বিদেশের খবর ডেস্ক: প্রথম সন্তানকে স্বাগত জানানোর সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন নেহা সতপুতে এবং অক্ষয় পিসে। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার এই ভারতীয় দম্পতি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এইচ-১ বি ভিসাতে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। দক্ষ বিদেশি কর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করার জন্য এই এইচ-১ বি ভিসা। ২৬ ফেব্রুয়ারি তাদের আসন্ন পুত্রসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার কথা। তাদের আশা ছিল মার্কিন নাগরিক হিসেবে জন্মগ্রহণ করবেন তাদের প্রথম সন্তান।
একটা বড় প্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করেন এই দম্পতি। নতুন অভিভাবকদের জন্য ছুটির নীতি রয়েছে ওই প্রযুক্তি সংস্থায়। এসব কিছু মাথায় রেখেই ধীরে ধীরে ক্যালিফোর্নিয়ার সান জোসেতে নিজেদের জীবন গড়ে তুলেছিলেন তারা। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক নির্বাহী আদেশ তাদের স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত অস্থায়ী বিদেশি কর্মীদের (যুক্তরাষ্ট্রে) জন্মানো সন্তানদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে মার্কিন নাগরিকত্ব না দেওয়ার বিষয়ে তিনি আইন করতে চান। এতদিন মা-বাবার অভিবাসন স্ট্যাটাস যাই থাকুক না কেন, তাদের সন্তানদের জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিকত্ব দেওয়া হতো।
জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্প যে পরিবর্তন আনতে চান, সেই সংক্রান্ত মামলায় প্রাথমিকভাবে দুই সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দিয়েছিল সিয়াটল আদালত। সেই মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়ে ট্রাম্পের প্রচেষ্টাকে আপাতত আটকে দিয়েছেন মেরিল্যান্ডের একজন ফেডারেল বিচারক। এর অর্থ হলো, আদালতে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওই বিধি কার্যকর করা যাবে না। যদিও উচ্চতর আদালত যে কোনো সিদ্ধান্তকে বদলে দিতে পারে এবং এক্ষেত্রেও সেই সম্ভাবনা রয়ে যাচ্ছে। এই বিষয় সংক্রান্ত একাধিক মামলা এবং আইনি চ্যালেঞ্জ, অক্ষয় পিসা এবং তার স্ত্রী নেহার মতো হাজার হাজার মানুষকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
এই প্রসঙ্গে পিসা বলেন, এর সরাসরি প্রভাব আমাদের ওপর পড়েছে। যদি এই বিধি কার্যকর হয়, তাহলে আমরা জানি না এর পরে কী হবে – এটা সম্পূর্ণ ধোঁয়াশা একটা ব্যাপার।
যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অভিবাসী যারা খুব শিগগিরই অভিভাবক হতে চলেছেন, তাদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, নতুন বিধি চালু হলে তাদের সন্তানের জাতীয়তা কী হবে? নিউইয়র্কভিত্তিক ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নি সাইরাস মেহতা জানিয়েছেন, উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মেহতা বলেছেন, মার্কিন আইনে এই দেশে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিকে অ-অভিবাসী (নন-ইমিগ্রেন্ট) মর্যাদা দেওয়ার কোনো রকম বিধান নেই।
এদিকে সন্তান জন্মের নির্ধারিত তারিখ যতই এগিয়ে আসছে, ততই উদ্বেগ বাড়ছে হবু মা-বাবাদের। আসন্ন সন্তানকে নির্ধারিত সময়ের আগেই সি-সেকশনের মাধ্যমে প্রসবের বিষয়ে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শও করেছেন নেহা এবং অক্ষয় পিসার মতো অনেকেই। চিকিৎসকদের মতে, যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে গর্ভবতীরা ৪০তম সপ্তাহে সন্তান জন্ম দিতে পারেন।
এই অবস্থায় নির্ধারিত সময়ের জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নেহা সতপুতে ও তার স্বামী। হবু মা নেহা সতপুতে বলেছেন, আমি চাই প্রাকৃতিক নিয়মেই সবকিছু চলুক।
অন্যদিকে অক্ষয় পিসে জানিয়েছেন, তার অগ্রাধিকার হলো তার সন্তান এবং স্ত্রীর স্বাস্থ্য। তার কথায়, সন্তানের নির্বিঘ্নে জন্মগ্রহণ করা এবং স্ত্রীর স্বাস্থ্যই আমার কাছে অগ্রাধিকার। তার পরে আসবে সন্তানের নাগরিকত্বের বিষয়টা।
আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ফিজিশিয়ানস অব ইন্ডিয়ান অরিজিন (এএপিআই) সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন ডা. সতীশ কাঠুলা। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয় পরিবারগুলো নির্ধারিত সময়ের আগেই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাদের সন্তানের জন্মের কথা ভাবছেন- এরকম প্রতিবেদন সংবাদমাধ্যমে দেখার পর ডা. কাঠুলা আমেরিকায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রসূতি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘নিউ জার্সিতে এমন কয়েকটা ঘটনা’ ছাড়া বেশির ভাগ চিকিৎসকই এ জাতীয় কোনো বিষয়ের কথা তাকে জানাননি।
ওহাইওভিত্তিক ডা. সতীশ কাঠুলা বলেছেন, এমন এক দেশে যেখানে কঠোর চিকিৎসা আইন রয়েছে, সেখানে শুধু নাগরিকত্বের জন্য নির্ধারিত সময়ের আগে সি-সেকশন করার বিরুদ্ধে আমি দৃঢ় পরামর্শ দিই। আমাদের চিকিৎসকরা নীতিবান। চিকিৎসাগতভাবে প্রয়োজন না হলে, তারা কোনোভাবেই তা (সন্তান প্রসবের জন্য অস্ত্রোপচার) করবেন না।
মার্কিন নাগরিকত্ব ‘অত্যন্ত লোভনীয়’, বিশেষত দক্ষ এইচ-১এস বি ভিসাধারী ব্যক্তিদের কাছে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী দ্বিতীয় বৃহত্তম অভিবাসী গোষ্ঠী হলো ভারতীয়রা।
অভিবাসন নীতি বিশ্লেষক স্নেহা পুরী এই বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, জন্মগত নাগরিকত্বের বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ ভারতীয়দের জন্য বেশ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রে ৫০ লাখেরও বেশি ভারতীয়ের নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসাতে (অ-অভিবাসী ভিসায়) রয়েছেন। তিনি বলেন, এটা কার্যকর হলে, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মানো তাদের কোনো সন্তানই নাগরিকত্ব পাবে না।
অনলাইন গ্রুপগুলোয় দক্ষিণ এশিয়ার হবু মা-বাবারা এই নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা ক্রমাগত জানিয়ে চলেছেন। আইন কার্যকর হলে তার প্রভাব এবং এক্ষেত্রে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে, সেটি নিয়েও অনলাইনে আলোচনাও করে চলেছেন তারা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছে, এটা বৈধ ও স্থায়ী বাসিন্দাদের সন্তানদের মার্কিন নাগরিকত্ব সংক্রান্ত ডকুমেন্টেশন পাওয়ার ক্ষমতাকে কোনোভাবে প্রভাবিত করবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য প্রয়োজনীয় গ্রিন কার্ড পাওয়া সহজ নয়। তার জন্য যে কোনো বিদেশি নাগরিকদের যতদিন অপেক্ষা করতে হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় ভারতীয়দের। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী কোনো একটা নির্দিষ্ট দেশের মানুষকে দেওয়া গ্রিন কার্ডের সংখ্যা মোট গ্রিন কার্ডের সংখ্যার সাত শতাংশের বেশি হতে পারবে না। প্রতি বছর, এইচ-১বি ভিসার ৭২ শতাংশ পেয়ে থাকেন ভারতীয়রা। কেটো ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে গ্রিন কার্ডের জন্য অপেক্ষায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ৬২ শতাংশই ভারতীয়।
বর্তমানে যারা কর্মসংস্থানভিত্তিক গ্রিন কার্ড পেয়েছেন, সেই ভারতীয়রা ২০১২ সালে এর জন্য আবেদন করেছিলেন।
কেটোর ইমিগ্রেশন স্টাডিজের পরিচালক ডেভিড বিয়ারওয়ার্ন তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, নতুন ভারতীয় আবেদনকারীদের আজীবন অপেক্ষা করতে হবে। গ্রিন কার্ড পাওয়ার আগেই চার লাখ আবেদনকারীর মৃত্যু হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে বেশিরভাগ অভিবাসী এক বছরের মধ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পান, যা তাদের নাগরিকত্ব লাভের পথকে ত্বরান্বিত করে দেয়। যদি ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ বাস্তবায়িত হয় তবে তা যুক্তরাষ্ট্রের নথিপত্রহীন অভিবাসীদেরও প্রভাবিত করবে। এই নথিহীন অভিবাসীদের সন্তানরা যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অর্জন করেছিলেন। তাদের ২১ বছর বয়স হলে, তারা তাদের অভিভাবকদের গ্রিন কার্ডের জন্য আবেদন করার জন্য স্পনসরও করতে পারতেন।
প্রসঙ্গত, পিউ রিসার্চ এর তথ্য বিশ্লেষণ বলছে, ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ৭ লাখ ২৫ হাজার কাগজপত্র ছাড়া ভারতীয় অভিবাসী রয়েছে; যা তাদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা নথিপত্রহীন অভিবাসী গোষ্ঠীর তালিকায় তৃতীয় বৃহত্তম গোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। অন্যদিকে মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের হিসাব আবার ভিন্ন।
এই প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণ বলছে, এই সংখ্যা ৩ লাখ ৭৫ হাজার এবং কাগজ ছাড়া অভিবাসী গোষ্ঠীর তালিকায় ভারতের স্থান পঞ্চম। মার্কিন জনসংখ্যার তিন শতাংশ নথিপত্রহীন অভিবাসী মানুষ। তারাই ভিন্ন দেশে জন্মগ্রহণ করে যারা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন এমন জনসংখ্যার ২২ শতাংশ।
এইচ-১বি বা ‘ও’ ভিসায় থাকা ভারতীয়দের প্রধান উদ্বেগের বিষয় তাদের সন্তানদের জীবনযাত্রার মান। বিদেশে মার্কিন দূতাবাসে ভিসা স্ট্যাম্প লাগানোর জন্য পর্যায়ক্রমে যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করতে হয় এই ক্যাটাগরির ভিসায় থাকা ব্যক্তিদের। ভিসা স্ট্যাম্পের উদ্দেশ্যে যাদের নির্দিষ্ট সময়ে ভারতে আসতে হয়, তাদের প্রায়শই অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে দেরি হয়।
যারা এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন, সেই অভিবাসীরা চান না যে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জন্মানো তাদের সন্তানদেরও একই আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতির সম্মুখীন হতে হোক। বেশ কয়েক বছর ধরে গ্রিন কার্ডের আবেদনকারী হিসাবে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে অক্ষয় পিসেকে। তিনি জানেন মার্কিন নাগরিকত্ব জীবনকে কতটা সহজ করে দিতে পারে। তিনি বলেছেন, আমরা এখানে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আছি। আমার বাবা-মায়ের বয়স বাড়ছে। তাই আমার নাগরিকত্ব থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিসা স্ট্যাম্পিংয়ের জন্য সমস্ত কিছু সামলে যাতায়াত করা আমাদের জন্য কঠিন। এবার আমাদের সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে বিষয়টা আরও কঠিন হয়ে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের অনেক চিকিৎসক ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে জানিয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে দক্ষ বিদেশি কর্মীরা কী ভূমিকা পালন করেন।
ডা. কাঠুলা বলেছেন, উত্তর ও দক্ষিণ ডাকোটার মতো গ্রামীণ অঞ্চলে ভারতীয় চিকিৎসকরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা না থাকলে স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়বে। এখন তারাই নিজেদের সংসার শুরু করার ব্যাপারে দ্বিধায় ভুগছেন। গ্রিন কার্ড পাওয়ার প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। এইচ-১ বি ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরতদের সন্তানদের তাদের অভিভাবকদের অবদানের কারণে জন্মগত নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য আর্জি জানিয়েছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে ওয়ার্ক ভিসা এবং স্টুডেন্ট ভিসায় আসা ভারতীয়দের মধ্যে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। তারা অবশ্য ইতোমধ্যেই তাদের আইনি অনিশ্চয়তা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তাদের কাছে একটাই ‘গ্যারান্টি’ ছিল- যুক্তরাষ্ট্রে জন্মানো তাদের সন্তানদের নাগরিকত্ব। কিন্তু সেই বিষয়েও এখন সংশয় দেখা দিয়েছে।
ওই নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন সান জোসের বাসিন্দা প্রিয়দর্শিনী জাজুও। আগামী এপ্রিল মাসে মা হতে চলেছেন তিনি। তার কথায়- পাসপোর্টের জন্য
আমাদের কি ইন্ডিয়ান কনস্যুলেটে যোগাযোগ করতে হবে? কোন ভিসা কার্যকর হবে? এই নিয়ে অনলাইনে কোনো তথ্য নেই।
সন্তানের আগমনের দিন গুনতে গুনতে নেহা সতপুতে বলেন, এই অনিশ্চয়তা বাড়তি দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। গর্ভাবস্থা এমনিতেই যথেষ্ট স্ট্রেসের সময়। আমরা ভেবেছিলাম, এক দশক পর এখানে বিষয়টা সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে গিয়ে এটা ঘটল! তার স্বামী অক্ষয় পিসে বলেন, বৈধ অভিবাসী এবং করদাতা হিসেবে আমাদের সন্তানেরও মার্কিন নাগরিকত্ব প্রাপ্য- এটাই তো আইন, তাই না? বিবিসি বাংলা।