খান মুহঃ আশরাফুল আলম: একটি গাছ, একটি প্রাণ- এ কথা সবার জানা। তবে মানে কতজন? অবাধে গাছ কেটে নিজেদের অস্তিত্ব নিজেরাই বিপন্ন করে তুলছে মানুষ। পরিবেশবিদ বা গাছ বাঁচাতে লড়ছেন যারা, তাদের বিশেষত ক্ষমতাসীনরা অবজ্ঞার চোখে দেখেন, ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিপক্ষ ভাবেন। অনেক সময়ই তাদের এ লড়াইকে বোকামি মনে করা হয়। তারা যে কত বৃহৎ ও মহৎ উদ্দেশ্যে লড়ছেন, তা নিয়ে যেন ভাবার কোনো প্রয়োজনই নেই! অথচ বিজ্ঞানের ভিত্তিতে, গাছ থাকলে মানুষ থাকবে; গাছ না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে না। এই সহজ-সরল সত্যিটা গুরুত্বের সঙ্গে বোঝার সময় বোধহয় এবার হয়েছে। না হলে অদূর ভবিষ্যতে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে গোটা মানবজাতির সামনে।
গ্রিন হাউসে কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি পেয়ে
সমুদ্রগুলোরও তাপ শুষে নেওয়ায় উষ্ণ
পানি অক্সিজেন ধরে রাখতে পারছে না
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি খামার এবং শিল্প-কারখানা থেকে নাইট্রোজেন ও ফসফরাস সমুদ্রের পানিতে গিয়ে মেশার কারণেই পুষ্টিদূষণের ঘটনা ঘটছে। একই সঙ্গে সমুদ্রের পানিতে থাকা অক্সিজেনের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলছে বলে বিজ্ঞানীরা জানতেন। এতদিন ধারণা করা হতো, এটি শুধু উপকূলীয় এলাকার সমুদ্রেই প্রভাব ফেলছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই হুমকির মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রিন হাউসের কারণে যেহেতু কার্বন ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেহেতু সমুদ্রগুলোকে আরো তাপ শুষে নিতে হচ্ছে। ফলে উষ্ণ পানি কম অক্সিজেন ধরে রাখতে পারছে।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন অক্সিজেনের ভাণ্ডার বয়ে আনে না; বরং অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। ফলে অক্সিজেন দ্রবীভূত হওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। এতে সমুদ্রের তলদেশে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পায়। তা মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বিজ্ঞানীরা এবার যে দাবিটা করলেন, তা প্রত্যেকের জানা দরকার। কারণ ধীরে ধীরে পৃথিবীর অক্রিজেন ভাণ্ডার ফুরিয়ে আসছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, আর কতদিন এই গ্রহে মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে! পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের প্রায় ২১ শতাংশ অক্সিজেন দিয়ে গঠিত। অক্সিজেনের জন্যই এ পৃথিবীতে প্রাণীকুলের বাস।
যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথ ইউনিভার্সিটির এক্সট্রিম এনভায়রনমেন্ট ল্যাবরেটরির প্রধান মাইক টিপটন জানান, অক্সিজেন শূন্যতার অর্থ হচ্ছে বেঁচে থাকার একদম শেষ সীমা। মানুষের শরীরে অক্সিজেনের বড় কোনো ভাণ্ডার নেই। মাত্র কয়েক লিটার সংরক্ষিত থাকতে পারে; এর বেশি না। তবে তা মানুষ কীভাবে এই অক্সিজেন ব্যবহার করবে, তা সম্পূর্ণরূপে মানবদেহের বিপাকীয় হারের ওপর নির্ভর করে।
ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধ থেকে জানা গেছে, অক্সিজেন সমৃদ্ধ এই পৃথিবী আর সর্বোচ্চ এক বিলিয়ন বছর টিকে থাকবে। সূর্যের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এটি অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। ভবিষ্যতে আরো উজ্জ্বল হবে এবং পৃথিবী অধিক সৌরশক্তি লাভ করবে। এই বর্ধিত শক্তি পৃথিবীপৃষ্ঠকে প্রভাবিত এবং বেসাল্ট ও গ্রানাইটের মতো সিলিকেট শিলাগুলোর আবহাওয়াকে ত্বরান্বিত করবে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের অভাবে গাছ অক্সিজেন ও খাদ্য উৎপাদন করতে পারবে না। এতে ধীরে ধীরে মানুষসহ সব প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
জর্জিয়া টেক ও তোহো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। পৃথিবার জলবায়ু, সূর্যের তাপ, বায়ুমণ্ডল, অক্সিজেন ইত্যাদি বিষয় ছিল ওই গবেষণায়। বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, পৃথিবীতে অক্সিজেনের আয়ু একশ কোটি বছরের একটু বেশি। এরপর এই গ্রহে আর অক্সিজেন থাকবে না। ফলে প্রাণের অস্তিত্বও থাকবে না। এছাড়া জানা গেছে, আর ৫০০ কোটি বছর পর পৃথিবী ধ্বংস হবে। তবে বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফল ওই দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবীতে অক্সিজেনের আয়ু শেষের পেছনে দায়ী থাকবে ‘সূর্য’। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সূর্য আরো প্রখর হবে। ফলে পৃথিবীর বায়ু আরো গরম হবে। সূর্যের কারণেই এ পৃথিবীতে আর গাছপালা বেঁচে থাকতে পারবে না। আর গাছপালা না থাকায় আজ থেকে প্রায় ১১০ কোটি বছর পর পৃথিবীতে অক্সিজেনের মাত্রা নেমে আসবে ১ শতাংশেরও নিচে।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) হিসাবে সমুদ্র পৃথিবীর প্রায় ২৫ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে। এ কারণেই সারা দুনিয়ায় সমুদ্র বাঁচানোর এত তোড়জোড়!
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকডর্সের তথ্য অনুসারে ২০২১ সালের মার্চে ক্রোয়েশীয় নাগরিক বুদিমির সোবাত তৎকালীন বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে ২৪ মিনিট ৩৭ দশমকি ৩৬ সেকেন্ড ধরে অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে থাকার রেকর্ড গড়েছেন। তবে এটি ছিল পানির নিচে। পানিতে মানুষ তুলনামূলক বেশিক্ষণ দম আটকে থাকতে পারে। কিন্তু টানা এক ঘণ্টার জন্য যদি অক্সিজেন শূন্যতা দেখা দেয়; তাহলে কোনো মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. গাউসিয়া ওয়াহিদুন্নেসা চৌধুরী বলেন, গত ৫০ বছরে অক্সিজেন কমে যাওয়ার হার যে শুধু চারগুণ হয়ে গেছে, তা নয়; এমনকি যেসব জায়গায় কার্বন নিঃসরণ কম হয়েছে, সেখানেও মহাসাগর থেকে অক্সিজেন কমে যাচ্ছে। গ্রীষ্মপ্রধান এলাকাগুলোয় এই হার হবে অনেক বেশি। বেশির ভাগ ক্ষতি হবে সমুদ্রের প্রথম এক হাজার মিটারের মধ্যে; যেখানে সবচেয়ে বেশি জৈববৈচিত্র্য রয়েছে। কম মাত্রার অক্সিজেনের ফলে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যচক্রের মতো মৌলিক ক্ষেত্রেও হুমকি তৈরি হবে। আমরা যদি সাগর থেকে অক্সিজেন হারিয়ে ফেলি, তাহলে সেখানে প্রাণীর আবাসস্থল ও জৈববৈচিত্র্য নষ্ট হবে। এ জন্য আরো জেলিফিশের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হবে। এটি একই সঙ্গে মহাসাগরের শক্তি ও জৈব রাসায়নিক চক্র পাল্টে দেবে। ফলে আমরা এখনো জানি না, এসব জৈববৈচিত্র্য ও রাসায়নিক পরিবর্তন মহাসাগরের ভেতরে কী ঘটাবে।
ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং সংস্থার (বিবিসি) তথ্য সূত্রে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ গড়ে প্রতি মিনিটে এক লিটারের এক-চতুর্থাংশ বা এক-পঞ্চমাংশ অক্সিজেন গ্রহণ করে। তবে কঠোর ব্যায়ামের সময় প্রতি মিনিটে এই অক্সিজেন গ্রহণের মাত্রা চার লিটার পর্যন্ত হতে পারে। অনেকে আছেন ব্যতিক্রম। তারা স্বাভাবিক মাত্রাকে অতিক্রম করে দীর্ঘ সময় ধরে তাদের শ্বাস ধরে রাখতে পারেন অর্থাৎ অক্সিজেন ছাড়া বেঁচে থাকতে পারেন।
পৃথিবীতে অক্সিজেন কী চিরন্তন: পৃথিবী অমর নয়, এর একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমা রয়েছে। পৃথিবীর সব শক্তির উৎস সূর্য। ধীরে ধীরে সূর্য হাইড্রোজেনশূন্য হয়ে যাবে, বন্ধ হয়ে যাবে এর পারমাণবিক ক্রিয়া। ক্রমেই এ দানবীয় গ্রহটি একটা লাল দানবে পরিণত হবে। অবশ্য এর অনেক আগেই পৃথিবী থেকে অক্সিজেন নির্মূল ও এর প্রভাবে প্রাণের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ