ঢাকা ১২:১০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

চলে গেলেন জাপা মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু

  • আপডেট সময় : ০১:৪০:২৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অক্টোবর ২০২১
  • ৯৫ বার পড়া হয়েছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেষবারের মতো সিক্ত হলেন জাতীয় পার্টির সদ্য প্রয়াত মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু।
গতকাল শনিবার দুপুর ১টায় রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় চত্বরে আনা হয় প্রয়াত মহাসচিবের মরদেহ। এসময় তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীদের চোখের জলে ভাবগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হয়। অনেককেই কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে শনিবার সকাল ৯টা ১২ মিনিটে রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজ্ড হাসপাতালে মারা যান জাতীয় পার্টির মহাসচিব, সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক ডাকসু জিএস জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। তিনি স্ত্রী ও এক ছেলেসহ অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী এবং রাজনৈতিক অনুসারী রেখে গেছেন।
দলের এ শীর্ষ নেতাকে শেষবারের মতো দেখতে এসে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, তিনি (বাবলু) ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আশির দশকে তিনি ডাকসুর জিএস হিসেবে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। দেশ ও জাতির কল্যাণে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে তিনি সদা প্রস্তুত ছিলেন। এমন একজন দক্ষ নেতাকে হারিয়ে জাতীয় পার্টিতে শূন্যতা সৃষ্টি হলো।
জাপার কো-চেয়ারম্যান ও ঢাকা-৪ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপা, রাহ্গীর আলমাহি সাদ এরশাদসহ দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও শেষবারের মত বিদায় জানাতে আসেন বাবলুকে।
জাপার কো-চেয়ারম্যান ও ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, তিনি অত্যন্ত স্পষ্টবাদী ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি করেছেন, মহাজোট গঠনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। দলের জন্যই, দলের কাজ করতে গিয়ে তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। তিনি চিরদিনের মত আমাদের কাছ থেকে চলে গেলেন, এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক। আমরা তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শ্যামলীতে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন বাবলু। গত ৬ সেপ্টেম্বর তার করোনা পজিটিভ হয়। এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থী আতিকুর রহমান আতিকের পক্ষে প্রচারণায় যোগ দিতে টানা পাঁচদিন সিলেটে অবস্থান করেন তিনি। পরে ঢাকায় ফিরে অসুস্থ বোধ করলে তাকে করোনা পরীক্ষা করানো হয়। করোনা পজিটিভ হলে ৬ সেপ্টেম্বরই তাকে ধানমন্ডিতে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। অবস্থার অবনতি হলে পরদিন নেওয়া হয় বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের আইসিইউতে। তিনি আগে থেকে অ্যাজমা ও হার্টের জটিলতাসহ নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। করোনা শনাক্তের পর তার ফুসফুস মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর নামাজে জানাজা বাদ এশা গুলশান আজাদ মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। পরে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
প্রয়াত মহাসচিব স্মরণে তিনদিনের শোক ঘোষণা করেছে জাতীয় পার্টি। শনি থেকে সোমবার পর্যন্ত দলটির প্রতিটি দলীয় কার্যালয়ে দলীয় ও কালো পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
আজ রোববার বিকেল ৩টায় জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কাকরাইল চত্বরে প্রয়াত মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর মৃত্যুতে শোকসভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ পার্টি শীর্ষ নেতাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জিয়াউদ্দিন বাবলু। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এলএলবি সম্পন্ন করেন।

১৯৮১-৮৩ মেয়াদে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৮৫-৮৬ সালে শিক্ষা উপমন্ত্রী, ১৯৮৬-৮৭ সালে বন্দর ও নৌপরিবহন উপমন্ত্রী, ১৯৮৭ সালে অর্থ প্রতিমন্ত্রী, ১৯৮৭-৮৮ সালে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী ও ১৯৮৮-৯০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন বাবলু।
রাজনৈতিক অঙ্গণে শোকের ছায়া : জাতীয় পার্টি মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গণে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রীর শোক : জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো এক শোক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
জাপা চেয়ারম্যানের শোক : দলের মহাসচিবের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। এক শোকবার্তায় প্রয়াত নেতার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ছিলেন গণমানুষের নেতা। তিনি ছাত্র জীবন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গণমানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। ছাত্র জীবনেই তার অনুপম নেতৃত্ব প্রকাশ হয়েছিল। বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন ডাকসুর জিএস।
মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু সবসময় আপসহীন ছিলেন উল্লেখ করে বলেন, তিনি (জিয়াউদ্দিন বাবলু) অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন আজীবন। জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ছিলেন গণমানুষের কন্ঠস্বর। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। তার মৃত্যুতে দেশের রাজনীতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা সহসাই পূরণ হওয়ার নয়।
মির্জা ফখরুলের শোক : এদিকে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু’র মৃত্যুতে তার শোকাহত পরিবার-পরিজনদের মতো আমিও গভীরভাবে সমব্যাথী। আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকার্ত পরিবারবর্গ, আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা।’
ওবায়দুল কাদেরের শোক : সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এক শোকবার্তায় মন্ত্রী প্রয়াত জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শোক : জাপা এই নেতার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
আইনমন্ত্রীর শোক : গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকও। তিনি এক শোকবার্তায় মরহুম জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।
জাতীয় পার্টির তিন দিনের দলীয় শোক : জাতীয় পার্টি মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু’র মৃত্যুতে তিন দিনের দলীয় শোক ঘোষণা করেছে জাতীয় পার্টি। শনি থেকে সোমবার পর্যন্ত জাতীয় পার্টির প্রতিটি দলীয় কার্যালয়ে দলীয় ও কালো পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
খেলাফত মজলিসের শোক : জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসাইন। তারা বলেন, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর ইন্তিকালে জাতি একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদকে হারালো।

এ ছাড়াও সাবেক এই মন্ত্রীর মৃত্যুতে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান, বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন : ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া বাবলু দ্বিতীয় দফায় জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সাবেক সংসদ সদস্য বাবলু এইচ এম এরশাদের সরকারে উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র বাবলু বাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। গত শতকের ৮০ এর দশকের শুরুতে ডাকসুর জিএস থাকা অবস্থায় সামরিক শাসক এরশাদের দলে যোগ দিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। তাকে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের উপদেষ্টা করেছিলেন সামরিক আইন প্রশাসক এরশাদ। পরে শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। এরপর বাবলুকে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এবং পরে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী করা হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বাবলু। পরে ২০১৪ সালে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এরশাদের নির্দেশে তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। এরশাদের জীবদ্দশায় ২০১৪ থেকে দুই বছর জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্বে ছিলেন বাবলু। ২০২০ সালে আবার সেই দায়িত্বে ফিরেছিলেন তিনি। কয়েক বছর আগেই জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদের ভাগ্নি মেহেজাবুন্নেসা রহমান টুম্পাকে বিয়ে করেছিলেন বাবলু। তার প্রথম স্ত্রী অধ্যাপক ফরিদা আক্তার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৫ সালে মারা যান। বাবলু-ফরিদা দম্পতির এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

চলে গেলেন জাপা মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু

আপডেট সময় : ০১:৪০:২৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অক্টোবর ২০২১

নিজস্ব প্রতিবেদক : দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেষবারের মতো সিক্ত হলেন জাতীয় পার্টির সদ্য প্রয়াত মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু।
গতকাল শনিবার দুপুর ১টায় রাজধানীর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় চত্বরে আনা হয় প্রয়াত মহাসচিবের মরদেহ। এসময় তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মীদের চোখের জলে ভাবগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হয়। অনেককেই কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে শনিবার সকাল ৯টা ১২ মিনিটে রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজ্ড হাসপাতালে মারা যান জাতীয় পার্টির মহাসচিব, সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক ডাকসু জিএস জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। তিনি স্ত্রী ও এক ছেলেসহ অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী এবং রাজনৈতিক অনুসারী রেখে গেছেন।
দলের এ শীর্ষ নেতাকে শেষবারের মতো দেখতে এসে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, তিনি (বাবলু) ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আশির দশকে তিনি ডাকসুর জিএস হিসেবে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিলেন। দেশ ও জাতির কল্যাণে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে তিনি সদা প্রস্তুত ছিলেন। এমন একজন দক্ষ নেতাকে হারিয়ে জাতীয় পার্টিতে শূন্যতা সৃষ্টি হলো।
জাপার কো-চেয়ারম্যান ও ঢাকা-৪ আসনের সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপা, রাহ্গীর আলমাহি সাদ এরশাদসহ দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও শেষবারের মত বিদায় জানাতে আসেন বাবলুকে।
জাপার কো-চেয়ারম্যান ও ঢাকা-৬ আসনের সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, তিনি অত্যন্ত স্পষ্টবাদী ছিলেন। ছাত্র রাজনীতি করেছেন, মহাজোট গঠনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। দলের জন্যই, দলের কাজ করতে গিয়ে তিনি করোনায় আক্রান্ত হন। তিনি চিরদিনের মত আমাদের কাছ থেকে চলে গেলেন, এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক। আমরা তার রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শ্যামলীতে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন বাবলু। গত ৬ সেপ্টেম্বর তার করোনা পজিটিভ হয়। এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচনে দলীয় প্রার্থী আতিকুর রহমান আতিকের পক্ষে প্রচারণায় যোগ দিতে টানা পাঁচদিন সিলেটে অবস্থান করেন তিনি। পরে ঢাকায় ফিরে অসুস্থ বোধ করলে তাকে করোনা পরীক্ষা করানো হয়। করোনা পজিটিভ হলে ৬ সেপ্টেম্বরই তাকে ধানমন্ডিতে ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। অবস্থার অবনতি হলে পরদিন নেওয়া হয় বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের আইসিইউতে। তিনি আগে থেকে অ্যাজমা ও হার্টের জটিলতাসহ নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। করোনা শনাক্তের পর তার ফুসফুস মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর নামাজে জানাজা বাদ এশা গুলশান আজাদ মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। পরে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
প্রয়াত মহাসচিব স্মরণে তিনদিনের শোক ঘোষণা করেছে জাতীয় পার্টি। শনি থেকে সোমবার পর্যন্ত দলটির প্রতিটি দলীয় কার্যালয়ে দলীয় ও কালো পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
আজ রোববার বিকেল ৩টায় জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কাকরাইল চত্বরে প্রয়াত মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর মৃত্যুতে শোকসভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ পার্টি শীর্ষ নেতাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন জিয়াউদ্দিন বাবলু। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। এরপর একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এলএলবি সম্পন্ন করেন।

১৯৮১-৮৩ মেয়াদে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। ১৯৮৫-৮৬ সালে শিক্ষা উপমন্ত্রী, ১৯৮৬-৮৭ সালে বন্দর ও নৌপরিবহন উপমন্ত্রী, ১৯৮৭ সালে অর্থ প্রতিমন্ত্রী, ১৯৮৭-৮৮ সালে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী ও ১৯৮৮-৯০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন বাবলু।
রাজনৈতিক অঙ্গণে শোকের ছায়া : জাতীয় পার্টি মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গণে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
প্রধানমন্ত্রীর শোক : জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো এক শোক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
জাপা চেয়ারম্যানের শোক : দলের মহাসচিবের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। এক শোকবার্তায় প্রয়াত নেতার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছেন তিনি। তিনি বলেছেন, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ছিলেন গণমানুষের নেতা। তিনি ছাত্র জীবন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গণমানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। ছাত্র জীবনেই তার অনুপম নেতৃত্ব প্রকাশ হয়েছিল। বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন ডাকসুর জিএস।
মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু সবসময় আপসহীন ছিলেন উল্লেখ করে বলেন, তিনি (জিয়াউদ্দিন বাবলু) অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন আজীবন। জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ছিলেন গণমানুষের কন্ঠস্বর। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। তার মৃত্যুতে দেশের রাজনীতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা সহসাই পূরণ হওয়ার নয়।
মির্জা ফখরুলের শোক : এদিকে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু’র মৃত্যুতে তার শোকাহত পরিবার-পরিজনদের মতো আমিও গভীরভাবে সমব্যাথী। আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকার্ত পরিবারবর্গ, আত্মীয়স্বজন, গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা।’
ওবায়দুল কাদেরের শোক : সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এক শোকবার্তায় মন্ত্রী প্রয়াত জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর শোক : জাপা এই নেতার মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবার প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
আইনমন্ত্রীর শোক : গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকও। তিনি এক শোকবার্তায় মরহুম জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।
জাতীয় পার্টির তিন দিনের দলীয় শোক : জাতীয় পার্টি মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু’র মৃত্যুতে তিন দিনের দলীয় শোক ঘোষণা করেছে জাতীয় পার্টি। শনি থেকে সোমবার পর্যন্ত জাতীয় পার্টির প্রতিটি দলীয় কার্যালয়ে দলীয় ও কালো পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
খেলাফত মজলিসের শোক : জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসাইন। তারা বলেন, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর ইন্তিকালে জাতি একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদকে হারালো।

এ ছাড়াও সাবেক এই মন্ত্রীর মৃত্যুতে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান, বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি, মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন : ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া বাবলু দ্বিতীয় দফায় জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সাবেক সংসদ সদস্য বাবলু এইচ এম এরশাদের সরকারে উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র বাবলু বাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। গত শতকের ৮০ এর দশকের শুরুতে ডাকসুর জিএস থাকা অবস্থায় সামরিক শাসক এরশাদের দলে যোগ দিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি। তাকে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের উপদেষ্টা করেছিলেন সামরিক আইন প্রশাসক এরশাদ। পরে শিক্ষা উপমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। এরপর বাবলুকে অর্থ প্রতিমন্ত্রী এবং পরে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী করা হয়েছিল। ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বাবলু। পরে ২০১৪ সালে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এরশাদের নির্দেশে তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। এরশাদের জীবদ্দশায় ২০১৪ থেকে দুই বছর জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্বে ছিলেন বাবলু। ২০২০ সালে আবার সেই দায়িত্বে ফিরেছিলেন তিনি। কয়েক বছর আগেই জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদের ভাগ্নি মেহেজাবুন্নেসা রহমান টুম্পাকে বিয়ে করেছিলেন বাবলু। তার প্রথম স্ত্রী অধ্যাপক ফরিদা আক্তার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৫ সালে মারা যান। বাবলু-ফরিদা দম্পতির এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে।