চট্টগ্রাম প্রতিনিধি: ভাড়া বাসার দারোয়ান এক ছাত্রীকে মারধর করেন-এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের সংঘর্ষের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসন। সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত ১২টা পর্যন্ত এ ধারা বলবৎ থাকবে। রোববার বেলা তিনটার দিকে উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হাটহাজারী উপজেলার অধীন।
উপজেলা প্রশাসনের বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, হাটহাজারী উপজেলাধীন ফতেপুর ইউনিয়নের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট বাজারের পূর্ব দিক থেকে রেলগেট পর্যন্ত উভয় দিকের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি থাকবে। এ ছাড়া ২ নম্বর গেট এলাকায় সভা, সমাবেশ, বিক্ষোভ, গণজমায়েত কিংবা অস্ত্র পরিবহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। উল্লিখিত এলাকায় পাঁচজনের বেশি ব্যক্তি একসঙ্গে চলাচল করতে পারবেন না।
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন বলেন, শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এর আগে গত শনিবার রাত সোয়া ১২টা থেকে রোববার দুপুর পর্যন্ত বিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন, প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফ ও অন্তত ১৮০ শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, এ ঘটনায় তাঁদের পক্ষের আহত হয়েছেন ১০ থেকে ১২ জন।
সব বিভাগের পরীক্ষা স্থগিত: চট্টগ্রাম সংবাদদাতা: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের সংঘর্ষের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। রোববার (৩১ আগস্ট) সকালে সংবাদমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে রোববারের সব পরীক্ষা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পরীক্ষার বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
সংঘর্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা না পেয়ে কাঁদলেন উপ-উপাচার্য: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের দফায় দফায় সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ধরনের সহায়তা না পাওয়ায় কান্নায় ভেঙে পড়েন আহত উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন। রোববার (৩১ আগস্ট) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট সংলগ্ন এলাকায় সংঘর্ষ বাধলে প্রশাসন থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা না পেয়ে তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিওতে উপ-উপাচার্য ড. মো. কামাল উদ্দিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি কমপারেটিভলি ভালো আছি। আমার ছাত্ররা সবচেয়ে বেশি আহত। আমরা এখন পর্যন্ত আর্মি-বিজিবির কোনো সাহায্য পাচ্ছি না। প্রত্যেকটা ছাত্রকে তারা দা দিয়ে কোপাচ্ছে। এটা কোন জগতে আছি আমরা? আপনারা আমাদের ছাত্রদের উদ্ধার করুন। আমাদের প্রক্টর, প্রো-ভিসি (একাডেমিক) আহত, আমাদের প্রায় সব শিক্ষক-ছাত্র আহত। আমরা মেডিকেলে জায়গা দিতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ছাত্রলীগের ক্যাডাররা হেলমেট পরে আমাদের ছাত্রদের মারতেছে। আমরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছি, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে কথা বলেছি, কিন্তু এখনো আমাদের পাশে কেউ নেই। এসময় কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমি হাত জোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা তোমরা শান্ত হও। এলাকাবাসী আপনারা শান্ত হোন। আমরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এত বছর ধরে আছি, এই গ্রামের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক ছিল। অন্য একটি কুচক্রী মহলের ইন্ধনে এ ঘটনা ঘটেছে। এই গেমে কেউ হাত দিয়েন না।’ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, তোমরা শান্ত হও। আমরা তোমাদের পাশে আছি। এ ঘটনার বিচার হবে।
যৌথবাহিনীর অভিযান শুরু: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ শেষে অভিযানে নেমেছে যৌথবাহিনী। রোববার (৩১ আগস্ট) বিকেল ৪টার দিকে যৌথবাহিনী অভিযান শুরু করেছে। এসময় ক্যাম্পাসের আশপাশে যৌথবাহিনীর অন্তত ১০টি গাড়ি প্রবেশ করতে দেখা গেছে। এর আগে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট সংলগ্ন এলাকায় সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।
শরীরে জখম নিয়ে চমেক হাসপাতালে আহত শিক্ষার্থীরা: কারও কপালে জখম, কারও হাতে, বুকে-পিঠে আবার কারও পায়ে জখম। সহপাঠী বন্ধুদের কাঁধে ভর করে একে একে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে আসতে থাকেন সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীরা। রোববার (৩১ আগস্ট) বিকাল থেকে চমেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি বিভাগের সামনে ভিড় আহত এবং তাদের স্বজন-সহপাঠীদের। আহত শিক্ষার্থীরা হাসপাতাল থেকে বের হচ্ছেন হাতে-মাথায়-পায়ে ব্যান্ডেজ মোড়ানো অবস্থায়।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় মোট ১০৮ জন শিক্ষার্থী চিকিৎসার জন্য এসেছেন। এর মধ্যে শনিবার রাতে প্রথম দফায় সংঘর্ষে আহত ৩০ শিক্ষার্থী চিকিৎসা নেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ভর্তি করা হয়। আজ দুপুরে দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষের ঘটনায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৭৮ জন আহত শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিয়েছেন। অধিকাংশই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। গুরুতর আহত ২০ থেকে ২৫ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। এর বাইরেও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে কেউ কেউ চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে শুনেছি। তাদের পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে দুজন ছাত্র বেসরকারি দুটি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের মধ্যে একজন ন্যাশনাল হাসপাতালে অপরজন পার্ক ভিউ হাসপাতালে রয়েছেন।’
চবি মেডিক্যাল সেন্টারে দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. ফারহানা বলেন, ‘আজ সকাল থেকে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়ে চবি মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কমপক্ষে ২৫ জনকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আমার কর্মজীবনে এত সংখ্যক শিক্ষার্থী একসঙ্গে হতাহতের ঘটনা ঘটতে দেখিনি।’ এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিস্থিতিতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারার আদেশ জারি করেছেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন।