ঢাকা ০৬:০৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

চা বাগানের শিশুদের আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন

  • আপডেট সময় : ১১:৪৭:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২২
  • ৯৬ বার পড়া হয়েছে

দারিদ্র্যের চক্করে চা শ্রমিকদের সন্তানরা সাধারণত বড় হয়ে মা-বাবার মত চায়ের কুড়ি ছেঁড়াকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয়। মা-বাবাকে সাহায্য করতে গিয়ে অল্প বয়সেই শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে।
জাগোর এই স্কুলের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাত বছর আগে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সুরমা চা বাগানের স্কুলটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩০০ জন; ঝরে পড়ার হার প্রায় শূন্যের কোটায়। এখানে শিশুরা পড়াশোনা করে বিনামূল্যে। দুপুরের খাবার, বই-খাতা-কলমসহ পাঠ্য সামগ্রীর জন্যও টাকা লাগে না।
জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান করভী রাখসান্দ বললেন, “হবিগঞ্জে চা শ্রমিকদের শিশুদের স্কুলে গিয়ে পড়াশোনার সুযোগ খুব কম। সে কারণেই আমরা তাদের বেছে নিয়েছি। সিলেবাস হিসাবে নিয়েছি সরকারের এনসিটিবির ইংলিশ ভার্সন বইগুলো। কারণ গতানুগতিক শিক্ষার চেয়ে ভবিষ্যৎমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষাকে আমরা প্রাধান্য দিতে চেয়েছি, যাতে তারা দুই একটা ডিগ্রি নেওয়ার পর আবার চাকরির অনিশ্চয়তায় না পড়ে।”
ইংরেজিকে কেন শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বেছে নেওয়া হল? করভীর উত্তর: “আমরা চিন্তা করেছি বাংলা মাধ্যমের চেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করলে চাকরি পাওয়াটা তুলনামূলক সহজ। বর্তমানে চাকরির সংকট থাকলেও একজন ইংরেজি জানা লোক আর যাই হোক বেকার থাকবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। এছাড়া কখনও যদি তাদের ইচ্ছে হয়, পড়াশোনা করে বাংলাদেশ থেকে বাইরে যাবে, এই ইংরেজি সেখানেও তাদের সহযোগিতা করবে।“
হবিগঞ্জ জেলাজুড়ে ছোট-বড় ২৪টি চা বাগান রয়েছে। জাগোর ওই স্কুলটি জেলার সবচেয়ে বড় চা বাগান সুরমা টি এস্টেটে। দেশের ১০ জেলায় জাগোর এই মডেলের মোট ১১টি ডিজিটাল স্কুলে পড়ালেখা করছে প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থী।
শুরুটা কীভাবে? শহরাঞ্চলের ভালো শিক্ষক দিয়ে ডিজিটাল কানেক্টিভিটির মাধ্যমে যুক্ত হয়ে প্রান্তিক অঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মানসম্মত শিক্ষার আওতায় আনার যাত্রাটা নিজেই বর্ণনা করলেন করভী। “গত ১৫ বছর ধরে জাগো ফাউন্ডেশন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করছে। ঢাকার বস্তি এলাকায় আমাদের যাত্রা শুরু। তারপর আমরা দেখলাম ঢাকার বাইরেও সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে।
“ঢাকার বাইরে কাজ করতে এসে আমরা দেখলাম, যোগ্য শিক্ষকের অভাবে সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গুণগত শিক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। সেখান থেকেই আমরা অনলাইন স্কুলের ধারণাটা প্রয়োগ করলাম।” এসব স্কুলে শ্রেণিকক্ষের মনিটরের সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে ঢাকার দক্ষ শিক্ষকদের যুক্ত করা হয়। তারা সামনাসামনি ক্লাসের মতই ঢাকা থেকে সরাসরি ক্লাস নেন। তাছাড়া শ্রেণিকক্ষেও সহযোগিতা করার জন্য একজন শিক্ষক থাকেন। ক্লাসের ভিডিও রেকর্ড করে শিক্ষার্থীদের দেখানো হলে তাতে তাদের ‘মনের খোরাক মেটে না’ বলেই মনে করেন করভী। তিনি বলেন, শিক্ষক উপস্থিত থাকলে শিক্ষার্থীরা নিজের প্রয়োজন মত প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারে, সে সুযোগ ভার্চুয়াল ক্লাসে মিলছে। “এই প্রক্রিয়ায় আমরা চেয়েছি, শুধু চা বাগানে নয়, যতটুকু সম্ভব প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে যেন এই কাজগুলো আমরা করতে পারি। শিশু শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আপাতত আমরা- আমাদের স্কুলে পড়াশোনা করাচ্ছি। “উচ্চ মাধ্যমিক ও ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে তারা অন্যান্য জায়গায় চলে যায়। কিন্তু খরচ আমরা বহন করি।” এত শিক্ষার্থীর খরচ কোথা থেকে মেটে? করভী জানালেন, এজন্য তারা প্রচলিত পদ্ধতিতে ফান্ড কালেকশন করেন না। বরং কয়েকভাবে এই খরচগুলো বহন করা হয়। “আমরা একেকজন শিক্ষার্থীর বছরের খরচের জন্য দাতা খুঁজে বের করি। একজন দাতা ১০/১৫ জন শিক্ষার্থীর খরচ বহন করার দায়িত্ব নিয়েছে- এমন ঘটনাও আছে।”
স্কুল অবকাঠামো নির্মাণ, আধুনিক সুযোগ সুবিধা স্থাপনের ক্ষেত্রে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল থেকে অর্থ নেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
“এখন আমরা যে ডিজিটাল ক্লাসের সুবিধাটা দেখছি, এর খরচ এখন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বহন করছে। পরে আবার আমরা হয়ত অন্য কোনো কোম্পানিকে বেছে নেব দাতা হিসাবে। এভাবেই আমরা কাজগুলো এগিয়ে নিচ্ছি। “ঢালাওভাবে অনুদান না নিয়ে প্রজেক্ট সৃষ্টি করে, সে অনুযায়ী বাজেট করে, সেই বাজেট অনুযায়ী আমরা অনুদান নিচ্ছি। ফলে আমাদের কাজগুলো সহজ হয়ে যাচ্ছে।”
বড় স্বপ্ন, বড় আশা: সুরমা চা বাগানে জাগো ফাউন্ডেশনের স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে উঠে এল তাদের স্বপ্নের কথা। কেউ প্রকৌশলী, কেউ চিকিৎসক, কেউ পুলিশ কর্মকর্তা, আবার কেউ পাইলট হতে চাইল। বিদেশে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নের কথাও এল কারও কারও কথায়। জাগো ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তা কারভী বলছিলেন, “বিদেশে উচ্চ শিক্ষা এখন আর স্বপ্নের পর্যায়ে নেই। ইতোমধ্যে আমাদের এক শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। সে এখন যুক্তরাষ্ট্রেই অবস্থান করছে। “আমাদের কিছু শিক্ষার্থীকে প্রথম দিন যখন ‘ভবিষ্যতে কী হতে চাও’ জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাদের কেউ কেউ বলেছিল ‘রিকশাচালক হতে চাই’। এখন তাদেরই একজন আমেরিকায় পাইলট হওয়ার জন্য পড়াশোনা করছে। শিক্ষা একজন মানুষের চিন্তাধারায় কতটা পরিবর্তন আনতে পারে, এটা তারই একটা উদাহরণ।”
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের কান্ট্রি হেড বিটপী দাশ চৌধুরী বলেন, “ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে যোগাযোগ দক্ষতাটা খুব বেশি দরকার হয়। আজকে বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে হলে শুধু বাংলা জানলে হবে না, ইংরেজিটাও ভালোভাবে জানা থাকা লাগে।
“আমাদের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা যেন অর্থের অভাবে ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে না থাকে, সেজন্যই ইংরেজি সংস্করণের বই দিয়ে তাদের পড়ানো হচ্ছে।” প্রান্তিক জনপদে ডিজিটাল স্কুল বাস্তবায়নে ব্যক্তির যেমন অবদান আছে, তেমনই প্রতিষ্ঠানেরও ভূমিকা রয়েছে মন্তব্য করে জাগো ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কারভী বলেন, “এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চ্যার্টার্ড ব্যাংক অন্যতম, যাদের সঙ্গে আমরা গত ১২ বছর ধরে কাজ করছি। ১১টি অনলাইন স্কুলে মনিটর হতে শুরু করে ইন্টারনেট কানেকশন- সব ধরনের অবকাঠামোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে স্ট্যান্ডার্ড চ্যার্টার্ড। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন মত লেখার খাতাপত্রও সরবরাহ করছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।”
‘আমরা এখন শুদ্ধ বাংলা, কিছু কিছু ইংরেজি জানি’: চা বাগানে এ ধরনের একটি স্কুলে নিজের সন্তানকে পড়ালেখা করাতে পেরে বেশ উচ্ছ্বসিত অভিভাবকরা। তাদের একজন প্রদীপ কৈরি জানালেন, তার সন্তান প্রবীণ কৈরি এখন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। “পাঁচ বছর ধরে আমার ছেলে এখানে পড়ে। আমরা আসলেই ভাগ্যবান। এই রকম একটি স্কুল আমরা উপহার পেয়েছি। এরকম স্কুল হবিগঞ্জের কোনো চা বাগানে নেই। আমার ছেলে অনেক ভালো করছে। আগে আমরা ইংরেজি তো দূরে থাক, ভালোভাবে বাংলাও বলতে পারতাম না। সে নিজে যেমন ইংলিশ শিখেছে, আমাকেও শিখিয়েছে।
“হাউ আর ইউ, আই অ্যাম ফাইন, গুড মর্নিং- এসব কথা ছেলের কাছে শিখেছি। অত্যন্ত খুশি আমরা। জাগো স্কুলের কাছে আমার ছেলে-মেয়েকে দিয়ে দিয়েছি সম্পূর্ণভাবে। খাওয়া দাওয়া হতে শুরু করে- সবই এই স্কুল থেকে হয়। দুই হাত তুলে সবাই দোয়া করবেন যেন এই স্কুল সফলতা পায়।” আরেকজন অভিভাবক বললেন, “আমার একটা মেয়ে সায়েন্স বিভাগে ক্লাস নাইনে পড়ে। ছেলেটা এখানে পড়ে ক্লাস সেভেনে। অন্য স্কুলের সঙ্গে এই স্কুলের অনেক পার্থক্য। ইংলিশ পারফেক্ট, সময় পারফেক্ট, ম্যাডাম পারফেক্ট। “এখানে সবকিছু পারফেক্ট। সকালে কোরান তেলাওয়াত থেকে শুরু করে গীতাপাঠ- সবকিছু সুন্দরভাবে হয় এখানে।” অবশ্য চা বাগানের এই স্কুলে খেলার মাঠ না থাকার আক্ষেপ প্রকাশ পেল এক অভিভাবকের কথায়। “এখানে শিশুদের যা দিচ্ছে, আর কিছু দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে যদি নতুন কিছু দিতে হয়, সেটা হবে খেলার মাঠ। এখানে একটা খেলার মাঠ হলে ভালো হয়।“
ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সাবরীন সামীর মা স্বপ্না বেগম বললেন, “আমার মেয়ে এখানে ক্লাস সিক্সে পড়ে। আমার স্বামী চা বাগানের একজন স্টাফ। আমার মেয়ে এই স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছে, সেজন্য আমি খুবই গর্বিত। আমার একটাই মেয়ে, আমার যদি আরেকটা সন্তান থাকত আমি এই স্কুলেই দিতাম।
“এখানকার পরিচর্যা বলে শেষ করা যাবে না। কোভিড মহামারীর সময় দুই বছর স্কুল বন্ধ ছিল, কিন্তু পড়াশোনার কোনো ব্যঘাত ঘটেনি। অনলাইনে আমার মেয়ে খুব সুন্দর ক্লাস করেছে। স্কুল বন্ধ ছিল, কিন্তু পড়াশোনা বন্ধ হয়নি। শুধু পড়াশোনা নয়, টিফিনও দেওয়া হয় স্কুল থেকে।“

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

চা বাগানের শিশুদের আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন

আপডেট সময় : ১১:৪৭:৩৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২২

দারিদ্র্যের চক্করে চা শ্রমিকদের সন্তানরা সাধারণত বড় হয়ে মা-বাবার মত চায়ের কুড়ি ছেঁড়াকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয়। মা-বাবাকে সাহায্য করতে গিয়ে অল্প বয়সেই শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে।
জাগোর এই স্কুলের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাত বছর আগে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সুরমা চা বাগানের স্কুলটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩০০ জন; ঝরে পড়ার হার প্রায় শূন্যের কোটায়। এখানে শিশুরা পড়াশোনা করে বিনামূল্যে। দুপুরের খাবার, বই-খাতা-কলমসহ পাঠ্য সামগ্রীর জন্যও টাকা লাগে না।
জাগো ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান করভী রাখসান্দ বললেন, “হবিগঞ্জে চা শ্রমিকদের শিশুদের স্কুলে গিয়ে পড়াশোনার সুযোগ খুব কম। সে কারণেই আমরা তাদের বেছে নিয়েছি। সিলেবাস হিসাবে নিয়েছি সরকারের এনসিটিবির ইংলিশ ভার্সন বইগুলো। কারণ গতানুগতিক শিক্ষার চেয়ে ভবিষ্যৎমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষাকে আমরা প্রাধান্য দিতে চেয়েছি, যাতে তারা দুই একটা ডিগ্রি নেওয়ার পর আবার চাকরির অনিশ্চয়তায় না পড়ে।”
ইংরেজিকে কেন শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বেছে নেওয়া হল? করভীর উত্তর: “আমরা চিন্তা করেছি বাংলা মাধ্যমের চেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করলে চাকরি পাওয়াটা তুলনামূলক সহজ। বর্তমানে চাকরির সংকট থাকলেও একজন ইংরেজি জানা লোক আর যাই হোক বেকার থাকবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। এছাড়া কখনও যদি তাদের ইচ্ছে হয়, পড়াশোনা করে বাংলাদেশ থেকে বাইরে যাবে, এই ইংরেজি সেখানেও তাদের সহযোগিতা করবে।“
হবিগঞ্জ জেলাজুড়ে ছোট-বড় ২৪টি চা বাগান রয়েছে। জাগোর ওই স্কুলটি জেলার সবচেয়ে বড় চা বাগান সুরমা টি এস্টেটে। দেশের ১০ জেলায় জাগোর এই মডেলের মোট ১১টি ডিজিটাল স্কুলে পড়ালেখা করছে প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থী।
শুরুটা কীভাবে? শহরাঞ্চলের ভালো শিক্ষক দিয়ে ডিজিটাল কানেক্টিভিটির মাধ্যমে যুক্ত হয়ে প্রান্তিক অঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মানসম্মত শিক্ষার আওতায় আনার যাত্রাটা নিজেই বর্ণনা করলেন করভী। “গত ১৫ বছর ধরে জাগো ফাউন্ডেশন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করছে। ঢাকার বস্তি এলাকায় আমাদের যাত্রা শুরু। তারপর আমরা দেখলাম ঢাকার বাইরেও সুবিধাবঞ্চিতদের নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে।
“ঢাকার বাইরে কাজ করতে এসে আমরা দেখলাম, যোগ্য শিক্ষকের অভাবে সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গুণগত শিক্ষা দেওয়া যাচ্ছে না। সেখান থেকেই আমরা অনলাইন স্কুলের ধারণাটা প্রয়োগ করলাম।” এসব স্কুলে শ্রেণিকক্ষের মনিটরের সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে ঢাকার দক্ষ শিক্ষকদের যুক্ত করা হয়। তারা সামনাসামনি ক্লাসের মতই ঢাকা থেকে সরাসরি ক্লাস নেন। তাছাড়া শ্রেণিকক্ষেও সহযোগিতা করার জন্য একজন শিক্ষক থাকেন। ক্লাসের ভিডিও রেকর্ড করে শিক্ষার্থীদের দেখানো হলে তাতে তাদের ‘মনের খোরাক মেটে না’ বলেই মনে করেন করভী। তিনি বলেন, শিক্ষক উপস্থিত থাকলে শিক্ষার্থীরা নিজের প্রয়োজন মত প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারে, সে সুযোগ ভার্চুয়াল ক্লাসে মিলছে। “এই প্রক্রিয়ায় আমরা চেয়েছি, শুধু চা বাগানে নয়, যতটুকু সম্ভব প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে যেন এই কাজগুলো আমরা করতে পারি। শিশু শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আপাতত আমরা- আমাদের স্কুলে পড়াশোনা করাচ্ছি। “উচ্চ মাধ্যমিক ও ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে তারা অন্যান্য জায়গায় চলে যায়। কিন্তু খরচ আমরা বহন করি।” এত শিক্ষার্থীর খরচ কোথা থেকে মেটে? করভী জানালেন, এজন্য তারা প্রচলিত পদ্ধতিতে ফান্ড কালেকশন করেন না। বরং কয়েকভাবে এই খরচগুলো বহন করা হয়। “আমরা একেকজন শিক্ষার্থীর বছরের খরচের জন্য দাতা খুঁজে বের করি। একজন দাতা ১০/১৫ জন শিক্ষার্থীর খরচ বহন করার দায়িত্ব নিয়েছে- এমন ঘটনাও আছে।”
স্কুল অবকাঠামো নির্মাণ, আধুনিক সুযোগ সুবিধা স্থাপনের ক্ষেত্রে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল থেকে অর্থ নেওয়া হয় বলে জানান তিনি।
“এখন আমরা যে ডিজিটাল ক্লাসের সুবিধাটা দেখছি, এর খরচ এখন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বহন করছে। পরে আবার আমরা হয়ত অন্য কোনো কোম্পানিকে বেছে নেব দাতা হিসাবে। এভাবেই আমরা কাজগুলো এগিয়ে নিচ্ছি। “ঢালাওভাবে অনুদান না নিয়ে প্রজেক্ট সৃষ্টি করে, সে অনুযায়ী বাজেট করে, সেই বাজেট অনুযায়ী আমরা অনুদান নিচ্ছি। ফলে আমাদের কাজগুলো সহজ হয়ে যাচ্ছে।”
বড় স্বপ্ন, বড় আশা: সুরমা চা বাগানে জাগো ফাউন্ডেশনের স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপের একপর্যায়ে উঠে এল তাদের স্বপ্নের কথা। কেউ প্রকৌশলী, কেউ চিকিৎসক, কেউ পুলিশ কর্মকর্তা, আবার কেউ পাইলট হতে চাইল। বিদেশে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্নের কথাও এল কারও কারও কথায়। জাগো ফাউন্ডেশনের উদ্যোক্তা কারভী বলছিলেন, “বিদেশে উচ্চ শিক্ষা এখন আর স্বপ্নের পর্যায়ে নেই। ইতোমধ্যে আমাদের এক শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। সে এখন যুক্তরাষ্ট্রেই অবস্থান করছে। “আমাদের কিছু শিক্ষার্থীকে প্রথম দিন যখন ‘ভবিষ্যতে কী হতে চাও’ জিজ্ঞেস করেছিলাম, তাদের কেউ কেউ বলেছিল ‘রিকশাচালক হতে চাই’। এখন তাদেরই একজন আমেরিকায় পাইলট হওয়ার জন্য পড়াশোনা করছে। শিক্ষা একজন মানুষের চিন্তাধারায় কতটা পরিবর্তন আনতে পারে, এটা তারই একটা উদাহরণ।”
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স বিভাগের কান্ট্রি হেড বিটপী দাশ চৌধুরী বলেন, “ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে যোগাযোগ দক্ষতাটা খুব বেশি দরকার হয়। আজকে বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে হলে শুধু বাংলা জানলে হবে না, ইংরেজিটাও ভালোভাবে জানা থাকা লাগে।
“আমাদের সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা যেন অর্থের অভাবে ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে না থাকে, সেজন্যই ইংরেজি সংস্করণের বই দিয়ে তাদের পড়ানো হচ্ছে।” প্রান্তিক জনপদে ডিজিটাল স্কুল বাস্তবায়নে ব্যক্তির যেমন অবদান আছে, তেমনই প্রতিষ্ঠানেরও ভূমিকা রয়েছে মন্তব্য করে জাগো ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কারভী বলেন, “এর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চ্যার্টার্ড ব্যাংক অন্যতম, যাদের সঙ্গে আমরা গত ১২ বছর ধরে কাজ করছি। ১১টি অনলাইন স্কুলে মনিটর হতে শুরু করে ইন্টারনেট কানেকশন- সব ধরনের অবকাঠামোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে স্ট্যান্ডার্ড চ্যার্টার্ড। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন মত লেখার খাতাপত্রও সরবরাহ করছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক।”
‘আমরা এখন শুদ্ধ বাংলা, কিছু কিছু ইংরেজি জানি’: চা বাগানে এ ধরনের একটি স্কুলে নিজের সন্তানকে পড়ালেখা করাতে পেরে বেশ উচ্ছ্বসিত অভিভাবকরা। তাদের একজন প্রদীপ কৈরি জানালেন, তার সন্তান প্রবীণ কৈরি এখন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। “পাঁচ বছর ধরে আমার ছেলে এখানে পড়ে। আমরা আসলেই ভাগ্যবান। এই রকম একটি স্কুল আমরা উপহার পেয়েছি। এরকম স্কুল হবিগঞ্জের কোনো চা বাগানে নেই। আমার ছেলে অনেক ভালো করছে। আগে আমরা ইংরেজি তো দূরে থাক, ভালোভাবে বাংলাও বলতে পারতাম না। সে নিজে যেমন ইংলিশ শিখেছে, আমাকেও শিখিয়েছে।
“হাউ আর ইউ, আই অ্যাম ফাইন, গুড মর্নিং- এসব কথা ছেলের কাছে শিখেছি। অত্যন্ত খুশি আমরা। জাগো স্কুলের কাছে আমার ছেলে-মেয়েকে দিয়ে দিয়েছি সম্পূর্ণভাবে। খাওয়া দাওয়া হতে শুরু করে- সবই এই স্কুল থেকে হয়। দুই হাত তুলে সবাই দোয়া করবেন যেন এই স্কুল সফলতা পায়।” আরেকজন অভিভাবক বললেন, “আমার একটা মেয়ে সায়েন্স বিভাগে ক্লাস নাইনে পড়ে। ছেলেটা এখানে পড়ে ক্লাস সেভেনে। অন্য স্কুলের সঙ্গে এই স্কুলের অনেক পার্থক্য। ইংলিশ পারফেক্ট, সময় পারফেক্ট, ম্যাডাম পারফেক্ট। “এখানে সবকিছু পারফেক্ট। সকালে কোরান তেলাওয়াত থেকে শুরু করে গীতাপাঠ- সবকিছু সুন্দরভাবে হয় এখানে।” অবশ্য চা বাগানের এই স্কুলে খেলার মাঠ না থাকার আক্ষেপ প্রকাশ পেল এক অভিভাবকের কথায়। “এখানে শিশুদের যা দিচ্ছে, আর কিছু দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে যদি নতুন কিছু দিতে হয়, সেটা হবে খেলার মাঠ। এখানে একটা খেলার মাঠ হলে ভালো হয়।“
ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সাবরীন সামীর মা স্বপ্না বেগম বললেন, “আমার মেয়ে এখানে ক্লাস সিক্সে পড়ে। আমার স্বামী চা বাগানের একজন স্টাফ। আমার মেয়ে এই স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়েছে, সেজন্য আমি খুবই গর্বিত। আমার একটাই মেয়ে, আমার যদি আরেকটা সন্তান থাকত আমি এই স্কুলেই দিতাম।
“এখানকার পরিচর্যা বলে শেষ করা যাবে না। কোভিড মহামারীর সময় দুই বছর স্কুল বন্ধ ছিল, কিন্তু পড়াশোনার কোনো ব্যঘাত ঘটেনি। অনলাইনে আমার মেয়ে খুব সুন্দর ক্লাস করেছে। স্কুল বন্ধ ছিল, কিন্তু পড়াশোনা বন্ধ হয়নি। শুধু পড়াশোনা নয়, টিফিনও দেওয়া হয় স্কুল থেকে।“