নারী ও শিশু ডেস্ক: ঐতিহাসিকভাবে পুরুষশাসিত সমাজে ক্যারিয়ারে কাজ করার ক্ষেত্রে নারীরা লিঙ্গবৈষম্যের শিকার হন বলে অভিযোগ শোনা যায়। তবে এটিও ঠিক যে বৈষম্য কমে আসছে। আগের চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক নারী কাজে যুক্ত হচ্ছেন আর সর্বোচ্চ বেতনও পাচ্ছেন। অনেক নারী আছেন- যারা অনেকেই ছয় অঙ্কের বেতন পান; যাকে আমরা সিক্স ডিজিট স্যালারি বলি। ফলে তারা নিজেদের নানা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
ক্যারিয়ার বা চাকরির ক্ষেত্রে একটি ধারণা প্রচলিত আছে, অনেক সময় জোর দিয়েও বলা হচ্ছে যে পুরুষেরা নেতৃত্বের জন্য বেশি উপযুক্ত। কর্মক্ষেত্র নিয়ে করা এক জরিপের ফলাফলে ৭৮ শতাংশ কর্মজীবী নারীকে ‘অত্যধিক আবেগপ্রবণ’ বা ‘অত্যধিক সংবেদনশীল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পুরুষরা ‘অত্যধিক আবেগপ্রবণ’ বা ‘অত্যধিক সংবেদনশীল’-এর ক্ষেত্রে মাত্র ১১ শতাংশ। তবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ মাত্র ছয় শতাংশ নারী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আছেন বিশ্বে।
২০২৫ সালে এসে এসব পরিসংখ্যান আবার পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। কারণ সর্বাধিক বেতনের পেশাগুলোয় নারীদের আধিপত্য দিনকে দিনকে বাড়ছে। তারা কর্মক্ষেত্রে বড় বড় অবদান রাখছেন এবং সমাজে বড় প্রভাবও পড়ছে। এই অগ্রগতির স্বীকৃতি মিলেছে রিজিউম জিনিয়াসের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে।
রিজিউম জিনিয়াস মার্কিনভিত্তিক চাকরি খোঁজার ওয়েবসাইট। তারা ইউরোপের সুইজারল্যান্ডেও কাজ করে। তাইওয়ানেও আছে তাদের মার্কেটিং অফিস।
রিজিউম জিনিয়াস ২০২৫ হাইয়েস্ট পেয়িং, ইউমেন লিড ক্যারিয়ার্স রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, নারীরা পুরুষদের চেয়ে সেরা ও সংখ্যায় বেশি। রিজিউম জিনিয়াসের গবেষকরা ইউমেন ব্যুরো এবং ইউএস ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকস থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। যেসব চাকরিতে নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি (শিল্পে ৫০ শতাংশেরও বেশি), তাদের বার্ষিক গড় বেতন অনুসারে একটি তালিকা করা হয়েছে। ওই তালিকা অনুযায়ী সেরা নারীদের শীর্ষ ১০ চাকরির তালিকা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্যভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বস। তা হলোÑ
এক. নার্স অবেদনবিদ: এ পদে গড় বেতন ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫২৩ ডলার। এ পেশায় ৫৫ শতাংশ নারী এবং ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৬০০ জন চাকরি করছেন। পেশায় একজন অবেদনবিদের কাজ পরিচালনা এবং রোগীর সেবা যত্নের কাজ করেন। এ জন্য নার্সিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি প্রয়োজন। এর সঙ্গে এ–সংক্রান্ত নিবন্ধিত (লাইসেন্স) এবং আইসিইউয়ে কাজ করার কমপক্ষে এক বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। এরপর স্নাতক স্তরের স্বীকৃত নার্স অবেদনবিদ (নার্স অ্যানেসথেসিয়া) প্রোগ্রাম সম্পন্ন করতে হবে এবং একটি সার্টিফিকেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।
দুই. ফার্মাসিস্ট: ১ লাখ ২৮ হাজার ১৩২ ডলার বেতন। এ পেশায় আছেন ৫৭ শতাংশ নারী এবং ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৭০০ জন চাকরি করছেন। এ চাকরিতে রোগী বা রোগীর স্বজনকে ওষুধ বিতরণ এবং ওষুধের ব্যবহার এবং ডোজ সম্পর্কে নির্দেশনা প্রদান করতে হয়। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত দলের সদস্যদের ডোজ, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করতে হয়। এ চাকরির জন্য বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি এবং স্বীকৃত ফার্মেসি স্কুল থেকে ডক্টর অফ ফার্মেসি (ফার্ম. ডি.) ডিগ্রির প্রয়োজন। এরপরই দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে এবং নিবন্ধন (লাইসেন্স) পেতে হবে।
তিন. চিকিৎসক সহকারী: ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৭৩ ডলার বেতন। এ পেশায় ৬৪ শতাংশই নারী এবং ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪০০ জন চাকরিতে নিয়োজিত। একজন চিকিৎসক সহকারী হিসেবে, একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রোগীদের পরীক্ষা এবং চিকিৎসাসেবা দিতে হয়। ওষুধ লেখা এবং রোগীর সেলাই বা ফ্র্যাকচারের মতো শারীরিক আঘাতের চিকিৎসায় সহায়তা করতে হয় এ পেশায়। এ পেশার জন্য স্বীকৃত প্রোগ্রাম থেকে ফিজিশিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টাডিজে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রয়োজন। ফিজিশিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্ট ন্যাশনাল সার্টিফাইং এক্সামিনেশনও পাস করতে হবে।
চার. পশুচিকিৎসক: এ পেশার ৬৩ শতাংশই নারী। এ পেশায় চাকরি ৮৮ হাজার ২০০টি। ১ লাখ ১৫ হাজার ৫২১ ডলার বেতন। একজন পশুচিকিৎসককে পশুদের সুস্থতার জন্য যত্ন নিতে হয়। পোষা প্রাণী এবং গবাদিপশুর চিকিৎসার অবস্থা বা রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা করেন তিনি। এ পেশায় কেউ যুক্ত হতে চাইলে অবশ্যই স্বীকৃত একটি ভেটেরিনারি কলেজ থেকে ডক্টর অফ ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম) ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। এরপরই এ নর্থ আমেরিকান ভেটেরিনারি লাইসেন্সিং এক্সামিনেশন পরীক্ষায় পাস করতে হবে।
পাঁচ. নার্স প্র্যাকটিশনার: এ পেশায় যুক্ত থাকা ব্যক্তিদের মধ্য ৮৭ শতাংশই নারী। এ পেশায় চাকরি আছে ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৬০০টি। এ চাকরিতে বেতন ১ লাখ ১৪ হাজার ৮৯১ ডলার। নার্স প্র্যাকটিশনারের কাজ হলো রোগীর স্বাস্থ্য মূল্যায়ন এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা তৈরি করে সেবা প্রদান করা। এ পেশায় কেউ আসতে চাইলে প্রথমে নার্সিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। এরে পরেই রেজিস্টার্ড নার্সে (আরএন) লাইসেন্স পেতে হবে। লাইসেন্সের পরই নার্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি (এমএসএন) বা ডক্টরেট (ডিএনপি) ডিগ্রি সম্পন্ন করতে পাররে নার্স প্র্যাকটিশনার হওয়ার পথ তৈরি হবে।
ছয়. বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্য বিচার বিভাগীয় কর্মী: ৫৪ শতাংশ নারী এসব পদে কাজ করেন। এ পেশার চাকরি ৪১ হাজার ৭০০টি। চাকরিজীবী। মাস শেষে এ পদে বেতন মেলে ১ লাখ ৯৯৩ ডলার। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পরই তিন বছর আইন স্কুলে পড়াশোনার করতে হবে এ পদের চাকরির জন্য। এর পরই জুরিস ডক্টর ডিগ্রি প্রয়োজন।
সাত. মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক: আমেরিকার এ পেশায় যুক্ত থাকা ৭৫ শতাংশই নারী। এ পেশায় চাকরি আছে ২ লাখ ৮ হাজার ৯০০টি। এইচআর ব্যবস্থাপকেরা কোম্পানির প্রশাসনিক চাহিদা তত্ত্বাবধান করেন, এর মধ্যে নিয়োগ, পদায়নসহ নানা কাজে যুক্ত থাকেন। কৌশলগত পরিকল্পনা এবং কর্মচারী সুবিধা সম্পর্কে নিয়মিত প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হয় এ পদে চাকরি করলে। কোম্পানির দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতাকে সর্বোত্তম করার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় তাদের। কেই এইচআর ব্যবস্থাপনায় আগ্রহী হলে প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে স্নাতক ডিগ্রি অথবা এইচআর বা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা প্রয়োজন।
আট. মার্কেটিং ম্যানেজার: এ পদের গড় বেতন ৮৫ হাজার ৩২৭ ডলার। এ পদে এখন ৬১ শতাংশ নারী এবং ৪ লাখ ১১ হাজার ৩০০ জন চাকরি করেন। একজন মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে আপনার কোম্পানির পণ্য বা পরিষেবা প্রচারের জন্য প্রচারণার দায়িত্ব আপনার উপর বর্তায়। আপনি ব্যবসায়িক কৌশল বিকাশ এবং গ্রাহকের চাহিদা সম্পর্কে অবগত থাকার জন্য বাজার গবেষণা তত্ত্বাবধান করবেন। বেশির ভাগ মার্কেটিং ম্যানেজার মার্কেটিংয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
নয়. ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট: যুক্তরাষ্ট্রে ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট পেশাটি নারীদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় একটি ক্যারিয়ার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশটিতে মোট ২ লাখ ৫৯ হাজার ২০০টি ফিজিক্যাল থেরাপিস্টের চাকরি রয়েছে, যার মধ্যে ৫৮ শতাংশ-ই নারী। এ পদের বেতন ৮২ হাজার ৪৭৬ ডলার। ফিজিক্যাল থেরাপিস্ট রোগীদের শারীরিক নড়াচড়া উন্নত করতে, ব্যথা কমাতে এবং আঘাত থেকে সেরে উঠতে সাহায্য করেন। তারা রোগীদের ব্যায়াম পরিকল্পনা তৈরি করে দেন এবং ভবিষ্যতে আঘাত প্রতিরোধ করতে রোগীর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করেন। কেউ এ পদে আগ্রহী হলে প্রথমে একটি স্নাতক (ব্যাচেলর) ডিগ্রি সম্পন্ন করতে হবে এবং এরপর একটি স্বীকৃত ফিজিক্যাল থেরাপি প্রোগ্রাম শেষ করে সরকারি লাইসেন্স নিতে হবে।
দশ. টেকনিক্যাল লেখক: যুক্তরাষ্ট্রে টেকনিক্যাল রাইটার বা প্রযুক্তি লেখক পেশাটি নারীদের মধ্যে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বর্তমানে এই খাতে মোট ৫০ হাজার ১০০টি চাকরি রয়েছে, যার মধ্যে ৫৬ শতাংশেই নারীরা কর্মরত। এই পেশায় বার্ষিক গড় আয় প্রায় ৮২ হাজার ১৪৭ মার্কিন ডলার। সাধারণত, ইংরেজি, গণযোগাযোগ বা সাংবাদিকতায় স্নাতক ডিগ্রি অথবা কারিগরি বিষয়ে অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা থাকা প্রয়োজন এ পদের জন্য।
বর্তমানে আমেরিকার শীর্ষ কোম্পানিগুলোর সিইওদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ নারী। এই পরিসংখ্যানে অনেক তরুণী বা নারী নিরাশ হলেও আশার দিকও আছে। ২০২৪ সালে নারী সিইওরা পুরুষদের তুলনায় গড়ে ৫ শতাংশ বেশি আয় করেছেন; যা ভবিষ্যতের জন্য একটি আশাব্যঞ্জক বার্তা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ বাস্তবতা প্রমাণ করে যে নারীরাও উচ্চ আয়ের, প্রযুক্তিনির্ভর ও নেতৃত্বমূলক পেশাগুলোয় সফল হতে পারেন। নিজের যোগ্যতা যাচাই, সাহসের সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অব্যাহত শিক্ষাই নারীদের ক্যারিয়ারে বড় অগ্রগতির পথ খুলে দিতে পারে।
আজকের প্রত্যাশা/কেএমএএ