ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ
বাংলাদেশ এখন এমন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে; যেখানে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আর সময় অপচয়ের সুযোগ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির মাত্র ০.৭৪ শতাংশ বরাদ্দ রেখেছিল; যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। এটি স্পষ্ট করে যে, আমরা এখনো স্বাস্থ্যখাতকে যথার্থভাবে জাতীয় অগ্রাধিকারে আনতে পারিনি।
স্বাস্থ্য খাতে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও কার্যকর নীতির অভাব, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, দুর্বল শাসনব্যবস্থা এবং তীব্র অর্থসংকট—সব মিলিয়ে এ খাত আজ চরম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এই প্রেক্ষাপটে শুধু বাজেট বাড়ালেই যথেষ্ট হবে না; প্রয়োজন বাজেটের দক্ষ ও দায়বদ্ধ ব্যবস্থাপনা।
অর্থাৎ যেখান থেকে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের জন্য সবচেয়ে বেশি সুফল বয়ে আনবে, সেখানে অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে নিশ্চিতভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে । এই প্রেক্ষাপটে ‘জনবান্ধব স্বাস্থ্য বাজেট’ ধারণাটি এখন জাতীয় আলোচনায় আসা জরুরি।
জনবান্ধব স্বাস্থ্য বাজেট মানে শুধু টাকা বাড়ানো নয়; বরং এই বাজেট এমনভাবে বিন্যস্ত হওয়া উচিত যাতে এটি জনগণের উপকারে আসে; বিশেষ করে দরিদ্র, প্রান্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর।
এর অর্থ হচ্ছে- স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির অনুপাতে সরকারি ব্যয় বাড়ানো, অঞ্চলভিত্তিক বাজেট বরাদ্দে সাম্যতা আনা, জনস্বাস্থ্য অবকাঠামো শক্তিশালী করা, প্রতিরোধমূলক ও প্রোমোটিভ সেবায় জোর দেওয়া এবং সর্বোপরি, জনগণের পকেট থেকে অতিরিক্ত ব্যয় কমানো।
বাজেট কম, ব্যয় তারও কম: স্বাস্থ্য বাজেটের সংকট শুধু কম অর্থ বরাদ্দে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এই সীমিত বাজেটও আমরা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারি না। ১০ বছরের প্রস্তাবিত, সংশোধিত এবং বাস্তবায়িত বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিবারই প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় সংশোধিত বাজেট ২০-৩০ শতাংশ কম।
আবার বরাদ্দের তুলনায় ব্যয় ২৫-৩০ শতাংশ কম হয়। অর্থাৎ স্বাস্থ্যখাতে প্রস্তাবিত বাজেটের ৫০-৬০ শতাংশের বেশি খরচ করা সম্ভব হয় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আরও কম ব্যয় করেছে। আবার যতটুকু খরচ হয় তাও কার্যকরীভাবে ব্যয় করা যায় না।
এর পেছনে রয়েছে নানান কাঠামোগত বাধা। যেমন- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাইরে অর্থ মন্ত্রণালয়, জন প্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা কমিশনের কাছে স্বাস্থ্যখাত বিশেষ অগ্রাধিকার পায় না। আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভেতরে রয়েছে দক্ষতার অভাব, বিভক্তি ও সিদ্ধান্তহীনতা; যেখানে সচিবালয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের ব্যবস্থাপকদের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে বিরাট ফারাক বিদ্যমান।
মাঠ প্রশাসন এবং হাসপাতাল প্রশাসনের সঠিক প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা না থাকায় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদি দক্ষতার সাথে প্রকিউরমেন্ট কার্যক্রম যথাযথ সময় করতে না পারা ‘পরিচালন বাজেট’-এর অর্থ পুরোপুরি খরচ না হওয়ার একটি অন্যতম কারণ।
পাবলিক প্রোকিউরমেন্ট আইন ও বিধিমালায় অস্পষ্টতা প্রোকিউরমেন্ট কার্যক্রম ও প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা আরও বাড়ায়। এর পাশাপাশি এসেন্সিয়াল ড্রাগস্ কোম্পানি (ইডিসিএল), সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরেজ ডিপো (সিএমএসডি), ন্যাশনাল ইলেকট্রো-মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার (নিমিউ অ্যান্ড টিসি), ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স অর্গানিজশন (টেমও), স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের সীমাবদ্ধতা ও গাফিলতিও দায়ী। আর একাউন্টস এবং অডিট অফিসের দৌরাত্ম্যের চিত্রও আমাদের অজানা নয়।
উন্নয়ন বাজেট পুরোপুরি এবং যথাযথভাবে খরচ না করতে পারার ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকের দক্ষতার অভাব, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদল, প্রকল্প পরিচালকের অফিসে উপযুক্ত জনবলের অভাব, সচিবালয় এবং বিভিন্ন দপ্তরের উপযুক্ত সহযোগিতার অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির ঘূর্ণি চক্রে সঠিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বাছাই করতে না পারা এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দুর্বলতাসহ বহুবিদ বিষয় জড়িত।
স্বাস্থ্য বাজেটের আরেক বড় সমস্যা হলো বাজেটের অপচয় ও দুর্নীতি। যদিও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই, তবুও বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় কেনাকাটায় দুর্নীতি, ভুয়া রোগীর রেকর্ড, ওষুধ সরবরাহ ও সংরক্ষণে বিশৃঙ্খলা ও তদারকির অভাব রয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, শাসনব্যবস্থা দুর্বল। অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকদের দক্ষতা ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভেতরে ও বাইরে (যেমন- স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, গণপূর্ত অধিদপ্তর) অসংখ্য কষ্ট সেন্টার থাকায় সমন্বয়ের অভাব তৈরি হয়।
সমাধানের পথ: স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানোর আগে কিছু পূর্বশর্ত পূরণ আবশ্যক। যেমন- বর্তমান বাজেট পুরোপুরি ও দক্ষভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, শূন্য পদ পূরণ ও নতুন পদ সৃষ্টি করতে হবে, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও রিএজেন্ট নিশ্চিত করতে হবে এবং ক্রমবর্ধমান প্রয়োজন মিটাতে নতুন কার্যক্রম হাতে নিতে হবে এবং তা সম্পন্ন করতে আলাদা বরাদ্দ রাখতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হলে বাজেট বাড়ানোর জন্য সরকার আরও বিশ্বাসযোগ্য অবস্থানে যেতে পারবে।
জনবান্ধব স্বাস্থ্য বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার।
প্রথমত, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে প্রতিরোধমূলক ও প্রোমোটিভ সেবায় জোর দিতে হবে। যেমন- বেসিক আউটডোর সেবা, টিকাদান, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি উন্নয়ন। এজন্য গ্রামীণ এলাকায় তিন ধারা (তথা কমিউনিটি ক্লিনিক, ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার সেন্টার এবং হেলথ-সাব সেন্টার) বিশিষ্ট স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এক ধারায় রূপান্তর করতে হবে এবং বিদ্যমান জনবল পূনর্বিন্যাসের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় নতুন জনবলের পদ সৃষ্টি ও নিয়োগ দিতে হবে।
আর শহর এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত এবং ইউনিসেফ কর্তৃক বাস্তবায়িত আলো ক্লিনিকের মডেলের ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর’ (এসওপি) অনুসরণ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে হবে। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সৃজনশীল পদ্ধতিতে স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম চালুকরণে ওয়েলবিং ক্লাব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, একটি ইউনিভার্সাল ফ্যামিলি হেলথ কার্ড চালু করতে হবে। এই কার্ডের আওতায় সরকারি অর্থায়নে রেফারেড ওপিডি এবং সেকেন্ডারি সেবার জন্য ‘এক্সপ্লিসিট বেনিফিট প্যাকেজ’ চালু করতে হবে- যেখানে জনগণ জানতে পারবে, একেকটি পরিবার বছরে কী কী সেবা এবং মোট কত টাকা মূল্যের সেবা বিনামূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে পাবে।
তৃতীয়ত, একটি ‘ন্যাশনাল হেলথ অথরিটি (এনএইচএ)’ গঠন করতে হবে এবং এর অধীনে ‘ন্যাশনাল হেলথ ফান্ড (এনএইচএফ)’ গঠন করতে হবে যা সরকারি অনুদানের পাশাপাশি বিভিন্ন উৎস থেকে টেবিল জোগাড় করতে পারবে। এই তহবিল মূলত, রেফারেড আইপিডি, ক্রিটিক্যাল ইলনেস, ইমার্জেন্সি কেয়ার এবং ইমার্জেন্সি রেসপন্স মোকাবিলায় খরচ করা হবে। এর মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো একটি সমন্বিত কাঠামোতে আনতে হবে।
এই সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য। তবে শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছা নয়, দরকার সচেতন ও জনগণের সক্রিয় চাপ, যারা সুশাসন ও স্বচ্ছতা দাবি করবে। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও একাডেমিয়ার সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
সামনে নতুন অর্থবছর আসছে। এর আগেই আমাদের জোরালোভাবে জনবান্ধব স্বাস্থ্য বাজেট দাবি করতে হবে। স্বাস্থ্যখাত কেবল একটি খাত নয়—এটি মানব উন্নয়নের মূলভিত্তি। একটি অসুস্থ জাতি কখনোই উৎপাদনশীল হতে পারে না। দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেবল একটি প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়—এটি একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা।
এখন সময় এসেছে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও দায়িত্বশীল বাজেট কাঠামোর মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতকে টেকসই ও ন্যায়ভিত্তিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার। জনবান্ধব স্বাস্থ্য বাজেট নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার, নীতিনির্ধারকের দূরদর্শিতা এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ- সব একসঙ্গে প্রয়োজন।
সময় এসেছে, আমরা সকলে মিলে বলি- জনবান্ধব স্বাস্থ্য বাজেট চাই, এখনই চাই।
লেখক: অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; আহ্বায়ক, অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি); আহ্বায়ক, নেটওয়ার্ক ফর হেলথ কেয়ার এক্সেলেন্স (এনএইচই)
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ