ঢাকা ১০:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৭ অগাস্ট ২০২৫

চট্টগ্রামে কমছে ভূগর্ভের পানি, ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ

  • আপডেট সময় : ১২:০২:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ মার্চ ২০২২
  • ১০৪ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক : চট্টগ্রাম নগরী এবং জেলার শিল্পবহুল ও উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর দুই থেকে আড়াই মিটার করে নেমে যাচ্ছে বলে উঠে এসেছে এক গবেষণায়, যাতে সতর্ক সংকেত দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। গবেষক ও কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবেশ রক্ষায় এবং ঝুঁকি কমাতে হলে ভূগর্ভের পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে; পানি ব্যবহারে হতে হবে মিতব্যয়ী।
বিশ্ব পানি দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ‘গ্রাউন্ডওয়াটার, মেকিং দ্যা ইনভিজিবল ভিজিবল’ (ভূগর্ভস্থ পানি, অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা)। এবার পানি দিবসের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ভূগর্ভস্থ পানির গবেষণা, সংরক্ষণ ও পরিবেশবান্ধব ব্যবহার নিশ্চিত করা।
চট্টগ্রামের শিল্প-কারখানা অধ্যুষিত মীরসরাই ও সীতাকু- এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গত কয়েক বছরে এতটাই নিচে নেমে গেছে যে অগভীর নলকূপে আর পানি মিলছে না। তাই আগের চেয়ে বেশি গভীরতায় নলকূপ বসাতে হচ্ছে স্থানীয়দের।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ও নগরীতে পানীয় জলের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ করে।
অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন রায় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সীতাকু-, মীরসরাইসহ কয়েকটি উপজেলায় পাঁচ বছর আগেও ১৫-২০ ফুট গভীরতায় সুপেয় পানির স্তর পাওয়া যেত। এখন কমপক্ষে ৩০ ফুট নিচে যেতে হয়।
“হ্যান্ড পাম্প বা অগভীর নলকূপে শুকনো মৌসুমে আর পানিই ওঠে না। তাই এখন আর হ্যান্ড পাম্প বসাচ্ছি না। সাবমারসিবল বসাচ্ছি কমপক্ষে ১০০ ফুটে হাউজিং করে, যাতে সারা বছর পানিটা পাওয়া যায়।”
সুমন রায় বলছেন, শিল্প ও কৃষি খাতে পানি ব্যবহারের পরিমাণ অনেক বেশি। আর সেটাই পানির স্তর নেমে যাওয়ার প্রধান কারণ।
“একটি প্রডাকশন টিউবওয়েল চললে আশপাশে এক কিলোমিটার এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি শুকিয়ে যায়, এমনটাও ঘটে।”
মীরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনাপাহাড় এলাকায় একটি বেসরকারি ইস্পাত কারখানার গভীর নলকূপের কারণে পানি না পেয়ে গত বছরের ৩০ মে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আয়েশা আক্তার ও যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক শওকাত আহমেদ চট্টগ্রাম নগরীর ২২টি ওয়ার্ড নিয়ে গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন ৭ ওয়ার্ডে ভূগর্ভের পানি ক্রমাগত নি¤œমুখী।চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আয়েশা আক্তার ও যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক শওকাত আহমেদ চট্টগ্রাম নগরীর ২২টি ওয়ার্ড নিয়ে গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন ৭ ওয়ার্ডে ভূগর্ভের পানি ক্রমাগত নি¤œমুখী।জোরারগঞ্জের বাসিন্দা সাংবাদিক রাজীব মজুমদার জানান, হিংগুলী, জোরারগঞ্জ, সোনাপাহাড়, ধুম, ওসমানপুর, দুর্গাপুরসহ বেশকিছু ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় অগভীর নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যক্তি উদ্যোগে বসানো গভীর নলকূপের ক্ষেত্রে ৫০০ ফুট নিচে পানি মিলেছে এমন উদাহরণও আছে।
জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, “নতুন যেসব গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে সেগুলোতে পানি মিলছে। কিন্তু পুরনো নলকূপে সমস্যা হচ্ছে। বাস্তবতা হল, পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।
“বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর হওয়ায় আশা করি নতুন সব শিল্প কারখানা সেখানেই হবে। আমাদের এলাকায় আর হবে না। তবে পানির স্তর কেন নামছে তা জানতে গবেষণা প্রয়োজন।”
উপকূলে আরও গভীরে, সঙ্গে লবণাক্ততা : জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সমুদ্র তীরবর্তী বাঁশখালীর সরল ও গ-ামারা ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে মিঠা পানির স্তর মিলছে ৮০০-১২০০ ফুট নিচে। এছাড়া আনোয়ারা উপজেলার পারকি সৈকতের আশেপাশে এলাকায় নলকূপে উঠছে লবণাক্ত পানি। পটিয়া ও বাঁশখালী উপজেলাতেও সুপেয় পানি স্তর কমপক্ষে ৩০ ফুট নিচে।
ওয়াসার সাবেক জ্যেষ্ঠ রসায়নবিদ মিলন কুমার চক্রবর্তী বলেন, বেশি পরিমাণে পানি নিয়মিত উত্তোলনের কারণে স্তর নামতে পারে।

“অন্য কারণও থাকতে পারে। স্যাটেটিক্যাল ওয়াটার লেভেল সম্পর্কে তথ্য থাকলে প্রকৃত কারণ ও অবস্থা জানা যায়। সীতাকু-সহ উপকূলীয় কিছু এলাকায় লবণাক্ততা আগেও ছিল। ভূগর্ভে মিঠা পানির পরিমাণ কমলে লবণাক্ত পানি সেই স্থান দখল করতে পারে।”
নগরীর চিত্রও ভালো নয় : জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন রায় জানান, গত বছর নগরীর কেন্দ্রে পাঁচলাইশে একটি গভীর নলকূপ স্থাপনের সময় পানির স্তর মিলেছে ৫০০ ফুটের নিচে।
“নগরীর বেশিরভাগ স্থানে এখন ১০০-২০০ ফুট নিচে পানি মেলে। এছাড়া পাহাড়তলী এলাকায় ভূগর্ভে পানি পাওয়াই কঠিন।”
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আয়েশা আক্তার ও মিজৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক শওকাত আহমেদ তাদের গবেষণার প্রথম পর্যায়ে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নগরীর ২২টি ওয়ার্ডের তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর ২০২০-২১ সালে আবার ওইসব ওয়ার্ডের তথ্য নেন। আয়েশা আক্তার বলেন, নগরীর উত্তর পাঠানটুলি, উত্তর আগ্রাবাদ, রামপুরা, দক্ষিণ আগ্রাবাদ, পাঠানটুলি, পশ্চিম মাদারবাড়ি ও পূর্ব মাদারবাড়ি – এই ৭ ওয়ার্ডে ভূগর্ভের পানি ক্রমাগত নি¤œমুখী এবং প্রতি বছর ২ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৬৫ মিটার করে নেমে যাচ্ছে। ২০২০ সালে এসব ওয়ার্ডে পানির স্তর মিলেছে ১০২ ফুট থেকে ৩৫২ ফুট গভীরতায়।
নগরীর বেশিরভাগ ভবনেই যে ব্যক্তি উদ্যোগে বসানো গভীর নলকূপ আছে, সে কথা তুলে ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসার সদ্য সাবেক বোর্ড সদস্য মহসীন কাজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিয়মিত পর্যাপ্ত ওয়াসার পানি না পেয়ে নগরবাসী এসব গভীর নলকূপের উপর নির্ভর করছে। এতে ভূগর্ভের পানি কমছে।”
আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. সুমন বড়ুয়া বললেন, গভীর নলকূপের সংখ্যাধিক্যের পাশাপাশি প্লাস্টিক দূষণের কারণেও ‘গ্রাউন্ডওয়াটার পাসিং’ বাধাগ্রস্ত হয়। “নগরীতে কোনো কোনো স্থানে ৬০০-৭০০ ফুট গভীরে পানি মিলছে। এর অর্থ স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে, যা আশঙ্কাজনক। বাস্তব পরিস্থিতি জানতে এবং করণীয় ঠিক করতে পূণাঙ্গ সার্ভে দরকার।”
কমাতে হবে ভূগর্ভের পানির ব্যবহার : আয়েশা আক্তার বলছেন, এভাবে ভূগর্ভস্থ পানির অতি ব্যবহার চলতে থাকলে স্তর আরও নিচে নেমে যেতে পারে। তাতে পানি উত্তোলনের খরচ বাড়বে, লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়বে, জলাভূমি হারিয়ে যাবে। সব মিলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবেশ। গত ১৬ মার্চ চট্টগ্রাম ওয়াসার এক অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের দেশ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায়। তাই ভূগর্ভস্থ পানি যেন না কমে যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানি আমাদের ভূমিকম্প থেকে রক্ষা করতে পারে।”
পাশাপাশি প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে এবং জলাধার নির্মাণে শিল্প কারখানা ও আবাসন প্রকল্পগুলোকে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। ওয়াসার সাবেক কর্মকর্তা মিলন কুমার চক্রবর্তী বলেন, বৃষ্টির পানি মাটির নিচে গেলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বাড়ার কথা। কিন্তু বন্দরনগরীতে নিয়ন্ত্রণহীন অবকাঠামো নির্মাণের কারণে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে যেতে পারছে না। সেজন্য প্রতিটি ভবনে খালি জমি ও বৃষ্টির পানি ধারণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
“পুকুর-জলাধার ভরাট করে ফেলায় এবং বৃষ্টির পানি মাটিতে যেতে না পেরে নদী হয়ে সাগরে চলে যাওয়ায় ভূগর্ভে মিঠা পানির পরিমাণ কমছে ও স্তর নামছে।”
ভূগর্ভের পানির বিকল্প হিসেবে বৃষ্টির পানির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক আয়েশা আক্তার বলেন, “দূষণ ও লবণাক্ততা কমাতে কৃত্রিম উপায়ে ভূগর্ভে পানি পাঠানো যেতে পারে। গৃহস্থালীর কাজে, গাড়ি ধোয়া এবং টয়লেট ফ্লাশে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করা যেতে পারে।”
আর চট্টগ্রাম ওয়াসা যেহেতু এখন চাহিদার চেয়ে বেশি পানি উৎপাদনে সক্ষম বলে দাবি করছে, সেহেতু গভীর নলকূপের পানি সরবরাহ এখন বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন চট্টগ্রাম ওয়াসার সাবেক বোর্ড সদস্য মহসীন কাজী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল আমিন বলেন, “নতুন একাধিক প্রকল্প চালু হওয়ায় ওয়াসার বেশিরভাগ গভীর নলকূপ বন্ধ করা হয়েছে। বাকিগুলো সামনে বন্ধ করে দেয়া হবে।”
পৌরসভা পর্যায়েও ‘সারফেস ওয়াটার’ ব্যবহার শুরুর কথা জানিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সুমন রায় বলেন, সাঙ্গু নদীর পানি পরিশোধন করে চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া পৌর সদরে সরবরাহে প্রকল্প করা হচ্ছে। তবে কৃষিখাতে ভূগর্ভের পানির ব্যবহার কমাতে হলে নদীর পানি ব্যবহার বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি। আর আয়েশা আক্তার মনে করেন, শিল্পখাতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার যে নীতিমালা এখন আছে, তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

জনপ্রিয় সংবাদ

চট্টগ্রামে কমছে ভূগর্ভের পানি, ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ

আপডেট সময় : ১২:০২:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ মার্চ ২০২২

প্রত্যাশা ডেস্ক : চট্টগ্রাম নগরী এবং জেলার শিল্পবহুল ও উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর দুই থেকে আড়াই মিটার করে নেমে যাচ্ছে বলে উঠে এসেছে এক গবেষণায়, যাতে সতর্ক সংকেত দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। গবেষক ও কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবেশ রক্ষায় এবং ঝুঁকি কমাতে হলে ভূগর্ভের পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে; পানি ব্যবহারে হতে হবে মিতব্যয়ী।
বিশ্ব পানি দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ‘গ্রাউন্ডওয়াটার, মেকিং দ্যা ইনভিজিবল ভিজিবল’ (ভূগর্ভস্থ পানি, অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করা)। এবার পানি দিবসের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ভূগর্ভস্থ পানির গবেষণা, সংরক্ষণ ও পরিবেশবান্ধব ব্যবহার নিশ্চিত করা।
চট্টগ্রামের শিল্প-কারখানা অধ্যুষিত মীরসরাই ও সীতাকু- এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর গত কয়েক বছরে এতটাই নিচে নেমে গেছে যে অগভীর নলকূপে আর পানি মিলছে না। তাই আগের চেয়ে বেশি গভীরতায় নলকূপ বসাতে হচ্ছে স্থানীয়দের।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ও নগরীতে পানীয় জলের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ করে।
অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন রায় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সীতাকু-, মীরসরাইসহ কয়েকটি উপজেলায় পাঁচ বছর আগেও ১৫-২০ ফুট গভীরতায় সুপেয় পানির স্তর পাওয়া যেত। এখন কমপক্ষে ৩০ ফুট নিচে যেতে হয়।
“হ্যান্ড পাম্প বা অগভীর নলকূপে শুকনো মৌসুমে আর পানিই ওঠে না। তাই এখন আর হ্যান্ড পাম্প বসাচ্ছি না। সাবমারসিবল বসাচ্ছি কমপক্ষে ১০০ ফুটে হাউজিং করে, যাতে সারা বছর পানিটা পাওয়া যায়।”
সুমন রায় বলছেন, শিল্প ও কৃষি খাতে পানি ব্যবহারের পরিমাণ অনেক বেশি। আর সেটাই পানির স্তর নেমে যাওয়ার প্রধান কারণ।
“একটি প্রডাকশন টিউবওয়েল চললে আশপাশে এক কিলোমিটার এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি শুকিয়ে যায়, এমনটাও ঘটে।”
মীরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনাপাহাড় এলাকায় একটি বেসরকারি ইস্পাত কারখানার গভীর নলকূপের কারণে পানি না পেয়ে গত বছরের ৩০ মে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আয়েশা আক্তার ও যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক শওকাত আহমেদ চট্টগ্রাম নগরীর ২২টি ওয়ার্ড নিয়ে গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন ৭ ওয়ার্ডে ভূগর্ভের পানি ক্রমাগত নি¤œমুখী।চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আয়েশা আক্তার ও যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক শওকাত আহমেদ চট্টগ্রাম নগরীর ২২টি ওয়ার্ড নিয়ে গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন ৭ ওয়ার্ডে ভূগর্ভের পানি ক্রমাগত নি¤œমুখী।জোরারগঞ্জের বাসিন্দা সাংবাদিক রাজীব মজুমদার জানান, হিংগুলী, জোরারগঞ্জ, সোনাপাহাড়, ধুম, ওসমানপুর, দুর্গাপুরসহ বেশকিছু ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় অগভীর নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যক্তি উদ্যোগে বসানো গভীর নলকূপের ক্ষেত্রে ৫০০ ফুট নিচে পানি মিলেছে এমন উদাহরণও আছে।
জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, “নতুন যেসব গভীর নলকূপ বসানো হচ্ছে সেগুলোতে পানি মিলছে। কিন্তু পুরনো নলকূপে সমস্যা হচ্ছে। বাস্তবতা হল, পানির স্তর নেমে যাচ্ছে।
“বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর হওয়ায় আশা করি নতুন সব শিল্প কারখানা সেখানেই হবে। আমাদের এলাকায় আর হবে না। তবে পানির স্তর কেন নামছে তা জানতে গবেষণা প্রয়োজন।”
উপকূলে আরও গভীরে, সঙ্গে লবণাক্ততা : জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, সমুদ্র তীরবর্তী বাঁশখালীর সরল ও গ-ামারা ইউনিয়নের কয়েকটি স্থানে মিঠা পানির স্তর মিলছে ৮০০-১২০০ ফুট নিচে। এছাড়া আনোয়ারা উপজেলার পারকি সৈকতের আশেপাশে এলাকায় নলকূপে উঠছে লবণাক্ত পানি। পটিয়া ও বাঁশখালী উপজেলাতেও সুপেয় পানি স্তর কমপক্ষে ৩০ ফুট নিচে।
ওয়াসার সাবেক জ্যেষ্ঠ রসায়নবিদ মিলন কুমার চক্রবর্তী বলেন, বেশি পরিমাণে পানি নিয়মিত উত্তোলনের কারণে স্তর নামতে পারে।

“অন্য কারণও থাকতে পারে। স্যাটেটিক্যাল ওয়াটার লেভেল সম্পর্কে তথ্য থাকলে প্রকৃত কারণ ও অবস্থা জানা যায়। সীতাকু-সহ উপকূলীয় কিছু এলাকায় লবণাক্ততা আগেও ছিল। ভূগর্ভে মিঠা পানির পরিমাণ কমলে লবণাক্ত পানি সেই স্থান দখল করতে পারে।”
নগরীর চিত্রও ভালো নয় : জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন রায় জানান, গত বছর নগরীর কেন্দ্রে পাঁচলাইশে একটি গভীর নলকূপ স্থাপনের সময় পানির স্তর মিলেছে ৫০০ ফুটের নিচে।
“নগরীর বেশিরভাগ স্থানে এখন ১০০-২০০ ফুট নিচে পানি মেলে। এছাড়া পাহাড়তলী এলাকায় ভূগর্ভে পানি পাওয়াই কঠিন।”
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. আয়েশা আক্তার ও মিজৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষক শওকাত আহমেদ তাদের গবেষণার প্রথম পর্যায়ে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নগরীর ২২টি ওয়ার্ডের তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর ২০২০-২১ সালে আবার ওইসব ওয়ার্ডের তথ্য নেন। আয়েশা আক্তার বলেন, নগরীর উত্তর পাঠানটুলি, উত্তর আগ্রাবাদ, রামপুরা, দক্ষিণ আগ্রাবাদ, পাঠানটুলি, পশ্চিম মাদারবাড়ি ও পূর্ব মাদারবাড়ি – এই ৭ ওয়ার্ডে ভূগর্ভের পানি ক্রমাগত নি¤œমুখী এবং প্রতি বছর ২ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৬৫ মিটার করে নেমে যাচ্ছে। ২০২০ সালে এসব ওয়ার্ডে পানির স্তর মিলেছে ১০২ ফুট থেকে ৩৫২ ফুট গভীরতায়।
নগরীর বেশিরভাগ ভবনেই যে ব্যক্তি উদ্যোগে বসানো গভীর নলকূপ আছে, সে কথা তুলে ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসার সদ্য সাবেক বোর্ড সদস্য মহসীন কাজী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নিয়মিত পর্যাপ্ত ওয়াসার পানি না পেয়ে নগরবাসী এসব গভীর নলকূপের উপর নির্ভর করছে। এতে ভূগর্ভের পানি কমছে।”
আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. সুমন বড়ুয়া বললেন, গভীর নলকূপের সংখ্যাধিক্যের পাশাপাশি প্লাস্টিক দূষণের কারণেও ‘গ্রাউন্ডওয়াটার পাসিং’ বাধাগ্রস্ত হয়। “নগরীতে কোনো কোনো স্থানে ৬০০-৭০০ ফুট গভীরে পানি মিলছে। এর অর্থ স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে, যা আশঙ্কাজনক। বাস্তব পরিস্থিতি জানতে এবং করণীয় ঠিক করতে পূণাঙ্গ সার্ভে দরকার।”
কমাতে হবে ভূগর্ভের পানির ব্যবহার : আয়েশা আক্তার বলছেন, এভাবে ভূগর্ভস্থ পানির অতি ব্যবহার চলতে থাকলে স্তর আরও নিচে নেমে যেতে পারে। তাতে পানি উত্তোলনের খরচ বাড়বে, লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়বে, জলাভূমি হারিয়ে যাবে। সব মিলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরিবেশ। গত ১৬ মার্চ চট্টগ্রাম ওয়াসার এক অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে সতর্ক করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের দেশ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকায়। তাই ভূগর্ভস্থ পানি যেন না কমে যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানি আমাদের ভূমিকম্প থেকে রক্ষা করতে পারে।”
পাশাপাশি প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে এবং জলাধার নির্মাণে শিল্প কারখানা ও আবাসন প্রকল্পগুলোকে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। ওয়াসার সাবেক কর্মকর্তা মিলন কুমার চক্রবর্তী বলেন, বৃষ্টির পানি মাটির নিচে গেলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বাড়ার কথা। কিন্তু বন্দরনগরীতে নিয়ন্ত্রণহীন অবকাঠামো নির্মাণের কারণে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে যেতে পারছে না। সেজন্য প্রতিটি ভবনে খালি জমি ও বৃষ্টির পানি ধারণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
“পুকুর-জলাধার ভরাট করে ফেলায় এবং বৃষ্টির পানি মাটিতে যেতে না পেরে নদী হয়ে সাগরে চলে যাওয়ায় ভূগর্ভে মিঠা পানির পরিমাণ কমছে ও স্তর নামছে।”
ভূগর্ভের পানির বিকল্প হিসেবে বৃষ্টির পানির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক আয়েশা আক্তার বলেন, “দূষণ ও লবণাক্ততা কমাতে কৃত্রিম উপায়ে ভূগর্ভে পানি পাঠানো যেতে পারে। গৃহস্থালীর কাজে, গাড়ি ধোয়া এবং টয়লেট ফ্লাশে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করা যেতে পারে।”
আর চট্টগ্রাম ওয়াসা যেহেতু এখন চাহিদার চেয়ে বেশি পানি উৎপাদনে সক্ষম বলে দাবি করছে, সেহেতু গভীর নলকূপের পানি সরবরাহ এখন বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন চট্টগ্রাম ওয়াসার সাবেক বোর্ড সদস্য মহসীন কাজী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল আমিন বলেন, “নতুন একাধিক প্রকল্প চালু হওয়ায় ওয়াসার বেশিরভাগ গভীর নলকূপ বন্ধ করা হয়েছে। বাকিগুলো সামনে বন্ধ করে দেয়া হবে।”
পৌরসভা পর্যায়েও ‘সারফেস ওয়াটার’ ব্যবহার শুরুর কথা জানিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সুমন রায় বলেন, সাঙ্গু নদীর পানি পরিশোধন করে চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া পৌর সদরে সরবরাহে প্রকল্প করা হচ্ছে। তবে কৃষিখাতে ভূগর্ভের পানির ব্যবহার কমাতে হলে নদীর পানি ব্যবহার বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি। আর আয়েশা আক্তার মনে করেন, শিল্পখাতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার যে নীতিমালা এখন আছে, তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।