নিজস্ব প্রতিবেদক : সরকার যে দর বেঁধে দিয়েছে, ব্যবসায়ীরা চিনি বিক্রি করছেন তার চেয়ে বেশি দামে; তারপরও রাজধানীর বাজারগুলোতে তৈরি হয়েছে ‘চিনির সংকট’। রাজধানীর মিরপুর, কারওয়ানবাজার, সেগুনবাগিচাসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অনেক মুদি দোকানেই চিনি নেই। আবার যাদের কাছে আছে, তারা প্রতি কেজি বিক্রি করছেন ১১০ টাকা দরে। কারওয়ান বাজারের আনছার মাঝি স্টোরের একজন বিক্রয়কর্মী সরাসরিই বললেন, “সম্ভবত কোম্পানিগুলো চিনির দাম বাড়াবে। সে কারণে প্যাকেট চিনিসহ সবধরনের চিনির সাপ্লাই কমিয়ে দিয়েছে।” দাম বাড়ানোর ইচ্ছার কথা আগেই জানিয়ে রেখেছে চিনি আমদানিকারক ও পরিশোধনকারীরা। তাদের ভাষ্য, এলসি খোলার জটিলতায় আমদানি কমে গেছে, ডলারের উচ্চমূল্যে বেড়েছে আমদানি খরচ। আবার গ্যাস সংকটে কমেছে উৎপাদন। সব মিলিয়েই বাজারে টান পড়েছে। কারওয়ান বাজারের বেশিরভাগ দোকানে বৃহস্পতিবার প্যাকেটজাত চিনি পাওয়া যায়নি। কিছু দোকানে খোলা চিনি থাকলেও দাম নেওয়া হচ্ছে প্রতি কেজি ৯৫ টাকা। সেগুনবাগিচার ভাই ভাই স্টোরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্যাকেট ও খোলা চিনি দুটোই তারা ১১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। প্যাকেট চিনির গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য কত লেখা আছে জানতে চাইলে ওই দোকানের একজন কর্মী বলেন, “আমার কাছে প্যাকেট চিনি আর নেই। কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়ে গেছে।” সরকার নির্ধারিত সর্বশেষ মূল্য অনুযায়ী, প্রতি কেজি খোলা চিনি ৮৪ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ৮৯ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু রিফাইনার্সরা চলতি মাসের শুরুতেই প্রতিকেজি খোলা চিনি ৯০ টাকা ও প্যাকেট চিনি ৯৫ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন ট্যারিফ কমিশনে।
বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও দেশবন্ধু চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, “আমরা সরকারের কাছে বারবার ধরনা দিয়েও সমস্যার সমাধান পাচ্ছি না। বাজারে চিনির সরবরাহ কিছুটা কম আছে। তবে সরকার নির্ধারিত দামেই চিনি দেওয়ার চেষ্টা করছি। এতে আমাদের লোকসান হচ্ছে।” গোলাম রহমান বললেন, “চিনি নিয়ে কী হচ্ছে আমরা বুঝতে পারছি না। ব্যাংকগুলো এলসি করতে রাজি হচ্ছে না। একটা জাহাজে কম করে হলেও ২৭ মিলিয়ন থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলারের এলসি খুলতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, তিন মিলিয়ন ডলারের বেশি এলসি খোলা যাবে না। “সে ক্ষেত্রে আমাদের পরপর নয়টি এলসি খুলতে হচ্ছে। ডলার কিনতে হচ্ছে ১০৫ টাকা দরে। এখনও এক কেজি চিনিতে ৩২ টাকা শুল্ক দিতে হয়। আমরা এই শুল্ক কমাতে বলেছিলাম। আমরা লোকসান দিতে দিতে একেবারে তলানিতে এসে নেমেছি।” দশে বছরে ২৫ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। দেশীয় চিনিকলগুলো এক লাখ টনের মতো চিনি উৎপাদন করতে পারে, চাহিদার বাকি চিনি আসে বিদেশ থেকে। ব্রাজিল, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়া থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে মিল মালিকরা তা পরিশোধন করে বাজারে সরবরাহ করেন। চলমান সংকটের কারণে গত এক বছরে ১০ লাখ টন চিনি কম আমদানি হয়েছে বলে সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির ভাষ্য।
অথচ জাহাজে পণ্য পরিবহনের খরচ কমে গতবছরের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে বলে ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। সেই সুফল ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে না। সরকারের বিপণন সংস্থা টিসিবির হিসাবে দেশে চিনির দাম এক বছরে ১৯.৫০ শতাংশ বেড়েছে।
মূলত মিল থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার কারণেই বাজারে চিনির সঙ্কট দেখা দিয়েছে বলে জানালেন পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে পাইকারি ব্যবসায়ী আবুল হাসেম।
তিনি বলেন, “গত এক সপ্তাহ ধরে চিনির সরবরাহ কম। সে কারণে দামও একটু বেড়েছে। পাইকারি বাজারে খোলা চিনি প্রতি কেজি ৯৫ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।”
আর যোগান কমার কারণ হিসেবে সরবরাহীরা বললেন ‘নানামুখী চাপের’ কথা।
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, “সম্প্রতি চিনি শিল্প অনেকগুলো সঙ্কট মোকাবেলা করছে। এলসি ওপেন করা যাচ্ছে না, ডলারের অনেক উচ্চমূল্য এগুলোতে আছেই। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সঙ্কট হচ্ছে পরিশোধন ইউনিটে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়া।
“গ্যাস না থাকার কারণে প্রায় সবগুলো মিলেরই কর্মঘণ্টা কমে ছয় ঘণ্টায় নেমে এসেছে। অথচ এই চিনিকলগুলো আগে ২৪ ঘণ্টায় উৎপাদনে থাকত। গ্যাসের সমস্যার সমাধান না হলে চিনির সরবরাহ স্বাভাবিক করা যাবে না।” গ্যাসের সঙ্কটের কারণে গত একমাস ধরেই চিনি উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, “সারা দিনে মোটের ওপর ছয় ঘণ্টা গ্যাস পাচ্ছি কারখানা চালাতে। সরকার গ্যাস নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো ফল আসছে না। আমরা বলেছি এভাবে গ্যাস আসা যাওয়ার কারণে আমাদের কাঁচামাল নষ্ট হচ্ছে, ইঞ্জিনের ক্ষতি হচ্ছে। “সেজন্য আমরা প্রস্তাব করেছি যে, প্রয়োজনে এক সপ্তাহ টানা গ্যাস দিয়ে এক সপ্তাহ বন্ধ রাখা হোক। আগে যেখানে দৈনিক তিন হাজার থেকে ৩২০০ টন চিনি সরবরাহ করা যেত, সেখানে এখন এক হাজার থেকে ১২০০ টন দেওয়া যাচ্ছে।” দেশবন্ধু চিনি কলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, সরকার এখন যে দাম নির্ধারণ করেছে, সেটাও ‘যথাযথ হয়নি’। “আমরা বার বার সরকারকে বলছি যে, সব খরচ বিশ্লেষণ করে চিনির একটা সঠিক মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হোক। কিন্তু সরকারের দিক থেকে কোনো দাবিই পূরণ করা হচ্ছে না। এখন প্রতি কেজিতে যে ৩২ টাকা করে শুল্ক দিতে হচ্ছে, সেখান থেকেও কমাতে পারে।
চিনির বাজারে সঙ্কট
ট্যাগস :
জনপ্রিয় সংবাদ