সাহিত্য ডেস্ক : মানুষের আগুনের ব্যবহার আবিষ্কারের মতোই ছাপাখানা আবিষ্কার এক মহাযুগান্তকারী ঘটনা। আজকের পৃথিবীতে চিন্তার আদান-প্রদান, খবরাখবর, শিক্ষা ও আনন্দ বিতরণের জন্য ফিল্ম, রেডিও, টেলিভিশন, ভিডিও থেকে শুরু করে ভাচুর্য়াল ‘মাধ্যম’ উদ্ভাবনের নেপথ্যেও ছাপাখানার সবচাইতে বড় অবদান রয়েছে। আজকাল আমরা ছাপাখানা বলতে বুঝি অফসেট প্রিন্টিং মেশিন, যা কম্পিউটারের সাহায্যে পরিচালিত হয়। মাত্র কয়েক দশক আগেও ছিল লেটার প্রেস, অর্থাৎ ধাতুর তৈরি অক্ষর, ব্লক ইত্যাদি দিয়ে ছাপা লেখা ও ছবি।
ইউরোপে ১৫০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই ধরনের ছাপার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু ছাপার মূল কথা কীভাবে ছাপা হচ্ছে, তা নয়। মৌলিক অর্থে ছাপা হলো একটি লেখা বা একটি ছবির এক বা ততোধিক প্রতিরূপ করা। এভাবে দেখলে ছাপার ইতিহাস প্রায় ১২০০ বছরের পুরনো।
বারুদ, রেশম, চা, পোর্সেলেন ইত্যাদির মতো কাগজ, ছাপা আর কালি আবিষ্কারের কৃতিত্ব চীনের। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় সোয়া দুই হাজার বছর আগে কাগজ আবিষ্কৃত হয়। চীন দেশে ছাপার কাজ শুরু হয় কাঠ-খোদাই দিয়ে। একটা চৌকো ধরনের কাঠের ওপর লেখা বা ছবি কুঁদে তাতে কালি মাখিয়ে সম্ভবত রোলার দিয়ে ঘষে কাগজের ওপর ছাপা হতো। এভাবে চীনে এক-রঙা ছবি প্রথম ছাপা হয় তাং রাজত্বকালে (৬১৮-৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে)। কাঠ-খোদাই দিয়ে পৃথিবীর প্রথম বই ছাপা হয় ৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। বইটি ‘হীরকসূত্র’ নামে বৌদ্ধ ধর্মগ্রম্হের চীনা অনুবাদ, মুদ্রাকরের নাম ওয়াং চিয়েহ্। চীন থেকে কাঠ-খোদাই প্রথম জাপানে যায়। জাপানে প্রথম ছাপা বইয়ের নাম ‘ধরণীসূত্র’। কাঠ-খোদাইয়ে ছাপা ব্যাপকভাবে চালু হওয়ার পর চীনা মুদ্রাকররা ছাপার নতুন প্রণালী নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। ১০৪০ থেকে ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মাটির ছাঁচে তৈরি ‘মুভেবল’ বা অদল-বদল করা যায় এমন আলাদা আলাদা অক্ষর দিয়ে ছাপার কায়দা বের করেন পি-সেঙ। এর পরে মাটির তৈরি অক্ষরের বদলে এই ধরনের কাঠের অক্ষর দিয়ে কিছু কিছু ছাপা হয়। ছাপার ইতিহাসে এই চেষ্টা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হলেও এই কৌশলকে তখন কাজে লাগানো যায়নি। তার কারণ লাতিন বর্ণমালার মতো অল্পসংখ্যক অক্ষর ও সাংকেতিক চিহ্নের জায়গায় চীনা ভাষায় হাজার হাজার ইডিওগ্রাম বা ছবির বর্ণমালা ব্যবহৃত হতো। বলা বাহুল্য, এই ধরনের বর্ণমালাকে আলাদা আলাদা করে কেটে তখন কেন—এখনো কাজে লাগানো সম্ভব নয়। কেউ কেউ অবশ্য বলেন ১৪০৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই ব্রোঞ্জের মুভেবল টাইপ চীনে আবিষ্কৃত হয়েছিল।
চীন, জাপান, কোরিয়া, তিব্বত ও নেপাল বাদ দিলে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের আর কোনো জায়গায় আধুনিক ছাপাখানা আসার আগে ছাপা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। এসব দেশে সমানে হাতে লেখা পুঁথি চলে আসছিল। মহেঞ্জোদারোর সীলের কথা ছেড়ে দিলেও আমাদের দেশে কাপড়ের ওপর ছাপা অনেক দিনের ব্যাপার। মঙ্গলকাব্যে গুজরাটি ছিটের কথা শোনা যায়। চিনংজ (অর্থাৎ ছাপা ক্যালিকো, গুজরাটি ছিট শব্দের ইংরেজি অপভ্রংশ) কথাটা ইংরেজি অভিধানে ১৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢোকে। নামাবলীর বয়স আমাদের জানা নেই। এটা সত্য কাগজ আমাদের দেশে আসার আগে ভোজপাতা, তালপাতা বা গাছের ছালের ওপর কাঠ-খোদাই দিয়ে ছাপা সম্ভব ছিল না। কিন্তু কাগজও তো ভারতীয় উপমহাদেশে কম দিন আগে আসেনি। সবচেয়ে পুরনো কাগজে জৈন পুঁথি ১৪২৭ খ্রিষ্টাব্দে লেখা হয়; তারিখ না দেওয়া পুঁথির কিছু কিছু আরো পুরনো হওয়াও অসম্ভব নয়। মুঘলদের সময় থেকে লেখা ও আঁকার জন্য কাগজের ব্যবহার বাড়ে, অথচ আশ্চর্যের কথা কাঠ-খোদাই দিয়ে কাগজে ছাপার কথা এদেশে কেউ ভাবল না। হাতে ধর্মগ্রন্থ লিখলে পুণ্য হয়, এই মনোভাব ছাপার প্রতিবন্ধক ছিল বলে অনেকে মনে করেন। ইউরোপেও ছাপার আগে সেই মনোভাব ছিল এবং ছাপা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা একেবারে দূর হয়ে যায়নি।
ইউরোপে ছাপা শুরু ও প্রসারের কথা বলার আগে চীন থেকে কী করে কাগজ পৃথিবীর নানান দেশে ছড়িয়ে পড়ে তাও সংক্ষেপে জানা দরকার। ৭১০ খ্রিষ্টাব্দে আরবরা চীনাদের কাছ থেকে সমরকন্দ দখল করার পর কিছ্ ুচীনা সৈনিককে বন্দি করে নিজেদের দেশে নিয়ে যায়। এই বন্দিদের মধ্যে কয়েকজন কাগজ তৈরির কলাকৌশল জানত। আরবরা তাদের কাছ থেকে বিদ্যাটা শিখে নেয়। আজ পর্যন্ত সবচেয়ে পুরনো আরবি কাগজের পুঁথি যা পাওয়া গেছে তা প্রায় সাড়ে এগারো শ বছর আগে লেখা। আরব দেশ থেকে কাগজ প্রথম গ্রিসে যায়। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের মধ্যে আরবের সঙ্গে স্পেনের সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল। তাই আরবদের মারফত কাগজ তৈরির কায়দা স্পেনে ১২০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে যায়। এর কিছু পরে ফ্রান্সে কাগজ তৈরি শুরু হয়। ইতালিতে কাগজ যায় ১২৭৬ খ্রিষ্টাব্দে, জার্মানিতে ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি। এর কিছু পরে ইউরোপের অন্যান্য দেশ ও ইংল্যান্ডে কাগজ তৈরি ও কাগজের ব্যবহার শুরু হয়। এর পর ক্রমশ পার্চমেন্ট, ভেলাম ও অন্যান্য ধরনের দামি পালিশ করা চামড়ার বদলে পুঁথি লেখার জন্য কাগজের ব্যবহার বাড়তে থাকে।
কাগজের ব্যবহার চালু হওয়ায় ইউরোপে আধুনিক রীতিতে ছাপার আবিষ্কারের পথ উজ্জ্বল হয়। চীনের মতো ইউরোপেও কাঠ-খোদাই দিয়ে ছাপার সূত্রপাত হয় ১৫০০ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। ইউরোপে কাঠ-খোদাইয়ের সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন হলো খেলার তাস। এর পর এলো এক পাতার ইস্তেহার আর ছবি। এই ধরনের সবচেয়ে পুরনো তারিখ দেওয়া ছবি ১৪২৩ খ্রিষ্টাব্দে ছাপা হয়। এখানে বলা দরকার ইউরোপের প্রথম ‘ব্লকবুক’ বা কাঠ-খোদাইয়ে ছাপা বই ধাতুর অক্ষরে ছাপা বইয়ের পরে বেরোয়। ১৪৫৪-৫৫ খ্রিষ্টাব্দ মানুষের ইতিহাসে অবিস্মরণীয়, কারণ এই সময়ে আধুনিক প্রণালীতে ছাপার কৌশলের জন্ম বলে ধরা হয়।
এ কথা আজ প্রায় সর্বজন স্বীকৃত যে আধুনিক ছাপার জনক জোহান গুটেনবার্গ। তিনি সত্যিই বলতে পারতেন—‘ছাব্বিশটি ধাতুর তৈরি সৈন্য নিয়ে আমি পৃথিবী জয় করেছি।’ গুটেনবার্গ ১৩১৫ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানির মেনজ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পেশায় স্বর্ণকার ছিলেন। ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি তিনি মেনজে তাঁর ছাপাখানা খোলেন এবং প্রথম তিন-চার বছরে তিনি কিছু ধমীর্য় ইস্তেহার ছাপেন। তারপর ১৪৫৪-৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর ভুবন-বিখ্যাত ‘গুটেনবার্গ বাইবেল’ ছাপান—যা আধুনিক মুদ্রণশিল্পের সূচক বলে ধরা হয়।
চিন্তাকে অক্ষর-বন্দি করার বিবর্তনধারা
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ