লীনা পারভীন: বাংলা চলচ্চিত্রের বিষয়ে খুব বেশি জানাশোনা নেই। কখন কোন সিনেমা আসে বা যায় তার কোনোটারই খবর নেওয়া হয় না আমাদের। বাংলা সিনেমা বলতে আমি মূলত বুঝাচ্ছি এফডিসিকেন্দ্রিক সিনেমাকে। বাংলাদেশের যে কোনো মানুষ হিন্দি সিনেমার বিষয়ে যতটা খোঁজখবর রাখে বা উত্তেজনা, আবেগ, অনুভূতি প্রকাশ করে তার সিঁকি ভাগও বাংলা সিনেমা নিয়ে হয় না। এর পেছনে কারণ কী?
এই কারণ খুঁজতে গেলে এক লেখায় ফুরাবে না। তবে মোটা দাগে বলা যায় আমাদের দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে কোনো সময়ই গঠনমূলক বা কাঠামোবদ্ধ কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা করা হয়নি। চলচ্চিত্রও যে একটা শিল্প হতে পারে এ চিন্তাভাবনা মাধ্যমটির সাথে সংশ্লিষ্ট কারও ছিল না, ছিল রাষ্ট্রের। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। পরিবার ছাড়া এতিম সন্তানের মতো বেড়ে ওঠা সিনে জগৎ হয়ে পড়েছে ছন্নছাড়া। ভালো পরিচালক, ভালো কোনো অভিনয় শিল্পী গড়ে ওঠেনি।
অথচ সিনেমা সমাজের একটি শক্ত গণমাধ্যম। এর মাধ্যমে অনেক কিছু করার থাকে, বলার থাকে। এমনকি পরিবর্তনেরও বার্তা দেওয়া যায়। এমন উদাহরণ আমরা পেয়েছিলাম জহির রায়হানের চলচ্চিত্রেও। এমনকি স্বাধীনতা-উত্তর যে কটি সিনেমা হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে তার সবকটি এখনও স্মরণীয় হয়ে আছে। কিন্তু সেই গৌরবোজ্জ্বল দিন এখন আর নেই। কেবল সিনেমা জগৎ কেন, আমাদের গোটা সংস্কৃতি জগৎটাই এখন ধ্বংসের মুখে আছে। বিনোদনের কোনো ব্যবস্থাই আর গড়ে উঠছে না, যা ছিল তাও বিলুপ্তির পথে।
তাহলে প্রশ্ন আসে, আজ আমার এই লেখা কী নিয়ে? যা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে আমি ঘোষণা দিচ্ছি তাকে নিয়ে আর লিখে কী হবে? এ প্রশ্ন করাটা অমূলক না হলেও, লেখার তাগিদটাও কিন্তু তৈরি করেছে আমাদের চলচ্চিত্র জগতের লোকেরাই। সম্প্রতি নানা সিনেমা নাটকের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হলো চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন। যদিও আমার জানা নেই, আসলেই সেটা শেষ হয়েছে না আরও কোনো সিন বা এপিসোড এখনও পর্দার ওপারে রয়ে গেছে। কারণ এরই মধ্যে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থিতা বাতিল হওয়া প্রার্থী জায়েদ খান হাইকোর্টে রিট করেছেন। এই এক নির্বাচন নিয়ে মত্ত ছিল গোটা দেশ। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে এবারের নির্বাচন। কেন? এই কেন নিয়েও বোদ্ধারা নিশ্চয়ই ভাববেন।
আমি সিনেমা বোদ্ধা নই। তবে একজন সিনেমাপ্রেমি বা নিদেনপক্ষে একজন বাংলাদেশ প্রেমিক হিসেবে আমি নিজেও এবারের নির্বাচন ফলো করেছি। এর আগে কোনোকালেই আমরা কেউই জানতাম না কবে কোথায় কারা নির্বাচন করছে। অথচ এবার এক নির্বাচনের মাধ্যমেই আমি জেনে গেলাম এফডিসি পরিচালিত হয় সিনেমার বাইরের একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। পরিচালকরা সেই এফডিসি ব্যবহারের জন্য ভাড়া দেন। সেই ভাড়া নিয়েও ঝামেলা চলছে মালিক ও পরিচালকদের মধ্যে।
প্রার্থীদের কারও কারও বিরুদ্ধে আছে দুর্নীতির অভিযোগ। আলোচনায় উঠে এসেছে পরিচালক, অভিনয় শিল্পী দ্বন্দ্ব। শিল্পীদের মধ্যকার অন্তর্কলহ বা চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেক ইস্যুই এখন সাধারণ মানুষের জানার মধ্যে। এবারের নির্বাচন নিয়ে এই যে এতো আলোচনা যার ফলাফল নির্ধারণে মন্ত্রণালয়কেও হস্তক্ষেপ করতে হলো সেখানে থেকে নেওয়ার মতো অনেক বিষয় আছে।
আমি মনে করি যা হয়েছে হয়েছে, অন্তত এখন আমাদের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের উচিত এদিকে ফোকাস করা। চলচ্চিত্র একটি শক্তশালী গণমাধ্যম। এই মাধ্যমটি এভাবে ক্ষয়ে যেতে দেয়া উচিত নয়। আগের কোনো কমিটি বা চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত মানুষগুলো কেউই কোনো দায় বা দায়িত্ব নেয়নি। যারা নিতে পারতো তারা সব অভিমান বা অবহেলায় দূরে সরে গিয়েছে নানা সময়ে।
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে একটি শিল্পী সমিতি পাওয়া গেছে, যারা আপাত অর্থে হলেও সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছে। ভোটার না হয়েও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এবারের নেতৃত্ব নির্বাচনে গোটা দেশের মানুষ অনেক বড় ইনফ্লুয়েন্সারের ভূমিকা রেখে গেছে। তাই সেই দাবি থেকেই আমরা আশা করি বর্তমান কমিটির প্রতিটি সদস্য আমাদের চলচ্চিত্রকে তার ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনতেই কাজ করবে।
আমার মনে হয় সবার আগে দরকার বাংলা সিনেমার প্রতি আপামর সাধারণ মানুষের যে অনীহা তৈরি হয়েছে তার কারণ অনুসন্ধান করে একটি সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা। সেটি হতে পারে চলচ্চিত্রের জন্য যোগ্য ও শিক্ষিত অভিনয় শিল্পী গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটি অভিনয় শিখার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজ শুরু করা।
প্রায়শই দেখা যায় শিল্পীদের আর্থিক সংকটের ঘটনা। অনেক বছর অভিনয় করার পরও শেষ বয়সে এসে সামান্য চিকিৎসা করানোর টাকাও থাকে না তাদের হাতে। এ ঘটনায় প্রমাণ করে আমাদের চলচ্চিত্র এখনও তার পেশাদারিত্বের জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। তাই সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের একটাই চাওয়া যেই নেতৃত্বে আসুক না কেন তারা কাজ করবেন সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে।
ব্যক্তিস্বার্থ পাশে রেখে এগিয়ে যাবেন গোটা শিল্পী সমাজের উন্নয়ন, আয়, প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি নিয়ে। ওহ, হ্যাঁ, আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে চলচ্চিত্র মানে সুস্থ একটি বিনোদনের মাধ্যম। সুতরাং আগামীর দিনে যাতে বাংলাদেশের সিনেমা গোটা দুনিয়ার কাছে একটি বার্তা দিতে পারে সেই পথেই প্রস্তুতি দরকার। আমাদের অভিনয় শিল্পীরা পাশের দেশে গিয়ে রাজত্ব করছে অথচ আমরা তাদের জন্য উপযুক্ত একটি প্ল্যাটফর্ম দিতে পারছি না। এটাও কিন্তু অনেক বড় লজ্জার বিষয়।
লেখক : অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।