মোঃ জাহাঙ্গীর আলম সরকার সাগর : কোন কোন সময় যখন একজন ব্যক্তি ধীরে ধীরে একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে-জীবনের নানা বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা, মানুষকে ভালোবাসার আকুতি, অতি সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার যে অন্তর্নিহিত শক্তি নিরন্তর কাজ করে; যা সচারচর সবার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না। শেখ পরিবারের কৃতিসন্তান বরেণ্য রাজনীতিবিদ, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস সেই বিরল ব্যক্তিত্বদের অন্যতম। যিনি তার ৫০ বছরের জীবনে নানা চড়াই উতরাইয়ের মধ্যে নিজেকে বার বার ছাড়িয়ে গেছেন। ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর জন্ম নেওয়া ফজলে নূর তাপস-এর জীবন নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর। শিশুকাল থেকেই নানা ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠা। পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে তিনি রাজনীতির পাঠ গ্রহণ করে জীবনের আদর্শকে স্থির করেছেন এক অবিচল কর্মবিন্দুতে; যেখানে জনগণের কল্যাণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
একজন আইনজীবী হিসেবে অত্যন্ত অল্প সময়েই সুনাম অর্জন করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হয়ে নবম, দশম এবং একাদশ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তাপস। এ সময় তিনি সংসদে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে দশম ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১০ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দশম সংসদে তিনি খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০১৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হিসেবে তাকে মনোনয়ন দেওয়ার পর একাদশ জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ১৬ মে শপথ গ্রহণ করে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
ফজলে নূর তাপস ১৯৯৬ সালে যুক্তরাজ্যের ওলভারহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনবিদ্যায় স্নাতক (এলএলবি) সম্পন্ন করেন। ১৯৯৭ সালে ‘বার অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস’-এর জেনারেল কাউন্সিলের অধীনে বার ফাইনাল কোর্স সম্পন্ন করেন। তিনি লিংকনস্ ইন ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের একজন সদস্য। তাপস ২০০১ সাল থেকে হাইকোর্ট বিভাগের একজন আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ২০১০ সালের ২৪শে আগস্ট আপিল বিভাগের একজন আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ পান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় তিনি সরকার পক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেন। ২০০৭ সালে তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্তাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করার পর তাপস শেখ হাসিনার পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি তার পিতা ফজলুল হক মনির প্রতিষ্ঠিত ও বন্ধ হয়ে যাওয়া দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন।
তাপসের পিতা শেখ ফজলুল হক মনি আওয়ামী লীগের একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন এবং এর অঙ্গসংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের গেরিলা বাহিনী মুজিব বাহিনী তার নির্দেশে ও প্রত্যক্ষ তত্তাবধানে গঠিত এবং পরিচালিত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের সময় ফজলুল হক মনি ও আরজু মনিকে হত্যা করা হয়। এই দম্পতির দুই পুত্র যুবলীগের বর্তমান সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ ও শেখ ফজলে নূর তাপস। ১৫ আগস্টের কাল রাতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মাত্র চার বছরের শিশু আজকের ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে আইন প্রণেতা হিসেবেও ভূমিকা রেখেছেন। আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ ও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ নামে দুটি সংগঠনে দীর্ঘদিন যাবত বিভক্ত থাকার পরে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার নির্দেশে শেখ ফজলে নূর তাপসের নেতৃত্বে এক হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই সহযোগী সংগঠনের নাম- বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ এবং শেখ তাপস এর সদস্য সচিব। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যেও ফেলেছেন শেখ ফজলে নূর তাপস। দু’বার তিনি হামলার শিকার হয়েছেন। পুরানা পল্টনের বাংলার বাণী অফিসে তার ওপর সবচেয়ে বড় হামলার ঘটনা ঘটে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার আগেই ওই হামলার পরিকল্পনা করা হয়। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এরপর হাজারীবাগের পার্কের মধ্যে দ্বিতীয় হামলার শিকার হন তিনি।
মূলত: শেখ ফজলে নূর তাপস আলোচনায় আসেন ২০০৮ সালে। তখন দেশে জরুরি অব¯’া চলাকালে সংসদ ভবনে আ¯’ায়ীভাবে গঠিত বিশেষ আদালতে প্রতিদিন আওয়ামী লীগ প্রধান, বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশিষ্ট কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের শুনানি চলছিল। একজন তরুণ আইনজীবী হয়েও অভিযুক্ত শীর্ষ নেতাদের নিরাপত্তা কামনায় সব আইনজীবীকে সুসংগঠিত সংঘবদ্ধ করাতে তাঁর দৃঢ়তা ছিল অভিভাবকতুল্য। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি আওয়ামীপšি’ আইনজীবীদের একত্র করে সুসংবদ্ধভাবে মামলা পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। এরপর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দিনগুলোতে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামীপš’ী আইনজীবীরা হাইকোর্টের আপীল বিভাগে উপ¯ি’ত হয়ে তাঁর সাথে একাত্ম হয়েছিলো। তার নেতৃত্বেই সাধারণ আইনজীবীরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য গণভবনে একাধিকবার একত্র হয়েছিলো। এ ধরণের নানা ঘটনায় তাঁর অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় আমরা দেখতে পেরেছি। বয়সে তরুণ হলেও একজন সাংসদ হিসাবে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ছিলেন সম্পূর্ণ সফল। একজন আইনজীবী হিসাবেও তিনি পুরোদ¯‘র সফল। একজন সিনিয়র আইনজীবী হিসাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর শুনানি তিনি করে থাকেন তাঁর জ্ঞানগর্ভ তথ্যের সাবলীল উপ¯’াপনের মাধ্যমে।
২০০৮ সালের সময় থেকে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসকে ঘিরে সব শ্রেণির মানুষের ইলেকশনের প্রতি যে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর গণজোয়ার দেখি, তা এর আগে অন্য কারো সময় দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা সব সময় গগনচুম্বী। নিঃসন্দেহে তাঁর মধ্যে সাধারণ মানুষ বা জনগণকে আকর্ষণের এক সম্মোহনী ক্ষমতা আছে, যার ফলে ঢাকা-১০ আসনের তিনবারের অত্যন্ত সফল আর জনপ্রিয় সাংসদ তিনি। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার তাঁর ওপর অর্পিত হলেও হয়তো তিনি সুষ্ঠুভাবে তা পালন করতে পারতেন! কেন তিনি তাঁর নিজের কক্ষচ্যুত হয়ে অন্য পথে গিয়ে নগরপিতার দায়িত্ব পাওয়ার মাধ্যমে জনগণের সেবক হতে মাঠে নেমেছেন সেটি তাঁর বিবেচ্য বিষয়।
মানুষের জন্যে রাজনীতি। স্বার্থ, দ্বন্ধ, আর্থিক লোভ ইত্যাদি কখনো ঘেঁষতে পারেনি তাঁর রাজনীতিতে। এ রাজনীতি তাঁকে শিখিয়েছে মানুষের কাছে থাকতে, মানুষকে ভালোবাসতে, আবার প্রয়োজনে মানুষের দাবি আদায়ে সো”চার হতে। মেয়র ফজলে নূর তাপসের রাজনৈতিক জীবন বর্ণাঢ্য ও জৌলুসময়। তাঁর কতটাই বা আমার জানা। তবুও একজন আইনজীবী হিসেবে আমার জানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়েই তার সম্পর্কে এই লেখাটা। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের অনুষ্ঠান ছাড়া তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগতভাবে তেমন কোনো কথা বলার সুযোগ কখনো হয়নি। জন্মদিনের আজকের দিনে তাঁর জন্য নিরন্তর আন্তরিক শুভকামনা। আপনি ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন, দীর্ঘজীবী হোন। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে পুনরায় আইনজীবীদের মাঝে আগের মতো ফিরে আসুন এই প্রত্যাশা রইলো।
লেখক : আইনজীবী ও পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল : ধফাংধমধৎ২৯@মসধরষ.পড়স
চৌকষ দৃষ্টিভঙ্গির অনন্য ব্যক্তিত্ব ফজলে নূর তাপস
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ