ড. মো. রফিকুল ইসলাম : জলবায়ু পরিবর্তন (ঈষরসধঃব ঈযধহমব) নিয়ে বিশ্বের সব দেশের সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ একমত হয়েছে যে, গভীরভাবে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে। গরমের সময় প্রচণ্ড গরম আর শীতকালে হাড় কাঁপানো শীত পড়লে সবাই বলা শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফল।
তাইতো, একাডেমিক আলোচনায় জলবায়ু পরিবর্তন একটি অন্যতম আলোচ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সাধারণ কথায় জলবায়ু পরিবর্তন বলতে জলের আর বায়ুর পরিবর্তন বোঝানো হয়। অর্থাৎ, স্বাভাবিকের তুলনায় জলের হেরফের হলে বন্যা হয়, প্লাবিত হয় জনবসতিসহ সবকিছু। একে জলবায়ু পরিবর্তনের ফল বলে থাকি।
অন্যদিকে, বায়ুর পরিবর্তন হলো গরমের সময় অধিক গরম ও শীতকালে অধিক শীত, যা বায়ু পরিবর্তনের ফলে হয়ে থাকে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে এটা আমরা বলে থাকি।
জলবায়ু পরিবর্তন মানবকুলের ওপর যে বহুমাত্রিক প্রভাব তৈরি করে তার অন্যতম হলো অভিবাসন (সরমৎধঃরড়হ), অর্থাৎ মানুষের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তর ও সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বসবাস করাকে বোঝায়। পৃথিবীর শুরু থাকে এমনটি ঘটছে বলে অভিবাসন গবেষকরা বলে থাকে।
মানুষ সাধারণত জীবন বাঁচাতে বা ভালোভাবে বাঁচার জন্য নিজভূমি ত্যাগ করে অন্য জায়গায় বসবাস করে। বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে যখন মানুষ নিজভূমি ত্যাগ করে অন্য কোনো জায়গায় স্থানান্তরিত হয় তাকে জলবায়ুজনিত অভিবাসন বলা হয়। কিন্তু, জলবায়ু অভিবাসন নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও বিতর্কও রয়েছে। কেউ কেউ বলছে, এটা স্বাভাবিক অভিবাসন। অন্যরা বলছে, এটা জলবায়ুজনিত বিতাড়ন ও অভিবাসন।
জলবায়ুজনিত কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। ভৌগোলিক অবস্থান ও গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রভাব দেশটিকে বিভিন্ন প্রকারের জলবায়ুজনিত ইভেন্টের (পষরসধঃরপ বাবহঃং) মুখোমুখি করে। ফলে বাস্তুচ্যুত হয় বাড়তে থাকে। নিজভূমিতে কেউ কেউ মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, কেউ কেউ একটু দূরে শহরে অবস্থান নেয় যাতে প্রতিকূলতা কেটে গেলে নিজভূমিতে ফিরতে পারে। কিন্তু, অনেকসময় তাদের আর নিজস্থানে ফিরে যাওয়া হয়ে ওঠে না, তারা হয়ে যায় স্থানীয় অভিবাসী।
কোনো কোনো সমালোচক পরিবেশ এবং সমাজের এইসব পরিবর্তনকে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে যুক্ত করার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার সাথে একমত নয়। তারা মনে করেন, অভিবাসনের সাথে জলবায়ু পরিবর্তন মিলিয়ে অনেকে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেইক্ষেত্রে তাদের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো উন্নত বিশ্ব ও দাতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও ফান্ড আদায় করা।
তাদের দাবি, এইসব গবেষকরা জলবায়ু নিয়ে ব্যবসা করে নিজেরা লাভবান হয়। কিন্তু, ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী খুব কমই সাহায্যের আওতায় আসে। ছিটেফোঁটা সাহায্য পেলেও তা সহনীয় (ংঁংঃধরহধনষব) নয়। কাজেই যাদের নিয়ে ব্যবসা করা হয় বলে অভিযোগ, তারা নিতান্তই উপেক্ষিত থাকে।
আবার জলবায়ু পরিবর্তনকে পুঁজি করে দেশের ধনী ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ এক ধরনের ব্যবসা করে বলে গবেষণায় দেখা যায়। যেমন, নদী ভাঙন বাংলাদেশের একটি প্রচলিত প্রত্যয়। নদী ভাঙনের ফলে ঘরবাড়ি ত্যাগ করে জল-পার্শ্বযুক্ত রাস্তা ও বাঁধের উপরে বসবাস শুরু করে। এই স্থানচ্যুতিটি প্রজন্ম ধরে চলে আসছে বলে অনেকে মনে করেন।
তারা আরও মনে করেন, এই ধরনের ক্ষয় ক্রমবর্ধমানভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট হিসেবে দেখা হচ্ছে যা অনেকটা রাজনৈতিক ও স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত। বাস্তুচ্যুত মানুষগুলোকে অভিবাসী বলে পশ্চিমা মিডিয়া এবং দাতা দেশের মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়। এদের ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’, বা ‘নদী দ্বারা গিলে ফেলা’ মানুষ হিসেবে চিত্রিত হয়। কিন্তু, নদী তীর ক্ষয়ের মতো একটি স্বল্পমেয়াদি পরিবেশগত ধাক্কা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে নয় বা নদী তীর-বাস্তুচ্যুত মানুষ অপরিহার্যভাবে জলবায়ু অভিবাসী নয়।
তারা মনে করেন, এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যার অংশ, যেখানে ভাঙন রোধ করে এই জনগোষ্ঠীদের বাস্তুহারা থেকে রেহাই করতে ব্যর্থ হয় রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সামগ্রিক ব্যর্থতা লুকাতে জনগোষ্ঠীকে জলবায়ুজনিত অভিবাসী বলা হয়।
উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হয়ে যাওয়া ও বসবাসের জমিতে লবণাক্ত পানি প্রবেশ করার কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়ে। ধীরে ধীরে তারা নিজভূমি ত্যাগ করে বাস্তুচ্যুত হয়, চলে আসে শহরে জীবিকার সন্ধানে, স্থায়ীভাবে জলবায়ু অভিবাসন হিসেবে বসবাস করে শহরে।
তাত্ত্বিক আলোচনায় এদের জলবায়ু অভিবাসন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। কিন্তু, রাষ্ট্রীয় বিধানের অভাবে এই রকম সমস্যা জটিল হয়, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের আলোচনাগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। অনেকে মনে করেন, এই আলোচনায় বাঘা চিংড়ি উৎপাদনকারী লুটেরা শ্রেণিরা আড়ালে চলে যায়।
বাঘা-চিংড়ি উৎপাদনকারী এলাকা থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষগুলো পরিবেশগত পরিবর্তনে যতটা আক্রান্ত, তার থেকে বেশি সমাজের রাজনৈতিক এলিটদের কূটচালে নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়। কিন্তু, সামগ্রিক আলোচনায় এদের জলবায়ু অভিবাসন বলে প্রচার করা হয়।
বছরের পর বছর লবণাক্ত পানির প্রকোপে দূর দূরান্তে চলে যায় তারা। পক্ষান্তরে, সেইখানে দেদারসে চিংড়ি চাষ হতে থাকে, লুটেরা শ্রেণি তাদের স্বার্থের কারণে এই প্রক্রিয়া চলমান রাখে।
জলবায়ু অভিবাসন নিয়ে এই বিতর্ক সত্যিকারে যারা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে তাদের অবস্থান দুর্বল করে তুলছে। এইসব বাস্তুচ্যুত মানুষ যে ধরনের সুরক্ষার আওতায় আসার দরকার ছিল তারা আসতে পারে না। অন্যদিকে, দাতা দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসন নিয়ে দ্বিধায় থাকে। ফলে মাইগ্রেশনের জলবায়ু হ্রাসকারী অনুবাদগুলো উপকূলীয় বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক এবং পরিবেশগত প্রক্রিয়াগুলো এমনভাবে ভুলভাবে উপস্থাপনে করা সমীচীন নয়।
পরিশেষে বলবো, অভিবাসনের আলোচনা প্রতিষ্ঠিত হলেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত মাইগ্রেশন নিয়ে এখনো বিস্তর আলোচনা দরকার, কারণ এর সাথে জড়িত কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা। পাঠ্যক্রম ও পলিসি আলোচনায় বিষয়টি বিতর্কের ঊর্ধ্বে তুলে মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখতে একমত হতে হবে জলবায়ুজনিত অভিবাসন নিয়ে।
বিশেষ করে, বাংলাদেশের মতো অতিমারি ও অতি জলবায়ুজনিত প্রকোপের ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষদের যেন মানবাধিকার সুরক্ষিত হয় সেই বিষয়ে সবাইকে একমত হতে হবে, পরিহার করতে হবে বিতর্ক। উন্নত দেশগুলো যারা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী তাদের এইসব বাস্তুচ্যুত মানুষদের দায়ভার নিতে হবে, তার আইনগত বন্দোবস্ত অবশ্যই করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন একাডেমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সমন্বয়।
লেখক: অধ্যাপক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়