ঢাকা ১০:৫৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫
জনআস্থা ধ্বংস করেছে গত তিন নির্বাচন: হাইকোর্ট

জনআস্থা ধ্বংস করেছে গত তিন নির্বাচন: হাইকোর্ট

  • আপডেট সময় : ১০:০৫:১৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ৪৯ বার পড়া হয়েছে

হাইকোর্টের ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক: অবাধ ও নিরপেক্ষতা ‘নিশ্চিত করতে না পারায়’ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিন জাতীয় নির্বাচনে ‘জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে’ বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে হাই কোর্ট।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিলের রায় ঘোষণা করেবিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর বেঞ্চ মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) এই পর্যবেক্ষণ দেয়।
রায়ে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংসদে পাস করা পঞ্চদশ সংশোধনীর পাঁচটি অনুচ্ছেদকে অবৈধ ঘোষণা করেছে আদালত, যার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে করা সংশোধনীও রয়েছে। রায়ে আদালত বলেছে, বিগত তিন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘জনগণের আস্থাকে ধ্বংস করেছে’।
২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। এরপর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়। এর মধ্যে দশম ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ না হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ বেশিরভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল। তাদের বর্জনের ফলে দশম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে যান। সেই সংসদকে ‘বিনা ভোটের সংসদ’ আখ্যা দেয় ভোট বর্জন করা বিএনপি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে শরিক ও বিরোধীদল জাতীয় পার্টির জন্য আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সঙ্গে দলের বিদ্রোহীদের। এ নির্বাচনের নাম হয় ‘আমি আর ডামি’ নির্বাচন।
বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠে। অধিকাংশ ভোট আগের রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগের মধ্যে বিরোধীরা মাত্র সাতটি আসনে জয় পায়। সে নির্বাচনের নাম হয় ‘নীশিরাতের নির্বাচন’। বিএনপিসহ বিরোধীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিরোধিতা করে এলেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাতে সাড়া দেয়নি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনাবসানের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ফেরানোর উদ্যোগ হিসাবে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট রিট আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট গত ১৯ আগস্ট রুল দেয়। পঞ্চদশ সংশোধনী কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। পরে বিএনপি, গণফোরাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি সংগঠন এবং কয়েকজন ব্যক্তি এ রিট মামলায় পক্ষভুক্ত হয়, তাদের পক্ষে আইনজীবীরা শুনানিতে অংশ নেন।
মঙ্গলবারের রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনী পুরোপুরি বাতিল ঘোষণা না করলেও পাঁচটি অনুচ্ছেদ অবৈধ ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট। যার মধ্যে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে ফেরানোর পথ খুলেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ‘গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে’ জুলাই-অগাস্টের গণআন্দোলন গড়ে ওঠার কথা বলেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
তিনি বলেন, নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা হারানোর প্রেক্ষাপটে হাজারো মানুষ প্রাণ দিয়েছে; হাজার হাজার মানুষ আজীবনের জন্য শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ‘অপরিহার্য’ বিবেচনা করে রায়ের পর্যবেক্ষণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত’ বলা হয়েছে। বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের এই পর্যবেক্ষণের বিষয়ে জামায়াতের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, গণতন্ত্র হল আমাদের সংবিধানে মৌলিক কাঠামো। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বলেছেন, সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে।
কেন? কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায় না। আর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায় না, গণতন্ত্র নিশ্চিত করা যায় না। এজন্য তিনি বলছেন, কেয়ারটেকার গভার্নমেন্ট সিস্টেম ইজ দ্য বেসিক স্ট্রাকচার অব দি কনস্টিটিউশন।
ওই সংশোধনীর মাধ্যমে আনা ‘অসাংবিধানিক পন্থায়’ সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ ‘রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত’ করার মত বিভিন্ন অপরাধকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ সাব্যস্ত করার ৭(ক) এবং সংবিধানের কিছু ধারাকে সংশোধনঅযোগ্য করার ৭(খ) অনুচ্ছেদকেও বাতিল করেছে আদালত।
পঞ্চদশ সংশোধনীর পর যুক্ত করা ৭(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়, এই সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ নিলে বা ষড়যন্ত্র করলে; কিংবা, এই সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ নিলে বা ষড়যন্ত্র করলে’, তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হবে।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের জন্য এই অনুচ্ছেদে যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোকে ‘ভেইক টার্ম’ (অস্পষ্ট পরিভাষা) হিসাবে বর্ণনা করে ফারাহ মাহবুব বলেন, এরূপ বিধান মানুষের বেঁচে থাকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নীতির পরিপন্থি।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। সেই সংশোধনীর অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায় এবং পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে ‘বৈপরীত্য’ (কনট্রাডিকশন) থাকার কথাও রায়ের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেন বিচারক। তিনি বলেন, সংক্ষিপ্ত রায়ে আরও দুইবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলা হলেও পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা ছিল না। রায় ঘোষণার পর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনকে সবকিছুর মূলে রেখেছে আমাদের সংবিধান। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোকে কেন্দ্রে রেখে আজকের রায় দিয়েছি।
আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রিভিউ আবেদনের বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক যাতে না হয়, সেদিকেও নজর দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

 

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনআস্থা ধ্বংস করেছে গত তিন নির্বাচন: হাইকোর্ট

জনআস্থা ধ্বংস করেছে গত তিন নির্বাচন: হাইকোর্ট

আপডেট সময় : ১০:০৫:১৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক: অবাধ ও নিরপেক্ষতা ‘নিশ্চিত করতে না পারায়’ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিন জাতীয় নির্বাচনে ‘জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে’ বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে হাই কোর্ট।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিলের রায় ঘোষণা করেবিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর বেঞ্চ মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) এই পর্যবেক্ষণ দেয়।
রায়ে ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সংসদে পাস করা পঞ্চদশ সংশোধনীর পাঁচটি অনুচ্ছেদকে অবৈধ ঘোষণা করেছে আদালত, যার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়ে করা সংশোধনীও রয়েছে। রায়ে আদালত বলেছে, বিগত তিন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘জনগণের আস্থাকে ধ্বংস করেছে’।
২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধান থেকে বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। এরপর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা হয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়। এর মধ্যে দশম ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের নির্দলীয় সরকারের দাবি পূরণ না হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপিসহ বেশিরভাগ বিরোধী রাজনৈতিক দল। তাদের বর্জনের ফলে দশম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হয়ে যান। সেই সংসদকে ‘বিনা ভোটের সংসদ’ আখ্যা দেয় ভোট বর্জন করা বিএনপি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক দেখাতে শরিক ও বিরোধীদল জাতীয় পার্টির জন্য আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সঙ্গে দলের বিদ্রোহীদের। এ নির্বাচনের নাম হয় ‘আমি আর ডামি’ নির্বাচন।
বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠে। অধিকাংশ ভোট আগের রাতে হয়ে যাওয়ার অভিযোগের মধ্যে বিরোধীরা মাত্র সাতটি আসনে জয় পায়। সে নির্বাচনের নাম হয় ‘নীশিরাতের নির্বাচন’। বিএনপিসহ বিরোধীরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিরোধিতা করে এলেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাতে সাড়া দেয়নি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনাবসানের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ফেরানোর উদ্যোগ হিসাবে পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট রিট আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট গত ১৯ আগস্ট রুল দেয়। পঞ্চদশ সংশোধনী কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয় রুলে। পরে বিএনপি, গণফোরাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি সংগঠন এবং কয়েকজন ব্যক্তি এ রিট মামলায় পক্ষভুক্ত হয়, তাদের পক্ষে আইনজীবীরা শুনানিতে অংশ নেন।
মঙ্গলবারের রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনী পুরোপুরি বাতিল ঘোষণা না করলেও পাঁচটি অনুচ্ছেদ অবৈধ ঘোষণা করেছে হাই কোর্ট। যার মধ্যে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে ফেরানোর পথ খুলেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ‘গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে’ জুলাই-অগাস্টের গণআন্দোলন গড়ে ওঠার কথা বলেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
তিনি বলেন, নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা হারানোর প্রেক্ষাপটে হাজারো মানুষ প্রাণ দিয়েছে; হাজার হাজার মানুষ আজীবনের জন্য শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য ‘অপরিহার্য’ বিবেচনা করে রায়ের পর্যবেক্ষণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে সংবিধানের ‘মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত’ বলা হয়েছে। বিচারপতি ফারাহ মাহবুবের এই পর্যবেক্ষণের বিষয়ে জামায়াতের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, গণতন্ত্র হল আমাদের সংবিধানে মৌলিক কাঠামো। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বলেছেন, সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে।
কেন? কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায় না। আর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা যায় না, গণতন্ত্র নিশ্চিত করা যায় না। এজন্য তিনি বলছেন, কেয়ারটেকার গভার্নমেন্ট সিস্টেম ইজ দ্য বেসিক স্ট্রাকচার অব দি কনস্টিটিউশন।
ওই সংশোধনীর মাধ্যমে আনা ‘অসাংবিধানিক পন্থায়’ সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ ‘রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত’ করার মত বিভিন্ন অপরাধকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ সাব্যস্ত করার ৭(ক) এবং সংবিধানের কিছু ধারাকে সংশোধনঅযোগ্য করার ৭(খ) অনুচ্ছেদকেও বাতিল করেছে আদালত।
পঞ্চদশ সংশোধনীর পর যুক্ত করা ৭(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, কোনো ব্যক্তি শক্তি প্রদর্শন বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা অন্য কোনো অসাংবিধানিক পন্থায়, এই সংবিধান বা এর কোনো অনুচ্ছেদ রদ, রহিত বা বাতিল বা স্থগিত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ নিলে বা ষড়যন্ত্র করলে; কিংবা, এই সংবিধান বা এর কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করলে কিংবা তা করার জন্য উদ্যোগ নিলে বা ষড়যন্ত্র করলে’, তা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ হবে।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের জন্য এই অনুচ্ছেদে যে কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোকে ‘ভেইক টার্ম’ (অস্পষ্ট পরিভাষা) হিসাবে বর্ণনা করে ফারাহ মাহবুব বলেন, এরূপ বিধান মানুষের বেঁচে থাকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নীতির পরিপন্থি।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। সেই সংশোধনীর অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায় এবং পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে ‘বৈপরীত্য’ (কনট্রাডিকশন) থাকার কথাও রায়ের পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেন বিচারক। তিনি বলেন, সংক্ষিপ্ত রায়ে আরও দুইবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলা হলেও পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা ছিল না। রায় ঘোষণার পর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনকে সবকিছুর মূলে রেখেছে আমাদের সংবিধান। জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোকে কেন্দ্রে রেখে আজকের রায় দিয়েছি।
আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রিভিউ আবেদনের বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক যাতে না হয়, সেদিকেও নজর দেওয়ার কথা বলেন তিনি।