নারী ও শিশু ডেস্ক: লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ জলবায়ুুজনিত বিপর্যয় স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ নানা সংকটে কয়রা উপজেলার কিশোরী ও নারীরা। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা কয়রা উপজেলা ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ জলবায়ুুজনিত বিপর্যয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। পরিবেশগত এসব চ্যালেঞ্জ নারী ও কিশোরীদের ওপর অসমভাবে প্রভাব ফেলছে, যার কারণে বিদ্যমান সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য আরো গভীর ও কিশোরী-নারীরা স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ বিভিন্ন সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে।
এদিকে উপকূলীয় কয়রা উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর যাওয়ার রাস্তা পর্যাপ্ত নয় ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গর্ভবর্তী নারী, বয়স্ক মানুষ ও শিশু-কিশোরীরা। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারীদের ঘর ও পরিবারের কাজ বেড়ে যায়। অনেক সময় তারা মানসিক ও শারীরিক সহিংসতার শিকার হন। সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এ তথ্য ওঠে এসেছে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান অ্যান্ড রুরাল ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান কর্তৃক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কয়রা উপজেলার সুন্দরবনের কোলঘেঁষা কয়রা সদর ইউনিয়ন, উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের ৬১ শতাংশ মানুষ বলেছেন, এ তিন ইউনিয়নের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার রাস্তা পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া ৪৯ শতাংশ মানুষ বলেছে, স্যানিটেশন ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন গর্ভবতী নারী, বয়স্ক মানুষ ও শিশু-কিশোরীরা। এ ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগে নারীদের ঘর ও পরিবারের কাজ বেড়ে যায়। অনেক সময় তারা মানসিক ও শারীরিক সহিংসতার শিকার হন।
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে নারী ও কিশোরীদের দুর্যোগজনিত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা দীর্ঘ মেয়াদে সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করে। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে সম্পদের ঘাটতি ও সামাজিক জটিলতা নারী ও কিশোরীদের আরো বিপন্ন করে তোলে। এ ছাড়াও দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে পুরুষদের কর্মসংস্থানের জন্য অন্যত্র চলে যাওয়া নারীপ্রধান পরিবারগুলোর ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে; যেমন-সহায়তা পাওয়ার সীমাবদ্ধতা এবং দায়িত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। যার ফলে দারিদ্র্য বেড়ে যায়; নারীদের সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষমতা আরো কোণঠাসা হয়, যা তাদের ক্ষমতায়ন ও সহনশীলতা গঠনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছানোর রাস্তাগুলো এখনো অনেক কষ্টসাধ্য।
কয়রা সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা ও কমিউনিটি প্রতিনিধি তাজনীন নাহার বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ও পরবর্তী পরিস্থিতি নারীদের প্রতি সহিংসতার প্রবণতা বেড়ে যায়। এ ছাড়া শিক্ষাপ্রাপ্তির সুযোগ কমায় ও দুর্যোগের সময় মানবিক সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, ঘূর্ণিঝড়ের সময় ও পরবর্তী দিনগুলোতে গর্ভবতী ও অসুস্থ নারীদের চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
কমিউনিটি প্রতিনিধি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় কয়রা উপজেলার নারী ও কিশোরীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো মালটিপারপাস করাসহ সেখানে নারীদের জন্য আলাদা স্যানিটেশন ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করা, প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রের যাওয়ার রাস্তা নারী ও শিশুদের জন্য সহজে পৌঁছানোর উপযোগী করা এবং ইউনিয়ন থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ে নারীদের নেতৃত্বে দল গঠন করে তাদের মতামত ও নেতৃত্বকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্তকরণ, নারীদের জন্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তৈরি, পানির সংকট ও স্যানিটেশন সমস্যা সমাধানে সুপেয় পানির উৎস স্থাপন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও বন্যা সহনশীল টয়লেট গড়ে তোলা, ঘূর্ণিঝড়ের সময় গর্ভবতী ও অসুস্থ নারীদের চিকিৎসা পেতে অনেক কষ্ট হয়, যার জন্য স্পিডবোট অ্যাম্বুলেন্স, মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা ও প্রশিক্ষিত নারী স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা, ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে ‘ইমার্জেন্সি মেডিকেল ফান্ড’ গঠন, মেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণে নষ্ট রাস্তা, ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াত, আর্থিক সমস্যার সমাধান ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় রিমোট এলাকায় অস্থায়ী শিক্ষাকেন্দ্র, যাতায়াত উন্নয়ন ও স্কুলে ফেরার জন্য ভাউচার চালু করা, ইউনিয়ন পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিতে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নিশ্চিতকরণ এবং নারীদের নেতৃত্বে আশ্রয়কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন ও নারীদের নেতৃত্বে স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন করার দাবি জানান। তিনি বলেন, ঐ দাবিসমূহ পূরণ করা হলে উপকূলের নারীরা ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দাঁড়াতে পারবে।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ