ঢাকা ০৯:৪৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১২ মে ২০২৫

ছিনতাই ঠেকানোর আইন কতটা কার্যকর?

  • আপডেট সময় : ১০:৪০:১৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৩
  • ১১২ বার পড়া হয়েছে

একটি সংবাদসংস্থার প্রতিবেদনে ভুক্তভুগীর অবস্থাসহ বিস্তারিত তুলে ধরে বলা হয়েছে-মহাখালীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আল আমিন। কাজ শেষে সাধারণত প্রতিষ্ঠানের গাড়িতেই ফেরেন পুরান ঢাকার লালবাগের বাসায়। একদিন অফিসের গাড়ি না থাকায় নিজের উদ্যোগে রওনা হয়েই বিপদে পড়েন তিনি। আল আমিন বলেন, রাত ১০টার দিকে মহাখালী থেকে অটোরিকশা সাত রাস্তার দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় হঠাৎ বামের রাস্তায় ঢুকে থেমে যায়। এসময় রাস্তার পাশে দাঁড়ানো আরো দুজন অটোরিকশায় উঠে ঢুকে পড়ে।
অটোরিকশায় ঢুকতে চালকই তাদের সহযোগিতা করেছিল জানিয়ে আল আমিন বলেন, তাকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে টাকাপয়সা নিয়ে অটোরিকশাটি নির্জন স্থানে নিয়ে তাকে নামিয়ে চলে যায়। “কিছুই বুঝতে পারিনি। এত দ্রুত আর এত মানুষের চলাচলের মধ্যে ঘটনাটি ঘটল, হতভম্ব হয়ে গেলাম।”
তবে সবকিছু হারিয়েও আল আমিন পুলিশের দ্বারস্থ হননি। অনেক সময় পুলিশও ছিনতাইয়ের মামলা করার বিষয়ে নিরূৎসাহিত করে। ছিনতাইয়ে মোবাইল ফোন হারানো একজন ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, থানায় গিয়ে সব বলার পর ডিউটি অফিসার তাকে বলেন, মামলা করলে কাজের চেয়ে ‘ঝামেলা’ বাড়বে। পরে তিনি জিডি করে ফেরেন।
ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীবাসীকে এখন চলাফেরা করতে হচ্ছে আতঙ্ক নিয়ে; ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সম্পদের সঙ্গে প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটছে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময়ে ছিনতাইকারীদের পাকড়াও করলেও পরে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে এসে আবারও অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। পুলিশের তথ্যভা-ারে প্রায় ৬ হাজার ছিনতাইকারীর তথ্য রয়েছে। তারপরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এ অপরাধ। সে কারণে প্রশ্ন উঠছে, ছিনতাই ঠেকাতে বিদ্যমান আইন কি যথেষ্ট?
মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় শতাধিক স্পট রয়েছে, যেখানে ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেশি। তবে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইপ্রবণ (হটস্পট) হচ্ছে উত্তরার আজমপুর, এয়ারপোর্ট রোড, যাত্রাবাড়ী মোড় ও আশপাশের এলাকা, সায়েদাবাদ, মতিঝিল ব্যাংক পাড়া, ফার্মগেইট, কারওয়ান বাজার, শেরে বাংলানগর রোড, জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের সড়ক, হাতিরঝিল, মিরপুরের এক নম্বর থেকে টেকনিক্যাল মোড়, মিরপুর ৬ নম্বরের শিয়ালবাড়ির মোড়, চলন্তিকা মোড়, পল্লবীর কালশি, উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর ও তিনশ ফুট এলাকা, ওয়ারী, মৌচাক, শান্তিনগর, কাকরাইল, শাহবাগ, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া, বাবুবাজার, রাজারবাগ, কমলাপুর, গেন্ডারিয়া, জুরাইন রেলগেইট এলাকা, ভাটারা, বাড্ডা ও মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকা।
মামলা হয় দস্যুতার: প্রচলিত আইনে ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয় ‘দস্যুতার’ অভিযোগে। পুলিশের হিসাব বলছে, গত বছর ঢাকার ৫০টি থানায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে ১৪৫টি মামলা হয়েছে। আর চলতি বছরে প্রথম পাঁচ মাসে দস্যুতার মামলা হয়েছে ৭২টি। ১ থেকে ৭ জুলাই সাতদিনে ছিনতাই, ডাকাতির চেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়েছে ২০৮টি। এবছরের প্রথম পাঁচ মাসে তেজগাঁও এলাকায় সবচেয়ে বেশি, ২৫টি দুস্যতার ঘটনা ঘটে। আর পুলিশের অপরাধ তথ্য অনুযায়ী তেজগাঁও এর পর মিরপুর বিভাগে বেশি দুস্যতার ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সংখ্যা কখনোই ছিনতাইয়ের প্রকৃত অবস্থাকে তুলে ধরে না। মানুষ ছিনতাইয়ের পর আইনি ‘ঝামেলায়’ পড়তে চান না বলে মামলা এড়িয়ে যান। সে কারণে অপরাধীদের পার পাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়। এতদিন ধরে পুলিশের পক্ষ থেকেও এই বিষয়টির সুরাহা করার কোনো জোরালো চেষ্টা দৃশ্যমান ছিল না। তবে এবার পুলিশ বলছে, ছিনতাইয়ের কোনো ঘটনাই হিসাবের বাইরে থাকবে না।
ছিনতাইকারীর ছুরিতে এক পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর পর ঢাকার পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলছেন, মামলার বাদী না পাওয়া গেলে পুলিশই মামলা করবে। পুলিশের তথ্যভা-ারে প্রায় ৬ হাজার ছিনতাইকারীর তথ্য থাকার পরও তারা কীভাবে ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছে, সেই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ঢাকার পুলিশ প্রধানের কাছে। তিনি বলেন, “আমরা কোরবানির ঈদের আগেই অনেক ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করছিলাম। কিন্তু এরপরও দুঃখজনকভাবে বিষয়গুলো ঘটেছে।
“এদের প্রত্যেকে গ্রেপ্তার হয়েছে বলেই আমাদের ডেটাবেইজে নাম এসেছে। আমরা প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছি। গ্রেপ্তারের পর একটা আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাদের জামিন পাওয়ার অধিকারও রয়েছে। তারা আইনি প্রক্রিয়ায় জামিনে বের হয়ে আসে। এরপর তাদের আমরা আবার অন্য মামলায় গ্রেপ্তার করি।”
তাহলে আইন সংশোধন করা দরকার কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “তা অপরাধ বিজ্ঞানী বা সমাজ বিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। সে বিষয়ে আপনারা (গণমাধ্যম) জনমত গড়ে তুলতে পারেন। আমাদের কাজ গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা। আমরা সেটা করছি।”
ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেড়ে গেলে ব্যর্থতার দায় পুলিশের ওপরই আসে, সেক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন দিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কিনা, তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল ডিএমপি কমিশনারের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, “এটাকে পুলিশের ব্যর্থতা বলা যাবে না, কারণ পুলিশের কাজ গ্রেপ্তার করা, আর তারা সেটা করছেন।”
কী আছে আইনে? দুস্যুতার ঘটনায় তিনটি ধারায় মামলা হয়। এগুলো হল- দ-বিধি ৩৯২, ৩৯৩ ও ৩৯৪ ধারা। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, দস্যুতার ঘটনা ঘটলে ৩৯২ ধারায়, আর দস্যুতার চেষ্টায় ৩৯৩ আর দস্যুতার সময় ছুরি বা কোনো বস্তু দিয়ে আঘাত করলে ৩৯৪ ধারায় মামলা হয়। তবে চলতি পথে টান মেরে মোবাইল বা ব্যাগ ছিনিয়ে নিলে চুরির মামলা হয়। কারণ এখানে কোনো ভয়ভীতি দেখানো হয়নি। চুরির মামলার সর্বোচ্চ সাজা তিন বছর। অথচ মোটর সাইকেল অথবা প্রাইভেট কারে করে রিকশাযাত্রীর হাত থেকে ব্যাগ টেনে নেওয়ার ঘটনাই বেশি ঘটে। এ ধরনের ঘটনায় রিকশা থেকে পড়ে আরোহীর মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। বাংলাদেশ দ-বিধি ৩৯২ ধারায় কোনো ব্যক্তি যদি দস্যুতা সংঘটন করে তবে তিনি দশ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদে সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হতে পারেন। সঙ্গে রয়েছে অর্থদ-।
যদি সুর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময় অর্থাৎ রাতে রাজপথে দস্যুতার ঘটনা ঘটে তবে কারাদ-ের মেয়াদ চৌদ্দ বছর পর্যন্ত হতে পারে। কোনো ব্যক্তি দস্যুতা ঘটানোর উদ্যোগ নিলে দ-বিধির ৩৯৩ ধারায় তার সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে, সঙ্গে রয়েছে অর্থদ-। আর ৩৯৪ ধারায় সাজা হচ্ছে যাবজ্জীবন কারাদ- অথবা দশ বছর পযর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম কারাদ- ও অর্থদ-।
বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দস্যুতা বা ছিনতাই বেড়ে গেলে পুলিশ বিশেষ অভিযান চালিয়ে ‘দস্যুতার চেষ্টার অভিযোগে’ অর্থাৎ, ৩৯৩ ধারায় বেশি মামলা করে, যার সাজা সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদ-। আর ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে কারো মৃত্যু হলে ৩০২ ধারায় মামলা হয়, যার সাজা সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ-। তবে যাবজ্জীবন সাজাও রয়েছে। দুস্যতার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর অনেক অপরাধী কিছুদিন জেল খেটে বের হয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় বর্তমান আইন সংশোধনের প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “মাদকের আইন পরিবর্তন করে শক্ত করা হয়েছে। এরকম যদি ফাঁকফোকর থাকে ভবিষ্যতে করব। “তবে এখন বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে চার্জশিট যেন ঠিকমত হয়। এজন্য পুলিশ সদস্যদের জন্য বিভিন্ন প্রশ্ক্ষিণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। চার্জশিট যত ভালো ও নির্ভুল হবে; অপরাধীদের জামিনে বের হওয়ার সম্ভবনাও কমে যাবে।” তবে কি অভিযোগপত্র বা চার্জশিট তৈরিতে দুর্বলতার কারণে অপরাধীরা বের হয়ে যাচ্ছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ওইভাবে বলছি না। তবে চার্জশিট ভালোভাবে তৈরি করার বিষয়ে আমরা জোর দিচ্ছি এবং পুলিশকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।”

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ছিনতাই ঠেকানোর আইন কতটা কার্যকর?

আপডেট সময় : ১০:৪০:১৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ অগাস্ট ২০২৩

একটি সংবাদসংস্থার প্রতিবেদনে ভুক্তভুগীর অবস্থাসহ বিস্তারিত তুলে ধরে বলা হয়েছে-মহাখালীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন আল আমিন। কাজ শেষে সাধারণত প্রতিষ্ঠানের গাড়িতেই ফেরেন পুরান ঢাকার লালবাগের বাসায়। একদিন অফিসের গাড়ি না থাকায় নিজের উদ্যোগে রওনা হয়েই বিপদে পড়েন তিনি। আল আমিন বলেন, রাত ১০টার দিকে মহাখালী থেকে অটোরিকশা সাত রাস্তার দিকে যাচ্ছিল। কিন্তু তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় হঠাৎ বামের রাস্তায় ঢুকে থেমে যায়। এসময় রাস্তার পাশে দাঁড়ানো আরো দুজন অটোরিকশায় উঠে ঢুকে পড়ে।
অটোরিকশায় ঢুকতে চালকই তাদের সহযোগিতা করেছিল জানিয়ে আল আমিন বলেন, তাকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে টাকাপয়সা নিয়ে অটোরিকশাটি নির্জন স্থানে নিয়ে তাকে নামিয়ে চলে যায়। “কিছুই বুঝতে পারিনি। এত দ্রুত আর এত মানুষের চলাচলের মধ্যে ঘটনাটি ঘটল, হতভম্ব হয়ে গেলাম।”
তবে সবকিছু হারিয়েও আল আমিন পুলিশের দ্বারস্থ হননি। অনেক সময় পুলিশও ছিনতাইয়ের মামলা করার বিষয়ে নিরূৎসাহিত করে। ছিনতাইয়ে মোবাইল ফোন হারানো একজন ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, থানায় গিয়ে সব বলার পর ডিউটি অফিসার তাকে বলেন, মামলা করলে কাজের চেয়ে ‘ঝামেলা’ বাড়বে। পরে তিনি জিডি করে ফেরেন।
ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীবাসীকে এখন চলাফেরা করতে হচ্ছে আতঙ্ক নিয়ে; ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সম্পদের সঙ্গে প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটছে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময়ে ছিনতাইকারীদের পাকড়াও করলেও পরে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে এসে আবারও অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। পুলিশের তথ্যভা-ারে প্রায় ৬ হাজার ছিনতাইকারীর তথ্য রয়েছে। তারপরও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এ অপরাধ। সে কারণে প্রশ্ন উঠছে, ছিনতাই ঠেকাতে বিদ্যমান আইন কি যথেষ্ট?
মহানগর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় শতাধিক স্পট রয়েছে, যেখানে ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেশি। তবে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইপ্রবণ (হটস্পট) হচ্ছে উত্তরার আজমপুর, এয়ারপোর্ট রোড, যাত্রাবাড়ী মোড় ও আশপাশের এলাকা, সায়েদাবাদ, মতিঝিল ব্যাংক পাড়া, ফার্মগেইট, কারওয়ান বাজার, শেরে বাংলানগর রোড, জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের সড়ক, হাতিরঝিল, মিরপুরের এক নম্বর থেকে টেকনিক্যাল মোড়, মিরপুর ৬ নম্বরের শিয়ালবাড়ির মোড়, চলন্তিকা মোড়, পল্লবীর কালশি, উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর ও তিনশ ফুট এলাকা, ওয়ারী, মৌচাক, শান্তিনগর, কাকরাইল, শাহবাগ, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া, বাবুবাজার, রাজারবাগ, কমলাপুর, গেন্ডারিয়া, জুরাইন রেলগেইট এলাকা, ভাটারা, বাড্ডা ও মোহাম্মদপুরের বসিলা এলাকা।
মামলা হয় দস্যুতার: প্রচলিত আইনে ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয় ‘দস্যুতার’ অভিযোগে। পুলিশের হিসাব বলছে, গত বছর ঢাকার ৫০টি থানায় ছিনতাইয়ের অভিযোগে ১৪৫টি মামলা হয়েছে। আর চলতি বছরে প্রথম পাঁচ মাসে দস্যুতার মামলা হয়েছে ৭২টি। ১ থেকে ৭ জুলাই সাতদিনে ছিনতাই, ডাকাতির চেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়েছে ২০৮টি। এবছরের প্রথম পাঁচ মাসে তেজগাঁও এলাকায় সবচেয়ে বেশি, ২৫টি দুস্যতার ঘটনা ঘটে। আর পুলিশের অপরাধ তথ্য অনুযায়ী তেজগাঁও এর পর মিরপুর বিভাগে বেশি দুস্যতার ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সংখ্যা কখনোই ছিনতাইয়ের প্রকৃত অবস্থাকে তুলে ধরে না। মানুষ ছিনতাইয়ের পর আইনি ‘ঝামেলায়’ পড়তে চান না বলে মামলা এড়িয়ে যান। সে কারণে অপরাধীদের পার পাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়। এতদিন ধরে পুলিশের পক্ষ থেকেও এই বিষয়টির সুরাহা করার কোনো জোরালো চেষ্টা দৃশ্যমান ছিল না। তবে এবার পুলিশ বলছে, ছিনতাইয়ের কোনো ঘটনাই হিসাবের বাইরে থাকবে না।
ছিনতাইকারীর ছুরিতে এক পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর পর ঢাকার পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলছেন, মামলার বাদী না পাওয়া গেলে পুলিশই মামলা করবে। পুলিশের তথ্যভা-ারে প্রায় ৬ হাজার ছিনতাইকারীর তথ্য থাকার পরও তারা কীভাবে ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছে, সেই প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ঢাকার পুলিশ প্রধানের কাছে। তিনি বলেন, “আমরা কোরবানির ঈদের আগেই অনেক ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করছিলাম। কিন্তু এরপরও দুঃখজনকভাবে বিষয়গুলো ঘটেছে।
“এদের প্রত্যেকে গ্রেপ্তার হয়েছে বলেই আমাদের ডেটাবেইজে নাম এসেছে। আমরা প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছি। গ্রেপ্তারের পর একটা আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাদের জামিন পাওয়ার অধিকারও রয়েছে। তারা আইনি প্রক্রিয়ায় জামিনে বের হয়ে আসে। এরপর তাদের আমরা আবার অন্য মামলায় গ্রেপ্তার করি।”
তাহলে আইন সংশোধন করা দরকার কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “তা অপরাধ বিজ্ঞানী বা সমাজ বিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। সে বিষয়ে আপনারা (গণমাধ্যম) জনমত গড়ে তুলতে পারেন। আমাদের কাজ গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা। আমরা সেটা করছি।”
ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেড়ে গেলে ব্যর্থতার দায় পুলিশের ওপরই আসে, সেক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন দিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কিনা, তাও জানতে চাওয়া হয়েছিল ডিএমপি কমিশনারের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, “এটাকে পুলিশের ব্যর্থতা বলা যাবে না, কারণ পুলিশের কাজ গ্রেপ্তার করা, আর তারা সেটা করছেন।”
কী আছে আইনে? দুস্যুতার ঘটনায় তিনটি ধারায় মামলা হয়। এগুলো হল- দ-বিধি ৩৯২, ৩৯৩ ও ৩৯৪ ধারা। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, দস্যুতার ঘটনা ঘটলে ৩৯২ ধারায়, আর দস্যুতার চেষ্টায় ৩৯৩ আর দস্যুতার সময় ছুরি বা কোনো বস্তু দিয়ে আঘাত করলে ৩৯৪ ধারায় মামলা হয়। তবে চলতি পথে টান মেরে মোবাইল বা ব্যাগ ছিনিয়ে নিলে চুরির মামলা হয়। কারণ এখানে কোনো ভয়ভীতি দেখানো হয়নি। চুরির মামলার সর্বোচ্চ সাজা তিন বছর। অথচ মোটর সাইকেল অথবা প্রাইভেট কারে করে রিকশাযাত্রীর হাত থেকে ব্যাগ টেনে নেওয়ার ঘটনাই বেশি ঘটে। এ ধরনের ঘটনায় রিকশা থেকে পড়ে আরোহীর মৃত্যুর ঘটনাও রয়েছে। বাংলাদেশ দ-বিধি ৩৯২ ধারায় কোনো ব্যক্তি যদি দস্যুতা সংঘটন করে তবে তিনি দশ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদে সশ্রম কারাদ-ে দ-িত হতে পারেন। সঙ্গে রয়েছে অর্থদ-।
যদি সুর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময় অর্থাৎ রাতে রাজপথে দস্যুতার ঘটনা ঘটে তবে কারাদ-ের মেয়াদ চৌদ্দ বছর পর্যন্ত হতে পারে। কোনো ব্যক্তি দস্যুতা ঘটানোর উদ্যোগ নিলে দ-বিধির ৩৯৩ ধারায় তার সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে, সঙ্গে রয়েছে অর্থদ-। আর ৩৯৪ ধারায় সাজা হচ্ছে যাবজ্জীবন কারাদ- অথবা দশ বছর পযর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম কারাদ- ও অর্থদ-।
বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দস্যুতা বা ছিনতাই বেড়ে গেলে পুলিশ বিশেষ অভিযান চালিয়ে ‘দস্যুতার চেষ্টার অভিযোগে’ অর্থাৎ, ৩৯৩ ধারায় বেশি মামলা করে, যার সাজা সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদ-। আর ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে কারো মৃত্যু হলে ৩০২ ধারায় মামলা হয়, যার সাজা সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ-। তবে যাবজ্জীবন সাজাও রয়েছে। দুস্যতার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর অনেক অপরাধী কিছুদিন জেল খেটে বের হয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় বর্তমান আইন সংশোধনের প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “মাদকের আইন পরিবর্তন করে শক্ত করা হয়েছে। এরকম যদি ফাঁকফোকর থাকে ভবিষ্যতে করব। “তবে এখন বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে চার্জশিট যেন ঠিকমত হয়। এজন্য পুলিশ সদস্যদের জন্য বিভিন্ন প্রশ্ক্ষিণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। চার্জশিট যত ভালো ও নির্ভুল হবে; অপরাধীদের জামিনে বের হওয়ার সম্ভবনাও কমে যাবে।” তবে কি অভিযোগপত্র বা চার্জশিট তৈরিতে দুর্বলতার কারণে অপরাধীরা বের হয়ে যাচ্ছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ওইভাবে বলছি না। তবে চার্জশিট ভালোভাবে তৈরি করার বিষয়ে আমরা জোর দিচ্ছি এবং পুলিশকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।”