নিজস্ব প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী দল ঘোষণা করে একে নিষিদ্ধ করাসহ ১২ দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। একইসাথে নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় আগামী তিন মাসের মধ্যে বিভাগীয় সম্মেলন এবং নারী সংস্কার কমিশন বাতিলসহ চার দফা দাবিতে ২৩ মে বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে।
শনিবার (৩ মে) দুপুরে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসমাবেশে নতুন এই দুই কর্মসূচি ঘোষণা দেন সংগঠনটির মহাসচিব সাজিদুর রহমান। তিনি বলেন, নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় আগামী তিন মাসের মধ্যে বিভাগীয় সম্মেলন করা হবে। এছাড়া আগামী ২৩ মে বাদ জুমা চার দফা দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে। এর আগে ১২ দফা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমির মাওলানা মাহফুজুল হক। সমাবেশে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে আমরা বিজয়ের স্বাদ লাভ করি এবং হারানো স্বাধীনতা ফিরে পাই। যা অর্জিত হয়েছে সহস্রাধিক প্রাণ ও অকল্পনীয় আত্মত্যাগের বিনিময়ে। স্বাধীনতা আল্লাহর দান- গত ১৫ বছর যা থেকে আমরা বঞ্চিত ছিলাম। তাই মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি।
আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, আমাদের দেশ এখন বহুমুখী সংকটে রয়েছে। একই সঙ্গে আগ্রাসী ভারতের ষড়যন্ত্রও থেমে নেই। উপরন্তু, মানবিক করিডোরের নামে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের ভূরাজনৈতিক লড়াইয়ের স্বার্থে আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশকে নতুন যুদ্ধের ক্ষেত্র বানাতে পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় আমাদের জাতীয় ঐক্য আরো সুদৃঢ় করতে হবে। বাংলাদেশ নিয়ে আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নানান সংকট মোকাবিলায় আমাদেরকে জুলাই-আগস্টের মতো ইস্পাত-কঠিন জাতীয় ঐক্য ও সংহতি আবারও গড়ে তুলতে হবে। তিনি আরো বলেন, দেশে ইসলামবিরোধী গোষ্ঠী আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সম্প্রতি নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন কোরআনবিরোধী প্রতিবেদন দাখিল করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে হুঁশিয়ার করে বলতে চাই, এনজিওবাদী গোষ্ঠীর প্ররোচনায় এমন কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিবেন না, যা কোরআন-সুন্নাহর বিরুদ্ধে যায়।
হেফাজতে ইসলাম নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সরকারের নিকট দাবি জানাচ্ছি, দেশের যৌতুকপ্রথা বন্ধে কঠোর আইন করুন। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। এছাড়া, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন ফৌজদারি দণ্ডবিধি ও সাইবার সিকিউরিটি আইন থেকে ধর্ম অবমাননার শাস্তি সংক্রান্ত ধারাগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে, এটি আরেক গভীর ষড়যন্ত্র। সংখ্যাগুরু কিংবা সংখ্যালঘু- কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অধিকার অন্য কারোও নেই। তাই ধর্ম অবমাননার শাস্তির আইনি ধারাগুলো বহাল রেখে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের ওই নির্দিষ্ট সুপারিশগুলো বাদ দিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.)-এর নামে কটূক্তি বা বিষোদ্গার বন্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির আইন করতে হবে। ৫ আগস্টের এই বিজয়কে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে হবে। এমন একটি ন্যায়ভিত্তিক সংবিধান ও সরকারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যাতে করে এই বাংলাদেশের মাটিতে আর কখনো কোনো ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারের জন্ম না হয়।
সমাবেশের সভাপতি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ করেন এই মহাসমাবেশ। মহাসমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন- হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাহমুদুর হাসান কাশেমী, নায়েবে আমির আহমেদ কাশেমী, জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, হেফাজত ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক প্রমুখ।
আ.লীগ নিষিদ্ধসহ ১২ দাবি: আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী দল ঘোষণা করে একে নিষিদ্ধ করাসহ ১২ দাবি জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। শনিবার (৩ মে) দুপুর সাড়ে ১২টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত মহাসমাবেশে এসব দাবি জানিয়েছেন সংগঠনটির নায়েবে আমির মাহফুজুল হক। তিনি বলেছেন, বিগত চব্বিশের জুলাই-আগস্টের রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদের শিকল থেকে মুক্তি লাভ করেছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। সহস্রাধিক প্রাণ ও ত্যাগের বিনিময়ে নতুন স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস রচিত হয়েছে। আজকে আমাদের এই মহাসমাবেশ থেকে ৫ মে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের গণহত্যা, জুলাই বিপ্লবে ৮৪ জন মাদরাসাছাত্র ও শিক্ষকসহ সব শহীদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি এবং শহীদ পরিবারদের প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। আহতদের জন্য দোয়া করি এবং সমবেদনা জানাই।
১২ দাবি হলো:
১. নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও তাদের কোরআনবিরোধী প্রতিবেদন অবিলম্বে বাতিল করে আলেম-ওলামার পরামর্শে ধর্মপ্রাণ বৃহত্তর নারীসমাজের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন কমিশন গঠন করতে হবে। নারীদের সামাজিক উন্নয়নে পশ্চিমা মূল্যবোধ নয়, বরং আমাদের নিজস্ব সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোকেই বাস্তবমুখী সংস্কারের দিকে যেতে হবে।
২. সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন করতে হবে এবং ধর্মপ্রাণ গণমানুষের ঈমান-আমল রক্ষার্থে ‘বহুত্ববাদ’ নামক আত্মঘাতী ধারণা থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। এছাড়া, লিঙ্গ পরিচয়, লিঙ্গ বৈচিত্র্য, লিঙ্গ সমতা, লিঙ্গ বৈষম্য, তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার), ‘অন্যান্য লিঙ্গ’ ইত্যাদি শব্দের মারপ্যাঁচে ‘কাউকে বাদ দিয়ে নয়’ এমন ধোঁয়াশাপূর্ণ স্লোগানের অন্তরালে এবং অসংজ্ঞায়িত ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ (ইনক্লুসিভ) ইত্যাদি শব্দের আড়ালে এলজিবিটি ও ট্রান্সজেন্ডারবাদের স্বীকৃতি ও অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সমাজবিধ্বংসী ও ধর্মবিরুদ্ধ সমকামীবান্ধব সমাজ প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা বন্ধ করতে হবে।
৩. শাপলা চত্বর ও জুলাই গণহত্যার বিচারে গতি আনতে ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের আগেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার চিহ্নিত দোসরদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে।
৪. গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী দল ঘোষণা করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। দলটির বিচার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের সব ধরনের কার্যক্রম ও তৎপরতা নিষিদ্ধ করতে হবে।
৫. আল্লাহ ও তার রাসুলের (সা.) নামে কটূক্তি ও বিষোদগার বন্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির আইন করতে হবে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে ধর্ম অবমাননার শাস্তি-সংক্রান্ত আইনি ধারাগুলো বাতিলের সুপারিশ বাদ দিতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
৬. চট্টগ্রামে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে শহীদ সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার উস্কানিদাতা চিন্ময় দাসের জামিন প্রত্যাহার করে তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে।
৭. ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে সারা দেশে প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদরাসা শিক্ষার্থী ও ইসলামমনা তরুণদের বিরুদ্ধে হওয়া মিথ্যা ও বানোয়াট মামলাগুলো অতিসত্বর প্রত্যাহার বা নিষ্পত্তি করতে হবে গণঅভ্যুত্থানের সরকারকে। সেইসঙ্গে ‘জঙ্গি নাটক’ বা ‘জঙ্গি কার্ড’ খেলে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী ও আলেম-ওলামার ওপর যারা গত ১৫ বছর নির্যাতন ও গুম-খুন চালিয়েছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
৮. গাজার মুসলমানদের ওপর অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের চলমান গণহত্যা ও ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের গণঅভ্যুত্থানের সরকারকে কূটনৈতিকভাবে আরো উচ্চকণ্ঠ হতে হবে এবং দেশের সর্বস্তরে জনতাকে ইসরায়েলি ও ভারতীয় পণ্য বয়কট করতে হবে।
৯. শিক্ষার সর্বস্তরে ইসলামী শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে।
১০. রাখাইনকে ‘মানবিক করিডোর’ প্রদানে সরকারের সম্মত হওয়া সম্পূর্ণরূপে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আমাদের ভৌগোলিক নিরাপত্তার স্বার্থে এ অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে ফিরে আসতে হবে।
১১. চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ভিনদেশি মিশনারীদের অপতৎপরতা ও দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সেখানে নিরাপত্তা সঙ্কট কমাতে আলেমসমাজের দাওয়াতি কার্যক্রমকে আরো সুযোগ করে দিতে হবে। সেখানে সামরিক নিরাপত্তা আরো বৃদ্ধি করা ছাড়াও পাহাড়ি বাঙালি ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক সমঝোতা ও স্থিতি নির্মাণে রাষ্ট্রীয় তৎপরতা আরো বাড়াতে হবে।
১২. কাদিয়ানিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘অমুসলিম’ ঘোষণা করতে হবে এবং সাধারণ মুসলমানদের ঈমান-আকিদা রক্ষার্থে এদের অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীর সভাপতিত্বে মহাসমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাহমুদুর হাসান কাশেমী, নায়েবে আমির আহমেদ কাশেমী ও যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক প্রমুখ।