ঢাকা ০৬:০৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৪ মে ২০২৫

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে ৩৩ জনের প্রাণহানি

  • আপডেট সময় : ০১:১৪:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর ২০২২
  • ৫৭ বার পড়া হয়েছে

প্রত্যাশা ডেস্ক : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দেশের ১৪ জেলায় অন্তত ৩৩ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। সেখানকার সন্দ্বীপ চ্যানেলে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে তীব্র বাতাস ও ঢেউয়ে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ভোলায় গাছচাপা পড়ে ও পানিতে ডুবে চারজনের প্রাণহানি হয়েছে। কুমিল্লায় গাছচাপা পড়ে বাবা, মা ও সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া টাঙ্গাইলে ঝড়ের কবলে পড়ে মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্য ও এক আসামির মৃত্যু হয়েছে। আর সিত্রাংয়ের তা-বে দেশের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। এলাকাবাসী, পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রের বরাত দিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর ও মন্ত্রীর খবর:
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের মিরসরাই উপকূলের সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সোমবার রাতে উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের ৩ নম্বর জেটি এলাকার পশ্চিমে এ ড্রেজারডুবির ঘটনা ঘটে। মারা যাওয়া শ্রমিকদের সবার বাড়ি পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠী এলাকায়।
ভোলা : ভোলায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ভোলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, সোমবার রাতে ঘূর্ণিঝড়ের দমকা হাওয়ায় গাছের চাপায় প্রাণ যায় বিবি খাদিজা (৬৮) নামের এক নারীর। চরফ্যাশন উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় মোটরসাইকেলে করে দুজন যাওয়ার পথে গাছের ডাল পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যান স্বর্ণ ব্যবসায়ী মো. মাইনুদ্দিন (৪৫)। ভোলা সদর উপজেলার চেউয়াখালী গ্রামের মফিজুল ইসলাম (৭০) ঘরচাপায় এবং লালমোহন উপজেলার ফাতেমাবাদ গ্রামের ফরিদুল ইসলামের স্ত্রী রাবেয়া বেগম (২৫) পানিতে ডুবে মারা যান।
কুমিল্লা : কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা হেসাখাল গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় সোমবার রাতে ঘরের ওপর গাছ পড়লে এক পরিবারের তিনজন নিহত হয়েছেন। নাঙ্গলকোট থানার ওসি ফারুক হোসেন বলেন, নিহত তিনজন হলেন নিজাম উদ্দিন, তাঁর স্ত্রী শারমিন আক্তার ও তাঁদের চার বছরের মেয়ে নুসরাত আক্তার।
নড়াইল : নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে সোমবার রাতে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে মারা যান মর্জিনা বেগম (৪০) নামের এক নারী। তাঁর বাড়ি বাগেরহাট সদর উপজেলার অর্জনবাহার গ্রামে।
কক্সবাজার : কক্সবাজারের টেকনাফে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়লে ডেক থেকে পড়ে শৌমিং (৭১) নামের একজনের মৃত্যু হয়। তিনি মিয়ানমারে নাগরিক। তিনি ওই জাহাজের বাবুর্চি ছিলেন। এ ছাড়া ঝড়ের সময় নিখোঁজ এক শিশুর লাশ পরে টেকনাফ পৌরসভার একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। সোহেনা (৯) নামের শিশুটি টেকনাফ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা জাফর আলমের মেয়ে। টেকনাফ মডেল থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান দুজনের মৃত্যুর খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেন।
টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের দুই কনস্টেবল ও এক আসামি নিহত হয়েছেন। মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল আমীন বলেন, জামালপুর সদর উপজেলার নারায়ণপুর তদন্তকেন্দ্রের পুলিশ সদস্যরা দুই আসামির ডিএনএ পরীক্ষার জন্য একটি মাইক্রোবাসে করে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। পথে প্রচ- ঝড়বৃষ্টির মধ্যে মাইক্রোবাসটি রাত সাড়ে আটটার দিকে গোলাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাককে ধাক্কা দেয়। এতে দুই পুলিশ সদস্য কনস্টেবল নুরুল ইসলাম ও মো. সোহেল এবং আসামি লালন নিহত হন। ঘরে বৃষ্টির পানি ঢুকে তলিয়ে যাওয়া আইপিএস সরাতে গিয়ে বিদ্যুৎপৃষ্টে মারা যান টাঙ্গাইল শহরের সাবালিয়া পাঞ্জাপাড়া এলাকার শরীফ ফকির। সদর থানার ওসি মোহাম্মদ আবু ছালাম মিয়া এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ তাদের কাছে দেওয়া হয়েছে।
বরগুনা : বরগুনা সদর উপজেলার সোনাখালী এলাকায় একটি ঘরের চালে গাছ পড়লে ওই ঘরে থাকা আমেনা খাতুন নামের এক নারী মারা যান। সোনাখালী এলাকার সমাজকর্মী এনামুল হক ওরফে শাহীন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে নিহত আমেনা খাতুনের বয়স ১০০ বছরের বেশি। ওই নারী রাত আটটার দিতে ঘরের ভেতর খাবার খাচ্ছিলেন। ঝড়ের সময় একটি গাছ তাঁর ঘরের ওপর পড়ে। এ সময় চাপা পড়ে তিনি মারা যান।
সিরাজগঞ্জ : প্রবল ঢেউয়ে সিরাজগঞ্জে নৌকাডুবিতে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত নয়টার দিকে জেলা সদরের সয়দা ইউনিয়নের মোহনপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত দুজন হলেন মোহনপুর গ্রামের খোকন হোসেনের স্ত্রী ও শিশুসন্তান। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম জানা যায়নি।
গোপালগঞ্জ : গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গাছচাপায় দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে। টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি মুহাম্মদ আবুল মনসুর বলেন, এই দুই নারী হলেন উপজেলার পাঁচকাহনিয়া গ্রামের রেজাউল খার স্ত্রী শারমিন বেগম (২৫) ও বাঁশবাড়ির চরপাড়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের স্ত্রী রোমেছা বেগম (৫৮)।
নোয়াখালী : ঝড়ের সময় রান্নাঘরের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা গ্রামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সানজিদ আফ্রিদি নামের শিশুটির বয়স ১১ মাস। সানজিদ ওই গ্রামের বাসিন্দা আইনজীবী মো. আবদুল্লাহর ছেলে। নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
শরীয়তপুর : শরীয়তপুরে গাছের নিচে চাপা পড়ে সাফিয়া বেগম (৬৫) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি জেলার জাজিরা উপজেলার সিডারচর এলাকার হালান মুসল্লির স্ত্রী। জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, সাফিয়ার পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে মৃত্যুটা এড়ানো যেত।
পটুয়াখালী : পটুয়াখালী সদর উপজেলার প্রতাপপুর খেয়াঘাট এলাকায় লোহালিয়া নদীতে ইটবোঝাই ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হন ট্রলারের শ্রমিক নুরুল ইসলাম (৪৫)। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পটুয়াখালী নদী ফায়ার স্টেশনের ডুবুরিরা তাঁর লাশ উদ্ধার করেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ট্রলারটি নোঙর করতে গেলে সেটি ডুবে যায়। ফায়ার স্টেশনের লিডার মজিবুর রহমান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মুন্সিগঞ্জ : মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তা-বের সময় বসত ঘরে গাছ ভেঙে পড়লে মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়। লৌহজং থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল তায়েবীর বলেন, নিহত দুজন হলেন উপজেলার কনকসার এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী আসমা বেগম (২৮) ও তাঁর মেয়ে সুরাইয়া আক্তার (৩)।
গাজীপুর : গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার ইকুরিয়া গ্রামে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় ঘরচাপায় আনিসুর রহমান (৯) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। কাপাসিয়ার ইউএনও এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় মাটির ঘর ধসে গিয়ে পাশের টিনের ঘরকে চাপা দেয়। এতে ওই ঘরে থাকা শিশু আনিসুরের মৃত্যু হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত ১০ হাজার ঘরবাড়ি, ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তা-বে দেশের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। ঝড়ের বিপদ কেটে যাওয়ার পর মঙ্গলবার দুপুরে মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে এসে তিনি বলেন, “শুকরিয়া, এটা ঘূর্ণিঝড় পর্যন্ত ছিল, কোনো সুপার সাইক্লোনে রূপান্তরিত হয়নি। বাতাসের গতিবেগ ৮০ কিলোমিটারের উপরে যায়নি।” ঘূর্ণিঝড়টি ভোলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে গেছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ৪১৯ ইউনিয়নের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এক হাজার মৎস্য ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের তরফ থেকে ঘর মেরামতের জন্য টিন দেওয়া হবে। আর যাদের মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা সুদমুক্ত ঋণ পাবেন। ঘূর্ণিঝড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মোট নয়জনের মৃত্যুর তথ্য দেন প্রতিমন্ত্রী, যদিও স্থানীয় কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য হিসাব করলে এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়।
ভারি বর্ষণ আর জলোচ্ছ্বাস নিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় ভোলার কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম শুরু করে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। সে সময় দমকা হওয়ায় গাছ ভেঙে পড়ে এবং দক্ষিণের বহু জেলা বিদ্যুৎহীন হয়ে যায়।
সোমবার সকালেই আবহাওয়া অফিস বিপদ সংকেত জারি করায় উপকূলীয় জেলাগুলোতে মাইকিং করে নিচু এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছিল। এনামুর রহমান জানান, দেশের ৬ হাজার ৯২৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১০ লাখ লোক আশ্রয় নিয়েছিলেন ঝড়ের সময়। ঝড় কেটে যাওয়ার পর তারা সবাই আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়েছেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কিছু স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, তবে এখন স্বাভাবিক হয়েছে।” বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জানান, ঝড়ে বিভিন্ন বিতরণ সংস্থার প্রায় দুই হাজার বৈদ্যুতিক খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। “আমাদের চার কোটি ৮০ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৮০ লাখ গ্রাহক এখনও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছেন। বিকালের মধ্যে এর ৭০ শতাংশ বিদ্যুতের আওতায় চলে আসবে বলে আশা করছি।”
দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকায় ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তি বাড়ছে। হাসপাতালসহ জরুরি সেবা বিঘিœত হচ্ছে। মোবাইল ফোন ও ইন্টারেনট যোগাযোগে বিভ্রাটও কাটেনি। ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা এরশাদ হোসাইন জানিয়েছেন, সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন সড়কে ২৮৭টি গাছ ভেঙে পড়ার তথ্য তারা পেয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন সড়কে ৫৬টি গাছ উপড়ে পড়েছে। তিনটি ঘটনায় গাছ পড়েছে বাসা বাড়ির ওপর। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সেসব গাছ সরিয়ে ফেলেছেন।

ট্যাগস :

যোগাযোগ

সম্পাদক : ডা. মোঃ আহসানুল কবির, প্রকাশক : শেখ তানভীর আহমেদ কর্তৃক ন্যাশনাল প্রিন্টিং প্রেস, ১৬৭ ইনার সার্কুলার রোড, মতিঝিল থেকে মুদ্রিত ও ৫৬ এ এইচ টাওয়ার (৯ম তলা), রোড নং-২, সেক্টর নং-৩, উত্তরা মডেল টাউন, ঢাকা-১২৩০ থেকে প্রকাশিত। ফোন-৪৮৯৫৬৯৩০, ৪৮৯৫৬৯৩১, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৭৯১৪৩০৮, ই-মেইল : [email protected]
আপলোডকারীর তথ্য

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে ৩৩ জনের প্রাণহানি

আপডেট সময় : ০১:১৪:৫৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর ২০২২

প্রত্যাশা ডেস্ক : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দেশের ১৪ জেলায় অন্তত ৩৩ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। সেখানকার সন্দ্বীপ চ্যানেলে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে তীব্র বাতাস ও ঢেউয়ে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ভোলায় গাছচাপা পড়ে ও পানিতে ডুবে চারজনের প্রাণহানি হয়েছে। কুমিল্লায় গাছচাপা পড়ে বাবা, মা ও সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া টাঙ্গাইলে ঝড়ের কবলে পড়ে মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্য ও এক আসামির মৃত্যু হয়েছে। আর সিত্রাংয়ের তা-বে দেশের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। এলাকাবাসী, পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রের বরাত দিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর ও মন্ত্রীর খবর:
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের মিরসরাই উপকূলের সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সোমবার রাতে উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের ৩ নম্বর জেটি এলাকার পশ্চিমে এ ড্রেজারডুবির ঘটনা ঘটে। মারা যাওয়া শ্রমিকদের সবার বাড়ি পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠী এলাকায়।
ভোলা : ভোলায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে। ভোলার পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম বলেন, সোমবার রাতে ঘূর্ণিঝড়ের দমকা হাওয়ায় গাছের চাপায় প্রাণ যায় বিবি খাদিজা (৬৮) নামের এক নারীর। চরফ্যাশন উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় মোটরসাইকেলে করে দুজন যাওয়ার পথে গাছের ডাল পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যান স্বর্ণ ব্যবসায়ী মো. মাইনুদ্দিন (৪৫)। ভোলা সদর উপজেলার চেউয়াখালী গ্রামের মফিজুল ইসলাম (৭০) ঘরচাপায় এবং লালমোহন উপজেলার ফাতেমাবাদ গ্রামের ফরিদুল ইসলামের স্ত্রী রাবেয়া বেগম (২৫) পানিতে ডুবে মারা যান।
কুমিল্লা : কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা হেসাখাল গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় সোমবার রাতে ঘরের ওপর গাছ পড়লে এক পরিবারের তিনজন নিহত হয়েছেন। নাঙ্গলকোট থানার ওসি ফারুক হোসেন বলেন, নিহত তিনজন হলেন নিজাম উদ্দিন, তাঁর স্ত্রী শারমিন আক্তার ও তাঁদের চার বছরের মেয়ে নুসরাত আক্তার।
নড়াইল : নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে সোমবার রাতে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে মারা যান মর্জিনা বেগম (৪০) নামের এক নারী। তাঁর বাড়ি বাগেরহাট সদর উপজেলার অর্জনবাহার গ্রামে।
কক্সবাজার : কক্সবাজারের টেকনাফে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়লে ডেক থেকে পড়ে শৌমিং (৭১) নামের একজনের মৃত্যু হয়। তিনি মিয়ানমারে নাগরিক। তিনি ওই জাহাজের বাবুর্চি ছিলেন। এ ছাড়া ঝড়ের সময় নিখোঁজ এক শিশুর লাশ পরে টেকনাফ পৌরসভার একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়। সোহেনা (৯) নামের শিশুটি টেকনাফ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা জাফর আলমের মেয়ে। টেকনাফ মডেল থানার ওসি মো. হাফিজুর রহমান দুজনের মৃত্যুর খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেন।
টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের দুই কনস্টেবল ও এক আসামি নিহত হয়েছেন। মধুপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল আমীন বলেন, জামালপুর সদর উপজেলার নারায়ণপুর তদন্তকেন্দ্রের পুলিশ সদস্যরা দুই আসামির ডিএনএ পরীক্ষার জন্য একটি মাইক্রোবাসে করে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। পথে প্রচ- ঝড়বৃষ্টির মধ্যে মাইক্রোবাসটি রাত সাড়ে আটটার দিকে গোলাবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাককে ধাক্কা দেয়। এতে দুই পুলিশ সদস্য কনস্টেবল নুরুল ইসলাম ও মো. সোহেল এবং আসামি লালন নিহত হন। ঘরে বৃষ্টির পানি ঢুকে তলিয়ে যাওয়া আইপিএস সরাতে গিয়ে বিদ্যুৎপৃষ্টে মারা যান টাঙ্গাইল শহরের সাবালিয়া পাঞ্জাপাড়া এলাকার শরীফ ফকির। সদর থানার ওসি মোহাম্মদ আবু ছালাম মিয়া এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ তাদের কাছে দেওয়া হয়েছে।
বরগুনা : বরগুনা সদর উপজেলার সোনাখালী এলাকায় একটি ঘরের চালে গাছ পড়লে ওই ঘরে থাকা আমেনা খাতুন নামের এক নারী মারা যান। সোনাখালী এলাকার সমাজকর্মী এনামুল হক ওরফে শাহীন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে নিহত আমেনা খাতুনের বয়স ১০০ বছরের বেশি। ওই নারী রাত আটটার দিতে ঘরের ভেতর খাবার খাচ্ছিলেন। ঝড়ের সময় একটি গাছ তাঁর ঘরের ওপর পড়ে। এ সময় চাপা পড়ে তিনি মারা যান।
সিরাজগঞ্জ : প্রবল ঢেউয়ে সিরাজগঞ্জে নৌকাডুবিতে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাত নয়টার দিকে জেলা সদরের সয়দা ইউনিয়নের মোহনপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত দুজন হলেন মোহনপুর গ্রামের খোকন হোসেনের স্ত্রী ও শিশুসন্তান। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম জানা যায়নি।
গোপালগঞ্জ : গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে গাছচাপায় দুই নারীর মৃত্যু হয়েছে। টুঙ্গিপাড়া থানার ওসি মুহাম্মদ আবুল মনসুর বলেন, এই দুই নারী হলেন উপজেলার পাঁচকাহনিয়া গ্রামের রেজাউল খার স্ত্রী শারমিন বেগম (২৫) ও বাঁশবাড়ির চরপাড়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের স্ত্রী রোমেছা বেগম (৫৮)।
নোয়াখালী : ঝড়ের সময় রান্নাঘরের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা গ্রামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সানজিদ আফ্রিদি নামের শিশুটির বয়স ১১ মাস। সানজিদ ওই গ্রামের বাসিন্দা আইনজীবী মো. আবদুল্লাহর ছেলে। নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
শরীয়তপুর : শরীয়তপুরে গাছের নিচে চাপা পড়ে সাফিয়া বেগম (৬৫) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি জেলার জাজিরা উপজেলার সিডারচর এলাকার হালান মুসল্লির স্ত্রী। জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, সাফিয়ার পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে মৃত্যুটা এড়ানো যেত।
পটুয়াখালী : পটুয়াখালী সদর উপজেলার প্রতাপপুর খেয়াঘাট এলাকায় লোহালিয়া নদীতে ইটবোঝাই ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হন ট্রলারের শ্রমিক নুরুল ইসলাম (৪৫)। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পটুয়াখালী নদী ফায়ার স্টেশনের ডুবুরিরা তাঁর লাশ উদ্ধার করেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ট্রলারটি নোঙর করতে গেলে সেটি ডুবে যায়। ফায়ার স্টেশনের লিডার মজিবুর রহমান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
মুন্সিগঞ্জ : মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তা-বের সময় বসত ঘরে গাছ ভেঙে পড়লে মা ও মেয়ের মৃত্যু হয়। লৌহজং থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল তায়েবীর বলেন, নিহত দুজন হলেন উপজেলার কনকসার এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী আসমা বেগম (২৮) ও তাঁর মেয়ে সুরাইয়া আক্তার (৩)।
গাজীপুর : গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার ইকুরিয়া গ্রামে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় ঘরচাপায় আনিসুর রহমান (৯) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। কাপাসিয়ার ইউএনও এ কে এম গোলাম মোর্শেদ খান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় মাটির ঘর ধসে গিয়ে পাশের টিনের ঘরকে চাপা দেয়। এতে ওই ঘরে থাকা শিশু আনিসুরের মৃত্যু হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত ১০ হাজার ঘরবাড়ি, ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তা-বে দেশের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। ঝড়ের বিপদ কেটে যাওয়ার পর মঙ্গলবার দুপুরে মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে এসে তিনি বলেন, “শুকরিয়া, এটা ঘূর্ণিঝড় পর্যন্ত ছিল, কোনো সুপার সাইক্লোনে রূপান্তরিত হয়নি। বাতাসের গতিবেগ ৮০ কিলোমিটারের উপরে যায়নি।” ঘূর্ণিঝড়টি ভোলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে গেছে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ৪১৯ ইউনিয়নের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর এক হাজার মৎস্য ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারের তরফ থেকে ঘর মেরামতের জন্য টিন দেওয়া হবে। আর যাদের মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারা সুদমুক্ত ঋণ পাবেন। ঘূর্ণিঝড়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মোট নয়জনের মৃত্যুর তথ্য দেন প্রতিমন্ত্রী, যদিও স্থানীয় কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য হিসাব করলে এই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়।
ভারি বর্ষণ আর জলোচ্ছ্বাস নিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় ভোলার কাছ দিয়ে উপকূল অতিক্রম শুরু করে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’। সে সময় দমকা হওয়ায় গাছ ভেঙে পড়ে এবং দক্ষিণের বহু জেলা বিদ্যুৎহীন হয়ে যায়।
সোমবার সকালেই আবহাওয়া অফিস বিপদ সংকেত জারি করায় উপকূলীয় জেলাগুলোতে মাইকিং করে নিচু এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছিল। এনামুর রহমান জানান, দেশের ৬ হাজার ৯২৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১০ লাখ লোক আশ্রয় নিয়েছিলেন ঝড়ের সময়। ঝড় কেটে যাওয়ার পর তারা সবাই আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়েছেন।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কিছু স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, তবে এখন স্বাভাবিক হয়েছে।” বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ মঙ্গলবার দুপুরে সচিবালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জানান, ঝড়ে বিভিন্ন বিতরণ সংস্থার প্রায় দুই হাজার বৈদ্যুতিক খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। “আমাদের চার কোটি ৮০ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৮০ লাখ গ্রাহক এখনও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন আছেন। বিকালের মধ্যে এর ৭০ শতাংশ বিদ্যুতের আওতায় চলে আসবে বলে আশা করছি।”
দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকায় ওইসব এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তি বাড়ছে। হাসপাতালসহ জরুরি সেবা বিঘিœত হচ্ছে। মোবাইল ফোন ও ইন্টারেনট যোগাযোগে বিভ্রাটও কাটেনি। ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা এরশাদ হোসাইন জানিয়েছেন, সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন সড়কে ২৮৭টি গাছ ভেঙে পড়ার তথ্য তারা পেয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন সড়কে ৫৬টি গাছ উপড়ে পড়েছে। তিনটি ঘটনায় গাছ পড়েছে বাসা বাড়ির ওপর। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা সেসব গাছ সরিয়ে ফেলেছেন।