ঢাকা ১২:৫৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫

চীনে স্টারলিংকের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরির চেষ্টার শুরুতেই বিপত্তি

  • আপডেট সময় : ০৬:৫৮:৫১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ মে ২০২৫
  • ৩ বার পড়া হয়েছে

প্রযুক্তি ডেস্ক: রাতের আকাশের দিকে তাকালে কিছু উজ্জ্বল ছোট ছোট আলোর রেখার দেখা মেলে, এগুলো নতুন পাঠানো স্টারলিংক স্যাটেলাইট। তবে শিগগিরই আরেক ধরনের স্যাটেলাইটেরও দেখা মিলবে, যেগুলো চীনের তৈরি নতুন ইন্টারনেট স্যাটেলাইট।

স্টারলিংকের মতো ইন্টারনেট পরিষেবা দিতে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথের জন্য স্যাটেলাইট তৈরি করছে চীন। সেগুলো তারা মহাকাশে পাঠিয়েছেও। গত আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত একশটির বেশি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়েছে দেশটি, যা বিশাল স্যাটেলাইট গুচ্ছের প্রথম ব্যাচ। দুইটি স্যাটেলাইট দল তৈরি করছে চীন, যার মধ্যে থাকবে মোট ২৮ হাজার স্যাটেলাইট।

চীনের দুইটি স্যাটেলাইট প্রকল্পের নাম ‘গুয়োওয়াং’ ও ‘চিয়ানফান’। তবে তাদের কর্পোরেট কাঠামো ও ভাষার পার্থক্যের কারণে ইংরেজিতে বিভিন্ন বিকল্প নামও রয়েছে এগুলোর, যা কিছুটা বিভ্রান্তিকর। প্রথম প্রকল্পটি ‘সিংওয়াং’ বা ‘স্যাটনেট’ নামেও পরিচিত, যা প্রধানত দেশীয় টেলিযোগাযোগ ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কাজ করছে।

দ্বিতীয় প্রকল্পটি ‘স্পেসসেইল’ বা এসএসএসটি নামে পরিচিত, যা বিদেশী বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানির জন্য সেবা দিতেই বেশি মনোযোগী। এখনও পর্যন্ত ব্রাজিল, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি করেছে চিয়ানফান প্রকল্পটি এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার আরো কয়েক ডজন বাজারে প্রবেশের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে সাত হাজারেরও বেশি স্যাটেলাইট রয়েছে স্টারলিংকের, তার তুলনায় চীন স্পষ্টভাবেই পিছিয়ে আছে। তবে গুয়োওয়াং ও চিয়ানফান এখন এমন এক দলে যোগ দিয়েছে যারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় স্টারলিংকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেদের কার্যক্রম বাড়িয়েছে এবং শেষমেশ এ বাজারের প্রধান প্রতিযোগীকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

নতুন আসা চীনের এসব স্যাটেলাইট কোম্পানি কিছু বিশেষ সুবিধা পেতে পারে। কারণ, মার্কিন রাজনীতির সঙ্গে ইলন মাস্কের গভীর সম্পৃক্ততার বিষয়টি তার মহাকাশ কোম্পানি স্পেসএক্স-এর স্টারলিংকের সুনাম ও নিরাপত্তার জন্য বৈশ্বিক ঝুঁকি তৈরি করছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে উইয়ার্ড।

জোনাথন ম্যাকডুয়েল, যিনি ‘স্মিথসোনিয়ান অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল অবজারভেটরি’র জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং বিশ্বজুড়ে স্যাটেলাইট গুচ্ছের ট্র্যাক রাখছেন, তিনি বলেছেন, “২০২৩ ও ২০২৪ সাল ছিল স্টারলিংক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের বছর। আর ২০২৫ সাল হলো এ বাজারে অন্যদের মাঠে নামার বছর। তবে, পশ্চিমে আমরা চীনের বাণিজ্যিক মহাকাশ শিল্প সম্পর্কে খুব কমই জানাই বা গুরুত্ব দিই।”

তবে গুয়োওয়াং ও চিয়ানফান যখন তাদের প্রথম দফার স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠাচ্ছে তখনই নানা সমস্যায় পড়েছে তারা। যার মধ্যে রয়েছে স্পেসএক্সের তুলনায় বেশি সংখ্যক ত্রুটিপূর্ণ স্যাটেলাইট, প্রশাসনিক জটিলতা ও সীমিত রকেট উৎক্ষেপণ সক্ষমতা।

শিগগিরই যদি চীন পর্যাপ্ত সংখ্যক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে না পারে তাহলে জাতিসংঘের অধীনে মহাকাশ যোগাযোগ সমন্বয় সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন’ বা আইটিইউ তাদের পরিকল্পিত স্যাটেলাইট সংখ্যা কমিয়ে আনতে বলতেও পারে।

এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য গুয়োওয়াং ও চিয়ানফানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে, উইয়ার্ডের মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি স্পেসএক্সও।

ত্রুটিপূর্ণ স্যাটেলাইট: গত মাস পর্যন্ত ৯০টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে চিয়ানফান, যা ভূমিতে থাকা ব্যবহারকারীদের জন্য ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দেবে। অন্যদিকে, গুয়োওয়াং উৎক্ষেপণ করেছে ২৯টি স্যাটেলাইট। ২০২৩ সাল থেকে গুয়োওয়াং আরো প্রায় এক ডজন পরীক্ষামূলক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। তবে সেগুলোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে খোলামেলা কিছু জানায়নি তারা এবং এসব স্যাটেলাইটকে তাদের অফিসিয়াল স্যাটেলাইটগুচ্ছের অংশ হিসেবে গণনা করছে বলে মনে হচ্ছে না।

এক্ষেত্রে চিয়ানফান কিছুটা এগিয়ে থাকলেও একটি বড় সমস্যার মুখে পড়েছে এসব স্যাটেলাইট। তাদের বিভিন্ন স্যাটেলাইটের মধ্যে তুলনামূলক বেশিরভাগ ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। আর এ বিষয়টি অন্যান্য একইরকম নানা প্রকল্পের তুলনায় উদ্বেগজনক।

স্টারলিংক নিজেদের বিভিন্ন স্যাটেলাইটের জিপিএস তথ্য প্রকাশ করলেও চীনা কোম্পানিগুলো তাদের বিভিন্ন স্যাটেলাইটের কার্যকারিতা সম্পর্কে খুব কম তথ্যই দিয়েছে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস ফোর্সের সংগ্রহ করা তথ্যের ওপর নির্ভর করছেন গবেষকরা। তারা রেডারের মাধ্যমে মহাকাশের সব বস্তুকে ট্র্যাক করে এবং সেই সংক্রান্ত কিছু তথ্য সবার জন্য উন্মুক্তও করে দেয়।

জোনাথন বলেছেন, চিয়ানফান এখন পর্যন্ত যে ৯০টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে, তার ১৩টির মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা গিয়েছে। এসব স্যাটেলাইট তাদের অন্যান্য সঙ্গীদের সঙ্গে কক্ষপথে নির্ধারিত উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। চিয়ানফানের দ্বিতীয় ব্যাচ, যা অক্টোবর ২০২৪-এ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে তাতে থাকা ১৮টি স্যাটেলাইটের মধ্যে কেবল ৫টি পরিকল্পিত উচ্চতায় পৌঁছাতে পেরেছিল।

সাংহাইয়ের স্থানীয় সরকারের তথ্য বলছে, চিয়ানফানের দ্বিতীয় দফার স্যাটেলাইটগুলো তৈরি করেছে ‘জিনস্যাট’ নামের দেশটির আলাদা এক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে এসব স্যাটেলাইটের খারাপ পারফরম্যান্সের যোগসূত্র থাকতে পারে। উৎক্ষেপণের সময় প্রকাশিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, এটি জিনস্যাটের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো গণহারে উৎপাদিত স্যাটেলাইট সাপ্লাই।

আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, চিয়ানফান ও গুয়োওয়াং প্রকল্প দুটি আক্ষরিক অর্থেই বেশি উচ্চতায় স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে। স্টারলিংকের তুলনায় এসব স্যাটেলাইটকে আরো উঁচু কক্ষপথে স্থাপন করছে তারা। ফলে যদি কোনো স্যাটেলাইট কাজ করতে না পারে তাহলে সেটিকে কক্ষপথ থেকে সরানো আরো কঠিন হয়ে পড়ছে এবং এ বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি মহাকাশ আবর্জনায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। এ দুটি প্রকল্পের স্যাটেলাইট সংখ্যা হাজার হাজার হবে তাই তাদের ব্যর্থ হওয়ার মানে, মহাকাশে ‘মৃত’ স্যাটেলাইটের ভিড় আরো বেড়ে যাওয়া।

স্টারলিংকের বিকল্প: গুয়োওয়াং ও চিয়ানফান এখন পর্যন্ত একে অপরের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতা করার বিষয়টি এড়িয়ে চলেছে। কারণ তারা ভিন্ন ভিন্ন বাজারকে টার্গেট করেছে। গুয়োওয়াং চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের বেশি সমর্থন পাচ্ছে। ফলে গুয়োওয়াং’কে জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত কাজে ব্যবহারের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।

গত মাসে প্রকাশিত ‘অ্যাটলান্টিক কাউন্সিল’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাইওয়ান গোয়েন্দা তথ্য বলছে, গুয়োওয়াং স্যাটেলাইট পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় কার্যকরভাবে কাজ করে কি না ও সম্ভাব্য মিসাইল হামলায় দিকনির্দেশনা দিতে পারে কি না-তা যাচাইয়ের চেষ্টা করছে চীনের বিভিন্ন সামরিক মহড়া।

অন্যদিকে, নিজেকে আন্তর্জাতিক বাজারে স্টারলিংকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে চিয়ানফান। চীনে অনুষ্ঠিত এক মহাকাশ শিল্প সম্মেলনে চিয়ানফানের প্রতিনিধির উপস্থাপিত এক মানচিত্রে উঠে এসেছে, এরইমধ্যে ব্রাজিল, কাজাখস্তান, মালয়েশিয়া, ওমান, পাকিস্তান ও উজবেকিস্তান অর্থাৎ ছয়টি বাজারে কাজ শুরু করেছে তারা।

ওই মানচিত্রে আরো দেখানো হয়েছে, ২০২৫ সালে আরো দুই ডজন দেশের বাজারে প্রবেশের পরিকল্পনা করছে চিয়ানফান। যার মধ্যে রয়েছে ভারত, সৌদি আরব, ইরান, আর্জেন্টিনা ও আফ্রিকার অনেক দেশ।

কিছু দেশ স্টারলিংকের ওপর মাস্কের রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও তার প্রভাব নিয়ে ক্রমাগত সন্দিহান হয়ে উঠছে। এ কারণে, আন্তর্জাতিক বাজারে সুবিধা পেতে পারে চিয়ানফান। ২০২৩ সালে ইউক্রেইনে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের মাঝখানে স্টারলিংক সেবা সীমিত করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন মাস্ক।

স্টারলিংকের নতুন স্যাটেলাইটগুলোয় এমন সুবিধা রয়েছে, যার ফলে এদের ডেটা স্থানীয় ইন্টারনেট গেটওয়ের মাধ্যমে না যেয়ে সরাসরি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে চলে যায়। এ বিষয়টি কিছু দেশকে উদ্বিগ্ন করতে পারে, বিশেষ করে যারা স্থানীয় ইন্টারনেট ডেটার ওপর আরো নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়।

একইসঙ্গে স্টারলিংকের সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছে অনেক টেলিকম কোম্পানি। কারণ, একযোগে একাধিক স্থানীয় বিক্রেতার সঙ্গে কাজ করছে স্টারলিংক, যারা পরষ্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। মালয়েশিয়ার স্যাটেলাইট যোগাযোগ কোম্পানি ‘মিয়াস্যাট’ ফেব্রুয়ারিতে চিয়ানফানের সঙ্গে প্রাথমিক এক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেটি স্টারলিংকের প্রথম পার্টনারদের একটি ছিল।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

চীনে স্টারলিংকের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরির চেষ্টার শুরুতেই বিপত্তি

আপডেট সময় : ০৬:৫৮:৫১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ মে ২০২৫

প্রযুক্তি ডেস্ক: রাতের আকাশের দিকে তাকালে কিছু উজ্জ্বল ছোট ছোট আলোর রেখার দেখা মেলে, এগুলো নতুন পাঠানো স্টারলিংক স্যাটেলাইট। তবে শিগগিরই আরেক ধরনের স্যাটেলাইটেরও দেখা মিলবে, যেগুলো চীনের তৈরি নতুন ইন্টারনেট স্যাটেলাইট।

স্টারলিংকের মতো ইন্টারনেট পরিষেবা দিতে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথের জন্য স্যাটেলাইট তৈরি করছে চীন। সেগুলো তারা মহাকাশে পাঠিয়েছেও। গত আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত একশটির বেশি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠিয়েছে দেশটি, যা বিশাল স্যাটেলাইট গুচ্ছের প্রথম ব্যাচ। দুইটি স্যাটেলাইট দল তৈরি করছে চীন, যার মধ্যে থাকবে মোট ২৮ হাজার স্যাটেলাইট।

চীনের দুইটি স্যাটেলাইট প্রকল্পের নাম ‘গুয়োওয়াং’ ও ‘চিয়ানফান’। তবে তাদের কর্পোরেট কাঠামো ও ভাষার পার্থক্যের কারণে ইংরেজিতে বিভিন্ন বিকল্প নামও রয়েছে এগুলোর, যা কিছুটা বিভ্রান্তিকর। প্রথম প্রকল্পটি ‘সিংওয়াং’ বা ‘স্যাটনেট’ নামেও পরিচিত, যা প্রধানত দেশীয় টেলিযোগাযোগ ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কাজ করছে।

দ্বিতীয় প্রকল্পটি ‘স্পেসসেইল’ বা এসএসএসটি নামে পরিচিত, যা বিদেশী বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানির জন্য সেবা দিতেই বেশি মনোযোগী। এখনও পর্যন্ত ব্রাজিল, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি করেছে চিয়ানফান প্রকল্পটি এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার আরো কয়েক ডজন বাজারে প্রবেশের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।

পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে সাত হাজারেরও বেশি স্যাটেলাইট রয়েছে স্টারলিংকের, তার তুলনায় চীন স্পষ্টভাবেই পিছিয়ে আছে। তবে গুয়োওয়াং ও চিয়ানফান এখন এমন এক দলে যোগ দিয়েছে যারা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় স্টারলিংকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেদের কার্যক্রম বাড়িয়েছে এবং শেষমেশ এ বাজারের প্রধান প্রতিযোগীকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারে।

নতুন আসা চীনের এসব স্যাটেলাইট কোম্পানি কিছু বিশেষ সুবিধা পেতে পারে। কারণ, মার্কিন রাজনীতির সঙ্গে ইলন মাস্কের গভীর সম্পৃক্ততার বিষয়টি তার মহাকাশ কোম্পানি স্পেসএক্স-এর স্টারলিংকের সুনাম ও নিরাপত্তার জন্য বৈশ্বিক ঝুঁকি তৈরি করছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে উইয়ার্ড।

জোনাথন ম্যাকডুয়েল, যিনি ‘স্মিথসোনিয়ান অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল অবজারভেটরি’র জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং বিশ্বজুড়ে স্যাটেলাইট গুচ্ছের ট্র্যাক রাখছেন, তিনি বলেছেন, “২০২৩ ও ২০২৪ সাল ছিল স্টারলিংক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের বছর। আর ২০২৫ সাল হলো এ বাজারে অন্যদের মাঠে নামার বছর। তবে, পশ্চিমে আমরা চীনের বাণিজ্যিক মহাকাশ শিল্প সম্পর্কে খুব কমই জানাই বা গুরুত্ব দিই।”

তবে গুয়োওয়াং ও চিয়ানফান যখন তাদের প্রথম দফার স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠাচ্ছে তখনই নানা সমস্যায় পড়েছে তারা। যার মধ্যে রয়েছে স্পেসএক্সের তুলনায় বেশি সংখ্যক ত্রুটিপূর্ণ স্যাটেলাইট, প্রশাসনিক জটিলতা ও সীমিত রকেট উৎক্ষেপণ সক্ষমতা।

শিগগিরই যদি চীন পর্যাপ্ত সংখ্যক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে না পারে তাহলে জাতিসংঘের অধীনে মহাকাশ যোগাযোগ সমন্বয় সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন’ বা আইটিইউ তাদের পরিকল্পিত স্যাটেলাইট সংখ্যা কমিয়ে আনতে বলতেও পারে।

এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য গুয়োওয়াং ও চিয়ানফানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে, উইয়ার্ডের মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি স্পেসএক্সও।

ত্রুটিপূর্ণ স্যাটেলাইট: গত মাস পর্যন্ত ৯০টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে চিয়ানফান, যা ভূমিতে থাকা ব্যবহারকারীদের জন্য ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দেবে। অন্যদিকে, গুয়োওয়াং উৎক্ষেপণ করেছে ২৯টি স্যাটেলাইট। ২০২৩ সাল থেকে গুয়োওয়াং আরো প্রায় এক ডজন পরীক্ষামূলক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে। তবে সেগুলোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে খোলামেলা কিছু জানায়নি তারা এবং এসব স্যাটেলাইটকে তাদের অফিসিয়াল স্যাটেলাইটগুচ্ছের অংশ হিসেবে গণনা করছে বলে মনে হচ্ছে না।

এক্ষেত্রে চিয়ানফান কিছুটা এগিয়ে থাকলেও একটি বড় সমস্যার মুখে পড়েছে এসব স্যাটেলাইট। তাদের বিভিন্ন স্যাটেলাইটের মধ্যে তুলনামূলক বেশিরভাগ ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। আর এ বিষয়টি অন্যান্য একইরকম নানা প্রকল্পের তুলনায় উদ্বেগজনক।

স্টারলিংক নিজেদের বিভিন্ন স্যাটেলাইটের জিপিএস তথ্য প্রকাশ করলেও চীনা কোম্পানিগুলো তাদের বিভিন্ন স্যাটেলাইটের কার্যকারিতা সম্পর্কে খুব কম তথ্যই দিয়েছে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের স্পেস ফোর্সের সংগ্রহ করা তথ্যের ওপর নির্ভর করছেন গবেষকরা। তারা রেডারের মাধ্যমে মহাকাশের সব বস্তুকে ট্র্যাক করে এবং সেই সংক্রান্ত কিছু তথ্য সবার জন্য উন্মুক্তও করে দেয়।

জোনাথন বলেছেন, চিয়ানফান এখন পর্যন্ত যে ৯০টি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছে, তার ১৩টির মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা গিয়েছে। এসব স্যাটেলাইট তাদের অন্যান্য সঙ্গীদের সঙ্গে কক্ষপথে নির্ধারিত উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। চিয়ানফানের দ্বিতীয় ব্যাচ, যা অক্টোবর ২০২৪-এ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে তাতে থাকা ১৮টি স্যাটেলাইটের মধ্যে কেবল ৫টি পরিকল্পিত উচ্চতায় পৌঁছাতে পেরেছিল।

সাংহাইয়ের স্থানীয় সরকারের তথ্য বলছে, চিয়ানফানের দ্বিতীয় দফার স্যাটেলাইটগুলো তৈরি করেছে ‘জিনস্যাট’ নামের দেশটির আলাদা এক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে এসব স্যাটেলাইটের খারাপ পারফরম্যান্সের যোগসূত্র থাকতে পারে। উৎক্ষেপণের সময় প্রকাশিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, এটি জিনস্যাটের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো গণহারে উৎপাদিত স্যাটেলাইট সাপ্লাই।

আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, চিয়ানফান ও গুয়োওয়াং প্রকল্প দুটি আক্ষরিক অর্থেই বেশি উচ্চতায় স্যাটেলাইট পাঠাচ্ছে। স্টারলিংকের তুলনায় এসব স্যাটেলাইটকে আরো উঁচু কক্ষপথে স্থাপন করছে তারা। ফলে যদি কোনো স্যাটেলাইট কাজ করতে না পারে তাহলে সেটিকে কক্ষপথ থেকে সরানো আরো কঠিন হয়ে পড়ছে এবং এ বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি মহাকাশ আবর্জনায় পরিণত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। এ দুটি প্রকল্পের স্যাটেলাইট সংখ্যা হাজার হাজার হবে তাই তাদের ব্যর্থ হওয়ার মানে, মহাকাশে ‘মৃত’ স্যাটেলাইটের ভিড় আরো বেড়ে যাওয়া।

স্টারলিংকের বিকল্প: গুয়োওয়াং ও চিয়ানফান এখন পর্যন্ত একে অপরের সঙ্গে সরাসরি প্রতিযোগিতা করার বিষয়টি এড়িয়ে চলেছে। কারণ তারা ভিন্ন ভিন্ন বাজারকে টার্গেট করেছে। গুয়োওয়াং চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের বেশি সমর্থন পাচ্ছে। ফলে গুয়োওয়াং’কে জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত কাজে ব্যবহারের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।

গত মাসে প্রকাশিত ‘অ্যাটলান্টিক কাউন্সিল’-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাইওয়ান গোয়েন্দা তথ্য বলছে, গুয়োওয়াং স্যাটেলাইট পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় কার্যকরভাবে কাজ করে কি না ও সম্ভাব্য মিসাইল হামলায় দিকনির্দেশনা দিতে পারে কি না-তা যাচাইয়ের চেষ্টা করছে চীনের বিভিন্ন সামরিক মহড়া।

অন্যদিকে, নিজেকে আন্তর্জাতিক বাজারে স্টারলিংকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছে চিয়ানফান। চীনে অনুষ্ঠিত এক মহাকাশ শিল্প সম্মেলনে চিয়ানফানের প্রতিনিধির উপস্থাপিত এক মানচিত্রে উঠে এসেছে, এরইমধ্যে ব্রাজিল, কাজাখস্তান, মালয়েশিয়া, ওমান, পাকিস্তান ও উজবেকিস্তান অর্থাৎ ছয়টি বাজারে কাজ শুরু করেছে তারা।

ওই মানচিত্রে আরো দেখানো হয়েছে, ২০২৫ সালে আরো দুই ডজন দেশের বাজারে প্রবেশের পরিকল্পনা করছে চিয়ানফান। যার মধ্যে রয়েছে ভারত, সৌদি আরব, ইরান, আর্জেন্টিনা ও আফ্রিকার অনেক দেশ।

কিছু দেশ স্টারলিংকের ওপর মাস্কের রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও তার প্রভাব নিয়ে ক্রমাগত সন্দিহান হয়ে উঠছে। এ কারণে, আন্তর্জাতিক বাজারে সুবিধা পেতে পারে চিয়ানফান। ২০২৩ সালে ইউক্রেইনে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের মাঝখানে স্টারলিংক সেবা সীমিত করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন মাস্ক।

স্টারলিংকের নতুন স্যাটেলাইটগুলোয় এমন সুবিধা রয়েছে, যার ফলে এদের ডেটা স্থানীয় ইন্টারনেট গেটওয়ের মাধ্যমে না যেয়ে সরাসরি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে চলে যায়। এ বিষয়টি কিছু দেশকে উদ্বিগ্ন করতে পারে, বিশেষ করে যারা স্থানীয় ইন্টারনেট ডেটার ওপর আরো নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়।

একইসঙ্গে স্টারলিংকের সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছে অনেক টেলিকম কোম্পানি। কারণ, একযোগে একাধিক স্থানীয় বিক্রেতার সঙ্গে কাজ করছে স্টারলিংক, যারা পরষ্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। মালয়েশিয়ার স্যাটেলাইট যোগাযোগ কোম্পানি ‘মিয়াস্যাট’ ফেব্রুয়ারিতে চিয়ানফানের সঙ্গে প্রাথমিক এক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যেটি স্টারলিংকের প্রথম পার্টনারদের একটি ছিল।