নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অন্তত ৩১ জন নিহত হয়েছেন। গত সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে চীনের তৈরি এফটি-৭ বিজিআই মডেলের এ যুদ্ধবিমানটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
দেশে গত এক দশকে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবার। এর কোনোটিতে পাইলট আহত বা নিহত হয়েছেন। কোনোটি বিধ্বস্ত হয়েছে জনবসতি থেকে দূরে। তবে এবারের মতো প্রাণঘাতী যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনার নজির সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেই। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গত এক দশকে একের পর এক প্রশিক্ষণ বিমান দুর্ঘটনার পরও মৌলিক পরিবর্তন আসেনি বিমানবাহিনীর বহরে কিংবা নীতিনির্ধারণে। যুক্ত হয়নি আধুনিক যুদ্ধবিমান। পুরনো প্রযুক্তির এয়ারক্রাফট দিয়েই চলছে বাহিনীর কার্যক্রম।
বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতির শহর ঢাকায় প্রশিক্ষণ বিমান পরিচালনা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগামাধ্যমে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি দায়ী কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি ওঠেছে। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তার ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘কেন জনবহুল এলাকায় যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ চালানো হয় তার জবাব দিতে হবে। এর জন্য দায়ী ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। নিহত ও আহতদের সঠিক পরিসংখ্যান দিতে হবে।’
জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন খোদ নৌ পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনও। তিনি বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে বিমান প্রশিক্ষণ কোথায় হবে, তা নতুন করে ভাবতে হবে। দুর্ঘটনা এড়াতে প্রশিক্ষণের বিষয়ে সংস্থা এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে আরো যাচাই-বাছাই করতে হবে।’
একটি সংবাদসংস্থা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবাহিনীর সাবেক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানায়, ‘বিমানবাহিনীর প্রাথমিক ও এর পরের ধাপের প্রশিক্ষণ হয় ঢাকার বাইরে। ঢাকায় কোনো কর্মকর্তা বদলি হয়ে এলে তাকে ঢাকায় থাকা বিমান দিয়ে আবার প্রশিক্ষণ নিতে হয়।’
বিমানবাহিনীর সাবেক আরেক কর্মকর্তার জানান, ঢাকায় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণগুলা সেভাবে হয় না। বাহিনীর প্রাথমিক প্রশিক্ষণটা হয় যশোরে। এরপর অ্যাডভান্সড ট্রেনিংটা হয় চট্টগ্রামে। কিন্তু ঢাকাতে যে বিমানগুলো আছে কোনো পাইলট এখানে (বদলিজনিত কারণে) এলে পরে তাকে এগুলোতে পাঠানো হয় এবং প্রশিক্ষণ দিতে হয়। যে কর্মকর্তা প্রাণ হারালেন অন্য বিমানে কিন্তু আগেই তার প্রশিক্ষণ হয়ে গেছে।
ঢাকায় বিমানবাহিনী রাখার বিষয়ে বাহিনীর আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন আবেগ কাজ করছে আমাদেরৃ। কিন্তু আমাদের দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য, শুধু আমাদের না, যে কোনো দেশের জন্যই বিমানবাহিনী রাখতেই হবে। কিছুটা প্রশিক্ষণ সব জায়গায় চলবে। কিন্তু নিরাপত্তার বিষয়টা নিশ্চিত করতে হবে প্রশিক্ষণের মান বাড়িয়ে আর আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করে।’
তিনি বলেন, ‘আমি যতোটুকু জানি, আমাদের বিমানবাহিনীতে নিরাপত্তার বিষয়ে কখনো আপস করা হয় না। বিমানগুলো পুরোনো হলেও এগুলোর নিরাপত্তার মান বজায় রাখা হয়।’
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য যুবদলের রক্তদান কর্মসূচিতে দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বিমানের প্রশিক্ষণ কেন হচ্ছে, বিমানের ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল কি না, কতদিন আগের বিমান, সেটাকে কেন অনুমতি দেওয়া হলো, সেসব প্রশ্ন মানুষের মনে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত টিম করে আসল সত্য খুঁজে বের করা। দুর্ঘটনা বলে-কয়ে আসে না এটা সত্য, কিন্তু কোনো পরিকল্পিত ঘটনাকে যেন দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া না হয়।’
এদিকে, অ্যাভিয়েশন সিস্টেম পরিবর্তন করে ঢাকাসহ দেশের সব জনবহুল এলাকায় বিমান উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ত্রুটিপূর্ণ বিমান উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা কেন দেওয়া হবে না, রুলে তা-ও জানতে চেয়েছেন আদালত। এছাড়াও আদালত দেশে বর্তমানে ত্রুটিপূর্ণ বিমানের সংখ্যা কত, কেন তা প্রকাশ করা হবে না এবং ত্রুটিপূর্ণ বিমান রক্ষণাবেক্ষণে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তা-ও জানতে চেয়েছেন।
এ সংক্রান্ত বিষয়ে দায়ের করা রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে মঙ্গলবার (২২ জুলাই) হাইকোর্টের বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি সৈয়দ জাহেদ মনসুরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। গত সোমবার বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান মাইলস্টোন কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এতে এখন পর্যন্ত ৩১ জন নিহত ও ১৬৫ জন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বলে জানিয়েছে আইএসপিআর।