ঢাকা ০৩:৪৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫

জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনে বাংলাদেশের কী স্বার্থ?

  • আপডেট সময় : ০৭:৩৭:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫
  • ১৪ বার পড়া হয়েছে

ছবি সংগৃহীত

আমীন আল রশীদ

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে করিডোর ইস্যুতে বিতর্কের রেশ না কাটতেই সামনে আসে ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) কার্যালয় স্থাপনের বিষয়টি।

এই সেদিন ২৪ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বার্থেই ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। প্রয়োজনে ছয় মাসের নোটিশে সরকার এই কার্যালয় প্রত্যাহার করতে পারবে।’ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না বলেও বললেন তিনি। তবে এ মাসের শুরুতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন- জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে কি না, তিনি এটি বিচার করতে চান না। তাহলে ২০ দিন পরেই তিনি কেন বললেন যে এটি বাংলাদেশের স্বার্থেই হয়েছে, সেটি পরিষ্কার নয়।

এর আগে ৩ জুলাই পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, নেপাল থেকে জাতিসংঘের এ কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হলেও বাংলাদেশে কেন খোলা হচ্ছে? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘নেপালে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছিল। এরপর তারা (কার্যালয়) চলে গেছে। আমাদের এখানেও সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া রয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে সরকার যদি মনে করে, এ কার্যালয় কার্যকর হচ্ছে এবং আরো থাকা উচিত; তাহলে কার্যালয় থাকবে, না হলে থাকবে না।’

এরই মধ্যে ১৯ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, মানবাধিকারের সুরক্ষা ও বিকাশে সহায়তা করার লক্ষ্যে একটি মিশন খোলার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস এবং বাংলাদেশ সরকার তিন বছর মেয়াদি একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে। মিশনটির লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সংগঠনগুলোকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান। যদিও কবে এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে, সেটি বিবৃতিতে উল্লেখ নেই। এর আগের দিন সংবাদমাধ্যমেও খবরটি আসে; এমনকি জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে খবরটি প্রকাশিত হলেও সেখানে সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ উল্লেখ নেই। অর্থাৎ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের তারিখ উল্লেখ করা হয়নি। সাধারণত এ ধরনের ঘটনার সংবাদে, বিশেষ করে কোনো দেশ বা পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি স্বাক্ষরের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে কেন এই ব্যতিক্রম, সেটি প্রথম প্রশ্ন।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বিবৃতি পাঠানো হয় বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে। অথচ অন্য অনেক বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং নিয়মিত ব্রিফ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে বিবৃতি-বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে থাকে।

তৃতীয়ত, এ বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো উচিত ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পরেও এ বিষয়ে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।

সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, এই সমঝোতা স্মারকে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের পক্ষে ভলকার টুর্ক স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু কেন এই সমঝোতা? এখানে বাংলাদেশের স্বার্থ কী আর ঢাকায় এই কার্যালয় না হলে বাংলাদেশের ক্ষতি কী?

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, মিশনটির লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সংগঠনগুলোকে প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি সহায়তা প্রদান। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সক্ষমতা বৃদ্ধি, আইনি সহায়তা ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণের বাংলাদেশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা পূরণে সহায়তা করা।

প্রসঙ্গত, গত বছরের জুলাই-অগাস্টে গণঅভ্যুত্থান চলাকালে সহিংস দমন-পীড়ন নিয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান চালিয়ে এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে জাতিসংঘ। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের কার্যালয় খোলার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বাংলাদেশ সরকারের নীতি-নির্ধারকরাও কার্যালয় খোলার বিষয়ে সম্মতি দেন।

গত ২৯ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের ঢাকায় একটি অফিস স্থাপনের প্রস্তাবে নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। এরপর গত ১০ জুলাই এতে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় সরকার।

শঙ্কা, না জুজুর ভয়: জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের এই অফিস নিয়ে কেন বিতর্ক? বাংলাদেশে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপি বা শিশু বিষয়ক তহিবল-ইউনিসেফের কার্যালয় থাকলেও সব নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তাহলে মানবাধিকার কার্যালয় নিয়ে বিতর্ক কেন? এটি কি নিতান্তই জুজুর ভয় নাকি শঙ্কার পেছনে কোনো বাস্তবিক কারণ আছে?

বলা হচ্ছে, পৃথিবীর যেসব দেশে মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস আছে, সেগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত, যুদ্ধকবলিত, সংঘাতপূর্ণ অথবা সেসব দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘ কি বাংলাদেশকেও সেরকম দেশের তালিকাভুক্ত করল, নাকি তারা মনে করছে বা তাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আরও বেশি সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠবে?

কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, শরীরের চেয়ে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার সংস্কৃতি আমাদের দেশে প্রবল। ফলে অনেক সময় এমন সব ধারণা করা হয় বা এমন কিছু বিষয় নিয়ে জুজুর ভয় তৈরি হয়, যার সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকে না। জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় হলে এই অফিস পশ্চিমা সংস্কৃতি বিকাশে ভূমিকা রাখবে যা মুসলিম ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে; এই কার্যালয় বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করার নামে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে ইত্যাদি শঙ্কার কথা বলা হলেও এগুলোর বাস্তবতা কতখানি, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা অনেক সময় বাস্তবতার চেয়ে মানুষের মনে ভয় বেশি কাজ করে। তার পেছনে অনেক সময় কিছু যৌক্তিক কারণও থাকে।

শক্তিধর দেশগুলোর চাপ ও প্রভাব অনেক সময় জাতিসংঘের এ প্রতিষ্ঠানটির নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাছাড়া সংস্থাটি সব দেশকে সমান গুরুত্ব দেয় না। পৃথিবীর সব দেশের মানবাধিকার নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলে না। এখানে তাদের এক ধরনের ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ বা পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষার একটা গোপন অভিলাষ থাকে। কিছু দেশ যেমন- চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব অভিযোগ করে যে, জাতিসংঘের এ প্রতিষ্ঠানটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। ফলে বাংলাদেশে তারা এ মুহূর্তে কেন এই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় স্থাপনে আগ্রহী হলো, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠা অস্বভাবিক নয়।

যেসব প্রশ্নের সুরাহা করা জরুরি: এই মুহূর্তে ঢাকায় কেন এরকম একটি কার্যালয় করতে জাতিসংঘ উৎসাহী হলো বা করতে চাইলো? কেননা, বাংলাদেশে মানবাধিকারের প্রশ্নটি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে—যখন গুম ও নাগরিকের বাকস্বাধীনতা নিয়ে নানা উদ্বেগ ছিল। জাতিসংঘ কি মনে করছে যে, বাংলাদেশ এখনো গুরুতর মানবাধিকার সংকটের ভেতরে রয়েছে এবং ভবিষ্যতে এটা বাড়বে?

জাতিসংঘ কেন এই সময়ে বাংলাদেশে এ কার্যালয়টি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করল- তার উত্তর কি এই যে, জাতিসংঘ এখান থেকে বাংলাদেশের নিকটতবর্তী রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চায় এবং সম্ভব হলে এখান থেকে তারা যাতে দ্রুত রাখাইনে যেতে পারে, এ জন্য এই কার্যালয়? কেননা মিয়ানমার সরকার হয়তো সরাসরি তাদের এই অনুমতি বা অ্যাকসেস দেবে না বা দিতে চাইবে না। রাখাইন নিয়ে জাতিসংঘের যে একটি বড় উদ্বেগ আছে, সেটি গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফরে এসে বলে গেছেন খোদ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এরপরই আলোচনায় আসে করিডোরের প্রসঙ্গটি। যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র বিরোধিতার মুখে সরকার বলেছে যে, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রশ্ন হলো, ঢাকায় মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় নিয়ে যেহেতু নাগরিকদের একটি অংশের মধ্যে উদ্বেগ ও সংশয় রয়েছে, ফলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সরকার কেন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করল না?

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ নিয়েও এ রকম হাইড অ্যান্ড সিক (লুকোচুরি) করা হয়েছে। বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে আনতে দ্বিতীয় দফার আলোচনাকে ‘ইতিবাচক’ বলে মন্তব্য করলেও বিস্তারিত জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘যেহেতু একটা নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট আছে, তাই সেই ধরনের কোনো প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।’ তখনো এই প্রশ্ন উঠেছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই এগ্রিমেন্ট বা চুক্তি কবে হলো? কে করল? অন্তর্বর্তী সরকার এই ধরনের চুক্তি করতে পারে কি না?

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৫ (ক) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে, এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোনো চুক্তি কেবল সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হইবে।’

যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট হয়ে থাকে, তাহলে সেটি কি রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হয়েছে? রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করলেই কী লাভ, তাকে তো এটা সংসদে পেশ করতে হবে। এ মুহূর্তে সংসদ নেই। আর যদি এটি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে এই চুক্তি কেবলমাত্র সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করার কথা। সংসদ না থাকলে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নিরাপত্তা-সম্পর্কিত চুক্তি কীভাবে করে?

আরও যেসব প্রশ্ন জনমনে আছে-

এক. বেশ কয়েক মাস ধরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কার্যত অচল। দেশের মানবাধিকার কমিশন অচল রেখে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিস খোলা নিয়ে সরকারের উৎসাহ কেন?

দুই. জাতিসংঘ কি মনে করছে যে, নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নিলে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে ঢাকায় এরকম একটি অফিস স্থাপন করা যাবে না এবং এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘কনভিন্সড’ করে এখনই কাজটা সম্পন্ন করল?

তিন. জাতিসংঘের এই অফিস স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কি মানবাধিকারের প্রশ্নে বৈশ্বিকভাবে তার ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করতে চাইল?

চার. জাতিসংঘের এই অফিসের এখতিয়ার কতটুকু? তারা মানবাধিকবার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী বা অভিযুক্ত রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে সরাসরি জবাবদিহির আওতায় আনতে পারবে বা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সরাসরি তার তদন্ত করতে পারবে? ধরা যাক, সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী, র‌্যাব, ডিবি ইত্যাদি সংস্থার বিরুদ্ধে গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ রয়েছে। ফলে জাতিসংঘের এই কার্যালয়ের কর্মকর্তারা কি এইসব প্রতিষ্ঠানের ভেতরে গিয়ে তদন্ত করার সুযোগ পাবেন এবং তার মধ্য দিয়ে নাগরিকের মানবাধিকার কতটা সুরক্ষিত হবে আর দেশের সার্বভৌমত্ব কতটা হুমকিতে পড়বে, সে প্রশ্নও অনেকের মনে আছে।

কী শর্তে সমঝোতা: বলা হচ্ছে, ২০২৬ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সদস্যপদ বজায় রাখা, জিএসপি সুবিধা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সুরক্ষার দিক থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেও দেখা যেতে পারে। যেমন- দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কার পরে বাংলাদেশে একটি বড় অভ্যুত্থান হলো এবং যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নটি বেশ গুরুতর আকারে রয়েছে। জাতিসংঘ কি বাংলাদেশে এরকম একটি অফিস স্থাপন করে এখান থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে অন্য কোনো দেশে প্রয়োগ করতে চায় নাকি এরইমধ্যে তাদের যে অভিজ্ঞতা হলো সেগুলো বাংলাদেশে প্রয়োগ করতে চায়? অর্থাৎ তারা তাদের বেস্ট প্র্যাকটিস বা উত্তম চর্চাগুলো প্রয়োগের একটি ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করছে কি না?

আসলেই জাতিসংঘের উদ্দেশ্য কী, সেটি বোঝা যাবে কী কী শর্তে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। তাই সমঝোতা স্মারকের ডকুমেন্টটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকার, বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি দ্রুত সমঝোতা স্মারকটি পাবলিক ডকুমেন্ট হিসেবে উন্মুক্ত করে দেয়, তাহলে জনমনে অনেক প্রশ্ন ও সংশয়ের অবসান হবে। আর যদি এখানে কোনো ধরনের গোপনীয়তা বা লুকোচুরির বিষয় থাকে, তাহলে সন্দেহ আরও বাড়বে।

লেখক: সাংবাদিক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনে বাংলাদেশের কী স্বার্থ?

আপডেট সময় : ০৭:৩৭:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ জুলাই ২০২৫

আমীন আল রশীদ

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে করিডোর ইস্যুতে বিতর্কের রেশ না কাটতেই সামনে আসে ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) কার্যালয় স্থাপনের বিষয়টি।

এই সেদিন ২৪ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বার্থেই ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। প্রয়োজনে ছয় মাসের নোটিশে সরকার এই কার্যালয় প্রত্যাহার করতে পারবে।’ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না বলেও বললেন তিনি। তবে এ মাসের শুরুতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন- জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে কি না, তিনি এটি বিচার করতে চান না। তাহলে ২০ দিন পরেই তিনি কেন বললেন যে এটি বাংলাদেশের স্বার্থেই হয়েছে, সেটি পরিষ্কার নয়।

এর আগে ৩ জুলাই পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, নেপাল থেকে জাতিসংঘের এ কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হলেও বাংলাদেশে কেন খোলা হচ্ছে? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘নেপালে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছিল। এরপর তারা (কার্যালয়) চলে গেছে। আমাদের এখানেও সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া রয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে সরকার যদি মনে করে, এ কার্যালয় কার্যকর হচ্ছে এবং আরো থাকা উচিত; তাহলে কার্যালয় থাকবে, না হলে থাকবে না।’

এরই মধ্যে ১৯ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, মানবাধিকারের সুরক্ষা ও বিকাশে সহায়তা করার লক্ষ্যে একটি মিশন খোলার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস এবং বাংলাদেশ সরকার তিন বছর মেয়াদি একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে। মিশনটির লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সংগঠনগুলোকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা প্রদান। যদিও কবে এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে, সেটি বিবৃতিতে উল্লেখ নেই। এর আগের দিন সংবাদমাধ্যমেও খবরটি আসে; এমনকি জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে খবরটি প্রকাশিত হলেও সেখানে সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ উল্লেখ নেই। অর্থাৎ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের তারিখ উল্লেখ করা হয়নি। সাধারণত এ ধরনের ঘটনার সংবাদে, বিশেষ করে কোনো দেশ বা পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি স্বাক্ষরের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে কেন এই ব্যতিক্রম, সেটি প্রথম প্রশ্ন।

দ্বিতীয় প্রশ্ন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বিবৃতি পাঠানো হয় বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হওয়ার পরে। অথচ অন্য অনেক বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং নিয়মিত ব্রিফ করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে বিবৃতি-বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে থাকে।

তৃতীয়ত, এ বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো উচিত ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পরেও এ বিষয়ে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।

সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, এই সমঝোতা স্মারকে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের পক্ষে ভলকার টুর্ক স্বাক্ষর করেছেন। কিন্তু কেন এই সমঝোতা? এখানে বাংলাদেশের স্বার্থ কী আর ঢাকায় এই কার্যালয় না হলে বাংলাদেশের ক্ষতি কী?

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, মিশনটির লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সংগঠনগুলোকে প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি সহায়তা প্রদান। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে সক্ষমতা বৃদ্ধি, আইনি সহায়তা ও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিশালীকরণের বাংলাদেশকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা পূরণে সহায়তা করা।

প্রসঙ্গত, গত বছরের জুলাই-অগাস্টে গণঅভ্যুত্থান চলাকালে সহিংস দমন-পীড়ন নিয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান চালিয়ে এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে জাতিসংঘ। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের কার্যালয় খোলার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বাংলাদেশ সরকারের নীতি-নির্ধারকরাও কার্যালয় খোলার বিষয়ে সম্মতি দেন।

গত ২৯ জুন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের ঢাকায় একটি অফিস স্থাপনের প্রস্তাবে নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। এরপর গত ১০ জুলাই এতে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় সরকার।

শঙ্কা, না জুজুর ভয়: জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের এই অফিস নিয়ে কেন বিতর্ক? বাংলাদেশে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপি বা শিশু বিষয়ক তহিবল-ইউনিসেফের কার্যালয় থাকলেও সব নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তাহলে মানবাধিকার কার্যালয় নিয়ে বিতর্ক কেন? এটি কি নিতান্তই জুজুর ভয় নাকি শঙ্কার পেছনে কোনো বাস্তবিক কারণ আছে?

বলা হচ্ছে, পৃথিবীর যেসব দেশে মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস আছে, সেগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত, যুদ্ধকবলিত, সংঘাতপূর্ণ অথবা সেসব দেশে গৃহযুদ্ধ চলছে। প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘ কি বাংলাদেশকেও সেরকম দেশের তালিকাভুক্ত করল, নাকি তারা মনে করছে বা তাদের কাছে তথ্য রয়েছে যে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আরও বেশি সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠবে?

কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, শরীরের চেয়ে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার সংস্কৃতি আমাদের দেশে প্রবল। ফলে অনেক সময় এমন সব ধারণা করা হয় বা এমন কিছু বিষয় নিয়ে জুজুর ভয় তৈরি হয়, যার সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকে না। জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় হলে এই অফিস পশ্চিমা সংস্কৃতি বিকাশে ভূমিকা রাখবে যা মুসলিম ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে; এই কার্যালয় বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করার নামে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে ইত্যাদি শঙ্কার কথা বলা হলেও এগুলোর বাস্তবতা কতখানি, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কেননা অনেক সময় বাস্তবতার চেয়ে মানুষের মনে ভয় বেশি কাজ করে। তার পেছনে অনেক সময় কিছু যৌক্তিক কারণও থাকে।

শক্তিধর দেশগুলোর চাপ ও প্রভাব অনেক সময় জাতিসংঘের এ প্রতিষ্ঠানটির নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাছাড়া সংস্থাটি সব দেশকে সমান গুরুত্ব দেয় না। পৃথিবীর সব দেশের মানবাধিকার নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলে না। এখানে তাদের এক ধরনের ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ বা পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষার একটা গোপন অভিলাষ থাকে। কিছু দেশ যেমন- চীন, রাশিয়া, সৌদি আরব অভিযোগ করে যে, জাতিসংঘের এ প্রতিষ্ঠানটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। ফলে বাংলাদেশে তারা এ মুহূর্তে কেন এই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় স্থাপনে আগ্রহী হলো, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন ওঠা অস্বভাবিক নয়।

যেসব প্রশ্নের সুরাহা করা জরুরি: এই মুহূর্তে ঢাকায় কেন এরকম একটি কার্যালয় করতে জাতিসংঘ উৎসাহী হলো বা করতে চাইলো? কেননা, বাংলাদেশে মানবাধিকারের প্রশ্নটি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে—যখন গুম ও নাগরিকের বাকস্বাধীনতা নিয়ে নানা উদ্বেগ ছিল। জাতিসংঘ কি মনে করছে যে, বাংলাদেশ এখনো গুরুতর মানবাধিকার সংকটের ভেতরে রয়েছে এবং ভবিষ্যতে এটা বাড়বে?

জাতিসংঘ কেন এই সময়ে বাংলাদেশে এ কার্যালয়টি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করল- তার উত্তর কি এই যে, জাতিসংঘ এখান থেকে বাংলাদেশের নিকটতবর্তী রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চায় এবং সম্ভব হলে এখান থেকে তারা যাতে দ্রুত রাখাইনে যেতে পারে, এ জন্য এই কার্যালয়? কেননা মিয়ানমার সরকার হয়তো সরাসরি তাদের এই অনুমতি বা অ্যাকসেস দেবে না বা দিতে চাইবে না। রাখাইন নিয়ে জাতিসংঘের যে একটি বড় উদ্বেগ আছে, সেটি গত মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফরে এসে বলে গেছেন খোদ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এরপরই আলোচনায় আসে করিডোরের প্রসঙ্গটি। যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র বিরোধিতার মুখে সরকার বলেছে যে, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রশ্ন হলো, ঢাকায় মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় নিয়ে যেহেতু নাগরিকদের একটি অংশের মধ্যে উদ্বেগ ও সংশয় রয়েছে, ফলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সরকার কেন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করল না?

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ নিয়েও এ রকম হাইড অ্যান্ড সিক (লুকোচুরি) করা হয়েছে। বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে আনতে দ্বিতীয় দফার আলোচনাকে ‘ইতিবাচক’ বলে মন্তব্য করলেও বিস্তারিত জানাতে অপরাগতা প্রকাশ করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘যেহেতু একটা নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট আছে, তাই সেই ধরনের কোনো প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।’ তখনো এই প্রশ্ন উঠেছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই এগ্রিমেন্ট বা চুক্তি কবে হলো? কে করল? অন্তর্বর্তী সরকার এই ধরনের চুক্তি করতে পারে কি না?

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৫ (ক) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘বিদেশের সহিত সম্পাদিত সকল চুক্তি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করা হইবে, এবং রাষ্ট্রপতি তাহা সংসদে পেশ করিবার ব্যবস্থা করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, জাতীয় নিরাপত্তার সহিত সংশ্লিষ্ট অনুরূপ কোনো চুক্তি কেবল সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করা হইবে।’

যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট হয়ে থাকে, তাহলে সেটি কি রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হয়েছে? রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করলেই কী লাভ, তাকে তো এটা সংসদে পেশ করতে হবে। এ মুহূর্তে সংসদ নেই। আর যদি এটি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে এই চুক্তি কেবলমাত্র সংসদের গোপন বৈঠকে পেশ করার কথা। সংসদ না থাকলে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নিরাপত্তা-সম্পর্কিত চুক্তি কীভাবে করে?

আরও যেসব প্রশ্ন জনমনে আছে-

এক. বেশ কয়েক মাস ধরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কার্যত অচল। দেশের মানবাধিকার কমিশন অচল রেখে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিস খোলা নিয়ে সরকারের উৎসাহ কেন?

দুই. জাতিসংঘ কি মনে করছে যে, নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নিলে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে ঢাকায় এরকম একটি অফিস স্থাপন করা যাবে না এবং এ কারণে অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘কনভিন্সড’ করে এখনই কাজটা সম্পন্ন করল?

তিন. জাতিসংঘের এই অফিস স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কি মানবাধিকারের প্রশ্নে বৈশ্বিকভাবে তার ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করতে চাইল?

চার. জাতিসংঘের এই অফিসের এখতিয়ার কতটুকু? তারা মানবাধিকবার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী বা অভিযুক্ত রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে সরাসরি জবাবদিহির আওতায় আনতে পারবে বা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সরাসরি তার তদন্ত করতে পারবে? ধরা যাক, সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী, র‌্যাব, ডিবি ইত্যাদি সংস্থার বিরুদ্ধে গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ রয়েছে। ফলে জাতিসংঘের এই কার্যালয়ের কর্মকর্তারা কি এইসব প্রতিষ্ঠানের ভেতরে গিয়ে তদন্ত করার সুযোগ পাবেন এবং তার মধ্য দিয়ে নাগরিকের মানবাধিকার কতটা সুরক্ষিত হবে আর দেশের সার্বভৌমত্ব কতটা হুমকিতে পড়বে, সে প্রশ্নও অনেকের মনে আছে।

কী শর্তে সমঝোতা: বলা হচ্ছে, ২০২৬ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সদস্যপদ বজায় রাখা, জিএসপি সুবিধা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সুরক্ষার দিক থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবেও দেখা যেতে পারে। যেমন- দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কার পরে বাংলাদেশে একটি বড় অভ্যুত্থান হলো এবং যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নটি বেশ গুরুতর আকারে রয়েছে। জাতিসংঘ কি বাংলাদেশে এরকম একটি অফিস স্থাপন করে এখান থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে অন্য কোনো দেশে প্রয়োগ করতে চায় নাকি এরইমধ্যে তাদের যে অভিজ্ঞতা হলো সেগুলো বাংলাদেশে প্রয়োগ করতে চায়? অর্থাৎ তারা তাদের বেস্ট প্র্যাকটিস বা উত্তম চর্চাগুলো প্রয়োগের একটি ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করছে কি না?

আসলেই জাতিসংঘের উদ্দেশ্য কী, সেটি বোঝা যাবে কী কী শর্তে তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। তাই সমঝোতা স্মারকের ডকুমেন্টটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকার, বিশেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি দ্রুত সমঝোতা স্মারকটি পাবলিক ডকুমেন্ট হিসেবে উন্মুক্ত করে দেয়, তাহলে জনমনে অনেক প্রশ্ন ও সংশয়ের অবসান হবে। আর যদি এখানে কোনো ধরনের গোপনীয়তা বা লুকোচুরির বিষয় থাকে, তাহলে সন্দেহ আরও বাড়বে।

লেখক: সাংবাদিক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ