ঢাকা ০৬:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৮ জুন ২০২৫

জাকারবার্গের ‘মেটা’ আর আমাদের ছেলেটা

  • আপডেট সময় : ০৯:৪৫:৫৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ নভেম্বর ২০২১
  • ১০২ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক : সাতসকালেই ছোট খালুর ফোন। তার মানে জীবন থেকে পাক্কা আধা ঘণ্টা গায়েব। ছোট খালুর বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। ভোরে উঠেই তাঁর অন্যতম কাজ খবরের কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া এবং খবর পড়ে রাগ, দুঃখ, বিরক্ত বা আনন্দিত হলে আমাকে ফোন করা। কোনো এক বিচিত্র কারণে তিনি আমাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। এ জীবনে কোথাও অতটা গুরুত্ব পাই না। কাজেই ছোট খালু এতটা গুরুত্ব দেন বলে ফোনটা ধরতেই হয়। কিন্তু ফোন ধরার পর জীবন থেকে আধা ঘণ্টা গায়েব হওয়ার পর টের পাই, খালু আসলে কেন আমাকে এতটা গুরুত্ব দেন। কারণ, তাঁর এসব বকবকানি শোনার মতো ধৈর্য ও সময় আর কারও আছে বলে মনে হয় না। খালুর কথাবার্তা শুনলে একটা রোবটও ‘ছাতার মাথা’ বলে ফোন কেটে দিতে পারে!
জীবনের আধা ঘণ্টা অপচয়ের আশঙ্কা মাথায় নিয়েই ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা ধরলাম। খালু বললেন, ‘রবিন, জাকারবার্গ তো আমার বেয়াই হয়ে গেল!’
আমি চোখ বন্ধ করে বললাম, ‘খুব ভালো খবর, খালু! পরিচিত সব অগামগাচগা ছেলেদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ভেরিফায়েড হয়ে যাচ্ছে, আমারটাও হওয়া দরকার। আপনার বেয়াইকে যদি একটু বলতেন।’
খালু কঠিন গলায় বললেন, ‘সাতসকালে জরুরি বিষয়ে ফোন করেছি, মশকরা রাখো।’
আমার আক্কেলগুড়ুম। খালু নিজেই মশকরা করে আমাকে উল্টো ফাঁপর দিচ্ছেন, ঘটনা তো জটিল মনে হচ্ছে! আমি চোখ খুলে বললাম, ‘জাকারবার্গ আপনার বেয়াই হলে ছোট্ট এই তদবিরটা করতে পারবেন না?’
খালুর কণ্ঠ এখনো কঠিন, ‘শোনো, কাগজে পড়লাম, ওই জাকারবার্গ ছোকরাটা নাকি তার কোম্পানির নাম রেখেছে “মেটা”। আর পুরো সিস্টেমটাকেই বলা হচ্ছে “মেটাভার্স”, এ বিষয়ে কিছু জানো?’
আমি খানিকটা বেকায়দায় পড়ে গেলাম। আমার অবস্থা হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের চরিত্রের মতো। ওই যে বলে না, ‘গাঞ্জা খাইয়াই কূল পাই না, লেখাপড়া করব কোন সময়!’ তাই আমিও খালুকে বললাম, ‘মোটামুটি মানের একটা জীবন কাটিয়েই কূল পাই না, মেটাভার্সের খবর রাখব কোন সময়!’
ফোনের ওপাশে খালু হঠাৎ চুপ মেরে গেলেন। সম্ভবত দিব্যদৃষ্টিতে আমার অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখে এক মিনিট নীরবতা পালন করছেন। নীরবতা পালন শেষে বললেন, ‘শোনো, বিষয়টা সিরিয়াস। আমি তো টুটুলকে নিয়ে মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম!’
টুটুল আমার খালাতো ভাই, মানে খালুর ছেলে। মেটাভার্সের সঙ্গে টুটুলের সম্পর্ক খুঁজে না পেয়ে কৌতূহল হলো, ‘টুটুল কি মেটাভার্সে জয়েন করছে? ও তো এসব বিষয় বেশ ভালো বোঝে।’
ফোনের ওপাশ থেকে খালুর অট্টহাসি ভেসে আসতেই ফোনটা কান থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিতে হলো। হাসি থামিয়ে খালু বললেন, ‘রবিন, এই দুনিয়া সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নাই। টুটুল যদি মেটাভার্সে জয়েন করত, তাহলে আমি হতাম বিল গেটস।’
আমি এবার বিরক্তই হলাম, ‘খালু, দুনিয়ার সব চিন্তা আপনাকেই করতে হয় কেন?’ খালুর কণ্ঠ গম্ভীর, ‘টুটুলের মতো সারাদিন মোবাইলফোনে মাথা গুঁজে থাকা একটা ছেলে থাকলে মহাবিশ্বের সব চিন্তা তোমার মাথায় ভর করবে…’
আমি খালুর কথার আগামাথা খুঁজে না পেয়ে ‘হুম’ বলে থেমে গেলাম।
খালু বললেন, ‘তবে একদিক থেকে ভাবলে, তোমার কথা অবশ্য ঠিক, টুটুল আসলে মেটাভার্সে জয়েন করছে। জয়েন করছে বলতে জয়েন করে বসে আছে।’
আমি এবার নিজেকে গুটিয়ে না রেখে খোলস থেকে বেরিয়ে এলাম, ‘তাহলে তো ওর ভবিষ্যত ফকফকা, জাকারবার্গের অফিসে বসে ফেসবুক চালাবে।’
খালু এবারও হাসলেন, ‘তা মন্দ বলোনি। এ কারণেই তো বললাম, জাকারবার্গ আমার বেয়াই হয়ে গেল।’
‘খালু, বিষয়টা একটু পরিষ্কার করেন। আমার তাড়া আছে, অফিসে যেতে হবে।’
‘আরে, রাখো অফিস! অফিসে তো যাবেই। যেটা বলছিলাম, জাকারবার্গ আসলে এই মেটাভার্স খুলে পুরো দুনিয়াটাকেই একটা মরণফাঁদ বানাচ্ছে! ওর এই মেটাভার্স একটা থ্রিডি ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া, ওখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত হতে পারবে। বুঝতে পারছ বিষয়টা?’
আমি সাবধানতা অবলম্বন করে বললাম, ‘এটা না বোঝার কী হলো!’
খালু চালিয়ে গেলেন, ‘তবে ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় তো আর সশরীর উপস্থিত হওয়ার সুযোগ নেই। তাই প্রত্যেকের থ্রিডি আভাটার বা অবতার থাকবে। অনেকটা কার্টুন চরিত্রের মতো। এই ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় বাংলাদেশে বসেও কানাডায় বসে থাকা এক বন্ধুর সঙ্গে দিব্যি আড্ডাফাড্ডা দেওয়া যাবে। চাইলেই দোকানে না গিয়ে শপিং করা যাবে।’
আমি বললাম, ‘তাহলে তো ভালোই, বাসায় শুয়েবসেই অফিস করব।’
খালু এবার চেতেই গেলেন, ‘তুমি তো আছ তোমার ধান্দায়। আমি আছি নিজের চিন্তা নিয়ে।’
আমি এবার বিরক্তই হলাম, ‘খালু, দুনিয়ার সব চিন্তা আপনাকেই করতে হয় কেন?’
খালুর কণ্ঠ গম্ভীর, ‘টুটুলের মতো সারাদিন মোবাইলফোনে মাথা গুঁজে থাকা একটা ছেলে থাকলে মহাবিশ্বের সব চিন্তা তোমার মাথায় ভর করবে। এমনিতেই ও ফেসবুক, ইনস্টা, হোয়াটসঅ্যাপ নিয়ে মেতে আছে; তার মধ্যে এই মেটা এলে কী হবে ভেবেছ? গোল্লায় তো গেছেই, এবার মাইনাসে যাবে।’
আমি এবারও ‘হুম’ বলে নিরাপদ দূরত্বে থাকলাম।
খালু বললেন, ‘এ কারণেই বললাম, জাকারবার্গ এখন আমার বেয়াই। ওর “মেটা”র সঙ্গে আমার ছেলেটা গাঁটছড়া বেঁধেছে। তো তুমিই বলো, জাকারবার্গ আমার বেয়াই হবে কি না?’

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জাকারবার্গের ‘মেটা’ আর আমাদের ছেলেটা

আপডেট সময় : ০৯:৪৫:৫৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ নভেম্বর ২০২১

প্রত্যাশা ডেস্ক : সাতসকালেই ছোট খালুর ফোন। তার মানে জীবন থেকে পাক্কা আধা ঘণ্টা গায়েব। ছোট খালুর বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। ভোরে উঠেই তাঁর অন্যতম কাজ খবরের কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া এবং খবর পড়ে রাগ, দুঃখ, বিরক্ত বা আনন্দিত হলে আমাকে ফোন করা। কোনো এক বিচিত্র কারণে তিনি আমাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। এ জীবনে কোথাও অতটা গুরুত্ব পাই না। কাজেই ছোট খালু এতটা গুরুত্ব দেন বলে ফোনটা ধরতেই হয়। কিন্তু ফোন ধরার পর জীবন থেকে আধা ঘণ্টা গায়েব হওয়ার পর টের পাই, খালু আসলে কেন আমাকে এতটা গুরুত্ব দেন। কারণ, তাঁর এসব বকবকানি শোনার মতো ধৈর্য ও সময় আর কারও আছে বলে মনে হয় না। খালুর কথাবার্তা শুনলে একটা রোবটও ‘ছাতার মাথা’ বলে ফোন কেটে দিতে পারে!
জীবনের আধা ঘণ্টা অপচয়ের আশঙ্কা মাথায় নিয়েই ঘুম ঘুম চোখে ফোনটা ধরলাম। খালু বললেন, ‘রবিন, জাকারবার্গ তো আমার বেয়াই হয়ে গেল!’
আমি চোখ বন্ধ করে বললাম, ‘খুব ভালো খবর, খালু! পরিচিত সব অগামগাচগা ছেলেদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ভেরিফায়েড হয়ে যাচ্ছে, আমারটাও হওয়া দরকার। আপনার বেয়াইকে যদি একটু বলতেন।’
খালু কঠিন গলায় বললেন, ‘সাতসকালে জরুরি বিষয়ে ফোন করেছি, মশকরা রাখো।’
আমার আক্কেলগুড়ুম। খালু নিজেই মশকরা করে আমাকে উল্টো ফাঁপর দিচ্ছেন, ঘটনা তো জটিল মনে হচ্ছে! আমি চোখ খুলে বললাম, ‘জাকারবার্গ আপনার বেয়াই হলে ছোট্ট এই তদবিরটা করতে পারবেন না?’
খালুর কণ্ঠ এখনো কঠিন, ‘শোনো, কাগজে পড়লাম, ওই জাকারবার্গ ছোকরাটা নাকি তার কোম্পানির নাম রেখেছে “মেটা”। আর পুরো সিস্টেমটাকেই বলা হচ্ছে “মেটাভার্স”, এ বিষয়ে কিছু জানো?’
আমি খানিকটা বেকায়দায় পড়ে গেলাম। আমার অবস্থা হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের চরিত্রের মতো। ওই যে বলে না, ‘গাঞ্জা খাইয়াই কূল পাই না, লেখাপড়া করব কোন সময়!’ তাই আমিও খালুকে বললাম, ‘মোটামুটি মানের একটা জীবন কাটিয়েই কূল পাই না, মেটাভার্সের খবর রাখব কোন সময়!’
ফোনের ওপাশে খালু হঠাৎ চুপ মেরে গেলেন। সম্ভবত দিব্যদৃষ্টিতে আমার অন্ধকার ভবিষ্যৎ দেখে এক মিনিট নীরবতা পালন করছেন। নীরবতা পালন শেষে বললেন, ‘শোনো, বিষয়টা সিরিয়াস। আমি তো টুটুলকে নিয়ে মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম!’
টুটুল আমার খালাতো ভাই, মানে খালুর ছেলে। মেটাভার্সের সঙ্গে টুটুলের সম্পর্ক খুঁজে না পেয়ে কৌতূহল হলো, ‘টুটুল কি মেটাভার্সে জয়েন করছে? ও তো এসব বিষয় বেশ ভালো বোঝে।’
ফোনের ওপাশ থেকে খালুর অট্টহাসি ভেসে আসতেই ফোনটা কান থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিতে হলো। হাসি থামিয়ে খালু বললেন, ‘রবিন, এই দুনিয়া সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নাই। টুটুল যদি মেটাভার্সে জয়েন করত, তাহলে আমি হতাম বিল গেটস।’
আমি এবার বিরক্তই হলাম, ‘খালু, দুনিয়ার সব চিন্তা আপনাকেই করতে হয় কেন?’ খালুর কণ্ঠ গম্ভীর, ‘টুটুলের মতো সারাদিন মোবাইলফোনে মাথা গুঁজে থাকা একটা ছেলে থাকলে মহাবিশ্বের সব চিন্তা তোমার মাথায় ভর করবে…’
আমি খালুর কথার আগামাথা খুঁজে না পেয়ে ‘হুম’ বলে থেমে গেলাম।
খালু বললেন, ‘তবে একদিক থেকে ভাবলে, তোমার কথা অবশ্য ঠিক, টুটুল আসলে মেটাভার্সে জয়েন করছে। জয়েন করছে বলতে জয়েন করে বসে আছে।’
আমি এবার নিজেকে গুটিয়ে না রেখে খোলস থেকে বেরিয়ে এলাম, ‘তাহলে তো ওর ভবিষ্যত ফকফকা, জাকারবার্গের অফিসে বসে ফেসবুক চালাবে।’
খালু এবারও হাসলেন, ‘তা মন্দ বলোনি। এ কারণেই তো বললাম, জাকারবার্গ আমার বেয়াই হয়ে গেল।’
‘খালু, বিষয়টা একটু পরিষ্কার করেন। আমার তাড়া আছে, অফিসে যেতে হবে।’
‘আরে, রাখো অফিস! অফিসে তো যাবেই। যেটা বলছিলাম, জাকারবার্গ আসলে এই মেটাভার্স খুলে পুরো দুনিয়াটাকেই একটা মরণফাঁদ বানাচ্ছে! ওর এই মেটাভার্স একটা থ্রিডি ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া, ওখানে অনেক মানুষ একসঙ্গে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যুক্ত হতে পারবে। বুঝতে পারছ বিষয়টা?’
আমি সাবধানতা অবলম্বন করে বললাম, ‘এটা না বোঝার কী হলো!’
খালু চালিয়ে গেলেন, ‘তবে ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় তো আর সশরীর উপস্থিত হওয়ার সুযোগ নেই। তাই প্রত্যেকের থ্রিডি আভাটার বা অবতার থাকবে। অনেকটা কার্টুন চরিত্রের মতো। এই ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় বাংলাদেশে বসেও কানাডায় বসে থাকা এক বন্ধুর সঙ্গে দিব্যি আড্ডাফাড্ডা দেওয়া যাবে। চাইলেই দোকানে না গিয়ে শপিং করা যাবে।’
আমি বললাম, ‘তাহলে তো ভালোই, বাসায় শুয়েবসেই অফিস করব।’
খালু এবার চেতেই গেলেন, ‘তুমি তো আছ তোমার ধান্দায়। আমি আছি নিজের চিন্তা নিয়ে।’
আমি এবার বিরক্তই হলাম, ‘খালু, দুনিয়ার সব চিন্তা আপনাকেই করতে হয় কেন?’
খালুর কণ্ঠ গম্ভীর, ‘টুটুলের মতো সারাদিন মোবাইলফোনে মাথা গুঁজে থাকা একটা ছেলে থাকলে মহাবিশ্বের সব চিন্তা তোমার মাথায় ভর করবে। এমনিতেই ও ফেসবুক, ইনস্টা, হোয়াটসঅ্যাপ নিয়ে মেতে আছে; তার মধ্যে এই মেটা এলে কী হবে ভেবেছ? গোল্লায় তো গেছেই, এবার মাইনাসে যাবে।’
আমি এবারও ‘হুম’ বলে নিরাপদ দূরত্বে থাকলাম।
খালু বললেন, ‘এ কারণেই বললাম, জাকারবার্গ এখন আমার বেয়াই। ওর “মেটা”র সঙ্গে আমার ছেলেটা গাঁটছড়া বেঁধেছে। তো তুমিই বলো, জাকারবার্গ আমার বেয়াই হবে কি না?’