ঢাকা ০১:৪৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৯ জুন ২০২৫

চোখ বেঁচে থাক চোখের আলোয়

  • আপডেট সময় : ১১:৪০:৫২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
  • ৯১ বার পড়া হয়েছে

অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু : জীবদ্দশায় মানুষ যেমন তার মানবিক গুণাবলির জন্য এবং মানুষের তরে কাজের জন্য হতে পারেন সম্মানিত, তেমনি মৃত্যুর পরও মানুষ তার ত্যাগ দিয়ে হয়ে উঠতে পারেন এক জলন্ত মানবিকতার দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। অতি সম্প্রতি সন্ধানীতে চক্ষু দান করে গেলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট বামপন্থি নেতা, কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব হায়দার আকবর খান রণো। এর কিছুদিন আগে সন্ধানীতে চক্ষুদান করে গেছেন বাংলাদেশের প্রথম পতাকার অন্যতম রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস। তার চোখে এখন পৃথিবী দেখছে রংপুরের মশিউর রহমান এবং চাঁদপুরের আবুল কালাম। সন্ধানী বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ চক্ষুদাতা সালেহা সুলতানের কাছে- যিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির পরিচিত মুখ, সমাজসেবিকা এবং সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যার চোখে আলো ফিরে পেয়েছে ময়মনসিংহের খোকন রবি দাস এবং বগুড়ার তানিয়া আক্তার। জনকণ্ঠের সম্পাদনা পরিষদের সহকারী হারুনুর রশিদের চোখে পৃথিবী দেখছে কেরানীগঞ্জের মুকিম শেখ এবং দাউদকান্দীর আরব আলী। মাতৃভাষা বাংলার জন্য আমরা যে সৈনিকদের কাছে চির কৃতজ্ঞ তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন। সেই মহান ভাষা সৈনিকের চোখে পৃথিবী দেখছে এখন রেশমা।
আর সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য যিনি বাংলাদেশের প্রথম ক্যাটাবারিক অর্গান ডোনেশনকারী- যার দুটো কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে দুজন কিডনি রোগীর দেহে; আবার তার দুটো চোখে দেখছে ফেরদৌসী আক্তার ও সুজন। এ রকম আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে আমাদের মাঝে- যারা তাদের জীবনের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে গেছেন এই দেশের সাধারণ মানুষকে। এই তালিকাটা আরো অনেক দীর্ঘ হবে যদি তাদের সবার নাম এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়; এখানে জায়গার অভাবে না লিখলেও সেসব দানশীল ব্যক্তি এবং তাদের পরিবার ও সন্তানদের প্রতি অবিরাম শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানাই।
ইতোমধ্যে ভবিষ্যতের জন্য সন্ধানীতে যাদের চোখ দান করা আছে তাদের প্রতিও অনন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অবিরাম। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ডাক্তার দীপু মনি এমপি, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী আ খ ম মোজাম্মেল হক এমপি প্রমুখ।
এছাড়া অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা, বাঁধন, কণ্ঠশিল্পী মেহেরিনসহ আরও অনেকেই আছে মরণোত্তর চক্ষুদান করার এই তালিকায়। দুঃখজনক তথ্যটি হলো- বাংলাদেশের ১৪ লক্ষ অন্ধ ব্যক্তির মধ্যে ৫ লক্ষই হলো কর্নিয়াজনিত অন্ধ। এটা সাধারণ হিসাব। তবে বাংলাদেশের যেহেতু কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব নিয়ে কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তাই আমরা ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের একটি পরিসংখ্যানকে ব্যবহার করে তুলনামূলক আলোচনা করছি। এই পাঁচ লক্ষ অন্ধ মানুষের চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে হলে বর্তমানে বাংলাদেশে মরণোত্তর চক্ষু দানসূত্রে যে পরিমাণ কর্নিয়া পাওয়া যাচ্ছে এবং সে অনুযায়ী যে কর্নিয়ার অপারেশন হচ্ছে তাতে কর্নিয়াজনিত সব অন্ধ লোকের অপারেশন সমাপ্ত করতে অন্তত ছয় থেকে সাত হাজার বছর লেগে যাবে- যা এক কথায় অসম্ভব। এ যুগে এসে এতগুলো মানুষকে অন্ধত্বের মধ্যে রেখে আমরা আমাদের সামাজিক অর্থনৈতিক কোনো মানদণ্ডেই নিজেদেরকে উন্নত বলে দাবি করতে পারি না। তাই এই জনগোষ্ঠীকে যদি আমরা মূল স্রোতের সাথে সম্পৃক্ত করতে চাই, অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত করতে চাই- তাহলে আমাদের অবশ্যই তাদের অন্ধত্ব নিবারণ করতে হবে এবং এটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আসুন আমরা আলোচনা করি কীভাবে কর্নিয়াজনিত অন্ধ মানুষদের পাশে দাঁড়ানো যায় এবং কীভাবে তাদেরকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মূল স্রোতের সাথে সম্পৃক্ত করা যায়?

সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি ১৯৮৪ সাল থেকে এই অন্ধত্ব নিবারণের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি ৪০০০-এর অধিক কর্নিয়া কালেকশন করেছে এবং সাড়ে তিন হাজারের মতো কর্নিয়াজনিত অন্ধ মানুষকে আলো ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। দেশের বিশাল এই অন্ধ জনগোষ্ঠীর জন্য এই পরিসংখ্যানটা মোটেও কোনো রিমারকেবল সফলতা না; আর হেলাফেলার মতো কোনো বিষয়ও নয়।
এ বিষয়টি নিয়ে ধর্মীয় প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে দেখতে পাই এবং আমাদের সাধারণ জ্ঞান দিয়ে অনুধাবন করলেও আমরা বুঝতে পারি, কোনো ধর্মই মানুষের উপকার করতে বাঁধা দেয় না- বরং পরোপকার করাই প্রতিটি ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সকল ধর্মেই বলা আছে, মানুষের উপকার করাই হলো পরম ধর্ম। বিশে^র দিকে তাকালে দেখা যায়- আন্তর্জাতিক আধুনিক ইসলামিক প্রায় সকল পরিচিত ব্যক্তিত্বই মরণোত্তর চক্ষুদানকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেরাও চক্ষুদান করে গেছেন। আসলে মৃত্যুর পরেও মানুষের উপকার করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো এই মরণোত্তর চক্ষুদান করার এই বিষয়টি। এর চেয়ে মহৎ কর্ম আর হতে পারে না। ধর্ম এখানে কোনোভাবেই বাধা হয়ে থাকতে পারে না।
আগেকার দিনে দৃষ্টিহীনরা এই অন্ধত্বকে ঈশ্বরের অভিশাপ বা ভাগ্যের লিখন বলে সহজেই মেনে নিতো। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। মানুষের চিন্তা, ধ্যান-ধারণা ও জ্ঞান অনেক বেড়েছে। এখন আর আগের সেই অন্ধ ধারণা মানুষের মধ্যে কোনো কাজ করে না। মানুষ এখন জেনে গেছে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক ধরনের অন্ধত্ব রোধ করা যায়। মানুষ এও জেনে গেছে যে- কোনো দুর্ঘটনা বা রোধের অযোগ্য অন্ধত্বের জন্য অন্যের চোখ দিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আর এটা তো মানুষ জানেই যে- মানুষ মরে গেলে তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গই কিছুদিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়, মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তাই একজন মহৎ মানুষ নিজের মৃত্যুর পরেও নিজের চোখ অন্যকে দান করার মাধ্যমে ইচ্ছে করলেই বেঁচে থাকতে পারে এই পৃথিবীর আনন্দ আর উপভোগে মাঝে।
এত সচেতনতার পরও আমাদের দেশে এখনও অনেকে চক্ষুদান বিষয়ে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে থাকেন। এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়- মহৎ চিন্তা ও সচেতনতার অভাব, ধর্মীয় ভুল ধারণা ও আইনি জটিলতা। এছাড়া অনেকে কেবল মৃতদেহের অঙ্গহানি হচ্ছে এই ভয়েই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও চক্ষুদান থেকে বিরত থাকেন। তাই বাংলাদেশে সংগত কারণেই প্রয়োজনের তুলনায় কর্নিয়া প্রাপ্তির সংখ্যা অত্যন্ত কম। সন্দেহ নেই, এ বিষয়ে জোর তৎপরতা চালাতে হবে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে সচেতনতা আরো বাড়াতে হবে।
আসলে এটা অনুধাবন করলেই বুঝা যায় যে, মরণোত্তর চক্ষুদান একটি অত্যন্ত বড়ো মাপের মহৎ সেবা। এই মহৎ সেবাকে সবার মাঝে পৌঁছে দিতে যেমন প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত সচেতনতা, তেমন প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এজন্য প্রত্যেককে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। নিজে সচেতন হলেই কেবল একজন অন্যকে সচেতন করে তুলতে পারবে। আসলে দরকার ভয়কে জয় করা। মরণোত্তর চক্ষুদানের জন্য তেমন কোনো কঠিন নিয়ম নেই। এ ক্ষেত্রে চক্ষুদান করতে ইচ্ছুক একজন ব্যক্তিকে মরণোত্তর চক্ষুদানের ফর্ম পূরণের পুর্বে তার দুইজন অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে। এর কারণ মরণোত্তর চক্ষুদাতার মৃত্যুর অব্যবহিত পর অভিভাবকদের সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই চোখ সংগ্রহ সম্ভবপর হয় না। সুতরাং এ ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুইজন অভিভাবকের অনুমতি নেওয়া খুবই জরুরি। সুতরাং বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় আইনানুগভাবে নিকট আত্মীয়ের অনুমতি সাপেক্ষে মরণোত্তর চক্ষুদান করতে পারে।
স্বেচ্ছায় মরণোত্তর এই চক্ষুদানের ফলে কোনো মহৎ ব্যক্তি একজন অন্ধ মানুষকে ফিরিয়ে দিতে পারেন পৃথিবীতে আলোর জগৎ। একজন অন্ধ মানুষ ফিরে পেতে পারে দৃষ্টিশক্তি, ফিরে পেতে পারে একটি নতুন জীবন, ফিরে পেতে পারে একটি সুস্থ জীবনের সকল সৌন্দর্যকে অনুভব ও উপলব্ধি করে জীবনকে পরিপূর্ণভাবে ভোগ করতে। আর এ ক্ষেত্রে চক্ষুদাতা এই পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকতে পারেন অন্যকে চোখ দান করার মাধ্যমে। এতে মনুষ্য জীবনও হয়ে ওঠে স্বার্থক ও সুন্দর। কর্নিয়া সংগ্রহ বাড়াতে হলে আমাদের কিছু স্বল্পমেয়াদি এবং কিছু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা: ১) হাসপাতালে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনের কাছে কর্তব্যরত চিকিৎসক নার্স এবং সংশ্লিষ্ট অন্যরা কর্নিয়ার জন্য আবেদন করা এবং হসপিটাল থেকে কর্নিয়া সংগ্রহ করে তা আই ব্যাংকে প্রেরণ করা। ২) এক্সিডেন্টাল ডেথ, যেগুলো পোস্টমর্টেম হয় সেই ধরনের ডেড বডি থেকে কর্নিয়া সংগ্রহ করার জন্য হসপিটাল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করলে প্রচুর পরিমাণে কর্নিয়া সংগ্রহ করা সম্ভব। অন্ধ ব্যক্তির চোখে তা সংযোজন করে সুন্দর পৃথিবী দেখানো সম্ভব। ৩) যারা সচেতন তারা হসপিটাল ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় মৃত ব্যক্তির পরিবারের কাছে মৃত্যুর পরে আবেদন করতে পারেন চোখের জন্য এবং তারা চোখ দিতে রাজি হলে সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংকে খবর দিতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: ১) পাঠ্যপুস্তকে আই ডোনেশন সম্পর্কে গল্প অথবা প্রবন্ধ সংযোজন করা। বিখ্যাত চক্ষুদাতাদের গল্পগুলো শোনানো যাতে করে ছোটো ছোটো কমলমতি শিশুরা বুঝতে পারে চক্ষুদান একটি ভালো ও মহৎ কাজ। ২) ড্রাইভিং লাইসেন্স, জাতীয় পরিচয়পত্র ইত্যাদিতে চক্ষুদানের বিষয়ে একটি কলাম উল্লেখ রাখা যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রয়েছে। ৩) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ইমামদের যারা ট্রেনিং করছে তাদেরকে অবহিত করা যে- মরণোত্তর চক্ষুদানে কোনো ধর্মীয় বাধা নেই এবং এই কথাটি যাতে তারা মসজিদে মসজিদে প্রচার করেন খুতবার সময়। এতে করে সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে খুব সহজভাবে নিবেন।
আইনি সহযোগিতা: ২০১৮ সালের মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনটি চক্ষুদানের ক্ষেত্রে অনেকটা সহযোগী যা মানবদেহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ সংশোধন কল্পে প্রণীত হয়েছে। এখানে অনেককিছুই সহজীকরণ করা হয়েছে। তারপরও এক্সিডেন্টাল ডেথ যেগুলো আছে সেখানে পোস্টমর্টেমের প্রয়োজন হয় এবং এখান থেকে চোখ সংগ্রহ করার যথাযথ নিয়ম ও সহজ বিষয়গুলো যদি সংযুক্ত করা হয় তাহলে আরো অধিক কর্নিয়া সংগ্রহের পথ উন্মুক্ত ও সুগম হবে এবং এই দেশের ৫ লক্ষ কর্নিয়াজনিত মানুষ অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে দ্রুত মুক্তি পাবে।
লেখক: চিকিৎসক ও সভাপতি, সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি ও সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংক

 

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

চোখ বেঁচে থাক চোখের আলোয়

আপডেট সময় : ১১:৪০:৫২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪

অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু : জীবদ্দশায় মানুষ যেমন তার মানবিক গুণাবলির জন্য এবং মানুষের তরে কাজের জন্য হতে পারেন সম্মানিত, তেমনি মৃত্যুর পরও মানুষ তার ত্যাগ দিয়ে হয়ে উঠতে পারেন এক জলন্ত মানবিকতার দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। অতি সম্প্রতি সন্ধানীতে চক্ষু দান করে গেলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট বামপন্থি নেতা, কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রবাদ পুরুষ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব হায়দার আকবর খান রণো। এর কিছুদিন আগে সন্ধানীতে চক্ষুদান করে গেছেন বাংলাদেশের প্রথম পতাকার অন্যতম রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধা শিব নারায়ণ দাস। তার চোখে এখন পৃথিবী দেখছে রংপুরের মশিউর রহমান এবং চাঁদপুরের আবুল কালাম। সন্ধানী বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ চক্ষুদাতা সালেহা সুলতানের কাছে- যিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির পরিচিত মুখ, সমাজসেবিকা এবং সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। যার চোখে আলো ফিরে পেয়েছে ময়মনসিংহের খোকন রবি দাস এবং বগুড়ার তানিয়া আক্তার। জনকণ্ঠের সম্পাদনা পরিষদের সহকারী হারুনুর রশিদের চোখে পৃথিবী দেখছে কেরানীগঞ্জের মুকিম শেখ এবং দাউদকান্দীর আরব আলী। মাতৃভাষা বাংলার জন্য আমরা যে সৈনিকদের কাছে চির কৃতজ্ঞ তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন। সেই মহান ভাষা সৈনিকের চোখে পৃথিবী দেখছে এখন রেশমা।
আর সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য যিনি বাংলাদেশের প্রথম ক্যাটাবারিক অর্গান ডোনেশনকারী- যার দুটো কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে দুজন কিডনি রোগীর দেহে; আবার তার দুটো চোখে দেখছে ফেরদৌসী আক্তার ও সুজন। এ রকম আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে আমাদের মাঝে- যারা তাদের জীবনের সবটুকু দিয়ে ভালোবেসে গেছেন এই দেশের সাধারণ মানুষকে। এই তালিকাটা আরো অনেক দীর্ঘ হবে যদি তাদের সবার নাম এখানে লিপিবদ্ধ করা হয়; এখানে জায়গার অভাবে না লিখলেও সেসব দানশীল ব্যক্তি এবং তাদের পরিবার ও সন্তানদের প্রতি অবিরাম শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জানাই।
ইতোমধ্যে ভবিষ্যতের জন্য সন্ধানীতে যাদের চোখ দান করা আছে তাদের প্রতিও অনন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অবিরাম। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মোঃ আব্দুল হামিদ, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ডাক্তার দীপু মনি এমপি, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী আ খ ম মোজাম্মেল হক এমপি প্রমুখ।
এছাড়া অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা, বাঁধন, কণ্ঠশিল্পী মেহেরিনসহ আরও অনেকেই আছে মরণোত্তর চক্ষুদান করার এই তালিকায়। দুঃখজনক তথ্যটি হলো- বাংলাদেশের ১৪ লক্ষ অন্ধ ব্যক্তির মধ্যে ৫ লক্ষই হলো কর্নিয়াজনিত অন্ধ। এটা সাধারণ হিসাব। তবে বাংলাদেশের যেহেতু কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব নিয়ে কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তাই আমরা ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের একটি পরিসংখ্যানকে ব্যবহার করে তুলনামূলক আলোচনা করছি। এই পাঁচ লক্ষ অন্ধ মানুষের চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে হলে বর্তমানে বাংলাদেশে মরণোত্তর চক্ষু দানসূত্রে যে পরিমাণ কর্নিয়া পাওয়া যাচ্ছে এবং সে অনুযায়ী যে কর্নিয়ার অপারেশন হচ্ছে তাতে কর্নিয়াজনিত সব অন্ধ লোকের অপারেশন সমাপ্ত করতে অন্তত ছয় থেকে সাত হাজার বছর লেগে যাবে- যা এক কথায় অসম্ভব। এ যুগে এসে এতগুলো মানুষকে অন্ধত্বের মধ্যে রেখে আমরা আমাদের সামাজিক অর্থনৈতিক কোনো মানদণ্ডেই নিজেদেরকে উন্নত বলে দাবি করতে পারি না। তাই এই জনগোষ্ঠীকে যদি আমরা মূল স্রোতের সাথে সম্পৃক্ত করতে চাই, অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত করতে চাই- তাহলে আমাদের অবশ্যই তাদের অন্ধত্ব নিবারণ করতে হবে এবং এটা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আসুন আমরা আলোচনা করি কীভাবে কর্নিয়াজনিত অন্ধ মানুষদের পাশে দাঁড়ানো যায় এবং কীভাবে তাদেরকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক মূল স্রোতের সাথে সম্পৃক্ত করা যায়?

সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি ১৯৮৪ সাল থেকে এই অন্ধত্ব নিবারণের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি ৪০০০-এর অধিক কর্নিয়া কালেকশন করেছে এবং সাড়ে তিন হাজারের মতো কর্নিয়াজনিত অন্ধ মানুষকে আলো ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। দেশের বিশাল এই অন্ধ জনগোষ্ঠীর জন্য এই পরিসংখ্যানটা মোটেও কোনো রিমারকেবল সফলতা না; আর হেলাফেলার মতো কোনো বিষয়ও নয়।
এ বিষয়টি নিয়ে ধর্মীয় প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে দেখতে পাই এবং আমাদের সাধারণ জ্ঞান দিয়ে অনুধাবন করলেও আমরা বুঝতে পারি, কোনো ধর্মই মানুষের উপকার করতে বাঁধা দেয় না- বরং পরোপকার করাই প্রতিটি ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সকল ধর্মেই বলা আছে, মানুষের উপকার করাই হলো পরম ধর্ম। বিশে^র দিকে তাকালে দেখা যায়- আন্তর্জাতিক আধুনিক ইসলামিক প্রায় সকল পরিচিত ব্যক্তিত্বই মরণোত্তর চক্ষুদানকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে অনেকেই নিজেরাও চক্ষুদান করে গেছেন। আসলে মৃত্যুর পরেও মানুষের উপকার করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো এই মরণোত্তর চক্ষুদান করার এই বিষয়টি। এর চেয়ে মহৎ কর্ম আর হতে পারে না। ধর্ম এখানে কোনোভাবেই বাধা হয়ে থাকতে পারে না।
আগেকার দিনে দৃষ্টিহীনরা এই অন্ধত্বকে ঈশ্বরের অভিশাপ বা ভাগ্যের লিখন বলে সহজেই মেনে নিতো। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। মানুষের চিন্তা, ধ্যান-ধারণা ও জ্ঞান অনেক বেড়েছে। এখন আর আগের সেই অন্ধ ধারণা মানুষের মধ্যে কোনো কাজ করে না। মানুষ এখন জেনে গেছে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক ধরনের অন্ধত্ব রোধ করা যায়। মানুষ এও জেনে গেছে যে- কোনো দুর্ঘটনা বা রোধের অযোগ্য অন্ধত্বের জন্য অন্যের চোখ দিয়ে দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। আর এটা তো মানুষ জানেই যে- মানুষ মরে গেলে তার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গই কিছুদিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়, মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তাই একজন মহৎ মানুষ নিজের মৃত্যুর পরেও নিজের চোখ অন্যকে দান করার মাধ্যমে ইচ্ছে করলেই বেঁচে থাকতে পারে এই পৃথিবীর আনন্দ আর উপভোগে মাঝে।
এত সচেতনতার পরও আমাদের দেশে এখনও অনেকে চক্ষুদান বিষয়ে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগে থাকেন। এর মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়- মহৎ চিন্তা ও সচেতনতার অভাব, ধর্মীয় ভুল ধারণা ও আইনি জটিলতা। এছাড়া অনেকে কেবল মৃতদেহের অঙ্গহানি হচ্ছে এই ভয়েই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও চক্ষুদান থেকে বিরত থাকেন। তাই বাংলাদেশে সংগত কারণেই প্রয়োজনের তুলনায় কর্নিয়া প্রাপ্তির সংখ্যা অত্যন্ত কম। সন্দেহ নেই, এ বিষয়ে জোর তৎপরতা চালাতে হবে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে সচেতনতা আরো বাড়াতে হবে।
আসলে এটা অনুধাবন করলেই বুঝা যায় যে, মরণোত্তর চক্ষুদান একটি অত্যন্ত বড়ো মাপের মহৎ সেবা। এই মহৎ সেবাকে সবার মাঝে পৌঁছে দিতে যেমন প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত সচেতনতা, তেমন প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এজন্য প্রত্যেককে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। নিজে সচেতন হলেই কেবল একজন অন্যকে সচেতন করে তুলতে পারবে। আসলে দরকার ভয়কে জয় করা। মরণোত্তর চক্ষুদানের জন্য তেমন কোনো কঠিন নিয়ম নেই। এ ক্ষেত্রে চক্ষুদান করতে ইচ্ছুক একজন ব্যক্তিকে মরণোত্তর চক্ষুদানের ফর্ম পূরণের পুর্বে তার দুইজন অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে। এর কারণ মরণোত্তর চক্ষুদাতার মৃত্যুর অব্যবহিত পর অভিভাবকদের সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই চোখ সংগ্রহ সম্ভবপর হয় না। সুতরাং এ ক্ষেত্রে কমপক্ষে দুইজন অভিভাবকের অনুমতি নেওয়া খুবই জরুরি। সুতরাং বাংলাদেশে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী যেকোনো ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় আইনানুগভাবে নিকট আত্মীয়ের অনুমতি সাপেক্ষে মরণোত্তর চক্ষুদান করতে পারে।
স্বেচ্ছায় মরণোত্তর এই চক্ষুদানের ফলে কোনো মহৎ ব্যক্তি একজন অন্ধ মানুষকে ফিরিয়ে দিতে পারেন পৃথিবীতে আলোর জগৎ। একজন অন্ধ মানুষ ফিরে পেতে পারে দৃষ্টিশক্তি, ফিরে পেতে পারে একটি নতুন জীবন, ফিরে পেতে পারে একটি সুস্থ জীবনের সকল সৌন্দর্যকে অনুভব ও উপলব্ধি করে জীবনকে পরিপূর্ণভাবে ভোগ করতে। আর এ ক্ষেত্রে চক্ষুদাতা এই পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকতে পারেন অন্যকে চোখ দান করার মাধ্যমে। এতে মনুষ্য জীবনও হয়ে ওঠে স্বার্থক ও সুন্দর। কর্নিয়া সংগ্রহ বাড়াতে হলে আমাদের কিছু স্বল্পমেয়াদি এবং কিছু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা: ১) হাসপাতালে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনের কাছে কর্তব্যরত চিকিৎসক নার্স এবং সংশ্লিষ্ট অন্যরা কর্নিয়ার জন্য আবেদন করা এবং হসপিটাল থেকে কর্নিয়া সংগ্রহ করে তা আই ব্যাংকে প্রেরণ করা। ২) এক্সিডেন্টাল ডেথ, যেগুলো পোস্টমর্টেম হয় সেই ধরনের ডেড বডি থেকে কর্নিয়া সংগ্রহ করার জন্য হসপিটাল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করলে প্রচুর পরিমাণে কর্নিয়া সংগ্রহ করা সম্ভব। অন্ধ ব্যক্তির চোখে তা সংযোজন করে সুন্দর পৃথিবী দেখানো সম্ভব। ৩) যারা সচেতন তারা হসপিটাল ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় মৃত ব্যক্তির পরিবারের কাছে মৃত্যুর পরে আবেদন করতে পারেন চোখের জন্য এবং তারা চোখ দিতে রাজি হলে সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংকে খবর দিতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: ১) পাঠ্যপুস্তকে আই ডোনেশন সম্পর্কে গল্প অথবা প্রবন্ধ সংযোজন করা। বিখ্যাত চক্ষুদাতাদের গল্পগুলো শোনানো যাতে করে ছোটো ছোটো কমলমতি শিশুরা বুঝতে পারে চক্ষুদান একটি ভালো ও মহৎ কাজ। ২) ড্রাইভিং লাইসেন্স, জাতীয় পরিচয়পত্র ইত্যাদিতে চক্ষুদানের বিষয়ে একটি কলাম উল্লেখ রাখা যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রয়েছে। ৩) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ইমামদের যারা ট্রেনিং করছে তাদেরকে অবহিত করা যে- মরণোত্তর চক্ষুদানে কোনো ধর্মীয় বাধা নেই এবং এই কথাটি যাতে তারা মসজিদে মসজিদে প্রচার করেন খুতবার সময়। এতে করে সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে খুব সহজভাবে নিবেন।
আইনি সহযোগিতা: ২০১৮ সালের মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনটি চক্ষুদানের ক্ষেত্রে অনেকটা সহযোগী যা মানবদেহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন ১৯৯৯ সংশোধন কল্পে প্রণীত হয়েছে। এখানে অনেককিছুই সহজীকরণ করা হয়েছে। তারপরও এক্সিডেন্টাল ডেথ যেগুলো আছে সেখানে পোস্টমর্টেমের প্রয়োজন হয় এবং এখান থেকে চোখ সংগ্রহ করার যথাযথ নিয়ম ও সহজ বিষয়গুলো যদি সংযুক্ত করা হয় তাহলে আরো অধিক কর্নিয়া সংগ্রহের পথ উন্মুক্ত ও সুগম হবে এবং এই দেশের ৫ লক্ষ কর্নিয়াজনিত মানুষ অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে দ্রুত মুক্তি পাবে।
লেখক: চিকিৎসক ও সভাপতি, সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি ও সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংক