ঢাকা ০৪:৪৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৫

জাতিসংঘের জন্মবার্ষিকী ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন

  • আপডেট সময় : ০৮:৩৯:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ নভেম্বর ২০২৫
  • ২ বার পড়া হয়েছে

ড. আব্দুল ওয়াদুদ

বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘ ১৯৪৫ সালের এই দিনে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ৫১টি রাষ্ট্র দিয়ে শুরু, বর্তমানে যার সদস্য সংখ্যা ১৯৩। বাংলাদেশ এই সংস্থাটির ১৩৬তম সদস্য। এ সংস্থাটির সাফল্য- ব্যর্থতা নিয়ে আছে তর্কবিতর্ক। আশি বছর ধরে বিশ্বশান্তি ও বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। অবশ্য জাতিসংঘের কথা উঠলেই সবাই তার ব্যর্থতার কথাই বলেন, তার অর্জনের কথা ঢাকা পড়ে যায়। সন্দেহ নেই যে, জাতিসংঘের সাফল্য অনেক। কিন্তু ব্যর্থতার দায়ও আছে।

অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের অঙ্গ-সংস্থাগুলোর কাজ ও অর্জনের কথা সুবিদিত। জাতিসংঘ শিশু সংস্থা; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা; বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি; খাদ্য ও কৃষি সংস্থা; শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা; ‘জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির কর্মকাণ্ড একদিকে বৈশ্বিক উন্নয়নকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে, তেমনই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে এবং ক্ষুধা নিবৃত্তিতে একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে জাতিসংঘের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশ্বের নানান দেশে দুর্ভিক্ষ এড়াতে, মানবাধিকার নিশ্চিত করতে, কোটি কোটি শরণার্থীকে সাহায্য করতে জাতিসংঘ খাদ্য কর্মসূচি, মানবাধিকার এবং শরণার্থী সংস্থাগুলো নানান প্রতিকূলতা মাথায় নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। তাদের কাজের জন্য জাতিসংঘ ও তার অঙ্গসংস্থাগুলো একাধিকবার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। কিন্তু এত সব সাফল্যের পরও জাতিসংঘের ব্যর্থতাগুলোর তালিকাও নিতান্ত ছোট নয়।

সংগঠনটির কাঠামোর স্বরূপ এবং প্রকৃতি, বড় বড় দেশের প্রভাব, হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ তার কার্যক্ষেত্রে সীমিত স্বাধীনতা- সবকিছু মিলিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই জাতিসংঘের প্রাসঙ্গিকতা ও কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মনে রাখা দরকার, একটি বিশেষ সময় ও বৈশ্বিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের জন্ম হয়েছিল। গত আশি বছরে বিশ্ব বদলে গেছে। ফলে গতকালের সংগঠন দিয়ে বর্তমান বাস্তবতার মোকাবিলা করা যাচ্ছে না। বর্তমান অবস্থায় জাতিসংঘের কাঠামোগত সংস্কার অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

কোনো সন্দেহ নেই, ১৯৪৫ সালের বিশ্ব প্রেক্ষাপট থেকে আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ওই সময় সবচেয়ে ক্ষমতাধর পাঁচটি দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্স জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য হয়। অন্য রাষ্ট্রগুলোর মর্যাদা হয় সাধারণ সদস্য। এই পাঁচ রাষ্ট্র কোনো বিষয়ে একমত না হলে জাতিসংঘ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। যেহেতু এই নীতি চলমান থাকায় একমতও হওয়া যায় না, সেহেতু বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ সফল হতে পারে না। ঐকমত্য ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইরাকে হামলা চালায়। জাতিসংঘের সমর্থন ছাড়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ওপর এমন হামলা শুধু বেআইনিই নয়, অনৈতিকও। কিন্তু ইঙ্গ-মার্কিন মোড়লরা ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে ‘মানবধ্বংসী অস্ত্রভান্ডার আছে ধুয়া তুলে দেশটিকে ঝাঁঝরা করে দেয়। দেশটির প্রায় ১০ লাখ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

আফগানিস্তানে তালেবানের ওপর হামলা যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড। ওই হামলা বা যুদ্ধে চীন ও রাশিয়া অংশ নেয়নি। ফিলিস্তিনে বারবার হামলা চালালেও জাতিসংঘের শুধু দুঃখ প্রকাশ, শোক জানানো’ ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি ছাড়া বিশেষ কিছু করার নেই। হামাসকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ তকমা দিতে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ করলেও ইসরায়েলের শাস্তি দাবি করেনি যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্ররা। ফলে দেশটির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ।

ফিলিস্তিনের ব্যাপারে চুপ থাকলেও ওই জাতিসংঘই ইউক্রেনের ব্যাপারে সরব। ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। এসব নিষেধাজ্ঞায় জাতিসংঘ পশ্চিমাদের পাশেই আছে। যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারলেও যুদ্ধে গণহত্যায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ বা যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্গঠনে কিছু তৎপরতা চালায় জাতিসংঘ। যুদ্ধ এলাকা থেকে বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে সরাতেও কাজ করছে। এর বাইরে তাদের ভূমিকা সীমাবদ্ধ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বার্লিন-সংকট থেকে শুরু করে হালের ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘ নিন্দা, বিবৃতি প্রদান ও নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাশ করা ছাড়া খুব বেশি কিছু করতে পারেনি। ১৯৬২ সালে কিউবায় মিসাইল- সংকট সমাধানে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ভিয়েতনামে বা কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধে জাতিসংঘের ভূমিকা সন্তোষজনক ছিল না। নাপাম বোমার চিহ্ন এখনো বয়ে বেড়ায় ভিয়েতনাম।

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ ঠেকাতে পারেনি জাতিসংঘ; এমনকি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরাতেও কঠোর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। লিবিয়া বা ইরাকে সিভিলিয়ানদের রক্ষা করতে পারেনি তারা। বরং গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ধ্বংসের নামে ইরাকে, সোমালিয়ায় যুদ্ধের আয়োজন করে দিয়েছে বিশ্বসংগঠনটি। কাশ্মির সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ একেবারেই ব্যর্থ। রুয়ান্ডার গণহত্যার সময়ও সাক্ষীগোপালের ভূমিকায় ছিল সংগঠনটি বসনিয়ার সেব্রেনিৎসায় সার্বদের গণহত্যা যখন চলে, সংগঠনটি টিনের চশমা পরে চেয়ে চেয়ে দেখেছে শুধু দুই বছরের বেশি।

জাতিসংঘের বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামো, সদস্য রাষ্ট্রসমূহের ভূমিকা, কার্যপ্রণালি ও নিয়মনীতি এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পটভূমি বিবেচনা করলে এর সংস্কার তথা পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা সহজেই অনুমেয়। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— বাজেটের ব্যয় হ্রাস, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন প্রয়াসকে জোরদারকরণ, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহাসচিব নিয়োগ প্রভৃতি। সাবেক আরেক মহাসচিব ড. বুট্রোস ঘালিও জাতিসংঘ সংস্কারের বিষয়ে যে ঐতিহাসিক প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন। সংস্থাটির বর্তমান ব্যর্থতা ও অকার্যকারিতার জন্য এর সাংগঠনিক কাঠামো, প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাসহ বৃহৎ শক্তিগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতিকে দায়ী করেন বিশ্লেষকরা।

জাতিসংঘের প্রধান বিচার অঙ্গ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) আজ এক হতাশাজনক বাস্তবতার মুখোমুখি। এই আদালত যদিও ২০২৪ সালে ইসরায়েলের দখলদারিত্বকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থন জানায়, তবুও এর রায় বাস্তবায়নে আদালতের কোনো কার্যকর ক্ষমতা নেই। গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চলমান গণহত্যার মামলায় আইসিজে একাধিকবার ইসরায়েলি নেতাদের কার্যক্রমকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু আইসিজের রায় মানার জন্য কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সদিচ্ছার ওপর।

আইসিজের কার্যকারিতা রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে। ফলে যেসব রাষ্ট্র ভেটোধারী শক্তির আশীর্বাদপুষ্ট, তারা কার্যত দায়মুক্ত থেকে যায়। আইসিজের জন্য একটি সময়োপযোগী বৃহৎ সংস্কার কর্মসূচি অপরিহার্য। আইসিজের আর্থিক ও সাংগঠনিক স্বায়ত্তশাসন বাড়াতে হবে। এর রায় বাস্তবায়নে নিরাপত্তা পরিষদের রাজনৈতিক প্রভাব বাদ দিয়ে একটি স্বাধীন কাঠামো গড়া যেত। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকলেও বাস্তবে অনেকটাই প্রান্তিক একটি সংস্থায় পরিণত হয়েছে।

ইরান ঘিরে যখন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র বারবার চাপ সৃষ্টি করছে, তখন আইএইএ কার্যত একপাশে বসে রয়েছে। আইএইএ-এর প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো এর বাস্তবায়ন ক্ষমতার অভাব। এর কোনো সরাসরি ক্ষমতা নেই যে কোনো রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে পারে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে চাপ ও তদন্তের বিপরীতে ইসরায়েলের মতো পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র, যারা এনপিটির (পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি) সদস্যই নয়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত বা প্রশ্ন তোলা হয় না। এই দ্বৈত মানদণ্ড বৈশ্বিক দক্ষিণে জাতিসংঘ ও এর অঙ্গসংস্থাগুলোর ওপর আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।

জাতিসংঘের বর্তমান কাঠামো আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে যে ব্যর্থ হয়েছে, তা আজ স্পষ্ট। এরকম পরিস্থিতিতে তুরস্ক, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো উদীয়মান শক্তিগুলো সংস্কারের দাবিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং সন্ত্রাস, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অশিক্ষার বিরুদ্ধে একটি কার্যকরী সংগঠনে পরিণত হওয়ার জন্য জাতিসংঘের সংস্কার অত্যাবশ্যক। বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা সময়ের দাবি। প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে জাতিসংঘকে এখনো বিশ্ববাসীর শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার উপযোগী একটি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য সংস্থায় পরিণত করা সম্ভব।

লেখক: ফিকামলি তত্ত্বের জনক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : prottashasmf@yahoo.com
আপলোডকারীর তথ্য

কুড়িগ্রামে সাংবাদিকদের মানববন্ধন ও সমাবেশ

জাতিসংঘের জন্মবার্ষিকী ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন

আপডেট সময় : ০৮:৩৯:১৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ নভেম্বর ২০২৫

ড. আব্দুল ওয়াদুদ

বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘ ১৯৪৫ সালের এই দিনে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ৫১টি রাষ্ট্র দিয়ে শুরু, বর্তমানে যার সদস্য সংখ্যা ১৯৩। বাংলাদেশ এই সংস্থাটির ১৩৬তম সদস্য। এ সংস্থাটির সাফল্য- ব্যর্থতা নিয়ে আছে তর্কবিতর্ক। আশি বছর ধরে বিশ্বশান্তি ও বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে সংগঠনটি। অবশ্য জাতিসংঘের কথা উঠলেই সবাই তার ব্যর্থতার কথাই বলেন, তার অর্জনের কথা ঢাকা পড়ে যায়। সন্দেহ নেই যে, জাতিসংঘের সাফল্য অনেক। কিন্তু ব্যর্থতার দায়ও আছে।

অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের অঙ্গ-সংস্থাগুলোর কাজ ও অর্জনের কথা সুবিদিত। জাতিসংঘ শিশু সংস্থা; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা; বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি; খাদ্য ও কৃষি সংস্থা; শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা; ‘জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির কর্মকাণ্ড একদিকে বৈশ্বিক উন্নয়নকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে, তেমনই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণে এবং ক্ষুধা নিবৃত্তিতে একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে জাতিসংঘের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিশ্বের নানান দেশে দুর্ভিক্ষ এড়াতে, মানবাধিকার নিশ্চিত করতে, কোটি কোটি শরণার্থীকে সাহায্য করতে জাতিসংঘ খাদ্য কর্মসূচি, মানবাধিকার এবং শরণার্থী সংস্থাগুলো নানান প্রতিকূলতা মাথায় নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। তাদের কাজের জন্য জাতিসংঘ ও তার অঙ্গসংস্থাগুলো একাধিকবার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। কিন্তু এত সব সাফল্যের পরও জাতিসংঘের ব্যর্থতাগুলোর তালিকাও নিতান্ত ছোট নয়।

সংগঠনটির কাঠামোর স্বরূপ এবং প্রকৃতি, বড় বড় দেশের প্রভাব, হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ তার কার্যক্ষেত্রে সীমিত স্বাধীনতা- সবকিছু মিলিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই জাতিসংঘের প্রাসঙ্গিকতা ও কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মনে রাখা দরকার, একটি বিশেষ সময় ও বৈশ্বিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের জন্ম হয়েছিল। গত আশি বছরে বিশ্ব বদলে গেছে। ফলে গতকালের সংগঠন দিয়ে বর্তমান বাস্তবতার মোকাবিলা করা যাচ্ছে না। বর্তমান অবস্থায় জাতিসংঘের কাঠামোগত সংস্কার অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

কোনো সন্দেহ নেই, ১৯৪৫ সালের বিশ্ব প্রেক্ষাপট থেকে আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ওই সময় সবচেয়ে ক্ষমতাধর পাঁচটি দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া ও ফ্রান্স জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য হয়। অন্য রাষ্ট্রগুলোর মর্যাদা হয় সাধারণ সদস্য। এই পাঁচ রাষ্ট্র কোনো বিষয়ে একমত না হলে জাতিসংঘ কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে না। যেহেতু এই নীতি চলমান থাকায় একমতও হওয়া যায় না, সেহেতু বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ সফল হতে পারে না। ঐকমত্য ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইরাকে হামলা চালায়। জাতিসংঘের সমর্থন ছাড়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ওপর এমন হামলা শুধু বেআইনিই নয়, অনৈতিকও। কিন্তু ইঙ্গ-মার্কিন মোড়লরা ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে ‘মানবধ্বংসী অস্ত্রভান্ডার আছে ধুয়া তুলে দেশটিকে ঝাঁঝরা করে দেয়। দেশটির প্রায় ১০ লাখ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

আফগানিস্তানে তালেবানের ওপর হামলা যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড। ওই হামলা বা যুদ্ধে চীন ও রাশিয়া অংশ নেয়নি। ফিলিস্তিনে বারবার হামলা চালালেও জাতিসংঘের শুধু দুঃখ প্রকাশ, শোক জানানো’ ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি ছাড়া বিশেষ কিছু করার নেই। হামাসকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ তকমা দিতে নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধ করলেও ইসরায়েলের শাস্তি দাবি করেনি যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্ররা। ফলে দেশটির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ।

ফিলিস্তিনের ব্যাপারে চুপ থাকলেও ওই জাতিসংঘই ইউক্রেনের ব্যাপারে সরব। ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। এসব নিষেধাজ্ঞায় জাতিসংঘ পশ্চিমাদের পাশেই আছে। যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারলেও যুদ্ধে গণহত্যায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ বা যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্গঠনে কিছু তৎপরতা চালায় জাতিসংঘ। যুদ্ধ এলাকা থেকে বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ স্থানে সরাতেও কাজ করছে। এর বাইরে তাদের ভূমিকা সীমাবদ্ধ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বার্লিন-সংকট থেকে শুরু করে হালের ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘ নিন্দা, বিবৃতি প্রদান ও নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাশ করা ছাড়া খুব বেশি কিছু করতে পারেনি। ১৯৬২ সালে কিউবায় মিসাইল- সংকট সমাধানে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ভিয়েতনামে বা কোরীয় উপদ্বীপের যুদ্ধে জাতিসংঘের ভূমিকা সন্তোষজনক ছিল না। নাপাম বোমার চিহ্ন এখনো বয়ে বেড়ায় ভিয়েতনাম।

মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ ঠেকাতে পারেনি জাতিসংঘ; এমনকি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরাতেও কঠোর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। লিবিয়া বা ইরাকে সিভিলিয়ানদের রক্ষা করতে পারেনি তারা। বরং গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র ধ্বংসের নামে ইরাকে, সোমালিয়ায় যুদ্ধের আয়োজন করে দিয়েছে বিশ্বসংগঠনটি। কাশ্মির সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ একেবারেই ব্যর্থ। রুয়ান্ডার গণহত্যার সময়ও সাক্ষীগোপালের ভূমিকায় ছিল সংগঠনটি বসনিয়ার সেব্রেনিৎসায় সার্বদের গণহত্যা যখন চলে, সংগঠনটি টিনের চশমা পরে চেয়ে চেয়ে দেখেছে শুধু দুই বছরের বেশি।

জাতিসংঘের বর্তমান সাংগঠনিক কাঠামো, সদস্য রাষ্ট্রসমূহের ভূমিকা, কার্যপ্রণালি ও নিয়মনীতি এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পটভূমি বিবেচনা করলে এর সংস্কার তথা পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা সহজেই অনুমেয়। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— বাজেটের ব্যয় হ্রাস, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন প্রয়াসকে জোরদারকরণ, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহাসচিব নিয়োগ প্রভৃতি। সাবেক আরেক মহাসচিব ড. বুট্রোস ঘালিও জাতিসংঘ সংস্কারের বিষয়ে যে ঐতিহাসিক প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন। সংস্থাটির বর্তমান ব্যর্থতা ও অকার্যকারিতার জন্য এর সাংগঠনিক কাঠামো, প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাসহ বৃহৎ শক্তিগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক প্রভৃতিকে দায়ী করেন বিশ্লেষকরা।

জাতিসংঘের প্রধান বিচার অঙ্গ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) আজ এক হতাশাজনক বাস্তবতার মুখোমুখি। এই আদালত যদিও ২০২৪ সালে ইসরায়েলের দখলদারিত্বকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থন জানায়, তবুও এর রায় বাস্তবায়নে আদালতের কোনো কার্যকর ক্ষমতা নেই। গাজায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চলমান গণহত্যার মামলায় আইসিজে একাধিকবার ইসরায়েলি নেতাদের কার্যক্রমকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিন্তু আইসিজের রায় মানার জন্য কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সদিচ্ছার ওপর।

আইসিজের কার্যকারিতা রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে। ফলে যেসব রাষ্ট্র ভেটোধারী শক্তির আশীর্বাদপুষ্ট, তারা কার্যত দায়মুক্ত থেকে যায়। আইসিজের জন্য একটি সময়োপযোগী বৃহৎ সংস্কার কর্মসূচি অপরিহার্য। আইসিজের আর্থিক ও সাংগঠনিক স্বায়ত্তশাসন বাড়াতে হবে। এর রায় বাস্তবায়নে নিরাপত্তা পরিষদের রাজনৈতিক প্রভাব বাদ দিয়ে একটি স্বাধীন কাঠামো গড়া যেত। আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকলেও বাস্তবে অনেকটাই প্রান্তিক একটি সংস্থায় পরিণত হয়েছে।

ইরান ঘিরে যখন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র বারবার চাপ সৃষ্টি করছে, তখন আইএইএ কার্যত একপাশে বসে রয়েছে। আইএইএ-এর প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো এর বাস্তবায়ন ক্ষমতার অভাব। এর কোনো সরাসরি ক্ষমতা নেই যে কোনো রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে পারে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে চাপ ও তদন্তের বিপরীতে ইসরায়েলের মতো পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্র, যারা এনপিটির (পারমাণবিক অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি) সদস্যই নয়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত বা প্রশ্ন তোলা হয় না। এই দ্বৈত মানদণ্ড বৈশ্বিক দক্ষিণে জাতিসংঘ ও এর অঙ্গসংস্থাগুলোর ওপর আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।

জাতিসংঘের বর্তমান কাঠামো আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে যে ব্যর্থ হয়েছে, তা আজ স্পষ্ট। এরকম পরিস্থিতিতে তুরস্ক, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো উদীয়মান শক্তিগুলো সংস্কারের দাবিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং সন্ত্রাস, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অশিক্ষার বিরুদ্ধে একটি কার্যকরী সংগঠনে পরিণত হওয়ার জন্য জাতিসংঘের সংস্কার অত্যাবশ্যক। বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করা সময়ের দাবি। প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে জাতিসংঘকে এখনো বিশ্ববাসীর শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার উপযোগী একটি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য সংস্থায় পরিণত করা সম্ভব।

লেখক: ফিকামলি তত্ত্বের জনক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
(মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজস্ব)

আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ