলেন, ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসই উল্টো বেসামরিক মানুষজনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যুক্তি দেখিয়ে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা ন্যায্যতা পেতে পারে না।

ভাষণে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন নেতানিয়াহু। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার তুলনা করেন তিনি। নেতানিয়াহু বলেন, ‘৭ অক্টোবরের পর জেরুজালেমের এক মাইল দূরে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি রাষ্ট্র দেওয়া ১১ সেপ্টেম্বরের পর নিউইয়র্কের এক মাইল দূরে আল–কায়েদাকে একটি রাষ্ট্র দেওয়ার মতো।’

সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ যে ১০ দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তারও বিরোধিতা করেন নেতানিয়াহু। বর্তমানে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যদেশের মধ্যে ১৫৭টিই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতির ফলে ইহুদিদের ওপর হামলা বাড়িয়ে তুলবে উল্লেখ করে নেতানিয়াহু বলেন, ‘আপনারা সঠিক কাজটি করেননি। আপনারা যা করেছেন, তা ভুল কাজ। মারাত্মক ভুল কাজ।’

অধিবেশনে গাজায় ইসরায়েলের ‘যুদ্ধ’ এখনো শেষ হয়ে যায়নি বলে উল্লেখ করে নেতানিয়াহু। উপত্যকাটিতে ইসরায়েলের আগ্রাসনের জন্য সাধারণ পরিষদে যেসব দেশ নিন্দা জানিয়েছে, তাদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন যে ইসরায়েল আপনাদের হয়েই লড়াই করছে। তাই পর্দার আড়ালের একটি গোপন কথা আপনাদের বলতে চাই। তা হলো, অনেক নেতাই আমাদের জনসমক্ষে নিন্দা করেন, আর আড়ালে ধন্যবাদ জানান।’

বিশ্ব দেখছে আমরা মারা যাচ্ছি: জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে যখন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রে, তখন গতকাল (বৃহস্পতিবার) গাজায় নির্বিচার হামলা চালাচ্ছিল ইসরায়েলি বাহিনী। এদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপত্যকাটিতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৭ জন। তাঁদের মধ্যে ১১ জন ত্রাণের খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের হামলায় নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুই শিশুও রয়েছে।

এই নিয়ে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত চলমান ইসরায়েলের হামলায় গাজা উপত্যকায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৬৫ হাজার ৫০২ জন ফিলিস্তিনি। আহত ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি। গাজায় হামলা শুরুর আগে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। ইসরায়েল থেকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয় প্রায় আড়াই শ জনকে।

গতকাল (বৃহস্পতিবার) গাজায় নিহতের মধ্যে ২৮ জনই গাজা নগরীর। উপত্যকাটির উত্তর ভাগে এই শহর এলাকায় ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। নগরীর রেমাল এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আল–সালোউল আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ইসরায়েলের এই হামলা যেকোনো যৌক্তিকতা ও মানবিকতার বাইরে। বিশ্ব কী করছে? আমরা মারা যাচ্ছি, তা শুধু তারা দেখছে।’

গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে যে ১১ জন নিহত হয়েছেন, তাঁরা মধ্য গাজার নেতজারিম করিডরের কাছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত বিতর্কিত একটি ত্রাণকেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। তখন তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়। গতকাল গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উপত্যকাটিতে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৫০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

আলোচনায় গাজার অন্তর্বর্তী প্রশাসন: বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, গাজায় যদি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, তখন সেখানে একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসন গঠনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। ওই প্রশাসনে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রেসিডেন্ট টনি ব্লেয়ারকে প্রধান করার কথা উঠেছে। তিনি গাজায় যুদ্ধ বন্ধে এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করছেন বলে জানা গেছে।

চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘে ট্রাম্প ও আরব নেতাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ সময় কয়েকটি প্রস্তাব তোলা হয়। প্রস্তাবের মূল বিষয় হলো, যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসন গাজার দায়িত্ব নেবে। এই প্রশাসনকে জাতিসংঘ সমর্থন দেবে এবং আরব দেশগুলো সহায়তা করবে। গাজার দায়িত্ব ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের আগপর্যন্ত এ প্রশাসন কার্যকর থাকবে।

এই প্রস্তাবে টনি ব্লেয়ারকে গাজার অন্তর্বর্তী প্রশাসনের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। টনি ব্লেয়ার ২০০৭ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও জাতিসংঘের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে দূত হিসেবে কাজ করেছিলেন।

সানা/আপ্র/২৭/০৯/২০২৫

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

হিরো আলমের ওপর হামলা, অবস্থা আশঙ্কাজনক

জাতিসংঘে নেতানিয়াহুর ভাষণের সময় প্রতিবাদ, বেরিয়ে যান অনেক প্রতিনিধি

আপডেট সময় : ০১:১০:৩৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

প্রত্যাশা ডেস্ক: ফিলিস্তিনে চলমান আগ্রাসনের জন্য বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। এ সময় অনেক দেশের প্রতিনিধিরা প্রতিবাদ জানিয়ে অধিবেশন কক্ষ বর্জন করেন। ভাষণ ঘিরে বিক্ষোভ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কেও।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের চতুর্থ দিন ছিল শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর)। এদিন নেতানিয়াহুর ভাষণ শুরু হতে না হতেই প্রতিবাদ জানাতে থাকেন অনেক দেশের প্রতিনিধিরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রায় সব আরব ও মুসলিম দেশ, আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি। একপর্যায়ে তাঁরা অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন (ওয়াকআউট)। এ সময় অধিবেশন কক্ষে নেতানিয়াহু সামনে আসনগুলো ফাঁকা দেখা যায়।

বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অধিবেশন কক্ষ ত্যাগের সময় সেখানে থাকা অনেকে হাততালি দেন। পরিষদের সভাপতি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বললেও, তাতে কাজ দেয়নি।

জাতিসংঘের অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে নেতানিয়াহু মধ্যপ্রাচ্য, গাজা সংঘাত, ইরানসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। ঠিক এই সময়ে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের বাইরে গাজায় সংঘাত বন্ধ এবং হামাসের হাতে বন্দী জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে চলছিল বিক্ষোভ। এর আয়োজন করেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ইসরায়েলি ও ইহুদিরা। এদিন ফিলিস্তিনের পক্ষেও নিউইয়র্কে বিক্ষোভ হয়।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েল থেকে নিউইয়র্ক পৌঁছান নেতানিয়াহু। সেখানে ম্যানহাটান এলাকায় যে হোটেলে তিনি অবস্থান করছেন, তার বাইরেও বিক্ষোভ করেছেন ইসরায়েলি প্রবাসীরা। এ সময় তাঁদের ‘যুদ্ধ বন্ধ করুন’, ‘তাঁদের (জিম্মি) সবাইকে মুক্ত করুন’ স্লোগান দিতে শোনা যায়। ড্রামের শব্দের তালে তালে অনেকেই বলছিলেন, ‘সামরিকভাবে এর (সংঘাত) সমাধান হবে না।’

এবারের জাতিসংঘের অধিবেশনে গাজা সংকট বড় গুরুত্ব পেয়েছে। মঙ্গলবার অধিবেশন শুরুর আগে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য–ফ্রান্সসহ পশ্চিমা ১০ দেশ। অধিবেশনে দেওয়া বক্তব্যে ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়েছেন বিভিন্ন দেশের নেতা। যেমন জাতিগত নিধনের অভিযোগে নেতানিয়াহুকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) তোলার দাবি করেছেন চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বোরিক।

ইতিমধ্যে আইসিজেতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনের অভিযোগে মামলা করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। আর গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আইসিসি। সে কারণে নিউইয়র্ক যাওয়ার পথে ফ্রান্সের আকাশসীমা এড়িয়ে গিয়েছিল তাঁর উড়োজাহাজ। তবে যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু ইসরালের সবচেয়ে বড় মিত্র আর আইসিসির সদস্য নয়, তাই সেখানে তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার শঙ্কা নেই।

নেতানিয়াহুর সাফাই: সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নেতানিয়াহুর ভাষণের বড় অংশ ছিল গাজায় চলমান সংঘাত নিয়ে। দুই বছর ধরে গাজায় চলমান ইসরায়েলি নৃশংসতার পক্ষে সাফাই তুলে ধরেন তিনি। এই সময়ে উপত্যকাটিতে ইসরায়েলি বাহিনী সাড়ে ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করলেও, নেতানিয়াহু দাবি করেন, জাতিগত নিধনের সঙ্গে জড়িত নয় তাঁর দেশ।

গাজায় ইসরায়েলের জাতিগত নিধনের বিষয়টি উঠে এসেছে জাতিসংঘের গঠন করা একটি স্বাধীন কমিশনের তদন্তে। একে ‘মিথ্যা অভিযোগ’ আখ্যা দিয়ে জাতিসংঘে নেতানিয়াহু বলেন, ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসই উল্টো বেসামরিক মানুষজনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যুক্তি দেখিয়ে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা ন্যায্যতা পেতে পারে না।

ভাষণে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন নেতানিয়াহু। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার তুলনা করেন তিনি। নেতানিয়াহু বলেন, ‘৭ অক্টোবরের পর জেরুজালেমের এক মাইল দূরে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি রাষ্ট্র দেওয়া ১১ সেপ্টেম্বরের পর নিউইয়র্কের এক মাইল দূরে আল–কায়েদাকে একটি রাষ্ট্র দেওয়ার মতো।’

সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ যে ১০ দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তারও বিরোধিতা করেন নেতানিয়াহু। বর্তমানে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যদেশের মধ্যে ১৫৭টিই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই স্বীকৃতির ফলে ইহুদিদের ওপর হামলা বাড়িয়ে তুলবে উল্লেখ করে নেতানিয়াহু বলেন, ‘আপনারা সঠিক কাজটি করেননি। আপনারা যা করেছেন, তা ভুল কাজ। মারাত্মক ভুল কাজ।’

অধিবেশনে গাজায় ইসরায়েলের ‘যুদ্ধ’ এখনো শেষ হয়ে যায়নি বলে উল্লেখ করে নেতানিয়াহু। উপত্যকাটিতে ইসরায়েলের আগ্রাসনের জন্য সাধারণ পরিষদে যেসব দেশ নিন্দা জানিয়েছে, তাদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন যে ইসরায়েল আপনাদের হয়েই লড়াই করছে। তাই পর্দার আড়ালের একটি গোপন কথা আপনাদের বলতে চাই। তা হলো, অনেক নেতাই আমাদের জনসমক্ষে নিন্দা করেন, আর আড়ালে ধন্যবাদ জানান।’

বিশ্ব দেখছে আমরা মারা যাচ্ছি: জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিতে যখন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রে, তখন গতকাল (বৃহস্পতিবার) গাজায় নির্বিচার হামলা চালাচ্ছিল ইসরায়েলি বাহিনী। এদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপত্যকাটিতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৭ জন। তাঁদের মধ্যে ১১ জন ত্রাণের খাবার সংগ্রহ করতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের হামলায় নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুই শিশুও রয়েছে।

এই নিয়ে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত চলমান ইসরায়েলের হামলায় গাজা উপত্যকায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৬৫ হাজার ৫০২ জন ফিলিস্তিনি। আহত ১ লাখ ৬৭ হাজারের বেশি। গাজায় হামলা শুরুর আগে ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। ইসরায়েল থেকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয় প্রায় আড়াই শ জনকে।

গতকাল (বৃহস্পতিবার) গাজায় নিহতের মধ্যে ২৮ জনই গাজা নগরীর। উপত্যকাটির উত্তর ভাগে এই শহর এলাকায় ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। নগরীর রেমাল এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ আল–সালোউল আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ইসরায়েলের এই হামলা যেকোনো যৌক্তিকতা ও মানবিকতার বাইরে। বিশ্ব কী করছে? আমরা মারা যাচ্ছি, তা শুধু তারা দেখছে।’

গাজায় ত্রাণ নিতে গিয়ে যে ১১ জন নিহত হয়েছেন, তাঁরা মধ্য গাজার নেতজারিম করিডরের কাছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত বিতর্কিত একটি ত্রাণকেন্দ্রে খাবার সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। তখন তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়। গতকাল গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উপত্যকাটিতে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৫০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

আলোচনায় গাজার অন্তর্বর্তী প্রশাসন: বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, গাজায় যদি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়, তখন সেখানে একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসন গঠনের বিষয়ে আলোচনা চলছে। ওই প্রশাসনে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রেসিডেন্ট টনি ব্লেয়ারকে প্রধান করার কথা উঠেছে। তিনি গাজায় যুদ্ধ বন্ধে এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করছেন বলে জানা গেছে।

চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘে ট্রাম্প ও আরব নেতাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ সময় কয়েকটি প্রস্তাব তোলা হয়। প্রস্তাবের মূল বিষয় হলো, যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসন গাজার দায়িত্ব নেবে। এই প্রশাসনকে জাতিসংঘ সমর্থন দেবে এবং আরব দেশগুলো সহায়তা করবে। গাজার দায়িত্ব ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের আগপর্যন্ত এ প্রশাসন কার্যকর থাকবে।

এই প্রস্তাবে টনি ব্লেয়ারকে গাজার অন্তর্বর্তী প্রশাসনের দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। টনি ব্লেয়ার ২০০৭ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর কয়েক বছর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও জাতিসংঘের পক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে দূত হিসেবে কাজ করেছিলেন।

সানা/আপ্র/২৭/০৯/২০২৫